বিষয়বস্তুতে চলুন

ডমরু-চরিত/সপ্তম গল্প/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

আরব্য উপন্যাসের জিন।

 কেশব আর লুক্কায়িত হন নাই। নাই। ভিড়ের অন্য লোকের সহিত দাঁড়াইয়া তিনি সমুদয় ঘটনা দেখিতেছিলেন। ঢাক মহাশয়ের দৃষ্টি তাঁহার উপর পড়িল। ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া তিনি তাঁহাকে গালি দিতে লাগিলেন। তিনি বলিলেন,— “দূর হঃ, দূর হঃ! বোগদাদি মোল্লা আসিয়া আজ আমার হিন্দুধর্ম নষ্ট করিল।” এইরূপ বলিতে বলিতে তাঁহার রাগ দাবানলের ন্যায় আরও জ্বলিয়া উঠিল। কেশবকে তিনি এক পাটি জুতা ছুড়িয়া মারিলেন।

 কেশব ধীরে ধীরে বলিলেন, — “আপনি আমার পিতৃস্থানীয় গুরুজন। আমি প্রত্যুত্তর করিব না। চারি দিন পরে আপনার কন্যাকে ও আমার পুত্রকে আমি লইতে পাঠাইব, পাঠাইয়া দিবেন। না পাঠাইলে আপনাকে অনুতাপ করিতে হইবে।”

 এই কথা বলিয়া কেশব চলিয়া গেলেন। কেশব তখনও বাড়ীর বাহির হন নাই। এমন সময় ঢাক মহাশয়ের সম্মুখে মাথায় পাগড়ি, বুক পর্যন্ত দাড়ি, ইজের পরা, প্রকাণ্ড এক জিন আসিয়া দাঁড়াইল। জিন ঠিক দৈত্য নহে। আমাদের দেশে যেরূপ যক্ষ রক্ষ অপ্সর কিন্নর গন্ধর্ব্ব আছে, বোগদাদ অঞ্চলে সেইরূপ জিন নামক এক প্রকার ভৌতিক বায়বীয় জীব আছে। জিনকে দেখিয়া সকলে ভয়ে রুদ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। কেবল আমি ডমরুধর ভয় পাইলাম না। অনেক ভূত প্রেতের সহিত আমি কারবার করিয়াছি। ঢাক মহাশয়ের নিকট আমি গট্‌ হইয়া বসিয়া রহিলাম।


আরব দেশের জিন।

 জিনটীর কথা আমি এইরূপ শুনিলাম। একদিন কেশব ছিপ ফেলিয়া তাইগ্রীস নদীতে মাছ ধরিতেছিলেন। হঠাৎ তাঁহার বঁড়্‌শীতে কি লাগিয়া গেল। সাবধানে উপরে তুলিয়া দেখিলেন যে, তাহা এক তাম্র নির্ম্মিত হাড়ী। তামার ঢাকন দ্বারা হাঁড়ীর মুখ বন্ধ। সেই ঢাকনের উপর হিজিবিজি লেখা আছে ও তাহার উপর সিল মোহর আছে। হাঁড়ীর ভাব দেখিয়া তাঁহার আরব্য উপন্যাস বর্ণিত ধীবরের কথা স্মরণ হইল। তিনি ভাবিলেন যে, ঢাকন খুলিতে হয় তো হাঁড়ীর ভিতর হইতে প্রথম ধুম বাহির হইবে, তাহার পর সেই ধুম জিনের আকার ধারণ করিবে, তাহার পর জিন আমাকে বধ করিতে চাহিবে। এই ভয়ে তিনি তিনদিন হাড়ীর ঢাকন খুলিলেন না। তিনদিন পরে হাড়ীর ঢাকন খুলিবার ইচ্ছা তাঁহার মনে অতিশয় প্রবল হইল। ছুরি দিয়া অতি কষ্টে তিনি ঢাকন খুলিলেন। তাহার পর যে ভয় করিয়াছিলেন, তাহাই হইল। হাঁড়ী হইতে প্রথম ধুম বাহির হইল; ধুম গাঢ় হই প্রকাণ্ড জিনে পরিণত হইল। কেশব ঘোরতর ভীত হইলেন। কিন্তু জিন তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“আলাদিন কোথায়? প্রদীপের সে জিন কোথায়? আলাদিনের নিমিত্ত মণিমুক্তা-খচিত অট্টালিকা প্রস্তুত করিতে প্রদীপের জিন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছিল। মজুরি হিসাবে তাহার নিকট আমার এক সহস্র দিনার বা টাকা পাওনা আছে। সেই কথা লইয়া তাহার সহিত আমার বিবাদ হইয়াছিল। সেজন্য প্রদীপের জিন আমাকে তামার হাঁড়ীতে বন্ধ করিয়া সিল মোহর করিয়া তাইগ্রীস নদীতে নিক্ষেপ করিয়াছিল। এখন তাহার নিকট হইতে আমি আমার টাকা আদায় করিব।”

