টল্স্টয়ের গল্প/সেবা
সেবা
বহু পূর্ব্বে জেরুজালেমে দুই ভাই বাস করিত। বড় ভাইয়ের নাম ডেভিড, আর ছোট ভাইয়ের নাম জন্। সহরের কাছাকাছি একটা পাহাড়ে তারা বাস করিত এবং সকলে যা কিছু দিত, তাতেই দিন চালাইত। প্রত্যহ ভোরে তারা কাজ করিতে বাহির হইত; তবে নিজেদের জন্য কিছুই করিত না, খাটিত কেবল পরের জন্য—গরীবদের জন্য। যেখানেই ক্লান্ত, রুগ্ণ, বিধবা কিংবা বাপ-মা-হারা শিশু দেখিতে পাইত সেইখানেই এই দুই ভাই গিয়া তাদের সাহায্য করিত, কিন্তু এক কড়াও লইত না। সমস্ত সপ্তাহ তারা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যাইত, কেবল রবিবার সন্ধ্যার সময় বাড়ী আসিয়া মিলিত। সেই দিনই কেবল তারা বাড়ীতে থাকিত ও তাদের নানা কথাবার্ত্তা হইত। দেবদূত আসিয়া তাদের আশীর্ব্বাদ করিতেন। সোমবার তারা ভিন্ন ভিন্ন দিকে বাহির হইয়া যাইত। এইরূপে বহুদিন কাটাইল। দেবদূত ফি-সপ্তাহে আসিয়া তাদের আশীর্ব্বাদ করিতেন।
একদিন সোমবারে দুই ভাই কাজে বাহির হইল। দুইজন দুই দিকে গেল। জন্কে ছাড়িয়া যাইতে ডেভিডের মনে খুব কষ্ট হইল। ডেভিড খানিকক্ষণ চুপ করিয়া তার দিকে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
জন্ মাথা হেঁট করিয়া চলিতে লাগিল। সে আর পেছনে চাহিয়া দেখিল না; কিন্তু খানিক দূরে গিয়াই জন্ হঠাৎ থামিল। সে যেন কিছু একটা এক দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল। একটু পরেই সেই জিনিষটার কাছে গেল; এক মুহূর্ত্তও আর না থামিয়া, কোনও জানোয়ার তাড়া করিলে লোক যেমন দৌড় দেয় ঠিক তেমনি দৌড় দিল।
ডেভিড্ আশ্চর্যান্বিত হইল এবং জন কেন ভয় খাইল তা দেখিবার জন্য সেখানে ফিরিয়া গেল। দেখিল, রৌদ্রে একটা জিনিষ খুব চক্চক্ করিতেছে। আরও কাছে গেল, দেখিল যে ঘাসের উপর অনেকটা সোনা পড়িয়া রহিয়াছে। সোনা দেখা ও জনের লাফ মারায় সে আরও বিস্মিত হইল।
সে ভাবিল, ‘জন্ ভয় খেলে কেন? আর ছুটে পালালই বা কেন? সোনায় ত কোন পাপ নেই, পাপ হচ্ছে মানুষের মনে। সোনা দ্বারা যেমন অসৎকার্য্য করা যায়, সৎকার্য্যও তেমনি করা যাইতে পারে। কত বিধবা, কত অসহায় শিশুদের খাওয়াতে পারা যায়, কত বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিতে, দরিদ্র ও রোগীর শুশ্রূষা করতে ও যত্ন নিতে পারা যায়। আমরা পরের জন্যে খাটি বটে, কিন্তু আমাদের ক্ষমতা নিতান্ত অল্প। আমরা এখন যা কর্ছি তার চাইতে সোনা নিয়ে আরও অনেক বেশী কর্তে পারি।
জন্কে সে এই কথা বলিতে ইচ্ছা করিল, কিন্তু ইতিমধ্যে সে অনেক দূর গিয়া পড়িয়াছে। ডেভিড্ যতটা সোনা বহিয়া আনিতে পারে ততটা কাপড়ে বাঁধিয়া কাঁধে ফেলিয়া সহরে গেল। সেইখানে একটা হোটেলওয়ালার কাছে সেই সোনা রাখিয়া বাকী সোনাটা আনিবার জন্য আবার গেল। সকল সোনা আনিয়া বণিক্দের কাছে গিয়া জমি কিনিল এবং ইট-কাঠ কিনিয়া কুলী-মজুর খাটাইয়া তিনখানা বাড়ী তৈয়ার করাইতে আরম্ভ করিল। একটা বাড়ী হইল বিধবা ও অনাথ শিশুদের আশ্রম, দ্বিতীয়টি দরিদ্র রোগীর হাসপাতাল এবং তৃতীয়টি দরিদ্র যাত্রীদের অতিথিশালা। তিনজন সাধু পুরুষকে এই তিনটার ভার দেওয়া হইল।
ডেভিডের তবুও তিন হাজার মোহর অবশিষ্ট রহিল; গরীবদের বিতরণ করিবার জন্য সে তিন জন সাধুকে হাজার হাজার করিয়া দিল। তিন বাড়ীই লোকে পূর্ণ হইয়া গেল। এই সৎকার্য্যের জন্য সকলেই তাকে অশেষ প্রশংসা করিতে লাগিল, তার মনে ভারি আনন্দ হইল; কিন্তু সহর হইতে আর তার যাইতে ইচ্ছা হইল না। নিজে সে এক পয়সাও রাখিল না। যে কাপড়-চোপড় লইয়া সে সহরে আসিয়াছিল তা পরিয়াই বাড়ীতে গেল।
যাইতে যাইতে সে ভাবিল, ‘সোনা ফেলে ছুটে গিয়ে ভাই আমার ভুল ক’রেছে। আমি কি ওর চেয়ে ভাল করিনি?’
এই কথা ভাবিতে না-ভাবিতেই সে দেখিল যে, দেবদূত তার পথে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। তার দিকে তিনি কট্মট্ করিয়া চাহিলেন। ডেভিডের ভারি ভয় হইল, বলিল—‘কেন প্রভো?”
দেবদূত বলিলেন—“দূর হ’য়ে যাও এখান থেকে। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে বাস করবার যোগ্য তুমি নও। সোনা নিয়ে তুমি যা কিছু ক’রেছ তার চাইতে তার এই সোনা ত্যাগ করে যাওয়ার মূল্য ঢের বেশী।”
তারপর ডেভিড্ বলিল—“কত দরিদ্র, কত যাত্রী আশ্রয় পাচ্ছে, খেতে পাচ্ছে। কত অসহায় শিশুকে গ’ড়ে তোলা হচ্ছে।”
দেবদূত বলিলেন—তোমাকে নষ্ট করবার জন্যে যে শয়তান সোনা রেখেছিল, সে শয়তানই তোমার মুখে এমনি লম্বা-চওড়া কথা দিয়েছে।”
ডেভিডের বিবেক তাকে তিরস্কার করিতে লাগিল। তার মনে বড় কষ্ট হইল। সে কাঁদিয়া ফেলিল।
দেবদূত পথ ছাড়িয়া দিলেন। জন্ সেই পথেই তার অপেক্ষায় ছিল; ডেভিড্ আর শয়তানি মতলব কখনও মনে স্থান দেয় নাই। সে বুঝিতে পারিল যে, সোনা দিয়া ভগবানের পূজা কিংবা শ্রেষ্ঠ নরসেবা হয় না, কেবল সৎকর্ম্মের দ্বারাই পরোপকার হইয়া থাকে।