ডমরু-চরিত/সপ্তম গল্প/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।



সন্দেশের হাড়ী।
কিন্তু ঢাক মহাশয়ের কন্যা কালিকা তাহাতে সম্মত হইলেন না। তিনি শ্বশুর বাড়ী ঘাইবার নিমিত্ত মাতার নিকট কাঁদিতে লাগিলেন। স্বামীর নিকট তাঁহাকে পাঠাইবার নিমিত্ত মাতা ঢাক মহাশয়কে অনেক অনুরোধ করিলেন। কিন্তু ঢাক মহাশয় কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন যে,—সে পতিত পাপিষ্ঠ সমুদ্র প্রত্যাগত নরাধমের নিকট পাঠাইয়া আমি কন্যার ইহকাল পরকাল নষ্ট করিতে পারি না। হতাশ হইয়া কালিকা স্বামীকে পত্র লিখিলেন। পত্র পাইয়া একদিন সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে কেশব আসিয়া ঢাক মহাশয়ের খিড়কির নিকট এক বন্য জামতলায় স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। জামতলায় অল্প বন ছিল। সেই বনের আড়ালে দাঁড়াইয়া দুইজনে কথাবার্তা করিতে লাগিলেন। বন্য জাম গাছ। অসময়ে ইহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করা জাম হইয়াছিল। এখন কেষ্টা ছোড়া জাম গাছে উঠিয়া জাম খাইতেছিল। কেশব ও কালিকা তাহাকে দেখেন নাই। পতি-পত্নীর সকল কথা কেষ্টা শুনিতে পায় নাই। তবে, বুধবার সন্ধ্যার সময়' ইত্যাদি গোটা কতক কথা কেবল শুনিয়াছিল। যখন স্ত্রী-পুরুষের পরামর্শ শেষ হইবার উপক্রম হইল, তখন গাছ হইতে কেষ্টা বলিয়া উঠিল, ঢাক মহাশয়কে বলিয়া দিব।
দুইজনেই চমকিত হইলেন। একটু স্তব্ধ থাকিয়া কালিকা তাহাকে বলিলেন, না, দাদা! তা কি বলিতে আছে? লক্ষ্মী দাদা! কাহাকেও কিছু বলিও না।
কেশবকে লক্ষ্য করিয়া কেষ্টা জিজ্ঞাসা করিল, তুমি ইংরেজি জান?
কেশব উত্তর করিলেন, — হাঁ, একটু আধটু জানি। বি-এ পাশ করিয়াছি। কেষ্টা বলিল,—শীঘ্রই আমাদের পূজার ছুটি হইবে। 'পূজার সময় তুমি কি করিয়াছ' এই মর্ম্মে মাষ্টার আমাদিগকে একটা প্রবন্ধ লিখিতে দিবেন। আমার এত কাজ যে, আমি লিখিতে অবসর পাইব না। তুমি যদি আমাকে লিখিয়া দাও, তাহা হইলে আমি বলিয়া দিব না।
কেশব স্বীকার করিলেন। কেষ্টা তাঁহাকে তিন সত্য করিতে বলিল। কালিকাকেও সত্য করিতে হইল। তখন কেষ্টা গাছ হইতে নামিয়া চলিয়া গেল। কেশবও আপনার গ্রামে চলিয়া গেলেন।
‘বুধবার সন্ধ্যার সময়' এইরূপ দুই একটি কথা কেষ্টা সেদিন শুনিতে পাইয়াছিল। বুধবার সন্ধ্যা বেলা কেষ্টা ভাবিল,—যাই, গিয়া দেখি, আজ তাহারা কি করে। এইরূপ মনে করিয়া সে সেই জাম গাছে উঠিয়া বসিয়া রহিল। সন্ধ্যার পূর্ব্বে সে দেখিল যে, কালিকা শরা ঢাকা এক নূতন হাঁড়ী লইয়া ঘর হইতে চুপি চুপি বাহির হইলেন। জাম তলার বনের ভিতর হাড়ীটি লুকাইয়া রাখিয়া প্রস্থান করিলেন। কালিকা চলিয়া গেলে, কেষ্টা গাছ হইতে নামিল ও দেখিল যে, হাড়ীর মুখে শরাখানি কালিকা ময়দা দিয়া আঁটিয়া দিয়াছেন। কিন্তু ময়দা কাঁচা ছিল। শরা একটু উঠাইয়া কেষ্টা দেখিল যে, হাড়ীটি, সন্দেশে পরিপূর্ণ। কেশব বাবু আসিয়া কালিকা দিদির সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন, সেই কথা ঢাক মহাশয়কে বলিয়া দিব না, আমি এই অঙ্গীকার করিয়াছি। সন্দেশ খাইবনা, আমি এরূপ অঙ্গীকার করি নাই। অতএব আমি এই সন্দেশগুলি খাইব। এইরূপ মনে করিয়া কেষ্টা সন্দেশের হাঁড়ী লইয়া বন হইতে বাহির হইল। পথে দাঁড়াইয়া সে দেখিল যে, সম্মুখ দিকে দুইজন গ্রামের