টল্স্টয়ের গল্প/সফল স্বপ্ন
সফল স্বপ্ন
মার্টিন নামে এক মুচী কোনও এক নগরে বাস করিত। তার ঘরের নীচের তলায় ছোট একটা কামরা। বাড়ীর সামনেই রাস্তা। ঘরের জানালা রাস্তার দিকে। জানালাটা এতই ছোট যে, উহাতে বসিয়া রাস্তা দিয়া যে সব লোক চলিয়া যাইত তাদের কেবল পা দেখিতে পাওয়া যাইত। মার্টিন সেখানকার সকলকেই চিনিত, এমন কি জুতা দেখিয়া লোক চিনিতে পারিত। সে বহুদিন সেখানে বাস করিতেছে। সেখানে এমন কেহই ছিল না, যার জুতা মার্টিন দুই-একবার মেরামত করে নাই। সে প্রায়ই জানালায় বসিয়া লোকদের পায়ে নিজের মেরামত করা জুতা দেখিত। সেগুলির মধ্যে কতকগুলির সে তলা বদ্লাইয়াছে, কতকগুলিতে তালি মারিয়াছে, কতকগুলি সেলাই করিয়াছে, আর কতকগুলির উপরের চামড়া ফেলিয়া দিয়া নূতন সাজ লাগাইয়া দিয়াছে। সে খুব ভাল কাজ করিত, আর বেশী মজুরী চাহিত না বলিয়াই লোকে তাকে বিশ্বাস করিত এবং কাজ দিত। কাজের ভার লইয়া সে কথার খেলাপ করিত না এবং যা পারিবে না এমন কাজও লইত না।
এইজন্যই সকলে তাকে ভালবাসিত। মুচী হইলেও মার্টিন ছিল খুব ভাল লোক। বৃদ্ধ বয়সে সে সব কাজ ছাড়িয়া আত্মা ও ভগবানের চিন্তায় মন দিয়াছিল।
কিন্তু তখনও সে একজন লোকের কাজ করিত। কেবল একটি তিন বছরের ছেলে ছাড়া সংসারে আর কেহই তার ছিল না—স্ত্রী পুত্র সবই ছিল বটে, কিন্তু একে একে সব কয়টিকেই যমের মুখে দিয়াছিল।
প্রথমে মার্টিন মনে করিয়াছিল যে, এই ছেলেটিকে তার ভগিনীর কাছে রাখিবে, কিন্তু ছেলেকে ছাড়িয়া থাকিতে হইবে ভাবিয়া তার মন কেমন করিতে লাগিল। সে ভাবিল, ‘ক্যাপিটন আমার বড্ড ছোট, একটি অপরিচিত পরিবারের ভেতর ওর থাকতে ভয়ানক কষ্ট হবে। ওকে আমি আমার কাছেই রাখ্ব।’
তার মনিবের কাজ ছাড়িয়া দিয়া ছোট ছেলেটিকে লইয়া মার্টিন বসিয়া রহিল। কিন্তু ছেলে-মেয়ে লইয়া সুখে থাকা তার অদৃষ্টে ছিল না। ছেলেটি বেশ বড় হইয়াছে, মার্টিনকে সাহায্য করিবার উপযুক্ত হইয়া উঠিয়াছে, মার্টিনের শেষ বয়সের আশা-ভরসা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এমন সময়েই তার ব্যারাম হইল। এক সপ্তাহকাল ভয়ানক জ্বরে কষ্ট পাইয়া ছেলেটি মরিয়া গেল। মার্টিন নিজেই ছেলেটিকে কবর দিয়া আসিল। সে এতই ভাঙ্গিয়া পড়িল যে, ভগবানে বিশ্বাস হারাইতে বসিল। এই বুড়ো বয়সে তার নিজের মৃত্যু হইল না! সবে একটি ছেলে, সেও গেল! অত্যন্ত কাতর হইয়া সে আকুল প্রাণে প্রার্থনা করিতে লাগিল তার যেন মৃত্যু হয়। ইহার পর সে গীর্জায় যাওয়া বন্ধ করিল।
একদিন মার্টিনের গ্রামস্থ একজন বৃদ্ধ ট্রয়েট্সার মঠ হইতে ফিরিবার সময়ে মার্টিনের কাছে আসিলেন। তিনি গত আট বৎসর তীর্থ করিয়া বেড়াইতেছেন। সেই বৃদ্ধের সঙ্গে মার্টিনের কথাবার্ত্তা চলিল। মার্টিন প্রাণ খুলিয়া সব কথা বলিল, নিজের মনের ব্যথা তাকে জানাইল।
মার্টিন বলিল—“আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা নেই। ভগবানের কাছে আমার এই একমাত্র প্রার্থনা যে, আমি যেন শীগ্গির শীগ্গির মর্তে পারি। জগতে আমার যা আশা-ভরসা ছিল সব গেছে।”
সেই বৃদ্ধ বলিল—“এসব কথা বল্বার তোমার কোন অধিকার নেই। মার্টিন, ভগবান্ যা করেন তা আমরা বিচার কর্তে পারিনে। তাঁর যা ইচ্ছা তাই হবে। আমাদের যুক্তিতর্ক কিছুরই মীমাংসা করতে পারে না। যদি তিনি ইচ্ছা ক’রে থাকেন যে, তুমি বেঁচে থাক্বে আর তোমার ছেলে মারা যাবে, তা হ’লে তা ত হবেই। তুমি হতাশ হয়ে পড়েছ বটে,—কিন্তু এ হতাশ ভাবটা এসেছে তুমি নিজের সুখের জন্যে বেঁচে থাক্তে চাও ব’লে।”
মার্টিন বলিল—“আর কিসের জন্যে বেঁচে থাক্ব?”
বৃদ্ধ বলিল—“ভগবানের জন্যে। ভগবান তোমাকে জীবন দিয়াছেন। শুধু তাঁর জন্যেই বেঁচে থাক্বে। যখন তুমি তাঁরই জন্যে বেঁচে থাক্তে শিখ্বে, তোমার আর তখন দুঃখ কর্তে হবে না, সব তোমার কাছে সরল-সহজ ব’লে মনে হবে।”
মার্টিন কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল, তারপর বলিল—“আচ্ছা, ভগবানের জন্যে বেঁচে থাকাটা কি?”
