বিষয়বস্তুতে চলুন

টুনটুনির বই/বাঘ-বর

উইকিসংকলন থেকে

বাঘ-বর


এক গরিব ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার ঘরে ব্রাহ্মণী ছিলেন, আর ছোট্ট একটি মেয়ে ছিল কিন্তু তাদের খেতে দেবার জন্যে কিছু ছিল না। ব্রাহ্মণ অনেক কষ্টে ভিক্ষা করে যা আনতেন, এক বেলায় ভালো করে না খেতেই তা ফুরিয়ে যেত। সকল দিন আবার তাও মিলত না।

 একদিন তাদের ছোট্ট মেয়েটি পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। গিয়ে দেখল, সে বাড়িতে পায়েস রান্না হয়েছে, ছেলেরা পায়েস খাচ্ছে। দেখে সেই মেয়েটিরও বড্ড পায়েস খেতে ইচ্ছে হল। তাই সে বাড়ি এসে তার মাকে বললে, ‘মা, আমাকে পায়েস করে দাও না, আমি পায়েস খাব!’

 শুনে তো তার মা কাঁদতে লাগলেন। ভাতই ভালো করে খেতে পান না, পায়েস আবার কি করে করবেন?

 এমন সময় ব্রাহ্মণ ভিক্ষে নিয়ে ফিরে এসে ব্রাহ্মণী কাঁদছেন দেখে জিগগেস করলেন, ‘কাঁদছ কেন ব্রাহ্মণী, কি হয়েছে?’

 ব্রাহ্মণী বললেন, ‘মেয়ে পায়েস খেতে চেয়েছে, পায়েস কোত্থেকে দেব, তাই কাঁদছি।’

 শুনে ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দেখছি এর একটা কিছু করতে পারি কিনা, তুমি কেঁদ না’ বলে তিনি তখুনি আবার বেরিয়ে গেলেন।

 সেই গ্রামে একজন খুব ভালো জমিদার ছিলেন।

 তিনি যেই শুনলেন, ব্রাহ্মণের মেয়ে পায়েস খেতে চেয়েছে, অমনি তাঁকে চমৎকার গোপালভোগ চাল, দু-সের দুধ, চিনি আর মসলা দিলেন।

 ব্রাহ্মণ তাতে খুব খুশী হয়ে, জমিদারকে আশীর্বাদ করে, ছুটে বাড়ি এসে ব্রাহ্মণীকে বললেন, ‘এই নাও, তোমার পায়েসের যোগাড় এনেছি।’

 সেই ব্রাহ্মণী কি লক্ষ্মী মেয়েই ছিলেন! তিনি এমনি সুন্দর রাঁধতেন যে, তেমন রান্না কেউ কখনো খায়নি। তিনি যখন পায়েস রাঁধতে লাগলেন, তখন তার চমৎকার গন্ধে আশে পাশে সকল লোক পাগল হয়ে উঠল।

 একটা কাক সেই পায়েসের গন্ধ পেয়ে বললে, ‘আহা! এমন চমৎকার জিনিস একটু না খেয়ে দেখলে চলছে না।’

 বলেই সে ব্রাহ্মণের ঘরের চলে এসে বসল।

 কাক অনেকক্ষণ ধরে ঘরের চালে চুপ করে বসে রইল। তারপর রান্নাঘরে একটু শব্দ হতেই সে বললে, ‘ঐ! এবারে রান্না হয়েছে।’

 খানিক বাদে আর একটু শব্দ হল, আর অমনি কাক বললে, ‘ঐ! এবারে বাড়ছে।’

 খানিক বাদে আর একটু শব্দ হল, অমনি কাক বললে, ‘ঐ! এবারে খাচ্ছে!’

 সত্যি-সত্যি ব্রাহ্মণ আর তার মেয়ে তখন খেতে বসেছিলেন। সে পায়েস এতই ভালো হয়েছিল যে তারা দুজনেই তা প্রায় শেষ করে ফেললেন। ব্রাহ্মণীর জন্যে খুব কম রইল। তারপর ব্রাহ্মণীর খাওয়া যখন শেষ হল, তখন পাতে বা হাঁড়িতে পায়েসের একটু দাগ অবধি রইল না।

 কাক এতক্ষণ বসে থেকেও যখন কিছু খেতে পেল না, তখন তার বড্ড রাগ হল। সে মনে-মনে বললে, ‘আমাকে এমন করে ঠকালে! এর শোধ দিতেই হবে।’

 ব্রাহ্মণের বাড়ির কাছে একটি প্রকাণ্ড বন ছিল, সেই বনে মস্ত একটা বাঘ থাকত।

 কাক দুষ্টু ফন্দি এঁটে সেই বাঘকে গিয়ে বললে, ‘বাঘমশাই, আমাদের ব্রাহ্মণঠাকুরের একটি সুন্দর মেয়ে আছে। আপনি এমন সুন্দর বর, আপনার সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হলে বড় ভালো হয়।’

 বাঘ বললে, ‘বিয়ে ঠিক করে দেবে কে? আমি কথা কইতে গেলে তে। তারা ছুটে পালাবে!’

