বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/ষষ্ঠ গল্প/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

নারিকেলের বোরা।

 ছিপ গাছটা আমি ফেলিয়া দিলাম। প্রথম বনের ভিতর দিয়া, তাহার পর পুকুর পাড়ের নীচে দিয়া দুর্লভীর ঘরের পশ্চাৎদিকে উপস্থিত হইলাম। ধীরে ধীরে অগ্রসর হইরা উঁকি মারিয়া দেখিলাম যে, তাহার ঘরে কেহ নাই। দ্বারটী কেবল ভেজানো আছে। টুপ করিয়া আমি তাহার ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরের ভিতর অন্ধকার। চারিদিক্ চাহিয়া দেখিলাম। একখানি কাপড় কি একখানি গামছা দেখিতে পাইলাম না। কি করি, টুপি মাথায় দিয়া উলঙ্গ অবস্থায় ঘরের এক কোণে বসিয়া রহিলাম। মনে করিলাম যে, একটু অন্ধকার হইলে পলায়ন করিব। আর যদি দুর্লভী দেখিতে পায়, তাহা হইলে আমার সাহেবের পোষাক দেখিয়া তাহার মনে আনন্দ হইবে।

 ওদিকে, যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই হইল। গদাই ঘোষ গ্রামের চৌকিদার ও অন্যান্য লোক লইয়া পুষ্করিণীর ধারে উপস্থিত হইল। মহা গোল পড়িয়া গেল। ঘরের ভিতর বসিয়া আমি তাহা শুনিতে পাইলাম। ভয়ে সর্ব শরীর আমার কাঁপিতে লাগিল। পুকুরের সেই কোণে বনের ভিতর তাহারা অনেক অনুসন্ধান করিল। ছিপ দেখিতে পাইল। কিন্তু সাহেবকে তাহারা দেখিতে পাইল না। হতাশ হইয়া সকলে বাড়ী ফিরিয়া গেল। তখন দুর্লভী আসিয়া আপনার দাওয়া বা পিঁড়েতে বসিল।

 এমন সময় রস্‌কের মা আসিয়া বলিল,—“দুর্লভী! আমাকে শসা দিবি বলিয়াছিলি, কৈ দে।”

 দুর্লভী বলিল,—“শসা তুলিয়া রাখিয়াছি। ঘরের বাম কোণে ডালায় আছে; গিয়া লও।”

 আমি ঘরের বাম কোণে বসিয়া ছিলাম। আমার ভয় হইল। কোণের দিকে আরও ঘেসিয়া বসিলাম। রস্‌কের মা ঘরের ভিতর আসিয়া কোণের কাছে অন্ধকারে হাতড়াইতে লাগিল। সহসা ঝমাৎ করিয়া কি একটা শব্দ হইল। সে চীৎকার করিয়া উঠিল, বাম হাত আমার দিকে বাড়াইয়া দিল। আমার গায়ে তাহার হাত ঠেকিয়া গেল।

 সে চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল, ঘরের ভিতর একটা ভূত বসিয়া আছে। সে আমার হাতে কামড় মারিয়াছে। আমার আঙ্গুল গুলা চিবাইতেছে। এখন আমার সর্ব্বশরীর খাইয়া ফেলিবে।

 পরে শুনিলাম, ঘরে যে দুর্লভী করাতে ইঁদুরকল পাতিয়া রাখিয়াছিল, রস্‌কের মায়ের হাত তাহাতে পড়িয়া গিয়াছিল। কি হইয়াছে কি হইয়াছে বলিয়া দুর্লভী দৌড়িয়া আসিল। দ্বারের নিকট তাহাকে ঠেলিয়া আমি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। তখন দুর্লভী আমাকে দেখিতে পাইল। কিন্তু চিনিতে পারিল না। সে চীৎকার করিয়া বলিল,—“ভূত নহে, ভূত নহে, এ সেই নেংটা গোরা; এতক্ষণ নেংটা গোরা আমার ঘরের ভিতর বসিয়া ছিল।”

 তাহার চীৎকার শুনিয়া চারিদিক্ হইতে লোক ছুটিয়া আসিতে লাগিল। আমি আর বাটী পলাইতে অবসর পাইলাম না। কিছু আগে পথের বাম দিকে বিন্দু ব্রাহ্মণীর ঘর। বিন্দু ব্রাহ্মণী তখন গোয়ালে বসিয়া ঘুঁটে ধরাইয়া ধোঁয়া করিতেছিল। তাহার সেই একখানি মেটে ঘরের দ্বার খোলা ছিল। তাড়াতাড়ি আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।

 ঘরের ভিতর মিটমিট করিয়া এক কেরোসিনের ডিবে জ্বলিতেছিল। বিন্দু ব্রাহ্মণীর কেহ নাই। একলা সে সেই ঘরে বাস করে। তাহার অনেকগুলি নারিকেল, আম, কাঁঠাল ও আতা গাছ আছে। তাহার ফল বেচিয়া সে দিনপাত করে।

 আমি দেখিলাম যে, ঘরের এক কোণে অনেকগুলি নারিকেল স্তূপাকার হইয়া আছে। তাহার পার্শ্বে পাঁচ বোৱা বা গুণের থলি নারিকেলে পূর্ণ করিয়া তাহাদের মুখ বন্ধ করিয়া বিন্দু সারি সারি উচ্চ ভাবে বসাইয়া রাখিয়াছে।

 ইতিমধ্যে বাহিরে গোল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, নেঙটা গোরা এই দিকে আসিয়াছে। এস, বিন্দুর ঘরের ভিতর দেখি। হয়তো এই ঘরের ভিতর সে বসিয়া আছে। আমি তখন মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম যে,—মা! নষ্টচন্দ্র দেখিলে লোককে কি এত সাজা দিতে হয়? প্রতি বৎসর আমি তোমার পূজা করি, এ বিপদ হইতে তুমি আমাকে রক্ষা কর।”

 তোমাদিগকে আমি বার বার বলিয়াছি যে, আমার উপর মায়ের অপার কৃপা। মা তৎক্ষণাৎ আমার মনে বুদ্ধি দিলেন। নিকটে একটা খালি বোৱা পড়িয়া ছিল। সেই বোরার মুখে আমি আমার মাথা গলাইয়া দিলাম, তাহার পর টানিয়া আমার সর্ব্ব শরীর পা পর্যন্ত তাহা দিয়া ঢাকিয়া ফেলিলাম। অবশেষে নারিকেল পূর্ণ থলির ন্যায় অপর পাঁচটী বোরার পার্শ্বে আমিও বসিয়া রহিলাম। তিন চারি জন গ্রামবাসী ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। এদিকে ওদিকে চাহিয়া দেখিল যে, নেঙটা গোরা ঘরের ভিতর নাই। কেবল ছয়টী নারিকেল-পূর্ণ থলি সারি সারি বসিয়া আছে।

 ঘরের ভিতর নেঙটা গোরাকে দেখিতে না পাইয়া সকলের ভয় হইল। একজন বলিল, —'তাহাকে এই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে আমি নিশ্চয় দেখিয়াছি। তবে এখন কোথায় গেল? এ নেঙটা গোরা নহে; এই বর্ষাকালে জল কাদায় নেঙটা গোরা কোথা হইতে আসিবে? তাহার পর নেঙটা গোরা এত মিশমিশে কালো হয় না। এ নেঙটা গোরা নহে, এ নেঙটা ভূত।’