বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/সপ্তম গল্প/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম গল্প।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

জিলেট মন্ত্র।

 পূজার পঞ্চমীর দিন ডমরুধর যথারীতি বন্ধুবান্ধবের সহিত প্রতিমার সম্মুখে বসিয়া আছেন। হাঁ করিয়া তিনি বলিলেন,—“তোমরা একবার আমার মুখের ভিতরটা ভাল করিয়া দেখ।” সকলে দেখিলেন। লম্বোদর, বলিলেন,— “তোমার মুখের ভিতর কি আছে? কিছুই নাই। ফোক্‌লা মুখ। তিমির গিরিগহ্বরের ন্যায়।” ডমরু উত্তর করিলেন,—“তোমাদের পাপ চক্ষু তৈলপেশী বলদের ঠুলি দ্বারা আবৃত। তোমরা দেখিবে কেবল অন্ধকার।”

 গজানন জিজ্ঞাসা করিলেন, — “তবে তোমার মুখের ভিতর কি আছে?”

 ডমরুধর উত্তর করিলেন, “আমার জিহ্বা ও কণ্ঠে সরস্বতী দেবী অধিষ্ঠিতা আছেন। পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, আমি মা দুর্গার বরপুত্র। তাহার পর তাঁহার সঙ্গে যে দেবতাগুলি আগমন করেন, একে একে সকলের আরাধনা করিয়া আমি সিদ্ধি লাভ করিয়াছি। কার্তিকের বরে আমার কন্দর্পের ন্যায় রূপ হইয়াছে। মা সরস্বতীর বরে আমি এতবড় বিদ্বান্ হইয়াছি। মেঘনাদবধ কে লিখিয়াছে জান?”

 লম্বোদর উত্তর করিলেন, — “কেন? মাইকেল মধুসূদন দত্ত।”

 ডমরুধর বলিলেন, হাঁ, সকলের তাই বিশ্বাস। কিন্তু কলিকাতায় যখন আমি চাকরী করিতাম, তখন সন্ধ্যার পর সাহেবী পোষাক পরিয়া কে আমার নিকট আসিত? দুই ঘণ্টাকাল আমি যাহা বলিতাম, কে তাহা লিখিয়া লইত? সে লোকটি অপর কেহ নয়। সে লোকটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মেঘনাদবধ কাব্য আগাগোড়া আমার দ্বারা রচিত।

কিন্তু মাইকেল আমাকে অধিক টাকা দিতে পারিতেন না। টাকা দিতেন বঙ্কিম। কোন দিন পাঁচ, কোন দিন দশ। যে দিন “দুর্গেশনন্দিনী” শেষ করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম, সে দিন তিনি আমাকে একেবারে এক শত টাকা দিয়াছিলেন। অন্যান্য পুস্তকের জন্যও তিনি আমাকে অনেক টাকা দিয়াছিলেন। মাইকেল ও বঙ্কিম অনেক কাকুতি মিনতি করিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন যে,—“মহাশয়! আপনি যে আমাদের পুস্তক লিখিয়া দিয়াছেন, আমরা বাঁচিয়া থাকিতে সে কথা প্রকাশ করিবেন না।” সেই জন্য এতদিন চুপ করিয়া ছিলাম। আর দেখ, এখন যত বড় বড় গ্রন্থকার জীবিত আছেন, অন্ততঃ সাধারণে যাঁহাদিগকে গ্রন্থকার বলিয়া জানে, তাঁহাদের সমুদায় পুস্তকের প্রণেতা এই শর্মা। হাসি পায়। নাম করিব না। নাম করিলে, তাঁহাদের মান সম্ভ্রম একেবারে যাইবে। অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া নাম করিতে তাঁহারা আমাকে মানা করিয়াছেন। সেই জন্য চুপ করিয়া আছি। কিন্তু তাঁহারা যে গ্রন্থকার বলিয়া লোকের নিকট পরিচয় দেন। তাই আমার হাসি পায়।

 এই দেখ, আজ কাল হোমরুল বলিয়া একটা হুজুগ পড়িয়াছে। এই লোকটি সে সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতেছেন।


হোমরুলের বক্তা।
 ইহা অপেক্ষা আমি শতগুণ বক্তৃতা করিতে পারি। আমার বক্তৃতা লোকে এইরূপ মুখভঙ্গী করিয়া অবাক্ হইয়া শ্রবণ করে।
শ্রোতাদিগের মুখভঙ্গী।

 আমার প্রতি মা সরস্বতীর সামান্য কৃপা নহে। সে বৎসর কার্ত্তিকের ময়ূরে চড়িয়া আমি যখন আকাশ ভ্রমণে গিয়াছিলাম, তখন মায়ের কৃপায় আমার মুখ দিয়া মহামন্ত্র বাহির হইয়াছিল। এ তোমার হিড়িং বিড়িং মন্ত্র নহে। জিলেট মন্ত্র। আসল বীজ মন্ত্র। এ মন্ত্রের যে কি অদ্ভুত শক্তি, এতদিন তাহা আমি জানিতাম না। এইবার জানিতে পারিয়াছি। এই মন্ত্রের প্রভাবে আমি শুক্লাম্বর ঢাককে ঘোর বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছি। প্রেতযোনি প্রাপ্ত তাঁহার কন্যাকে উদ্ধার করিয়াছি। সমুদ্রযাত্রা জনিত পাপ হইতে তাঁহার জামাতাকে পরিত্রাণ করিয়াছি।

 লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন, শুক্লাম্বর ঢাক মহাশয়ের কি হইয়াছিল?