বৃদ্ধ উত্তর করিল—“কি ক’রে তাঁর জন্যে বেঁচে থাক্তে হয়—তা’ ত যীশুখৃষ্ট আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। তুমি পড়্তে পার কি? তা’ হ’লে বাইবেল কিনে পড়, তা’তে দেখ্তে পাবে তিনি কি ক’রে তাঁরই জন্যে মানুষকে বেঁচে থাক্তে উপদেশ দিয়েছেন। তুমি সবই তাতে পাবে।”
এই কথাগুলি মার্টিনের প্রাণে খুব লাগিল। সেই দিনই সে বড় বড় অক্ষরে ছাপা একখানি বাইবেল কিনিয়া আনিয়া পড়িতে লাগিল।
প্রথমে সে মনে করিল যে, কেবল রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনই পড়িবে। কিন্তু একবার পড়িতে আরম্ভ করিয়াই তার মনের ভার এতই কমিয়া গেল যে, সে রোজ পড়িতে লাগিল। কখনও কখনও সে পড়ায় এতই ডুবিয়া থাকিত যে, প্রদীপের তৈল সব পুড়িয়া গেলেও পড়া ছাড়িয়া উঠিতে চাহিত না। রোজ রাত্রেই পড়া আরম্ভ করিল; যতই পড়িতে লাগিল ততই কি করিয়া শুধু ভগবানের জন্যই সে বাঁচিয়া থাকিবে তা’ স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে লাগিল। ক্রমেই তার মন হাল্কা হইতে লাগিল। পূর্ব্বে তার ছোট ছেলে ক্যাপিটনের কথা ভাবিতে ভাবিতে মনটা ভার করিয়া শুইতে যাইত, কিন্তু এখন শুইবার সময় সে বারে বারে বলিত—“ভগবান্, তোমারই জয়—তোমারই জয়।”
সেই সময় হইতে মার্টিনের জীবনের গতি বদলাইতে লাগিল। পূর্ব্বে ছুটির দিনে সে দোকানে গিয়া চা খাইত; এমন কি মাঝে মাঝে দুই-এক গ্লাস মদও খাইত, কখনও কখনও কোনও বন্ধুর সঙ্গে মদ খাইয়া রাস্তায় আবোল-তাবোল বকিতে বকিতে যাইত, আর খুব মাত্লামি করিত; কিন্তু এখন তার এই সব দোষ একেবারে দূর হইয়া গেল। সে সম্পুর্ণ নূতন ধরণের লোক হইয়া পড়িল। তার জীবনে এখন কেবল শান্তি ও আনন্দ। সকালবেলা সে কাজ করিতে বসিত। সমস্ত দিন পরে তার কাজ যখন শেষ হইত সে দেওয়াল হইতে আলোকটি নামাইয়া টেবিলের উপর রাখিত এবং তাক হইতে বই আনিয়া পড়িতে বসিত। যতই সে বেশী পড়িতে লাগিল, সে ততই বেশী বুঝিতে পারিল এবং তার মনও ততই পরিষ্কার ও প্রফুল্ল হইয়া উঠিল।
একদিন মার্টিন পড়িতে পড়িতে অনেকক্ষণ কাটাইয়া দিল। বাইবেলের এক পরিচ্ছেদে সে পড়িল—
“যে তোমার এক গালে চড় মারিবে তার দিকে তোমার আর এক গাল ফিরাইয়া দিও, যে তোমার চাদরখানা লইয়া যাইবে তাকে তোমার জামাটাও দিও। যে তোমার কাছে যা চাহিবে তাকে তা দিবে, তোমার দ্রব্য কেহ গ্রহণ করিলে তা আর চাহিও না। নিজের প্রতি তুমি যেরূপ ব্যবহার পাইতে ইচ্ছা কর, অন্যের প্রতিও সেইরূপ ব্যবহার করিবে!”
সে আর এক জায়গায় পড়িল, যীশুখৃষ্ট বলিতেছেন—
“আমি যা বলি তা না করিয়া ‘প্রভু, প্রভু’ বলিয়া আমায় ডাক কেন। সেই আমার কাছে আসে, আমার কথা শুনে এবং সেই কথা যে কার্য্যে পরিণত করে, সে কার মত তোমাকে বলিব। সে তারই মত—যে পাহাড়ের উপর ভিত গাঁথিয়া বাড়ী করিয়াছিল। বন্যা আসিয়া সব ডুবাইয়া দিল, বড় বড় ঢেউ জোরে আছড়াইতে লাগিল, কিন্তু পাহাড়ের উপরে তৈরি বলিয়া সে বাড়ীটি নড়িলও না। কিন্তু যে আমার কথা শুনে, কিন্তু কথার মত কাজ করে না, সে তারই মত—যে শক্ত ভিত্তির উপরে বাড়ী না করিয়া বালিতে বাড়ী তুলিয়াছিল। বানের ঢেউ যেমনি জোরে লাগিল অমনি সে ঘর পড়িয়া গেল।”
মার্টিন যখন এই কথাগুলি পড়িল তার মন খুব খুশী হইয়া উঠিল। চোখ থেকে তার চশমা খুলিয়া বইয়ের উপরে রাখিল এবং টেবিলের উপর কনুই রাখিয়া যা পড়িল তাই ভাবিতে লাগিল। এই কথাগুলি তার জীবনে কতদূর সে কাজে লাগাইতে পারিবে তা বিচার করিয়া নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল—
“আমার ঘর কি পাহাড়ের ওপরে তৈরি ক’রেছি,—না বালির ওপরে? যদি পাহাড়ের ওপর ক’রে থাকি তা’ হ’লে ভালই ক’রেছি। মানুষের পক্ষে একলা এক জায়গায় ব’সে ব’সে মনে করা খুব সোজা যে, সে ভগবানের হুকুম মেনে চল্ছে। আমার পক্ষেও তাই—কিন্তু আমি যখন নিজেকে নিয়ে খুব সতর্ক থাকি তখনই তাঁর কথা ভুলে যাই,―আর পাপে মজি। যাই হোক্, আমি বার বার চেষ্টা কর্ব। এতে একটা আনন্দ আছে। ভগবান্, তুমি আমায় দয়া কর।”
