ডমরু-চরিত/প্রথম গল্প/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।



ঠিক কন্দর্প পুরুষ কি?
ডমরুধর বলিলেন,—“আমার তৃতীয় বিবাহের সময় এ বিপদ্ ঘটিয়াছিল। আমার বয়স তখন পঁয়ষট্টি বৎসর। এত বয়সে লোক বিবাহ করে না। তবে আমার ছেলে-বেটা মানুষ হইল না। আমি তাহাকে ত্যাজ্য পুত্র করিলাম। কোথায় সে চলিয়া গেল। সে একটা স্বতন্ত্র গল্প।”
শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,— “সে গল্প আর একদিন হইবে।”
ডমরুধর বলিলেন,—“তাহার পর বিবাহ না করিলে গৃহ শূণ্য হুইয়া থাকে; কিন্তু বিবাহ করিলেও কি হয়, তা জান তো, লম্বোদর?”
লম্বোদর উত্তর করিলেন,— “খ্যাচ, খ্যাচ, রাত্রি দিন খ্যাচ খ্যাচ।”
ডমরুধর রলিলেন,—“হাঁ, তুমি ভুক্তভোগী। ঘটনাচক্রে আমার এই বিবাহের কথা স্থির হইয়াছিল। আমডাঙ্গার মাঠে আমার যে বৃহৎ বাগান আছে, সে বৎসর বৈশাখ মাসে সেই বাগানে গিয়া আমি ডাব পাড়াইতেছিলাম। দুই চারি দিন পূর্ব্বে আমার পুরাতন উড়ে মালি দেশে গিয়াছিল, ভাইপোকে তাহার স্থানে রাখিয়া গিয়াছিল। সে আমাকে কখন দেখে নাই, আমি তাহাকে কখন দেখি নাই। উদ্ধব ঘোষের জামাতা সেই ছোঁড়ার সহিত সড় করিয়া চোর বলিয়া আমাকে বাঁধিয়া ফেলিল। তাহার পর মারিতে মারিতে কুতবপুরের মহকুমাতে আমাকে লইয়া গেল। কিন্তু সে আবার একটী স্বতন্ত্র গল্প।”
শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—“এই বিপদ্?”
ডমরুধর উত্তর করিলেন,—“রাম রাম! এ সীমান্য কথা। ইহা অপেক্ষা ঘোরতর সঙ্কটে আমি পড়িয়াছিলাম। সেই সঙ্কট হইতে মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিয়াছিলেন।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,—“কুতবপুরে ঘটকীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল, পুনরায় বিবাহ করিতে সে আমাকে প্রবৃত্তি দিল। আমি বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। বিবাহের কথাবার্ত্তা চলিতে লাগিল। টাকায় কি না হয়? বাঁশপুরে এক বয়স্কা কন্যার সহিত বিবাহ স্থির হইল। তিনিই আমার বর্তমান গৃহিণী।”
লম্বোদর বলিলেন, “সে কথা আমরা জানি, আমরা বরযাত্র গিয়াছিলাম।”
ডমরুধর বলিলেন,—“কন্যার মাতা পিতা অর্থহীন বটে, কিন্তু আমার নিকট হইতে নগদ টাকা চাহিলেন না। তবে ঘটকী বলিল যে, বিবাহের সমুদয় খরচা আমাকে দিতে হইবে এবং কন্যার শরীরে যেখানে যা ধরে, সেইরূপ অলঙ্কার দিতে হইবে। তোমরা জান যে, আমি কখন একটী পয়সা বাজে খরচ করি না। লোক পাছে অলস হইয়া পড়ে, সেই ভয়ে ভিখারীকে কখন মুষ্টি ভিক্ষা প্রদান করি না। সেক্রার পেট ভরাইতে প্রথম আমি সম্মত হইলাম না। আমি বলিলাম যে, গহনার পরিবর্ত্তে কন্যার আঁচলে নোট বাঁধিয়া দিব। কিন্তু কন্যার মাতা পিতা সে প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। অবশেষে আমি ভাবিয়া দেখিলাম যে, আমার বয়স পঁয়ষট্টি বৎসর, তাহার পর আমাকে দেখিয়া কেহ বলে না যে, ইনি সাক্ষাৎ কন্দর্প-পুরুষ। নিজের কথা নিজে বলিতে ক্ষতি নাই,—এই দেখ আমার দেহের বর্ণটা ঠিক যেন দময়ন্তীর পোড়া শোউল মাছ। দাঁত একটাও নাই, মাথার মাঝাখানে টাক, তাহার চারিদিকে চুল, তাহাতে একগাছিও কাঁচা চুল নাই, মুখে ঠোঁটের দুই পাশে সাদা সাদা সব কি হইয়াছে। এই সব কথা ভাবিয়া গহণা দিতে আমি সম্মত হইলাম। যতদূর সাধ্য সাদা-মাটা পেটা সোণার গহনা গড়াইলাম; কিন্তু তাহাতেও আমার অনেক টাকা খরচ হইল। ফর্দ্দ অনেক। এক বাক্স গহনা হইল।”
শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,—“তা বটে! কিন্তু বিপদটা কি?
ডমরুধর বলিলেন,— “ব্যস্ত হইও না। শুন।“