 কাক বললে, ‘আপনাকে কিছু করতে হবে না, আমি সব করে দিচ্ছি। আগে আপনি ব্রাহ্মণকে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিন।’

 বাঘ বললে, ‘বেশ কথা! আমি গ্রামে গিয়ে কুত্তা মেরে বামুনের বাড়ি রেখে আসব।’

 কাক তা শুনে জিভ কেটে বললে, ‘না-না! তারা কুত্তা খাবে না! আপনার বাড়িতে যে লেবুর গাছ আছে, সেই গাছের লেবু পাঠিয়ে দিন। আমি লেবু নিয়ে যাব এখন।’

 বলে সে কয়েকটা লেবু নিয়ে ব্রাহ্মণের বাড়িতে দিয়ে এসে বললে, ‘বাঘমশাই, তারা তো লেবু খেয়ে ভারী খুশী হয়েছে। এমনি করে দিন কতক লেবু দিলেই মেয়ে দিয়ে দেবে।’

 শুনে বাঘ আহ্লাদে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল।

 এমনি করে কাক রোজ লেবু নিয়ে যায় আর বাঘকে বলে, ‘তারা মেয়ে বিয়ে দেবে।’ আসলে সেটা মিথ্যে কথা, কিন্তু বাঘ মনে করে, ব্রাহ্মণ বুঝি সত্যি-সত্যি মেয়ে দেবে বলেছে।

 তারপর একদিন বাঘ বললে, ‘কই, লেবু তো ফুরিয়ে গেল, মেয়ে তো বিয়ে দিলে না।’

 কাক বললে, ‘দেবে বইকি! আপনি যখন চাইবেন, তক্ষুণি দেবে।

 বাঘ বললে, ‘তবে তাদের বল গিয়ে যে, যদি কাল রাত্রে মেয়ে বিয়ে না দেয়, তাহলে তাদের সবাইকে চিবিয়ে খাব।’

 কাক তো তাই চায়। সে তক্ষুণি ব্রাহ্মণের বাড়ি গিয়ে বললে, ‘ওগো শুনছ? কাল রাত্রে বাঘ আসবে, তোমাদের মেয়ে বিয়ে করতে। যদি বিয়ে না দাও, সকলকে চিবিয়ে খাবে।’

 একথা শুনেই তো ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী বুক চাপড়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

 কান্না শুনে গ্রামের লোক ছুটে এসে বললে, ‘কি হয়েছে?’

 ব্রাহ্মণ কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, ‘কাল বাঘ আসবে, আমাদের মেয়েকে বিয়ে করতে। বিয়ে না দিলে সকলকে চিবিয়ে খাবে।’

 শুনে গ্রামের লোক বললে, ‘এই কথা। আচ্ছা, দেখা যাবে বেটা কেমন বিয়ে করে, আর না দিলে চিবিয়ে খায়! আপনার কোনো ভয় নেই, আমরা সব ঠিক করে দিচ্ছি।’

 বলে তারা বাঘের কাছে খবর পাঠিয়ে দিলে, ‘বাঘমশাই, আপনার মতন এমন ভালো বর কি আর হবে! আপনি পোশাক পরে আসবেন, সভার
কাক বললে, ‘দেবে বৈকি!’! [পৃঃ ৬৪
মাঝে বসবেন, গান বাজনা শুনবেন, নিমন্ত্রণ খাবেন, তারপর বেশ ভালো মতো করে বিয়ে করে চলে যাবেন।’

 তারপর তারা সকলে মিলে ব্রাহ্মণের উঠানে তিনশো উনুন কেটে তাতে তিনশো হাঁড়ি তেল চড়াল। কুয়োর উপর চমৎকার বিছানা করে রাখল। তারপর ঢাক ঢোল বাজিয়ে খুব শোরগোল করতে লাগল।

 বাঘ সেই গোলমাল শুনে বললে, ‘ঐরে আমার বিয়ের ধুম লেগেছে।’

তখন সে তাড়াতাড়ি জামা জোড় পরে, পাগড়ি এঁটে, নাচতে-নাচতে এসে ব্রাহ্মণের বাড়ি উপস্থিত হল।

 অমনি সকলে ‘আরে, বর এসেছে! বাজা, বাজা!’ বলে বাঘমশাইকে সেই কুয়োর উপরকার বিছানা দেখিয়ে দিলে। বাঘমশাই তো তাতে লাফিয়ে বসতে গিয়েই ‘ঘেয়াও!’ করে বিছানারুদ্ধ কুয়োয় পড়েছেন, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে গ্রামের সকলে মিলে সেই তিনশো হাঁড়ির গরম তেল, আর তিনশো উনুনের আগুন কুয়োয় এনে ঢেলেছে।


‘আরে, বর এসেছে! বাজা, বাজা!’

 তারপর দেখতে দেখতে বোকা বাঘ পুড়ে ছাই হল, ব্রাহ্মণেরও আপদ কেটে গেল।

 কাক তামাশা দেখবার জন্যে ঘরের চালে বসে ছিল, পাড়ার ছেলেরা টিল ছুঁড়ে তার মাথা গুঁড়ো করে দিল।