 কেশব বলিলেন, — আমি বিদেশী লোক। আরব্য উপন্যাসের সে আলাদিন কোথায়, তাঁহার সে প্রদীপের জিন কোথায়, তাহা আমি জানি না।

 জিন বলিল, — “আমি আলাদিনকে ও প্রদীপের প্রদীপের জিনকে খুঁজিয়া বাহির করিব। কিন্তু প্রথম আমি তোমার উপকার করিব। কারণ, তুমি আমাকে জল হইতে তুলিয়াছ; হাড়ী হইতে বাহির করিয়াছ। তোমার সহিত তোমার দেশে আমি যাইব। নানা বিপদ হইতে তোমাকে আমি রক্ষা করিব। তাহার পর তোমাকে লইয়া এদেশে পুনরায় ফিরিয়া আসিব। সেই হাজার দিনার আদায় করিয়া তোমাকে আমি দিব।” কেশবের সহিত জিন সেই জন্য বঙ্গদেশে আসিয়াছে।

 জিন ঢাক মহাশয়ের দিকে ভয়ঙ্কর কোপদৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তাহার চক্ষু দুইটি হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হইতে লাগিল। অবশেষে সে বলিল, — “নরাধম কাফের! তুই আমার বন্ধুকে অপমান করিয়াছিস্। এক চক্ষু কাণা দামড়া গরুর আকৃতি ধারণ কর্।”

 তৎক্ষণাৎ ঢাক মহাশয় এক চক্ষু হীন দামড়া গরু হইয়া গেলেন। সেই মূহূর্তে জিন অদৃশ্য হইয়া গেল।

 ঘোর বিপদ দেখিয়া আমি দৌড়িয়া গিয়া পথে কেশবকে ধরিলাম। দুর্ঘটনার বিবরণ শুনিয়া তিনি বলিলেন, — “শ্বশুর মহাশয়কে পুনরায় মানুষ করি, সে ক্ষমতা আমার নাই। জিন কেবল মাঝে মাঝে আমার নিকট আগমন করে। পুনরায় কবে আসিবে, তাহা জানি না। এইবার যে দিন আসিবে, তাহার হাতে পায়ে ধরিয়া শ্বশুর মহাশয়কে ভাল করিতে চেষ্টা করিব।”

 এই কথা বলিয়া কেশব আপনার গৃহে চলিয়া গেলেন। এস্থানে ঢাক মহাশয়ের বাড়ীতে কান্নাহাটি পড়িয়া গেল। কালিকা কাঁদিতে লাগিলেন, কালিকার মাতা কাঁদিতে লাগিলেন, সকলেই কাঁদিতে লাগিল। ঢাক মহাশয় হাঁ করিয়া দেখাইলেন যে, তাঁহার মুখ শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। আমি এক হাঁড়ী ভাতের ফেন আনিয়া তাঁহার সম্মুখে ধরিলাম। ঢাক মহাশয় চোঁ চোঁ করিয়া তাহা খাইয়া ফেলিলেন। তাহা খাইয়া তাঁহার শরীর কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। আমরা তাঁহাকে ঘরের ভিতর লইয়া যাইতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তিনি পৈঠা উঠিতে সম্মত হইলেন না। অগত্যা তাঁহাকে গোয়ালে লইয়া যাইতে হইল। তাঁহার মুখের ভঙ্গী দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, তিনি আর সকলকে চলিয়া যাইতে বলিতেছেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া দর দর ধারায় অশ্রুপাত হইতে লাগিল। আমি তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া বলিলাম, — “কিছু ভয় নাই, শীঘ্রই পুনরায় আপনি মনুষ্য শরীর পাইবেন। আর যতদিন না পুনরায় আপনার মনুষ্য শরীর হয়, ততদিন আপনাকে আমি ছাড়িয়া যাইব না।”

 রাত্রি নয়টার সময় আমি নিজ হাতে খড় কাটিয়া তাঁহাকে জাব দিলাম।তাহার পর গোয়ালের দেল ঠেশ দিয়া বসিয়া আমি ক্রমাগত মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম যে, — “মা! তুমি আমাকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ। আমার বন্ধুকে তুমি এ বিপদ হইতে রক্ষা কর। ইনি পুজা করিবেন না বলিয়াছেন। কিন্তু মা! ভাবিও না; যাহাতে ইনি এ বৎসর ঘটা করিয়া তোমার পূজা করেন, আমি সে ব্যবস্থা করিব।”