সে এই সব চিন্তা করিতে করিতে শুইতে যাইবার উদ্যোগ করিল, কিন্তু বই ছাড়িয়া উঠিতে ইচ্ছা হইল না। কাজে কাজেই বাইবেলের আর এক পরিচ্ছেদ পড়িয়া ফেলিল। তাতে অনেক মহাপুরুষের কথা এবং নারী-চরিত পাঠ করিল। পড়িতে পড়িতে সে এক জায়গায় পাইল যে, একজন ধনী ইহুদী যীশুখৃষ্টকে তাঁর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, তিনি সেখানে আসিয়াছেন। তারপর এক পতিতা নারী চোখের জলে যীশুর পা দুখানি ভিজাইয়া দিল। সেই পরিচ্ছেদের ৪৪ শ্লোকে সে পড়িল—
“সেই স্ত্রীলোকটির দিকে ফিরিয়া যীশু সাইমন্কে বলিলেন—তুমি এই স্ত্রীলোকটিকে দেখিতেছ কি? আমি তোমার বাড়ীতেই আসিয়াছি, পা ধুইবার জন্য তুমি আমাকে জল দাও নাই, কিন্তু সে তার চোখের জলে আমার পা ধুইয়া চুলে করিয়া মুছাইয়া দিয়াছে। তুমি আমায় চুম্বন কর নাই, কিন্তু আমার আসা অবধি সে আমার পা ক্রমাগত চুম্বন করিয়াছে—থামে নাই; আমার মাথায় তুমি একটু তৈলও মাখাইয়া দাও নাই, কিন্তু সে আমার পায়ে তৈল মাখাইয়া দিয়াছে।”
মার্টিন এই কথাগুলি পড়িয়া ভাবিতে লাগিল, ‘তাঁর পা ধুইয়ে দেবার জন্যে সে জল দেয় নি, তাঁর পায়ে সে চুমোও খায় নি, তাঁর মাথায় একটু তেলও মাখিয়ে দেয় নি···।’ মার্টিন চোখ থেকে চশমা খুলিয়া বইয়ের উপর রাখিয়া চিন্তা করিতে লাগিল―
‘সেই ইহুদী নিশ্চয়ই আমার মত হ’য়ে থাক্বে; সে নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যস্ত থাক্ত। কি ক’রে এক পেয়ালা চা খাবে, কি ক’রে বেশ আরামে থাক্তে পার্বে—এই ছিল তার চিন্তা, সে অতিথির জন্যে মোটেই ভাব্ত না, তাঁর সেবাও কর্ত না। নিজের খুব যত্ন কর্ত। আবার, সেই অতিথিটি ছিলেন কে?—যীশু স্বয়ং। তিনি যদি আমার কাছে আস্তেন, আমি কি রকম ব্যবহার কর্তুম্?’
তারপর মার্টিন দুই হাতের উপরে মাথা রাখিয়া ভাবিতে ভাবিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িল।
হঠাৎ যেন তার কানের কাছে কেহ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া তাকে ডাকিল—“মার্টিন!”
মার্টিন চমকিয়া উঠিল এবং জিজ্ঞাসা করিল—“কে ওখানে?”
চারিদিকে ফিরিয়া দেখিয়া দরজার পানে সে তাকাইল, সেখানে কাহাকেও দেখিতে পাইল না। সে আবার ডাকিল। এবার সে স্পষ্ট শুনিতে পাইল—“মার্টিন, মার্টিন, কাল রাস্তার দিকে চেয়ে থেকো, আমি আস্ব।”
মার্টিন জাগিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিল, চোখ রগড়াইল। কিন্তু এই কথাগুলি জাগিয়া শুনিয়াছে কিংবা স্বপ্নে শুনিয়াছে সে কিছুই স্থির করিতে পারিল না। তারপর আলোটা নিবাইয়া দিয়া শুইয়া পড়িল।
ভোর হইবার অনেক আগে সে জাগিয়া উঠিয়া প্রার্থনা শেষ করিল, পরে আগুন জ্বালিয়া কপির ঝোল তৈয়ার করিল। তারপর ষ্টোভ্ জ্বালিয়া, কোমরে কাপড় জড়াইয়া জানালায় বসিয়া কাজ করিতে লাগিল। রাত্রের ব্যাপারটা কখনও স্বপ্ন বলিয়া বোধ হইল, আবার কখনও বা মনে করিল যে, সত্য সত্যই সে তাঁরই বাণী শুনিতে পাইয়াছে। সে মনে করিল, ‘এ রকম দৈববাণী পূর্ব্বেও ত শোনা গেছে।’
সে কাজ করিতে লাগিল বটে, কিন্তু কাজের চেয়ে বেশী মন দিল রাস্তার দিকে, কেবলই সে রাস্তার দিকে চাহিতে লাগিল। যখনই কোনও লোক এমন জুতা পায়ে দিয়া যাইত যে, সে জুতা দেখিয়া লোক চিনিতে পারিত না, তখনই হেঁট হইয়া চাহিয়া দেখিত—পথিকের আগাগোড়া ঠাহর করিয়া দেখিত। এক বাড়ীর এক দরোয়ান একজোড়া নূতন জুতা পরিয়া চলিয়া গেল, তারপর গেল একজন ভিস্তী। একটু পরেই একজন খুব বুড়া সেপাই কোদালি লইয়া তার জানালার কাছে আসিল। তার জুতা দেখিয়াই মার্টিন তাকে চিনিল। তার জুতা নিতান্ত অপরিষ্কার, পুরাতন, তার সব জায়গায় তালি-মারা। এই বৃদ্ধ সৈনিকের নাম ষ্টেপানিচ। মার্টিনের বাড়ীর কাছেই একজন বণিক্ তাকে রাখিয়াছিল। মার্টিনের জানালার সামনে রাত্রে যে বরফ পড়িয়াছিল তাই সে ভোরে পরিষ্কার করিতে আসিয়াছিল। মার্টিন তার দিকে একবার চাহিয়া দেখিল, তারপর আবার নিজের কাজ করিতে লাগিল।
