ডমরু-চরিত/দ্বিতীয় গল্প/প্রথম পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় গল্প।



প্রথম পরিচ্ছেদ।



পূর্ব্বকাহিনী।
ডমরুধর বলিলেন,—পূজার সময় সন্ন্যাসি-সঙ্কটের গল্পে আমার সম্বন্ধে আরও দুইটী বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার একটু পূর্ব্বকাহিনী না বলিলে তোমরা সে সমুদয় বিষয় বুঝিতে পারিবে না। আজ যদি কৃত্তিবাস, কাশীদাস থাকিতেন, তাহা হইলে আমার বুদ্ধি, আমার বীরত্ব, আমার কীর্ত্তির বিষয়ে তাঁহারা ছড়া বাঁধিতেন। ঘরে ঘরে লোকে তাহা পাঠ করিয়া কৃতার্থ হইত। আর, যাত্রায় যাহারা দূতী সাজে, হাত নাড়িয়া নাড়িয়া তাহারা আমার বিষয়ে গান করিত। একদিন রেলগাড়ীতে যাইবার সময় শুনিয়াছিলাম যে, কে একজন মাইকেল ছিলেন। কে একজন আবার তাঁহার জীবনচরিত লিথিয়াছেন। এ বৎসর আমার বাগানে অনেক কাঁচকলা হইয়াছে। খরিদদার নাই, যিনি মাইকেলের জীবনচরিত লিখিয়াছেন, তিনি যদি আমার বিষয়ে সেইরূপ একখানি পুস্তক লেখেন, তাহা হইলে তাহাকে আমি তের পণ কাঁচকলা দিতে সম্মত আছি।
আমার পিতা জমিদারি কাছারিতে মুহুরিগিরি করিতেন। যৎসামান্য যাহা বেতন পাইতেন, অতি কষ্টে তাহাতে আমাদের দিনপাত হইত। মাতা পিতা থাকিতে আমার প্রথম নম্বরের বিবাহ হইয়াছিল। তাঁহাদের পরলোক গমনে কলিকাতায় হর ঘোষের কাপড়ের দোকানে কাজ করিতাম। মাহিনা পাঁচ টাকা আর খাওয়া। যে বাড়ীতে বাবুর বাসা ছিল, তাহার নীচের এক সেঁতালে ঘরে আমি থাকিতাম। বাবুর এক চাকরাণী ব্যতীত অন্য চাকর ছিল না। তাঁহার গৃহিণী স্বয়ং রন্ধন করিতেন। রান্না হইত—অস্ততঃ আমার ও ঝিয়ের জন্য—মুসূর দাল ও বেগুন বা আলু বা কুমড়া ভাজা। মুসূর দালে কেবল একটু হলুদের রং দেখিতে পাইতাম,দালের সম্পর্ক তাহাতে থাকিত কিনা সন্দেহ। তাহার পর বলিহারি যাই গৃহিণীর হাত! কি করিয়া যে তিনি সেরূপ ঝিঁঝির পাতের ন্যায় বেগুণ কুটিতেন, তাহাই আশ্চর্য্য। অভ্রের চেয়ে বোধ হয় পাতলা। বাজারে যে চিংড়ি মাছ বিক্রয় হইত না, যাহার বর্ণ লাল হইয়া যাইত, বেলা একটার সময় কালে-ভদ্রে সেই চিংড়ি মাছ আসিত। তাহার গন্ধে পাড়ার লোককে নাকে কাপড় দিতে হইত। সেই চিংড়ি মাছের ধড়গুলি বাবু ও তাঁহার গৃহিণী খাইতেন মাথাগুলি আমাদের জন্য ঝাল দিয়া রান্না হইত। যেদিন চিংড়ি মাছ হইত, সেদিন আমাদের আহ্লাদের সীমা থাকিত না। সেই পচা চিংড়ি অমৃত জ্ঞান করিয়া আমরা খাইতাম। দুইবার ভাত চাহিয়া লইতাম। অধিক ভাত খরচ হইত বলিয়া চিংড়ি কিছুদিন পরে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর একগাঁট তেঁতুল ট্যাকে করিয়া আমি ভাত খাইতে বসিতাম। তাহা দিয়া কোনরূপে ভাত উদরস্থ করিতাম। যাহা হউক, এই স্থানে যাহা আমি শিক্ষা পাইয়াছিলাম, পরে তাহাতে আমার বিশেষ উপকার হইয়াছিল। আমি বুঝিয়াছিলাম যে, টাকা উপার্জ্জন করিলেই টাকা থাকে না; টাকা খরচ না করিলেই টাকা থাকে।
আমার বোধ হয় রাক্ষস গণ। আমার যখন পঁচিশ বৎসর বয়স, তখন আমার প্রথম গৃহিণীর কাল হইল। তাঁহার সন্তানাদি হয় নাই। তাহার পর দশ বৎসর পর্য্যন্ত আমার আর বিবাহ হইল না। আমার অবস্থা সেই; লোকে বিবাহ দিবে কেন?
