বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/প্রথম গল্প/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গাছে ঝোলা সাধু।

 ডমরুধর বলিলেন,—“গ্রামের প্রান্তভাগে বিন্দী গোয়ালিনীর যে ভিটা আছে, সে জমি আমার। কিছুদিন পূর্ব্বে বিন্দী মরিয়া গিয়াছিল। তাহার চালা ঘরখানি তখনও ছিল। দুই জন চেলা সঙ্গে কোথা হইতে এক সাধু আসিয়া সেই চালা ঘরে আশ্রয় লইল। সে সাধুকে তোমরা সকলেই দেখিয়াছ, তাহাকে সকলেই জান। সাধুর দুইটী চক্ষু অন্ধ। চেলারা বলিল যে, তাহার বয়স পাঁচশত তিপ্পান্ন বৎসর। চালা ঘরের সম্মুখে যে আম গাছ আছে, চেলারা তাহার ডালে সাধুর দুই পা বাঁধিয়া দিত। প্রতিদিন প্রাতঃকালে এক ঘণ্টাকাল নীচের দিকে মুখ করিয়া সাধু ঝুলিয়া থাকিত। চারিদিকে হৈ হৈ পড়িয়া গেল। যাহারা বি-এ, এম-এ, পাস করিয়াছে, সেই ছোঁড়ারা আসিয়া সাধুর কেহ পা টিপিতে লাগিল, কেহ বাতাস করিতে লাগিল, সকলেই পাদোদক খাইতে লাগিল। একখানি হুজুগে ইংরেজি কাগজের লোক আসিয়া সাধুকে দর্শন করিল ও তাহাদের কাগজে সাধুর মহিমা গান করিয়া দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিতে লাগিল। ফল কথা, দেশের লোকের ভক্তি একেবারে উথলিয়া পড়িল। সাধুর মাথার নিম্নে চেলারা একটা ধামা রাখিল; সেই” ধামায় পযসা-বৃষ্টি হইতে লাগিল।”

 লম্বোদর বলিলেন,—“তুমিও সেই হুজুগে দু’পয়সা লাভ করিয়াছিলে!”

 ডমরুধর বলিলেন,—সে জমি আমার, সে চালা আমার, সে আমগাছ আমার; কেন আমি লাভ করিব না? আমি সাধুকে গিয়া বলিলাম,—“ঠাকুর! সন্ন্যাসী মোহান্তের প্রতি আমার যে ভক্তি নাই, তাহা নহে। তবে কি জান, আমি বিষয়ী লোক। তুমি আমার জমিতে আস্তানা গাড়িয়াছ। দু’পয়সা বিলক্ষণ তোমার আমদানি হইতেছে। ভূস্বামীকে ট্যাক্‌স দিতে হইবে।”

 সাধু উত্তর করিলেন,—“আমরা উদাসীন। আমি নিজে বায়ু ভক্ষণ করি। চেলারা এখনও যৎকিঞ্চিৎ আহার করে। দীন দুঃখীকে আমরা কিছু দান করি। কোন পরিব্রাজক আসিলে তাহার সেবায় কিঞ্চিৎ অর্থ ব্যয় করি। সে জন্য পুণ্যাত্মা ভক্তগণ যাহা প্রদান করে, আমার শিষ্যদ্বয় এস্থানের খরচের জন্য তাহার অর্দ্ধেক রাখিয়া, অবশিষ্ট ধন প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তোমাকে দিয়া আসিবে।” বলা বাহুল্য যে, আহ্লাদসহকারে আমি এ প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। কোন দিন চারি টাকা, কোন দিন পাঁচ টাকা আমার লাভ হইতে লাগিল। সন্ন্যাসীর প্রতি আমার প্রগাঢ় ভক্তি হইল। যাহাতে তাহার পসার প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি হয়, দেশের যত উজবুক যাহাতে তাহার গোঁড়া হয়, সে জন্য আমি চেষ্টা করিতে লাগিলাম। মনে মনে সঙ্কল্প করিলাম যে, দুগ্ধবতী গাভীর ন্যায় সন্ন্যাসীটীকে আমি পুষিয়া রাখিব। কিন্তু একটা হুজুগ লইয়া বাঙ্গালী অধিক দিন থাকিতে পারে না। হুজুগ একটু পুরাতন হইলেই বাঙ্গালী পুনরায় নূতন হুজুগের সৃষ্টি করে। অথবা এই বঙ্গভূমির মাটির গুণে আপনা হইতেই নূতন হুজুগের উৎপত্তি হয়। এই সময় এ স্থান হইতে চারি ক্রোশ দূরে পাঁচগেছে গ্রামে রসিক মণ্ডলের সপ্তম বর্ষীয়া কন্যার স্কন্ধে মাকাল ঠাকুর অধিষ্ঠান হইলেন। রসিক মণ্ডল জাতিতে পোদ। মাকাল ঠাকুরের ভরে সেই কন্যা লোককে ঔষধ দিতে লাগিল। দেবদত্ত ঔষধের গুণে অন্ধের চক্ষু, বধিরের কর্ণ, পঙ্গুর পা হইতে লাগিল। বোবার কথা ফুটিতে লাগিল। কতকগুলি সুস্থ লোককে কাণা খোঁড়া, হাবা কালা, জ্বোরো অম্বুলে সাজাইতে হয়, তা না করিলে এ কাজে পসার হয় না। তুলসীর মালা গলায় দিয়া সেই ইংরেজি কাগজের লেখকও সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। ভক্তিতে গদগদ হইয়া কত কি তাহাদের কাগজে লিখিয়া বসিল। বি-এ, এম-এ, পাস করা ছোঁড়ারা আমার সন্ন্যাসীকে ছাড়িয়া সেই পোদ ছুঁড়ীর পাদক জল খাইতে গেল। কাতারে কাতারে সেই গ্রামে লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল। রসিক মণ্ডলের ঘরে টাকা পয়সা আর ধরে না। আমার সন্ন্যাসীর আস্তানা ভোঁ ভোঁ হইয়া গেল। রসিক মণ্ডলের মত আমার কেন বুদ্ধি যোগায় নাই, আমি কেন সেইরূপ ফন্দি করি নাই, আমি কেন একটা ছোট ছুঁড়ীকে জাহির করি নাই, সেই আপসোসে আমার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

