বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/তৃতীয় গল্প/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

ঘরে গৌতম বাহিরে গৌতম।

 ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,—কিছুক্ষণ পরে আমার চৈতন্য হইল। আমি উঠিয়া বসিলাম। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, মহাদেব নাই, দুর্গা নাই, নন্দী নাই, দোলা নাই, সে স্থানে কেহই নাই। কিন্তু আশ্চর্য্য! আছে কেবল আর একটা “আমি।” সেই টাক, সেই পাকা চুল, সেই কৃষ্ণ বর্ণ, সেই নাক, সেই মুখ, ফল কথা— হুবহু সেই আমি। প্রতিমার এক পার্শ্বে একটী আমি বসিয়া আছি, প্রতিমার অপর পার্শ্বে আর একটী আমি বসিরা আছি। কোন্ আমিটি প্রকৃত আমি, তাহা আমি ঠিক করিতে পারিলাম না। একদিকের আমি অন্য দিকের আমিকে জিজ্ঞাসা করিল,—“মহাশয়ের নাম?” সে উত্তর করিল,—“ডমরুধর।” পুনরায় অপর আমি এদিকের আমিকে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল। সেও সেইরূপ উত্তর করিল। ফল কথা, এ আমিও যা করে ও যা বলে, ও আমিও তাই করে ও তাই বলে।

 তখন আমার সকল কথা হৃদয়ঙ্গম হইল। সেবার সন্ন্যাসী-সঙ্কটে আমার লিঙ্গশরীর বাহির হইয়া যমালয়ে গিয়াছিল। শুনিয়াছি যে, আমাদের শরীর অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ প্রভৃতি কয়েকটী কোষ দ্বারা গঠিত। একবার লিঙ্গ শরীর বাহির হইয়াছিল বলিয়া কোষগুলির বাঁধন কিছু আল্‌গা হইয়া গিয়াছিল। সে জন্য দুই একটী কোষ বাহির হইয়া আর একটী ডমরুধরের সৃষ্টি হইয়াছে। এখন উপায় কি? লোকে একটা আমির ভাত কাপড় যোগাইতে পারে না। তা যোগাইবার যেন আমার সঙ্গতি আছে, কিন্তু একটা আমির পেট কামড়াইলে লোক ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ে। এক সঙ্গে দুইটা আমির পেট যদি কামড়ায় তখন আমি কি করিব?

 একটা আমি অপরটাকে বলিল,—“তুই চলিয়া যা, আমি প্রকৃত ডমরুধর, তুই জাল ডমরুধর।” অপরটাও সেই সেই কথা বলিল। দুই আমিতে ঘোরতর কলহ উপস্থিত হইল। ক্রমে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল। এমন সময় প্রভাত হইল। প্রভাত হইবা মাত্র আমি একটা হইয়া যাইলাম। তখন আমার ধড়ে প্রাণ আসিল।

 পাছে পুনরায় দুইটা হইয়া যাই, সেই দুশ্চিন্তায় সমস্ত দিন আমি মগ্ন রহিলাম। বিজয়া দশমীর পূজার পর পুরোহিত ঠাকুর যখন আমাকে মন্ত্র পড়াইলেন,—আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভবতি দেহি মে,—তখন আমার সুবল ঘোষের কথা মনে পড়িল। দুর্গোৎসব করিয়া, ভক্তিতে গদ্‌গদ হইয়া সুবল নিজেই ঠাকুরের সম্মুখে প্রাণপণ যতনে শঙ্খ বাজাইলেন। শঙ্খ বাজাইতে গিয়া সুবলের গোগ্‌গোল বাহির হইয়া পড়িল। সে জন্য দশমীর দিন সুবল অন্য বর প্রার্থনা না করিয়া, হাতযোড় করিয়া ঠাকুরকে বলিলেন,—

“ধন চাই না মা, যশ চাই না মা, চাই না পুত্তুর বর।
শঙ্খ বাজাতে গিয়া বেরিয়েছে গোগ্‌গোল, তাই রক্ষা কর॥”

 প্রতিমা বিসর্জ্জন হইয়া গেল। সন্ধ্যার সময় আমি এক সহস্র দুর্গা নাম লিখিলাম। পাড়ার ছেলেরা আমাকে নমস্কার করিয়া গেল। আহারাদি করিয়া যথাসময়ে দোতালায় আমার ঘরে গিয়া শয়ন করিলাম। সিদ্ধি খাইয়া শরীর একটু গরম হইয়াছিল। সে জন্য আমার নিদ্রা হইল না। বিছানা হইতে উঠিয়া জানালার ধারে দাঁড়াইলাম। জ্যোৎস্না রাত্রি। বাড়ীর বাহিরে বাগানে আমার জানালার নীচে ও কে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে? সেই আর একটা আমি! হাত নাড়িয়া তাহাকে আমি বলিলাম,—“যা চলিয়া যা!” নীচের আমিও উপরের আমিকে সেই কথা বলিল। উপরের আমি নীচে নামিলাম। থিড়কি দ্বার খুলিয়া আমি বাগানে যাইলাম। ও মা! দেখি না নীচের আমিটা উপরে গিয়া ঠিক আমার ঘরের জানালার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। এ আমিটা একবার উপরে, একবার নীচে, ও আমিটা একবার উপরে, একবার নীচে, কতবার যে এইরূপ হইল তাহা বলিতে পারি না। তৃতীয় পক্ষে এলোকেশীর সহিত আমার কি প্রকারে বিবাহ হইয়াছিল, গত বৎসর সে কথা তোমাদের নিকট বলিয়াছি। আমি এলোকেশীকে জাগাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,—“এইমাত্র যখন আমি নীচে গিয়াছিলাম, তখন তোমার ঘরে আর একটা কে আসিয়াছিল।” এলোকেশী বলিল,—“মুখপোড়া, বুড়ো ডেকরা! এখনি ঝাঁটাপেটা করিব।” এলোকেশীর স্বভাবটা কিছু উগ্র! তাহাতে তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী।

 জানালা বন্ধ করিয়া আমি পুনরায় শয়ন করিলাম। পরদিন রাত্রিতেও সেইরূপ হইল। প্রতি রাত্রিতে সেইরূপ উপরে একটা, নীচে একটা, দুইটা আমির উপদ্রব হইল। আমি ভাবিলাম যে, প্রতি রাত্রিতে আমার “ঘরে গৌতম বাহিরে গৌতম” হইতে লাগিল, এ তো ভাল কথা নহে!

চতুর্ভূজ বলিলেন,—“এবার আমাকে ঠকাইতে পারিবে না। আমি জানি—

‘অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যাঃ স্মরেন্নিত্যং মহাপাতকনাশনম্॥”


 পুরোহিত বলিলেন,—“সকল প্রাণীর সৌন্দর্য্য লইয়া ব্রহ্মা অহল্যাকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।

‘যস্যা ন বিদ্যতে হল্যং তেনাহল্যেতি বিশ্রুতা।”