এই সময় পাশের বাড়ী আমাদের এক স্বজাতি ভাড়া লইলেন। তাঁহার নাম প্রহ্লাদ সেন। দোতালায় সপরিবারে তিনি বাস করিলেন। একজন আত্মীয়কে নীচের দুইটী ঘর ভাড়া দিলেন। তাঁহার নাম গোলোক দে। প্রহলাদ বাবু কোন বণিকের আফিসে কাজ করিতেন। অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না, তবে টাকা কড়ি কি গহনা-পত্র কিছু ছিল না। গোলোক বাবু সরকারি আফিসে অল্প টাকা বেতনে কেরাণিগিরি করিতেন। তাঁহার পুত্র পশ্চিমে কোথায় কাজ করিতেন, কলিকাতায় তিনি ও তাঁহার গৃহিণী থাকিতেন।
প্রহ্লাদ বাবুর গৃহিণী, তাঁহার মাতা, এক বিধবা ভগিনী, দুই শিশু পুত্র ও এক কন্যা, তাঁহার পরিবার এই ছিল। এই সময়ে কন্যাটীর বয়স দশ কি এগার ছিল। আমি তাহাকে যখন প্রথম দেখিলাম, তখন অকস্মাৎ আমার মনে উদয় হইল—কে যেন আমার কাণে কাণে বলিয়া দিল যে,— ডমরুধর! এই কন্যাটী তোমার দ্বিতীয়পক্ষ হইবে। তোমার জন্যই বিধাতা ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু কি করিয়া কন্যার পিতার নিকট কথা উত্থাপন করি? বয়স তখন আমার পঁয়ত্রিশ বৎসর, রূপ আমার এই, অবস্থা আমার সেই—কথা উত্থাপন করিলে তিনি হয়তো হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। কিন্তু বিধাতার ভবিতব্য কে খণ্ডাইতে পারে? এই সময় এক ঘটনা ঘটিল, কন্যাটী নিদারুণ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হইল। এই সূত্রে পাশের বাড়ীতে আমি যাওয়া আসা করিতে লাগিলাম। “আপনার কন্যা আজ কেমন আছে?” দুই বেলা প্রহ্লাদ বাবুকে সেই কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। ক্রমে তাঁহাদের জন্য কিছু কাজ কর্মও করিতে লাগিলাম। প্রয়োজন হইলে ঔষধ আনিয়া দিতাম ও ডাক্তারের বাড়ী যাইতাম। নিজের পয়সা দিয়া বড়বাজার হইতে ছাড়ানো বেদানা আনিয়া দিতাম।ডাক্তারের সঙ্গে বাড়ীর ভিতর গিয়া দুই তিনবার ক্যাটীকেও দেখিলাম।কন্যাটীর রূপ ছিল না, তথাপি তাহাকে দেখিয়া আমার মন আরও মোহিত হুইয়া গেল। এইরূপ আত্মীয়তার গুণে প্রহ্লাদ বাবুর সহিত আমার অনেকটা সৌহার্দ জন্মিল। শুনিলাম যে, কন্যাটীর নাম মালতী। কেমন সুন্দর নাম দেখিয়াছ? নামটা শুনিলে কাণ জুড়ায়।
ভগবানের কৃপায় মালতী আরোগ্যলাভ করিল। আমাদের ঝিকে মাঝে মাঝে দুই একটী সন্দেশ, দুই একটী রসগোল্লা, দুই একখানি জিলেপি দিয়া বশ করিলাম, ক্রমে তাহার দ্বারা প্রহ্লাদ বাবুর মাতা, স্ত্রী ও বিধবা ভগিনীর নিকট কথা উত্থাপন করাইলাম। প্রহ্লাদ বাবুর ভগিনী সংসারের কর্ত্রী। যা বলিয়াছিলাম,—সে কথা তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তিনি বলিলেন—“কি! ঐ জলার ভূতটার সঙ্গে মালতীর বিবাহ দিব? পোড়া কপাল!”