 এইরূপ দুঃখে আছি, এমন সময় একজন চেলা সন্ন্যাসীর হাত ধরিয়া আমার বাড়ীতে আনিয়া উপস্থিত করিল। সন্ন্যাসী বলিল যে, নিভৃতে তোমার সহিত কোন কথা আছে। আমি, সন্ন্যাসী ও তাহার চেলা একটা ঘরে যাইলাম। সন্ন্যাসী বলিল যে ট্যাক্স বন্ধ হইয়া গিয়াছে, সে জন্য নিশ্চয় তোমার মনে সন্তাপ হইয়াছে, কিন্তু দুঃখ করিও না, অন্য উপায়ে তোমাকে আমি বিপুল ধনের অধিকারী করিব। একটী টাকা দাও দেখি!

 সন্ন্যাসীর হাতে আমি একটী টাকা দিলাম। সেই টাকাটীকে তৎক্ষণাৎ দ্বিগুণ করিয়া দুইটী টাকা সন্ন্যাসী আমার হাতে দিল। তাহার পর সন্ন্যাসীর আদেশে ভিতর হইতে একটী মোহর আনিয়া দিলাম, তাহাও ডবল করিয়া দুইটী মোহর সন্ন্যাসী আমার হাতে দিল। শেষে একখানি দশ টাকার নোটও ডবল করিয়া আমার হাতে দিল।

 তাহার পর সন্ন্যাসী আমাকে বলিল,—“এ কাজ অধিক পরিমাণে করিতে গেলে পূজা-পাঠের আবশ্যক। তোমার ঘরে যত টাকা, মোহর, নোট, সোণা রূপা আছে, পূজা-পাঠ করিয়া সমুদয় আমি ডবল করিয়া দিব।”

 আমি উত্তর করিলাম, “সন্ন্যাসী ঠাকুর! আমি নিতান্ত বোকা ন‍ই। এরূপ বুজরুকির কথা আমি অনেক শুনিয়াছি। গৃহস্থের বাড়ী গিয়া দুই একটী টাকা অথবা নোট ডবল করিয়া তোমরা গৃহস্বামীর বিশ্বাস উৎপাদন কর। তোমাদের কুহকে পড়িয়া গৃহস্বামী ঘরের সমুদয় টাকা কড়ি গহনা পত্র আনিয়া দেয়। হাঁড়ী অথবা বাক্সের ভিতর সেগুলি বড় করিয়া তোমরা পুজা কর। পূজা সমাপ্ত করিয়া সাত দিন কি আট দিন পরে গৃহস্বামীকে খুলিয়া দেখিতে বল। সেই অবসরে তোমরা চম্পট দাও। সাত আট দিন পরে গৃহস্বামী খুলিয়া দেখে যে, হাঁড়ি ঢন্ ঢন্। বাজিকরের ও–চালাকি আমার কাছে খাটিবে না।”

 সন্ন্যাসী বলিল,―“পুজা–পাঠ করিয়া আমি চলিয়া যাইব না। তোমার ঘরে তুমি আমাকে বন্ধ করিয়া রাখিও। আর দেখ আমি অন্ধ। কাহারও সহায়তা ভিন্ন দুই পা চলিতে পারি না। পলাইব কি করিয়া? পূজার দিন কোন শিষ্যকে আমি এ স্থানে আসিতে দিব না। সাত আট দিন পরে তোমাকে টাকা কড়ি খুলিয়া দেখিতে বলিব না; পূজা সমাপ্ত হইলেই তৎক্ষণাৎ তুমি খুলিয়া দেখিবে যে, সমুদয় সম্পত্তি দ্বিগুণ হইয়া গিয়াছে!”

 সন্ন্যাসীর এরূপ প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। সন্ন্যাসী শুভ দিন ও শুভ লগ্ন স্থির করিল। পূজা ও হোমের উপকরণের কর্ম দিল। সে সমুদয় আমি সংগ্রহ করিলাম। বাড়ীর দোতালায় নিভৃত একটা ঘরে পুজার আয়োজন করিলাম। ঘরে টাকা, মোহর, নোট যত ছিল, ও বিবাহের নিমিত্ত যে “গহনা গড়াইয়াছিলাম, সে সমুদয় বৃহৎ একটা বাক্সের মধ্যে বন্ধ করিয়া পূজার স্থানে লইয়া যাইলা।