ডমরু-চরিত/দ্বিতীয় গল্প/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।



মশার মাংস।
ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,—আমরা দেখিলাম যে, সাঁইয়ের গায়ে দশ বারটী কালো জীব বসিয়াছে। যাতনায় সাঁই ছট্ফট্ করিতেছে। লাঠি দিয়া আমি সেই জীবগুলিকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলাম। আমার লাঠির আঘাতে সাঁইয়ের দেহ হইতে তিনটী জীব উড্ডীয়মান হইল। তাহাদের একটা আমার গায়ে বসিতে আসিল। সবলে তাহার উপর আমি লাঠি মারিলাম। লাঠির আঘাতে জীবটী মৃত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। আমি তাহার মৃতদেহ তুলিয়া লইলাম। ইতিমধ্যে আর দুইটা জীব একজন মাঝির গায়ে গিয়া বসিল। মাঝি চীৎকার করিয়া উঠিল। দশ বার হাত দৌড়িয়া গিয়া সেও মাটিতে পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিল। আমি সাঁইয়ের দিকে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, সাঁই জীবিত নাই, সাঁই মরিয়া গিয়াছে। আমি বুঝিলাম যে, এ জীব কেবল যে রক্তপান করে তাহা নহে, ইহার ভয়ানক বিষও আছে। তখন অবশিষ্ট দুইজন মাঝির সহিত আমি দৌড়িয়া নৌকায় গিয়া উঠিলাম ও তৎক্ষণাৎ নৌকা ছাড়িয়া দিয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম।
নৌকায় বসিয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম। মনে করিলাম যে, মোহর বিক্রয়ের টাকাগুলি বুঝি জলাঞ্জলি দিলাম, পাপের ধন বুঝি প্রায়শ্চিতে গেল। এখন বুঝিতে পারিলাম যে, পাঁচ হাজার টাকার সম্পত্তি কেন সে লোক এক হাজার টাকায় বিক্রয় করিয়াছে। যে জীবটাকে লাঠি দিয়া মারিয়াছিলাম, যাহার মৃতদেহ আমি তুলিয়া লইয়াছিলাম, তাহা এখন পর্য্যন্ত আমার হাতেই ছিল। নৌকার উপর রাখিয়া সেইটাকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া আমি ঘোরতর আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম যে,—সে অন্য কোন জীব নহে, বৃহৎ মশা! চড়াই পাখীর ন্যায় বৃহৎ মশা! মশা যে এত বড় হয়, তাহা কখন শুনি নাই। শরীরটী চড়াই পাখীর ন্যায় বড়, শুঁড়টী বৃহৎ জোঁকের ন্যায়। ডাক্তারেরা যেরূপ ছুরি দিয়া ফোড়া কাটে, শুঁড়ের আগায় সেইরূপ ধারালো পদার্থ আছে। জীব জন্তু অথবা মানুষের গায়ে বসিয়া প্রথম সেই ছুরি দিয়া কতক চর্ম্ম ও মাংস কাটিয়া লয়। তার পর সেই স্থানে শুঁড় বসাইয়া রক্তপান করে। কেবল যে রক্তপান করিয়া জীব জন্তুর প্রাণ বিনষ্ট করে তাহা নহে, ইহাদের ভয়ানক বিষ আছে, সেই বিষে অপর প্রাণী ধড়ফড় করিয়া মরিয়া যায়।
লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কি করিয়া জানিলে যে, সে জীব কোন নূতন প্রকার পক্ষী নহে?”
ডমরুধর উত্তর করিলেন,—“পক্ষীদের দুইটা পা থাকে, ইহার ছয়টা পা; পক্ষীদের ডানার পালক থাকে, ইহার ডানায় পালক ছিল না; পক্ষীদের ঠোঁট থাকে, ঠোঁঠের স্থানে ইহার শুঁড় ছিল; পক্ষীদের শরীরে হাড় থাকে, ইহার শরীর কাদার ন্যায় নরম। সেই জন্য আমি স্থির করিলাম যে, ইহা পক্ষী নহে, মশা।
লম্বোদর বলিলেন,—“মশা যে এত বড় হয়, তাহা আমার বিশ্বাস হয় না।”
শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,—“কেন বিশ্বাস হইবে না? হস্তী বৃহৎ মশা ব্যতীত আর কিছুই নহে। মশারও শুঁড় আছে, হস্তীরও শুঁড় আছে। তবে হস্তী যদি রক্তপান করিত, তাহা হইলে পৃথিবীতে অপর কোন জীব জীবিত থাকিত না। সেই জন্য হাতী গাছপালা খাইয়া প্রাণ ধারণ করে।”
ডমরুধর বলিলেন,—“তাহা ভিন্ন আমি এ কথার প্রমাণ রাখিয়াছি। যেমন সেই বাঘের গল্পের প্রমাণ স্বরূপ আমি বাঘের ছালখানি ঘরে রাখিয়াছি, সেইরূপ এই মশার প্রমাণ স্বরূপ আমি জোঁক রাখিয়াছি। আমাদের গ্রামের নিকট যে বিল আছে, মশার শুঁড়টা কাটিয়া আমি সেই বিলে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সেই শুঁড় হইতে এখন অনেক বড় বড় জোঁক হইয়াছে। আমার কথায় তোমাদের প্রত্যয় না হয়, জলায় একবার নামিয়া দেখ। প্রমাণ ছাড়া আমি কথা বলি না।”
লম্বোদর বলিলেন,—মশার শুঁড় পচিয়া জোঁক হইতে পারে না।
শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,—কেন হইবে না? স্বেদ হইতে স্বেদজ জীব হয়। বাদা বনের পাতা পচিয়া চিংড়ি মাছ হয়। কোন বি-এ অথবা এম-এ অথবা কি একটা পাশ করা লোক কৃষিকার্য্য সম্বন্ধে একখানা বাঙ্গালা স্কুলপাঠ্য পুস্তক লিখিয়াছিলেন। পুদিনা গাছ সম্বন্ধে তাহাতে তিনি এরূপ লিখিয়াছিলেন,—এক খণ্ড দড়িতে গুড় মাখাইয়া বাহিরে বাঁধিয়া দিবে। গুড়ের লোভে তাহাতে মাছি বসিয়া মল ত্যাগ করিবে। মাছির মল মূত্রে দড়িটা যখন পূর্ণ হইবে, তখন সেই দড়ি রোপণ করিবে। তাহা হইতে পুদিনা গাছ উৎপন্ন হইবে। মক্ষিকার বিষ্ঠায় যদি পুদিনা গাছ হইতে পারে, তাহা হইলে মশার শুঁড় হইতে জোঁক হইবে না কেন?
ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,—যাহা হউক, আমার বড়ই চিন্তা হইল। এত কষ্টের টাকা সব বৃথায় গেল, তাহা ভাবিয়া আমার মন আকুল হইল। কিন্তু আমি সহজে কোন কাজে হতাশ হই না। গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, বৃহৎ একটা মশারি প্রস্তত করিলাম। কাপড়ের মশারি নহে, নেটের মশারি নহে, জেলেরা যে জাল দিয়া মাছ ধরে, সেই জালের মশারি। তাহার পর পাঁচ জন সাঁওতালকে চাকর রাখিলাম। একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া সেই পাঁচ জন সাঁওতাল সঙ্গে পুনরায় আবাদে গমন করিলাম। ধীরে ধীরে আমরা নৌকা হইতে নামিলাম। চারি কোণে চারিটী বাঁশ দিয়া চারি জন মাঝি ভিতর হইতে মশারি উচ্চ করিয়া ধরিল। তীর ধনু হাতে লইয়া চারি পার্শ্বে চারি জন সাঁওতাল দাঁড়াইল। এক জন সাঁওতালের সহিত আমি মশারির মাঝখানে রহিলাম। মশারির ভিতর থাকিয়া আমরা দশজন আবাদের অভ্যন্তরে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। অধিক দূর যাইতে হয় নাই। বৃহৎ মশকগণ বোধ হয় অনেক দিন উপবাসী ছিল। মানুষের গন্ধ পাইয়া পালে পালে তাহারা মশারির গায়ে আসিয়া বসিল। কিন্তু মশারির ভিতর প্রবেশ করিতে পারিল না। সাঁওতাল পাঁচ জন ক্রমাগত তাহাদিগকে তীর দিয়া বধ করিতে লাগিল। সেদিন আমরা আড়াই হাজার মশা মারিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা কাজ বন্ধ করিয়া পুনরায় নৌকায় ফিরিয়া আসিলাম। সাঁওতালগণ এক ঝুড়ি মৃত মশা সঙ্গে আনিয়াছিল। শুঁড় ও ডানা ও পা ফেলিয়া দিয়া সাঁওতালেরা মশা পোড়াইয়া ভক্ষণ করিল। তাহারা বলিল যে, ইহার মাংস অতি উপাদেয়, ঠিক বাদুড়ের মাংসের মত। আমাকে একটু চাকিয়া দেখিতে বলিল, কিন্তু আমার রুচি হইল না।
পরদিন আমরা দুই হাজার মশা বধ করিলাম, তাহার পরদিন ষোল শত, তাহার পরদিন বার শত, এইরূপ প্রতিদিন মশার সংখ্যা কম হইতে লাগিল। পঁয়ত্রিশ দিনে মশা একেবারে নিঃশেষ হইয়া গেল। হয় আমরা সমুদয় মশা মারিয়া ফেলিলাম, আর না হয় অবশিষ্ট মশা নিবিড় বনে পলায়ন করিল। সেই অবধি আমার আবাদে এ বৃহৎ জাতীয় মশার উপদ্রব হয় নাই। মশার হাত হইতে অর্থাৎ শুঁড় হইতে পরিত্রাণ পাইয়া আমি আবাদের চারিদিকে পুনরায় ভেড়ি বাঁধাইলাম। বন কাটাইয়া ও পুকরিণীর সংস্কার করিয়া কয়েক ঘর প্রজা বসাইলাম। এই সমুদয় কাজ করিতে আমার আট শত টাকা খরচ হইয়া গেল। তখন দেখিলাম যে, আরও হাজার টাকা খরচ না করিলে কিছুই হইবে না। সে হাজার টাকা কোথায় পাই!