যে বাণী সে শুনিয়াছিল সেই সম্বন্ধেই সে নানা জল্পনা-কল্পনা করিতে লাগিল। নিজের কল্পনায় নিজেই হাসিয়া বলিল, “বয়স বেশী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার মাথা খারাপ হ’য়ে গেছে। ষ্টেপানিচ বরফ সাফ কর্তে এসেছে, আর আমাকে মনে কর্তে হবে যে যীশু আমার সঙ্গে দেখা কর্তে এসেছেন। বুড়ো হ’য়ে আমার বুদ্ধি-সুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেছে দেখ্ছি।”
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সে জুতায় আরও দশ-বারটা ফোঁড় দিল; তারপরে জানালা দিয়া বাহিরের দিকে আবার চাহিয়া রহিল। সে দেখিল যে, ষ্টেপানিচ তার কোদালিটা একটা দেয়ালের গায়ে দাঁড় করাইয়া রাখিয়া বিশ্রাম করিতেছে, আর শরীরটা একটু গরম করিবার চেষ্টা করিতেছে। বুড়ো বয়সে তার স্বাস্থ্য ও শরীর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল; এবং ইহা স্পষ্টই বুঝা যাইতেছিল যে, বরফ সাফ করিবার শক্তি তার নাই।
মার্টিন ভাবিল—‘একে ভেতরে ডেকে এনে যদি একটু চা খেতে দেওয়া যায় তা হ’লে কেমন হয়! চায়ের জলও এইমাত্র চাপানো হয়েছে।’
সেলায়ের ফোঁড়টা জুতায় বিঁধিয়া রাখিয়া সে উঠিল। জল নামাইয়া টেবিলের উপর রাখিয়া চা তৈরি করিল। আস্তে আস্তে জানালাটা একটু খুলিল। ষ্টেপানিচ জানালার কাছে আসিলে সে তাকে ইসারায় ভিতরে ডাকিয়া, দরজা খুলিয়া দিতে গেল।
মার্টিন বলিল―“ভেতরে এসো, চা খেয়ে একটু গরম হবে—এখন তোমার খুবই শীত কর্ছে।”
ষ্টেপানিচ বলিল—“ধন্যবাদ, ভগবান্ তোমার মঙ্গল করুন। ঠাণ্ডায় হাড়গুলো সব কন্কন্ কর্ছে।”
ষ্টেপানিচের জুতায় বরফ লাগিয়াছিল। সে ভিতরে আসিবার আগে বরফের টুক্রাগুলি ঝাড়িয়া ফেলিল। মেঝেয় পায়ের দাগ লাগিবে বলিয়া হেঁট হইয়া পা মুছিতে গিয়া কাঁপিতে লাগিল এবং পড়িয়া যাইবার মত হইল।
মার্টিন বলিল—“পা-টা মুছ্বার জন্যে তোমাকে এত কষ্ট কর্তে হবে না। মেঝেটা আমি ঝাঁট দিয়ে পুঁছে ফেল্ব। এসো ভাই, ব’সে একটু চা খাও এখন।”
দুইটি পেয়ালা ভর্ত্তি করিয়া মার্টিন একটি ষ্টেপানিচকে দিল, আর একটি প্লেটের উপর রাখিয়া ফুঁ দিতে লাগিল।
ষ্টেপানিচ এক নিঃশ্বাসে শেষ করিয়া পেয়ালাটি উপুড় করিয়া রাখিল এবং মার্টিনকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল। কিন্তু মার্টিন স্পষ্টই বুঝিতে পারিল যে, আর এক পেয়ালা পাইলে সে আরও খুসী হয়।
তখন “আর এক পেয়ালা খাও” বলিয়া মার্টিন তার পেয়ালাটা আবার ভর্তি করিয়া দিয়া নিজের পেয়ালাতে চা ঢালিল। সে যখন চা খাইতে লাগিল, মার্টিন আবার রাস্তার দিকে চাহিয়া রহিল।
ষ্টেপানিচ জিজ্ঞাসা করিল—“তুমি কি আর কারও অপেক্ষায় রয়েছ নাকি?”
মার্টিন বলিল—“কারও অপেক্ষায় রয়েছি কি? তা―তোমায় বল্তে আমার লজ্জা হচ্ছে। আমি যে সত্যি সত্যিই কারও প্রতীক্ষায় রয়েছি তা নয়; তবে কাল রাত্তিরে এমন একটা কিছু শুন্তে পেয়েছিলুম যা আমি কিছুতেই ভুল্তে পার্ছিনে। আমি বল্তে পারিনে এটা স্বপ্ন কি আমার একটা খেয়াল। দেখ ভাই, কাল রাত্তিরে আমি বাইবেল নিয়ে পড়্ছিলুম, যীশু কি ক’রে পরের জন্যে নিজে কষ্ট ভোগ করেছিলেন, তিনি কি ক’রে এই পৃথিবীতে বেড়িয়েছিলেন―ইত্যাদি। তুমিও নিশ্চয়ই এ সব কথা শুনেছ।”
ষ্টেপানিচ বলিল—হ্যাঁ, সব কথা শুনেছি বটে, কিন্তু আমি মুখ্যু, লিখ্তে-পড়্তে পারিনে।
মার্টন বলিল―“বটে! দেখ, তিনি কি ক’রে পৃথিবীতে বেড়াতেন তাই আমি পড়্ছিলুম। এক জাগায় পড়্লুম যে, তিনি একজন ইহুদীর বাড়ীতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ইহুদী তাঁকে খাতির-যত্ন করেনি। মনে কর—তিনি যদি আমার মত একজন লোকের বাড়ীতে আস্তেন, তা’ হলে সে কি না কর্ত! সেই ইহুদীটা কিন্ত অতিথির সেবা একেবারেই কর্লে না। আমার ভাই, এসব চিন্তা কর্তে কর্তে একটু ঘুম এলো। আমি ঢুল্তে লাগ্লুম। আর ঝিমুতে ঝিমুতে শুন্তে পেলুম, কে যেন আমার নাম ধ’রে ডাক্লে। আমি জেগে উঠ্লুম, মনে হ’ল যেন কেউ ফিস্ফিস্ ক’রে বল্লে, “কাল প্রতীক্ষায় থেকো, আমি কাল আস্ব।’ এ রকম দুবার হ’ল। তোমায় সত্যি কথা বল্তে কি ভাই, যদিও আমি এতে খুব লজ্জিত হচ্ছি এ কথাগুলো আমার প্রাণে এমন লাগল যে, আজ আমি প্রাণাধিক প্রিয় যীশুর পথ চেয়ে বসে রয়েছি।”
