বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/সপ্তম গল্প/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

মোল্লা জামাতা।

 কুন্তলাকে কি উপায়ে উদ্ধার করা যায়, সেই সম্বন্ধে ঢাক মহাশয় আমার সহিত অনেক পরামর্শ করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাকে কিছু বলিতে পারিলাম না।

 ঢাক মহাশয়ের এক বালক দৌহিত্র আছে। তাহার নাম ভুলু। ভুলু ঢাক মহাশয়ের প্রাণস্বরূপ। এক মুহূর্ত্ত তাহাকে চক্ষুর আড় করিয়া ঢাক মহাশয় থাকিতে পারেন না। বিশেষতঃ পুত্রহীন হইয়া তাঁহার যত স্নেহ মমতা এই ভুলুর উপর পড়িয়াছিল। পাছে কুন্তলার চীৎকারে ভুলুর কোন অনিষ্ট হয়, সে জন্য ঢাক মহাশয় ঘোরতর ভীত হইলেন।

 বিপদের উপর বিপদ। ঢাক মহাশয়ের জামাতা, ভুলুর পিতা, যাহার নাম কেশব, বোগদাদে গিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত ঢাক মহাশয়ের সদ্ভাব ছিল না। ঢাক মহাশয় আশা করিয়াছিলেন যে, তিনি লড়াইয়ে মারা পড়িবেন। ভুলু ও ভুলুর মাতা চিরকাল তাঁহার নিকট থাকিবে। ভুলুর মাতার নাম কালিকা। বাল্যকাল হইতে তাহাকে আমি কোলে পিঠে করিয়াছি। কন্যার ন্যায় তাহাকে আমি স্নেহ করি। এত চুল কখন আমি কাহারও দেখি নাই। কিছুদিন পূর্ব্বে দোতালার ঘরে জানালার ধারে সে চুল এলো করিয়া বসিয়া ছিল। সে যে কি অপুর্ব্ব শোভা হইয়াছিল, তাহা তোমাদিগকে আর কি বলিব!

 ঢাক মহাশয়ের জামাতা, কালিকা দেবীর স্বামী, ভুলুর পিতা, কেশব লড়াইয়ে মারা যান নাই। তিনি দেশে ফিরিয়া আসিলেন। দেশে আসিয়া তিনি কালিকা ও ভুলুকে লইতে পাঠাইলেন। ঢাক মহাশয়ের মাথায় ঠিক যেন বজ্রাঘাত হইল। তিনি বলিলেন,—“কিছুতেই আমি আমার
ভুলুর মাতা কালিকা দেবী।
কন্যাকে ও দৌহিত্রকে তাহার বাড়ী পাঠাইব না। সে সমুদ্র পার হইয়া বিদেশে গমন করিয়াছে। তাহার জাতি গিয়াছে।”
হিন্দু মোল্লা।


 কিন্তু ঢাক মহাশয়ের কয়েক জন শিষ্য যাহারা বি-এ এম-এ পাশ করিয়াছে, তাহারা বলিল যে,—“মহাশয়! এমন কাজ করিবেন না। আপনার জামাতা রাজকার্য্যে বিদেশে গমন করিয়াছিলেন। মহা সংগ্রামে পৃথিবী টলমল করিতেছে। জর্ম্মণদিগকে যদি সম্পূর্ণ পরাজিত করা না যায়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে পৃথিবীর ঘোর অনিষ্ট ঘটিবে। আমাদেরও সর্ব্বনাশ হইবে। ইংরেজের প্রতাপে আমরা সুখে নিরাপদে বাস করিতেছি। আমাদের প্রাণপণে ইংরেজের সাহায্য করা উচিত। আপনি যাহা মনস্থ করিয়াছেন, তাহা করিলে রাজার বিরুদ্ধে কাজ করা হইবে। এমন কাজ কখন করিবেন না।”

 এইরূপ কথা শুনিয়া ঢাক মহাশয় আমাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। আমি গিয়া বলিলাম,—ইংরেজ প্রজার ধর্মে হস্তক্ষেপ করিবেন না। সাগর অতি ভয়ানক বস্তু। জগন্নাথে গিয়া আমি দেখিয়াছি। তিনটা ঢেউ খাইয়া আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়াছিল। সে সাগর পারে কেহ যাইলে হিন্দু ধর্ম্মের গন্ধটী পর্য্যন্ত তাহার গায়ে থাকে না।

 আমি পুনরায় বলিলাম,—আর দেখুন, ঢাক মহাশয়! বিলাত গেলে বরং নিষ্কৃতি আছে। বিলাত গেলে সাহেব হয়, সাহেবি পোষাক পরে, সাহেবি খানা খায়। তা এখন বিলাত না গিয়াও লোকে এই কাজ করিতেছে। কিন্তু বোগদাদে গমন করিলে লোকে মোল্লা হয়। মোল্লা হইয়া পীরের গান করে'। বলে, —

‘হুঁকো বন্দিলাম, কলকে বন্দিলাম, আর বন্দিলাম টিকে।
আর তালগাছে বন্দিলাম প্রভু চামচিকে॥”

 তাহার পর সে আরব্য উপন্যাসের দেশ। জিন, দৈত্য ও দানবীতে পরিপূর্ণ। গুজব এই যে, আপনার জামাতা একটা দৈত্য সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। অতএব এরূপ লোকের সহিত কোন সংস্রব রাখিবেন না। তাহার বাড়ীতে আপনার কন্যাকে পাঠাইবেন না। ঢাক মহাশয় তাহাই স্থির করিলেন।