বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/দ্বিতীয় গল্প/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

কুম্ভীর-বিভ্রাট।

 শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুনিয়াছি যে, সুন্দরবনে নদীনালায় অনেক কুমীর আছে। তোমার আবাদে কুমীর কিরূপ?”

 ডমরুধর বলিলেন,—কুমীর! আমার আবাদের কাছে যে নদী আছে, কুমীরে তাহা পরিপূর্ণ। খেজুর গাছের মত নদীতে তাহারা ভাসিয়া বেড়ায়, অথবা কিনারায় উঠিয়া পালে পালে তাহারা রৌদ্র পোহায়। গরুটা, মানুষটা, ভেড়াটা, ছাগলটা বাগে পাইলেই লইয়া যায়। কিন্তু এ সব কুমীরকে আমরা গ্রাহ্য করি না। একবার আমার আবাদের নিকট এক বিষম কুমীরের আবির্ভাব হইয়াছিল। গন্ধমাদন পর্ব্বতে কালনিমের পুকুরে যে কুমীর হনুমান্কে ধরিয়াছিল, ইহা তাহা অপেক্ষাও ভয়ানক, গঙ্গাদেবী যে মকরের পীঠে বসিয়া বায়ু সেবন করেন, সে মকরকে এ কুমীর এক গালে খাইতে পারে। পর্ব্বতপ্রমাণ যে গজ সেকালে বহুকাল ধরিয়া কচ্ছপের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল, সে গজ-কচ্ছপকে এ কুমীর নস্য করিতে পারে। ইহার দেহ বৃহৎ তাল গাছের ন্যায় বড়, ইহার উদর এই দালানটীর মত,অন্যান্য কুমীর জীব— জন্তুকে ছিঁড়িয়া ভক্ষণ করে। কিন্তু এ কুমীরটা আস্ত গরু আস্ত মহিষ গিলিয়া ফেলিত। রাত্রিতে সে লোকের ঘরে ও গোয়ালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু বাছুর লইয়া যাইত। লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেওয়াল ভিজাইয়া গর্ত্ত করিত। ইহার জ্বালায় নিকটস্থ আবাদের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রজাগণ পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে, আমাদের সেই ভয় হইল, তাহার পর লাঙ্গুলের আঘাতে নৌকা ডুবাইয়া আরোহীদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। সে নিমিত্ত এ পথ দিয়া নৌকায় যাতায়াত অনেক পরিমাণে বন্ধ হইয়া গেল।

 এই ভয়ানক কুম্ভীরের হাত হইতে কিরূপে নিষ্কৃতি পাই, এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় আমার আবাদের নিকট একখানি নৌকা ডুবাইয়া তাহার আরোহীদিগকে একে একে আমাদের সমক্ষে সে গিলিয়া ফেলিল। এই নৌকায় এক ভদ্রলোক কলিকাতা হইতে সপরিবারে পূর্ব্বদেশে যাইতেছিলেন। নদীর তীরে দাঁড়াইয়া আমরা দেখিলাম যে, তাঁহার গৃহিণীর সর্ব্বাঙ্গ বহুমূল্য অলঙ্কারে ভূষিত ছিল। তোমরা জান যে কুমীরের পেটে মাংস হজম হয়, গহনা পরিপাক পায় না। কুমীর যখন সেই স্ত্রীলোককে গিলিয়া ফেলিল, তখন আমার মনে এই চিন্তা উদয় হইল,—চিরকাল আমি কপালে পুরুষ; যদি এই কুমীরটাকে আমি মারিতে পারি, তাহা হইলে ইহার পেট চিরিয়া ঐ গহনাগুলি বাহির করিব, অন্ততঃ পাঁচ ছয় হাজার টাকা আমার লাভ হইবে।

 এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি কলিকাতায় গমন করিলাম। বড় একটী জাহাজের নঙ্গর কিনিয়া উকো ঘষিয়া তাহাতে ধার করিলাম, তাহার পর যে কাছিতে মানোয়ারি জাহাজ বাঁধা থাকে, সেইরূপ এক কাছি ক্রয় করিলাম। এইরূপ আয়োজন করিয়া আমি আবাদে ফিরিয়া আসিলাম। আবাদে আসিয়া শুনিলাম যে, কুমীর আর একটা মানুষ খাইয়াছে। চারি দিন পূর্ব্বে এক সাঁওতালনী এক ঝুড়ি বেগুণ মাথায় লইয়া হাটে বেচিতে যাইতেছিল। সে যেই নদীর ধারে গিয়াছে, আর কুমীর তাহাকে ধরিয়া বেগুণের ঝুড়ি সহিত আস্ত গিলিয়া ফেলিয়াছে, তাহাতে সাঁওতাল প্রজাগণ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে, বলিতেছে যে, আবাদ ছাড়িয়া তাহারা দেশে চলিয়া যাইবে।