ষ্টেপানিচ মাথাটা একটু নাড়িল, কিন্তু কথা কহিল না। সে চায়ের পেয়ালাটি শেষ করিয়া একপাশে সরাইয়া রাখিল; কিন্ত মার্টিন উঠিয়া আরও খানিকটা চা ঢালিয়া পেয়ালাটি ভরিয়া দিল।
মার্টিন বলিল—“আর এক পেয়ালা খাও ভাই। দেখ, আমি আরও ভাব্ছিলুম যে, এই পৃথিবীতে তিনি কি রকম ক’রে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, কাউকে কখন ঘৃণা করেন নি, আর সাধারণ লোকদের সঙ্গেই প্রায় বেড়াতেন। সাদাসিধে সরলপ্রাণ লোকদের সঙ্গে মিশ্তেন, আমাদের মত পতিত দরিদ্র মজুরদের ভেতর থেকেই তিনি তাঁর শিষ্য বাছাই কর্তেন। তিনি বলেছেন—যে নিজেকে জানাতে চায়, তার দর্প চূর্ণ হবে, আর যে শিষ্ট-শান্ত হ’য়ে থাকে, যার গর্ব্ব নেই, তাকে ভগবান্ উঁচু কর্বেন। তোমরা আমায় ঈশ্বর বল, আমি তোমাদের পা ধুয়ে দিতে পারি। যে সকলের বড় হ’তে চায়, সে আগে সকলের সেবা করুক, কারণ যারা সৎ, যারা শান্ত, যারা সকলের সেবা করে তারাই ভগবানের আশীর্ব্বাদ পায়।”
ষ্টেপানিচ চা ভুলিয়া গেল। সে বুড়ো মানুষ। তার মনটিও খুব নরম। কথাগুলি তার প্রাণে গিয়া পৌঁছিল। তার গাল বহিয়া চোখের জল গড়াইতে লাগিল।
মার্টিন বলিল—“এসো, আর একটু চা খাবে।”
ষ্টেপানিচ তার কথায় বাধা দিয়ে ধন্যবাদ জানাইল। তারপর পেয়ালাটা সরাইয়া রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
সে বলিল—“ধন্যবাদ মার্টিন, তুমি আমাকে ভগবানের কথা শুনিয়ে আমার প্রাণে ভারি একটা শান্তি দিয়েছ, আর আমার শরীরটাকেও বেশ তাজা ক’রে দিয়েছ।”
মার্টিন বলিল—“তোমাকে সব সময়ই আদর কর্ব। তুমি আর এক দিন আবার এসো! কেউ এলে আমি বড্ড খুসী হই।”
ষ্টেপানিচ চলিয়া গেল। যেটুক্ চা কেট্লীতে ছিল, মার্টিন পেয়ালায় ঢালিয়া খাইল,—চায়ের সাজ-সরঞ্জাম সরাইয়া রাখিয়া সে আবার কাজে বসিল, আর কাজ করিতে করিতে জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিতে লাগিল। খৃষ্টের প্রতীক্ষায় থাকিয়া সে তাঁর কাজের সম্বন্ধে কেবল চিন্তা করিতে লাগিল। তার হাতে কাজ, কিন্তু মনে কেবল সেই মহাপুরুষের কথা।
দুইজন সেপাই চলিয়া গেল। একজনের পায়ে সরকারী জুতা, আর একজনের পায়ে মার্টিনের হাতের তৈরি জুতা। তারপর তারই একজন প্রতিবেশী খুব ঝক্মকে পোষাক পরিয়া চলিয়া গেল। তারপর একজন রুটিওয়ালা মাথায় এক টুকরী রুটি লইয়া বিক্রী করিতে গেল। এইরূপে কত লোক আসিল-গেল, মার্টিন কাজ করিতে করিতে দেখিতে লাগিল। তারপর নিতান্ত ময়লা কাপড় ও ছেঁড়া জুতা পরিয়া একজন স্ত্রীলোক আসিল। সে জানালার ধারে দেওয়ালের পাশে গিয়া দাঁড়াইল। মার্টিন জানালার ফাঁক দিয়া চাহিয়া দেখিল যে, স্ত্রীলোকটি অচেনা, কোনও বিদেশিনী। তার কাপড়-চোপড় ছেঁড়া, ময়লা। আর তার কোলে একটি ছেলে। সে দেওয়ালের পাশে দাঁড়াইয়া কাপড় দিয়া ছেলেটিকে ঢাকিতে চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু ছেলেটির গায়ে দিবে এমন কাপড়ও তার ছিল না। তার কাপড়-চোপড় গ্রীষ্মকালের পোষাকের মত অত্যন্ত পাতলা, তাও নিতান্ত ময়লা—গাঁট দেওয়া। ছেলেটির কান্না মার্টিন শুনিতে পাইল। স্ত্রীলোকটি তাকে শান্ত করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না।
মার্টিন উঠিল; বাহিরে গিয়া তাকে ডাকিয়া বলিল—“ওগো বাছা, শোন ত।”
স্ত্রীলোকটি শুনিতে পাইয়া মার্টিনের দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইল।
—“এই কন্কনে ঠাণ্ডায় ছেলেটিকে নিয়ে বাইরে ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো। এখানে এসে বরং ওর গায়ে ভাল ক’রে কাপড় দিতে পার্বে। এই পথে চ’লে এসো।”
চোখে চশমা আঁটা, ইজেরের উপরে কোমরে একটা কাপড় জড়ানো একটা বৃদ্ধ লোক তাকে ডাকিতেছে দেখিয়া স্ত্রীলোকটি অবাক্ হইল। যাহাই হোক্, সে তার পেছনে পেছনে আসিল।
সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া ছোট ঘরের ভিতরে তারা আসিলে বিছানার কাছে গিয়া মার্টিন তাকে বলিল— “এখানে ব’সো বাছা, এই ষ্টোভটার কাছে বসো। শরীরটা একটু গরম হোক্, ছেলেটিকে কিছু খাওয়াও।”