লোক আসিতেছে। পশ্চাৎ দিকে চাহিয়া দেখিল যে, প্রেম চাকি ধান বোঝাই গরুর গাড়ী লইয়া আসিতেছে। কেষ্টা ভাবিল যে, উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে দিই, তা না করিলে আমি ধরা পড়িব। এইরূপ মনে করিয়া সে সন্দেশের হাড়ীটি গাড়ীওয়ালাকে দিয়া বলিল, — প্রেম খুড়ো! কালিকা দিদি আমাকে সন্দেশ দিয়াছেন। আমি একেলা খাইব না। তোমাতে আমাতে দুইজনে খাইব। তুমি ঘোষেদের গঙ্গার ঘাটে গিয়া গাড়ী রাখ। একটু পরে আমি যাইতেছি। [কলিকাতার দক্ষিণে এই সমুদয় ঘটনা ঘটিয়াছিল। এ স্থানে প্রাচীন গঙ্গার গর্ত লোকে ভাগ করিয়া লইয়াছে। তাই ঘোষেদের গঙ্গা, বসুদের গঙ্গা ইত্যাদি।] প্রেম চাকি সন্দেশের হাড়ী লইয়া গঙ্গার ঘাটে চলিল। কেষ্টাও অন্য পথ দিয়া সেই দিকে চলিল। প্রেম চাকি ঘাটে উপস্থিত হইয়া হাড়ীটি একটু খুলিয়া দেখিল যে, সন্দেশে পরিপূর্ণ। সে ভাবিল যে, আমার ছেলেদের জন্য সন্দেশ লইয়া যাইব। কেষ্টাকে ভাগ দিব না। কিন্তু এই সময় দেখিল যে, দূরে কেষ্টা আসিতেছে। তাড়াতাড়ি হাড়ীটির মুখ পুনরায় বন্ধ করিল। গাড়ী হইতে একটি ঝুড়ি লইয়া হাড়ীটি ঝুড়ি চাপা দিয়া তাহার উপরে সে বসিয়া রহিল। কেষ্টা আসিয়া সন্দেশের ভাগ চাহিল। প্রেম চাকি বলিল, — আমার ক্ষুধা পাইয়াছিল, মুখে সন্দেশ ভাল লাগিল, আমি সব সন্দেশ খাইয়া ফেলিয়াছি। দুই জনে ঝগড়া বাধিয়া গেল। এমন সময় কেষ্টা দেখিল যে, দূরে গজরাজ আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়া কেষ্টা সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল।
এদিকে কালিকার মন সুস্থির নাই। জামতলায় সন্দেশের হাড়ী ঠিক আছে কিনা, তাহা দেখিবার নিমিত্ত তিনি আর একবার বনের নিকট গমন করিলেন। সে স্থানে গিয়া দেখিলেন যে, বনের ভিতর সন্দেশের হাড়ী নাই। কালিকা কাঁদিয়া উঠিলেন। আমার হাড়ী কে লইয়া গিয়াছে, এই বলিয়া ক্রমাগত কাঁদিতে লাগিলেন।
সেদিন বৈকাল বেলা আমি ঢাক মহাশয়ের বাড়ী গিয়াছিলাম। ঢাক মহাশয় বলিয়াছিলেন যে, আমি নানা বিপদে পড়িতেছি। মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিতেছেন না, অতএব আর আমি মা দুর্গার পূজা করিব না। কথা শুনিয়া আমি থাকিতে পারিলাম না। আমি তাঁহাকে বুঝাইতে যাইলাম। আমি বলিলাম যে, মা দুর্গা পরম দয়াময়ী। যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে। ভক্তিভাবে ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব করুন। তাহা হইলে” আমাকেও যেরূপ তিনি নানা বিপদ হইতে রক্ষা করেন, আপনাকেও তিনি সেইরূপ নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিবেন।
কিন্তু প্রথম তিনি আমার কথায় কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তাহার পর যখন আমি বলিলাম যে, পূজা বন্ধ করিলে, শিষ্য-সেবক যে বার্ষিক প্রদান করে, তাহার কি হইবে? তখন তিনি পূজা করিতে সম্মত হইলেন।
আমাদের দুই জনে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় কালিকার কান্নার শব্দ আমাদের কাণে প্রবেশ করিল। আমরা সেই স্থানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হইয়াছে?
কালিকা উত্তর করিলেন যে,—“আমার সন্দেশের হাড়ী কে লইয়া গিয়াছে।” আমি বলিলাম,—“গোটা কত সন্দেশের জন্য এত কান্না কেন? ঢাক মহাশয় তোমাকে অনেক সন্দেশ কিনিয়া দিবেন।”