 আবাদে আসিয়া নঙ্গরটীকে আমি বড়শী করিলাম। তাহাতে জাহাজের কাছি বাঁধিয়া দিলাম। মাছ ধরিবার জন্য লোকে যে হাত—সূতা ব্যবহার করে, বৃহৎ পরিমাণে এও সেইরূপ হাত সূতার ন্যায় হইল। নঙ্গরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে এক মহিষের বাছুর গাঁথিয়া নদীর জলের নিকট বাঁধিয়া দিলাম। কাছির অন্যদিক্ এক গাছে পাক দিয়া রাখিলাম, তাহার পর পঞ্চাশজন সবল লোককে নিকটে লুক্কায়িত রাখিলাম। বেলা তিনটার সময় আমাদের এই সমুদয় আয়োজন সমাপ্ত হইল।

 বড়শীতে মহিষের বাছুর বিঁধিয়া দিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু তাহার প্রাণ আমরা একেবারে বধ করি নাই। নদীর ধারে দাঁড়াইয়া সে গাঁ গাঁ শব্দে ডাকিতে লাগিল, তাহার ডাক শুনিয়া সন্ধ্যার ঠিক পূর্ব্বে সেই প্রকাণ্ড কুমীর আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার লেজের ঝাপটে পর্ব্বতপ্রমাণ এক ঢেউ উঠিল, সেই ঢেউয়ে বাছুরটী ডুবিয়া গেল, তখন আর আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না, পরক্ষণেই কাছিতে টান পড়িল। তখন আমরা বুঝিলাম যে, নঙ্গরবিদ্ধ বাছুরকে কুমীর গিলিযাছে, বড়শীর ন্যায় নঙ্গর কুমীরের মুখে বিঁধিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি সেই পঞ্চাশজন লোক আসিয়া দড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল। ভাগ্যে গাছে পাক দিয়া রাখিয়াছিলাম, তা না হইলে কুমীরের বলে এই পঞ্চাশজন লোককে নদীতে গিয়া পড়িতে হইত। আমরা সেই রাক্ষস কুমীরকে বড়শীতে গাঁথিয়াছি, ঐ কথা শুনিয়া চারিদিকের আবাদ হইতে অনেক লোক দৌড়িয়া আসিল। প্রায় পাঁচ শত লোক সেই রশি ধরিয়া টানিতে লাগিল। দারুণ আসুরিক বলে কুমীর সেই পাঁচশত লোকের সহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে লাগিল। কখন আমাদের ভয় হইল যে, তাহার বিপুল বলে নঙ্গর বা ভাঙ্গিয়া যায়, কখন ভয় হইল যে, সে জাহাজের দড়ী বা ছিঁড়িয়া যায়। কখন ভয় হইল, গাছ উৎপাটিত হইয়া নদীতে গিয়া বা পড়ে। নিশ্চয় একটা না একটা বিভ্রাট ঘটিত, যদি না সাঁওতালগণ কুমীরের মস্তকে ক্রমাগত তীর বর্ষণ করিত, যদি না নিকটস্থ দুইটী আবাদের লোক বন্দুক আনিয়া কুমীরের মাথায় গুলি মারিত। তীর ও গুলি খাইয়া কুমীর মাঝে মাঝে জলমগ্ন হইতে লাগিল। কিন্তু নিঃশ্বাস লইবার জন্য পুনরায় তাহাকে ভাসিয়া উঠিতে হইল। সেই সময় লোকে তীর ও গুলি বর্ষণ করিতে লাগিল। কুমীরের রক্তে নদীর জল বহুদূর পর্য্যন্ত লোহিত বর্ণে রঞ্জিত হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি কুমীরের সহিত আমাদের এইরূপ যুদ্ধ চলিল। প্রাতঃকালে কুম্ভীর হীনবল হইয়া পড়িল। বেলা নয়টার সময় তাহার মৃতদেহ জলে ডুবিয়া গেল। তখন অতি কষ্টে তাহাকে আমরা টানিয়া উপরে তুলিলাম।

 বড় বড় ছোরা বড় বড় কাস্তে আনিয়া তাহার পেট চিরিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে রাক্ষস কুমীরের পেট অতি কঠিন ছিল। আমাদের সমুদয় অস্ত্র ভাঙ্গিয়া গেল। অবশেষে করাতি আনাইয়া করাতের দ্বারা তাহার উদর কাটাইলাম। কিন্তু পেট চিরিয়া তাহার পেটের ভিতর যাহা দেখিলাম, তাহা দেখিয়াই আমার চক্ষু স্থির!

 লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কি দেখিলে?”

 শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কি দেখিলে?”

 অন্যান্য শ্রোতৃগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি দেখিলে?”

 ডমরুধর বলিলেন,—বলিব কি ভাই আর দুঃখের কথা, কুমীরের পেটের ভিতর দেখি না যে, সেই সাঁওতাল মাগী, চারিদিন পূর্ব্বে কুমীর যাহাকে আস্ত ভক্ষণ করিয়াছিল, সেই মাগী পূর্ব্বদেশীয় সেই ভদ্র মহিলার সমুদয় গহনাগুলি আপনার সর্ব্বাঙ্গে পরিয়াছে, তাহার পর নিজের বেগুণের ঝুড়িটা সে উপুড় করিয়াছে, সেই বেগুণগুলি সম্মুখে ডাঁই করিয়া রাখিয়াছে। ঝুড়ির উপর বসিয়া মাগী বেগুণ বেচিতেছে!

 শঙ্কর ঘোষ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কুমীরের পেটের ভিতর ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুণ বেচিতেছিল?”

 ডমরুধর বলিলেন,—“হাঁ ভাই! কুমীরের পেটের ভিতর সেই ঝুড়ির উপর বসিয়া মাগী বেগুণ বেচিতেছিল।”

 লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কাহাকে সে বেগুণ বেচিতেছিল? কুমীরের পেটের ভিতর সে খরিদ—দার পাইল কোথা?”

 বিরক্ত হইয়া ডমরুধর বলিলেন, তোমার এক কথা! কাহাকে সে বেগুণ বেচিতেছিল, সে খোঁজ করিবার আমার সময় ছিল না। সমুদয় গহনাগুলি সে নিজের গায়ে পরিয়াছিল, তাহা দেখিয়াই আমার হাড় জ্বলিয়া গেল। আমি বলিলাম,—“মাগী! ও গহনা আমার। অনেক টাকা খরচ করিয়া আমি কুমীর ধরিয়াছি, ও গহনা খুলিয়া দে।” কেঁউ মেউ করিয়া মাগী আমার সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল। তাহার পর তাহার পুত্রগণ ও তাহার জাতি-ভাইগণ কাঁড়বাঁশ ও লাঠি সোটা লইয়া আমাকে মারিতে দৌড়িল। আমার প্রজাগণ কেহই আমার পক্ষ হইল না। সুতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল। সাঁওতালগণ সে মাগীকে ঘরে লইয়া গেল। দিন কয়েক শূকর মারিয়া ও মদ খাইয়া তাহারা আমোদ প্রমোদ করিল। পূর্ব্বদেশীয় সে ভদ্র মহিলার একখানি গহনাও আমি পাইলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে, কপালে পুরুষের ভাগ্যও সকল সময় প্রসন্ন হয় না।

 লম্বোদর বলিলেন,—“এত আজগুবি গল্প তুমি কোথায় পাও বল দেখি?”

 ডমরুধর বলিলেন,—এতক্ষণ হাঁ করিয়া এক মনে এক ধ্যানে গল্পটা শুনিতেছিলে। যেই হইয়া গেল, তাই এখন বলিতেছ যে, আজগুবি গল্প। কলির ধর্ম্ম বটে!

 শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—“এ কুমীরের গল্প যে সত্য, তাহার কোন প্রমাণ আছে?”

 ডেমরুধর উত্তর করিলেন,—“প্রমাণ? নিশ্চয় প্রমাণ আছে। কোমরের ব্যথার জন্য এই দেখ সেই কুমীরের দাঁত আমি পরিয়া আছি।”

 লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—“সে কুমীর যদি তাল গাছ অপেক্ষা বৃহৎ ছিল, তবে তাহার দাঁত এত ছোট কেন? ঠিক অন্য কুমীরের দাঁতের মত কেন?”

 ডমরুধর উত্তর করিলেন,—“অনেক মানুষ খাইয়া সে কুমীরের দাঁত ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল।”