“একটু দুধও খেতে পায়নি। আমিও আজকে সকালবেলা থেকে কিছুই খাই নি।”—এই বলিয়া স্ত্রীলোকটি মাই দিবার জন্য ছেলেটিকে বুকের কাছে টানিয়া নিল।
মার্টিন উঠিয়া এক গেলাস জল আর খানিকটা রুটি আনিল। তারপর একটা পেয়ালায় করিয়া খানিকটা কপির ঝোল দিল; টেবিলের উপর একখানা কাপড় পাতিয়া তার উপরে রুটি ও ঝোলের বাটী রাখিয়া মার্টিন বলিল—
“এখানে বসে খাও বাছা, ছেলেটিকে আমি দেখ্বখ’ন। আমার নিজেরও অনেকগুলি ছেলেমেয়ে ছিল ত; ওদের কি রকম ক’রে রাখ্তে হয় তা আমি জানি।”
স্ত্রীলোকটি উঠিয়া গিয়া খাইতে বসিল; এদিকে মার্টিন ছেলেটিকে বিছানায় শোয়াইয়া তার পাশে বসিল। ছেলেটিকে আদর করিয়া কত কথাই কহিল; আস্তে আস্তে তার পিঠ চাপড়াইতে লাগিল, তার গাল টিপিয়া দিল। ছেলেটির তখনও দাঁত উঠে নাই। সে কাঁদিতে লাগিল। তাকে শান্ত করিবার জন্য মার্টিন তার মুখের ভিতর আঙ্গুল দিয়াছিল; ছেলেটি যেই কামড় দিল, অমনি সে আঙ্গুল টানিয়া আনিল। তার আঙ্গুলটায় জুতার মোম মাখানো ছিল, পাছে ছেলেটির মুখে লাগে সেইজন্য সে আর তার মুখে আঙ্গুল দিল না। ছেলেটি আঙ্গুলের দিকে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল। মার্টিনও হাসিল এবং বেশ আনন্দ পাইল।
খাইতে খাইতে স্ত্রীলোকটি নিজের পরিচয় দিয়া বলিতে লাগিল—“আমার স্বামী একজন সৈনিক পুরুষ। আট মাস হ’য়ে গেল, অনেক দূরে কোনও এক জায়গায় তাঁকে পাঠান হয়েছে। তারপর থেকে এপর্য্যন্ত তাঁর আর কোনও খবর পাই নি। আমার ছেলে না হওয়া অবধি এক জায়গায় আমি ছিলুম, সেখানে রাঁধ্তুম। কিন্তু ছেলে নিয়ে আমায় তা’রা থাক্তে দিলে না। কোন খানে থাক্বার জন্যে এই তিন মাস ধরে ক্রমাগত চেষ্টা কর্ছি, কিন্তু কোনও খানে থাক্তে পাই নি। পেটের দায়ে আমাকে সব বিক্রি কর্তে হয়েছে। ঝি হ’য়ে থাক্বার জন্যে চেষ্টা কর্লুম, আমায় কেউ রাখ্তে চাইলে না; তারা বল্লে যে আমি খেতে না পেয়ে নিতান্ত রোগা ও দুর্ব্বল হ’য়ে পড়েছি। আমাদের গ্রামের একটি স্ত্রীলোক এক ব্যবসাদারের স্ত্রীর কাছে কাজ কর্ছে। তার কাছে এইমাত্র গিয়েছিলুম। সে আমায় রাখ্বে ব’লে কথা দিয়েছিল কিন্তু এখন আস্ছে হপ্তায় আমায় ফের যেতে বল্লে। তার বাড়ী এখান থেকে অনেকটা দূরে, আমিও বড় ধুঁকে পড়েছি, আর আমার ছেলেটাও খেতে না পেয়ে নেতিয়ে পড়েছে। ভাগ্যিস্ বাড়ীওয়ালী আমাদের ভাড়াটা দয়া ক’রে রেহাই দিয়েছেন, তা না হ’লে যে কি কর্তুম জানিনে।”
মার্টিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—“তোমার কি গরম কাপড়চোপড় নেই?”
স্ত্রীলোকটি বলিল—“গরম কাপড় কোথায় পা’ব? আমার শেষ শালখানা পর্য্যন্ত কাল ছয় আনায় বন্ধক দিয়েছি।”
তারপর স্ত্রীলোকটি উঠিয়া ছেলেটিকে কোলে নিল। মার্টিন উঠিল, দেওয়ালে ঝুলান কতকগুলি কাপড়-চোপড়ের ভিতর হইতে একটা কালো রঙের ছোট পুরাতন পোষাক বাহির করিল।
সে বলিল—“এটা বড় পুরণো হ’য়ে ছিঁড়ে গেছে বটে, কিন্তু ওর গায়ে দেওয়া চল্বে।”
স্ত্রীলোকটি একবার সেই পোষাকটার দিকে চাহিল, তারপর বৃদ্ধ মার্টিনের দিকে আবার চাহিয়া পোষাকটা হাতে লইয়া কাঁদিতে লাগিল। মার্টিন ফিরিয়া বিছানার নীচে হাতড়াইয়া খুব ছোট একটা বাক্স বাহির করিল। বাক্সটার ভিতর এটা-সেটা খানিকক্ষণ খুঁজিয়া স্ত্রীলোকটির সাম্না-সাম্নি বসিল।
স্ত্রীলোকটি বলিল―“ভগবান্ তোমার মঙ্গল করুন। নিশ্চয়ই যীশু আজ আমায় তোমার জান্লার কাছে পাঠিয়েছিলেন, না হ’লে ছেলেটা ঠাণ্ডায় জ’মে যেত। যখন বেরিয়ে ছিলুম তখন এত ঠাণ্ডা ছিল না; কিন্তু দেখ, এখন কি রকম ঠাণ্ডা। আমি ভারী হতভাগী। আমাকে দেখে তুমি দয়া কর্বে তাই নিশ্চয়ই যীশু তোমাকে জান্লা দিয়ে দেখিয়েছেন।”
মার্টিন হাসিয়া বলিল—“এটা খুবই সত্যি কথা। তিনিই আমাকে দিয়ে এটা করিয়েছেন। আমি যে হঠাৎ বাইরে চেয়ে দেখ্লুম তা নয়।”
তারপর সেই স্বপ্নের কথা এবং যীশু যে তার কাছে আসিবেন বলিয়া সে শুনিতে পাইয়াছিল তা স্ত্রীলোকটিকে বলিল।