কিন্তু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত প্রহ্লাদ বাবু বিব্রত ছিলেন। তাঁহার টাকা ছিল না। কি করিয়া কন্যাদায় হইতে তিনি উদ্ধার হইবেন, সর্ব্বদাই তাহা ভাবিতেছিলেন। সুতরাং ঝি যে প্রস্তাব করিয়াছিল, সম্পূর্ণরূপে তিনি তাহা অগ্রাহ্য করিলেন না। তিনি বলিলেন, “পুরুষ মানুষের পক্ষে পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়স কিছু অধিক নহে। তাহার পর রূপে কি করে, গুণ থাকিলেই হইল। মালতীর পীড়ার সময় সে আমাদের অনেক উপকার করিয়াছে। তাহাতে বোধ হয় যে, ডমরুধর মন্দ লোক নহে। কিন্তু কথা এই যে, সে সামান্য বেতনে কাপড়ের দোকানে কাজ করে। পরিবার প্রতিপালন সে কি করিয়া করিবে?”
এ বিষয়ে পূর্ব্ব হইতেই আমি ঝিকে শিক্ষা দিয়াছিলাম। আমার অবস্থা সম্বন্ধে যখন কথা উঠিল, তখন ঝি বলিল যে, “দেশে ডমরু বাবুর অনেক জমি আছে, তাহাতে অনেক ধান হয়। আম কাঁটাল নারিকেলেরও অনেক বাগান আছে।” বলা বাহুল্য যে, এসব কথা সমুদয় মিথ্যা। এ সময়ে আমার কিছুই ছিল না। কন্যার মাতা, পিতা ও পিতামহী এক প্রকার সম্মত হইলেন। কিন্তু প্রহ্লাদ বাবুর ভগিনী ক্রমাগত আপত্তি করিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি বলিলেন যে,—হবু জামাতার যদি এত সম্পত্তি আছে, তাহা হইলে তাহাকে অন্ততঃ পাঁচশত টাকার গহনা দিতে হইবে। একথা শুনিয়া আমি হতাশ হইয়া পড়িলাম। পাঁচশত টাকা দূরে থাকুক, তখন আমার পাঁচশত কড়া কড়ি ছিল না।
কিন্তু মালতী পয়মন্ত কন্যা। এই সময় সহসা আমার ভাগ্য খুলিয়া গেল। অভাবনীয় ঘটনাক্রমে অকস্মাৎ আমি দেড় হাজারের অধিক টাকা পাইলাম। আমার আনন্দের পরিসীমা রহিল না। কিন্তু মুখ ফুটিয়া আমি আনন্দ প্রকাশ করিতে পারিলাম না। আমার সৌভাগ্যের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে পারিলাম না। আমি আমার গ্রামে যাইলাম। তের শত টাকা কোন স্থানে লুক্কায়িত রাখিলাম। দুই শত টাকা লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।
কলিকাতা আসিয়া প্রহ্লাদ বাবুর কন্যাকে আমি পাঁচশত টাকার গহনা দিতে স্বীকৃত হইলাম। বিবাহের সমুদয় আয়োজন হইল। এ বিবাহে কোন বিড়ম্বনা ঘটে নাই। শুভদিনে শুভক্ষণে আমার দ্বিতীয় বারের বিবাহ কার্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা কন্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকার গহনা আমি পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। এই পাঁচশত টাকার গহনা আমি একশত টাকায় ক্রয় করিয়াছিলাম।