“তা কে বল্তে পারে? সবই সম্ভব”—এই বলিয়া স্ত্রীলোকটি উঠিয়া, সেই পোষাকটা কাঁধের উপরে ফেলিল। নিজের দেহের খানিকটা আর ছেলেটি তাতে ঢাকা পড়িল। তারপর সে আর একবার মার্টিনকে নমস্কার করিল ও ধন্যবাদ দিল।
“যীশুর দোহাই তুমি এইটি নাও,”—এই বলিয়া মার্টিন বন্ধক দেওয়া শাল ছাড়াইয়া আনিবার জন্য ছয় আনা তার হাতে দিল। প্রথমে সে নিতে অস্বীকার করিল, কিন্তু মার্টিনও ফেরৎ নিল না, স্ত্রীলোকটি তারপর চলিয়া গেল।
স্ত্রীলোকটি চলিয়া গেলে পর, মার্টিন কপির ঝোল খাইল, সমস্ত জিনিষ-পত্র পরিষ্কার করিতে লাগিল, কিন্তু জানালা দিয়া বারে বারে বাহিরের দিকে চাহিতে ভুলিল না। জানালায় একটা ছায়া পড়িলেই সে চাহিয়া দেখিত কে যাইতেছে। সেখানকার লোকদের সে চিনিত। অপরিচিত লোক অনেক চলিয়া গেল, কিন্তু তেমন কেহই গেল না যাকে আদর-অভ্যর্থনা করিবে।
কিছুক্ষণ পরে একজন স্ত্রীলোক ঠিক তার জানলার সম্মুখে থামিল। তার মাথায় একটা প্রকাণ্ড আতার ঝাঁকা; কিন্তু ঝাঁকায় বেশী আতা ছিল না; সে প্রায় সবই বিক্রী করিয়া আসিয়াছে, আর তার পিঠের উপর একবস্তা টুকরা কাঠ বোঝাই করিয়া লইয়া যাইতেছিল। সে পথে আসিতে কোনখান হইতে সেগুলি কুড়াইয়া আনিয়াছিল। বস্তাটা তার পিঠে খুব লাগিতেছিল, এক কাঁধ হইতে আর এক কাঁধে লইবার জন্য সে বস্তাটা ফুটপাতের উপর রাখিল, ঝাঁকাটাও নামাইয়া রাখিল। বোঝাটা একটু গুছাইয়া লইবার জন্য বস্তাটা ধরিয়া ঝাঁকানি দিল। একটা বালক সেই সময়েই সেখানে ছুটিয়া আসিয়া ঝাঁকা হইতে একটা আতা লইয়া পলাইতেছিল, কিন্তু সেই বৃদ্ধাটি দেখিতে পাইল ও তাকে ধরিয়া ফেলিল। বালকটি পলাইবার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তি করিতে লাগিল; কিন্তু স্ত্রীলোকটি তাকে দুই হাত দিয়া ধরিয়া ফেলিল এবং শেষে তার মাথার টুপী ফেলিয়া দিয়া চুল শক্ত করিয়া ধরিল। বালকটি চীৎকার করিতে লাগিল। মার্টিন জুতা সেলাই বন্ধ রাখিয়া, চশমাটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া রাখিয়া, দরজা খুলিয়া ছুটিয়া রাস্তায় বাহির হইল। ছেলেটা হাত ছাড়াইবার জন্য টানাটানি করিতেছে। বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটি তার চুল ধরিয়া টানিতেছে এবং পুলিসের হাতে দিবে বলিয়া শাসাইতেছে। আর ছেলেটা বলিতেছে—“আমি নিই নি, তুমি আমায় কিসের জন্য মার্ছ? আমায় ছেড়ে দাও।”
মার্টিন গিয়া তাদের ছাড়াইয়া দিল। বালকটির হাত ধরিয়া সে বলিল—“ওকে ছেড়ে দাও, দিদি, ওকে এবার ক্ষমা কর।”
স্ত্রীলোকটি বলিল—“ওকে এমন শিক্ষা দেবো যে, একবছরে তা না ভুলে যায়। বদ্মায়েসটাকে পুলিসের হাতে দেবো।”
মার্টিন তাকে অনেক মিনতি করিয়া বলিল—“ওকে ছেড়ে দাও, ও আর কখনও এ রকম করবে না। ওকে এবার যেতে দাও।”
বালকটিকে বৃদ্ধা ছাড়িয়া দিল। সে পলাইয়া যাইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু মার্টিন তাকে থামাইল।
সে বলিল—“দিদির কাছে ক্ষমা চাও, আর এ কাজ কখনও ক’রো না। আতাটা নিতে আমি তোমায় দেখেছিলুম।”
বালকটি কাঁদিয়া ফেলিল, ক্ষমা চাহিল। মার্টিন বলিল—“ব্যস্ ঠিক হয়েছে। এই নাও একটি আতা।”
মার্টিন ঝাঁকা হইতে একটি আতা তুলিয়া ছেলেটির হাতে দিয়া বলিল—“এর দাম দিদি, তোমায় আমি দেবো’খন্।”
বৃদ্ধা বলিল—“এই সব পাজি ছেলেগুলোকে তোমরাই এরকম ক’রে মাটি কর্বে। যাতে অনেক দিন মনে থাকে এমনি ভাবে ওকে বেত মারা উচিত ছিল।”
মার্টিন বলিল—“দিদি, সেটা হচ্ছে আমাদের ব্যবস্থা, ভগবানের ব্যবস্থা তা নয়। যদি একটা আতা চুরির জন্যে ও ছোঁড়াকে মারতে হয়, আমাদের পাপের জন্য কি ব্যবস্থা করা হবে?”
বৃদ্ধা চুপ করিয়া রহিল, মার্টিন তাকে যীশুখৃষ্টের ক্ষমার কাহিনী অনেক শুনাইল। সে খুব মন দিয়া নেইগুলি শুনিল। বালকটিও কাছে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল।
মার্টিন বলিল—“ভগবান্ আমাদের ক্ষমা কর্তেই শিক্ষা দিয়েছেন, নইলে আমরাও ক্ষমা চাইতে পারব না। প্রত্যেককে ক্ষমা কর, বিশেষতঃ যে ছোট, যে অবোধ, তাকে সব চাইতে বেশী ক্ষমা কর।”
বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল―“এ খুবই সত্যি কথা, কিন্তু এরা যে ভয়ানক খারাপ হচ্ছে?”
মার্টিন উত্তর করিল—“সেজন্য ওদের সৎপথ দেখিয়ে দিতে হবে।”
বৃদ্ধা বলিল—“আমিও ঠিক এই কথাই বলি। আমার নিজেরও সাতটা ছেলে-মেয়ে ছিল; এখন মোটে একটা মেয়ে বেঁচে আছে।”
কোথায় কিরূপভাবে সে মেয়ের সঙ্গে ছিল এবং কতগুলি নাতি ও নাতিনী তার ছিল মার্টিনকে সে তা বলিল—
“আমার এখন আর শক্তি নেই, তবু সেই নাতি-নাতিনীগুলোর জন্য বড্ড খাট্তে হয়, তারা বড় ভাল ছেলে-মেয়ে। ছেলে-মেয়ে ছাড়া আর কেউ আমার কাছে আসে না। সেই ছোট্ট য়্যানিটা আমাকে ছেড়ে আর কারও কাছে যাবেনা।” এই সকল কথা বলিতে বলিতে তার মনটা নরম হইল।
সেই ছেলেটার কথা উল্লেখ করিয়া বলিল—“অবশ্য এটা ওর ছেলেমানুষী, ভগবান্ ওকে সুমতি দিন।”
বুড়ীটা তার বোঝা পিঠে তুলিয়া লইতে গেল। সেই বালকটি তখন তার সম্মুখে গিয়া বলিল—“ঠাক্মা, আমিই বয়ে দেব’খন; আমিও ঐ পথে যাচ্ছি।”
বুড়ী খুসী হইয়া বস্তাটা বালকটির পিঠের উপর তুলিয়া দিল এবং দুইজনে একত্রে সেই রাস্তা দিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় মার্টিনের কাছ থেকে আতাটার দাম নিতে বুড়ী ভুলিয়া গেল। মার্টিনও অন্যমনে তাদের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
তারা অনেক দূরে চলিয়া চোখের বাহির হইয়া গেলে মার্টিন ঘরে ফিরিয়া আসিল। ছুটিয়া বাহিরে যাইবার সময় সে তার চশমা ও ফোঁড় সিঁড়ির উপরেই ফেলিয়া গিয়াছিল। সেইগুলি কুড়াইয়া আনিয়া আবার কাজ করিতে বসিল, কিন্তু একটু কাজ করিতে না করিতেই সন্ধ্যা হইয়া আসিল। সেলাই আর দেখা যায় না। একটু পরেই চাহিয়া দেখিল যে, রাস্তায় আলো জ্বালিতে আসিয়াছে।
মার্টিন ভাবিল—‘বোধ হয় এখন আলো জ্বাল্বার সময় হয়েছে।’
তখন উঠিয়া আলোটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া আবার কাজ করিতে বসিল। একজোড়া জুতা শেষ হইয়া গেল। সেইটা ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া একবার দেখিল। দেখিল বেশ হইয়াছে, তার পরে যন্ত্রপাতি জড় করিল, চামড়ার কুঁচিগুলি সব ঝাড়িয়া ফেলিয়া সূতা-বুরুশ সরাইয়া রাখিল। পরে আলোটি নামাইয়া টেবিলের উপরে বসাইল। তাকের উপর হইতে বাইবেল নামাইয়া আনিল। আগের দিন যেখানে পড়িয়াছিল, সেখানে এক টুক্রা মরক্কো চামড়া দিয়া চিহ্ন রাখিয়াছিল। কিন্তু সেই জায়গা খুলিতে খুলিতে সে অন্য এক জায়গা খুলিয়া ফেলিল। তখন পূর্ব্বদিনের স্বপ্নের কথা মনে পড়িয়া যাওয়ায় সে সেই কথাই বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। হঠাৎ যেন পিছন হইতে কোন লোকের পায়ের শব্দ কানে আসিল। মার্টিন ফিরিয়া তাকাইল, মনে হইল যে অন্ধকার কোণে কে একজন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।
ঠিক বুঝিতে পারিল না কে! তখন সে যেন তার কানে কানে বলিল—“তুমি কি আমায় চেন না মার্টিন?”
মার্টিন খুব আস্তে আস্তে বলিল—“কে?”
“আমি” বলিয়া ষ্টেপানিচ অন্ধকারের ভিতর হইতে বাহির হইল এবং একটু হাসিয়া চলিয়া গেল।
মার্টিন আবার শুনিতে পাইল, “আমি”। এবারে যেন সেই আশ্রয়হীন স্ত্রীলোকটি ছেলে কোলে করিয়া আসিল। তারাও একটু হাসিয়া চলিয়া গেল।
আবার শুনা গেল, “আমি”। এবারে সেই বৃদ্ধা ও আতা হাতে করিয়া সেই বালকটি বাহির হইয়া আসিল। তারাও হাসিয়া চলিয়া গেল।
মার্টিনের প্রাণটা আনন্দে ভরপূর হইয়া উঠিল। সে চশমা তুলিয়া কানে দিয়া বাইবেলের যেখানটা হঠাৎ খুলিয়া গিয়াছিল সেই খানটাই পড়িতে লাগিল। সেই পাতার উপরের দিকে পড়িল—“আমি ক্ষুধিত হইয়াছিলাম—তুমি আমায় খাইতে দিয়াছ, আমি তৃষিত হইয়াছিলাম—তুমি আমায় পানীয় দিয়াছ, আমি অচেনা ছিলাম—তুমি আমায় আদর করিয়া ডাকিয়াছ।”
সেই পাতার নিম্নে পড়িল,—
“এই ভাইদের সেবা করিয়া তুমি আমারই সেবা করিয়াছ।”
এবার মার্টিন বুঝিল যে, তার স্বপ্ন সফল হইয়াছে, সত্য সত্যই মুক্তিদাতা ভগবান্ সেই দিন তার কাছে আসিয়াছিলেন, আর সেও তাঁকে বরণ করিয়াছে।