ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 এক দিবস সন্ধ্যার পর আমরা উভয়ে গল্প করিতে করিতে চিৎপুর রাস্তা দিয়া গমন করিতেছি, এমন সময় “কেদার বাবু” “কেদার বাবু” এই শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলাম, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। পার্শ্বে বা সম্মুখেও কাহাকে লক্ষ্য হইল না; কিন্তু দুই এক পদ অগ্রসর হইতে না হইতেই আবার “কেদার বাবু” শব্দটী শুনিতে পাইলাম। স্বর বামাকণ্ঠ-নিঃসৃত বলিয়া বোধ হইল। উর্দ্ধে লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, ইষ্টকনির্ম্মিত একটী দ্বিতল গৃহের বারাণ্ডায় ৮।১০টী স্ত্রীলোক উত্তম উত্তম বসন-ভূষণে ভূষিত হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের মধ্যে একটী স্ত্রীলোেক বারম্বার কেদার বাবুকে সম্বোধন করিতেছে।

 বাল্যকাল হইতে আমি উহাদিগকে চিৎপুর রাস্তার দুই পার্শ্বে ও অন্যান্য স্থানে দেখিয়া আসিতেছি। উহারা এই নগরীর বিশেষ অনিষ্টকারী বারবনিতা বলিয়া অতিশয় ঘৃণাও করিয়া থাকি। বাল্যকাল হইতে আমার বিশ্বাস যে, উহাদিগের বাটীর ভিতর একবার প্রবেশ করিলে, মানবগণকে ভয়ানক বিপদে পতিত হইতে হয়। অদ্য উহাদিগের মধ্যে একজন স্ত্রীলোক কেদার বাবুকে ডাকিতেছে দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম ও সেইস্থানে দাঁড়াইলাম। কেদার বাবু উহাদিগের মধ্যে এক জনকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আমাকে ডাকিতেছ কেন?” সে উত্তর করিল, “বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে আর আপনাকে ডাকিব কেন? আপনি যদি অনুগ্রহ পূর্ব্বক একবার উপরে আসেন, তাহা হইলে বড়ই উপকৃত হই। বিশেষ আবশ্যক ভিন্ন আপনাকে বিরক্ত করিতে সাহসী হইতেছি না।”

 কেদার বাবু উত্তর করিলেন, “আমি এখন যাইতে পারি না; কারণ আমার সহিত এই বন্ধুটী আছেন, ইহাকে এই স্থানে রাখিয়া যাইতে পারিব না, অথচ ইহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতেও ইচ্ছা করি না। যদি তোমার কোন বিশেষ আবশ্যক থাকে, তাহা হইলে তুমি আমাদিগের বাটীতে যাইয়া, দেওয়ানজিকে বলিলেই তোমার উদ্দেশ্য সাধন হইবে।”

 কেদার বাবু এই সময়ে আমাকে আস্তে আস্তে বলিলেন,—“এই বাড়ীটী আমাদিগের, উহারা আমাদিগের প্রজা। বোধ হয় কোন প্রকার কষ্ট হইয়াছে বা কেহ উহাদিগের উপর কোনও রূপ অত্যাচার করিয়াছে, তাহাই বলিবার নিমিত্ত আমাকে ডাকিতেছে।”

 ঐ স্ত্রীলোকটী পুনরায় বলিল, “কেদার বাবু! বিশেষ আবশ্যক না থাকিলে আমি আপনাকে ডাকিতাম না, আপনাদিগের বাটীতে যাইতাম। বিশেষ আপনার সহিত একটী ভদ্রলোক রহিয়াছেন দেখিতেছি। তবে নিতান্ত দায়ে পড়িয়াছি, এই জন্য পুনরায় বলিতেছি, যদি আপনার বিশেষ কোন প্রতিবন্ধক না থাকে, তাহা হইলে অনুগ্রহ করিয়া অন্ততঃ দুই মিনিটের নিমিত্ত একবার উপরে আসিলে বিশেষ বাধিত হইব। আর আপনার সঙ্গী ভদ্রলোকটীকেও সঙ্গে লইয়া আসুন। কেবল একটীমাত্র কথা শুনিয়া চলিয়া যাইবেন—বিলম্ব হইবার কোন কারণই নাই।”

 কেদার বাবু আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “চল ভাই, স্ত্রীলোকটী কি বিপদে পড়িয়াছে, একবার যাইয়া দেখিয়া আসি; কিন্তু কোন ক্রমেই দুই মিনিটের অধিক বিলম্ব করিব না।” আমি প্রথমে যাইতে অস্বীকার করিলাম; পরে কেদার বাবুর অনুরোধ কোন প্রকারে লঙ্ঘন করিতে পারিয়া আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতে স্বীকৃত হইলাম; কিন্তু ভাবিতে লাগিলাম, ‘বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেই যেন কিরূপ ঘোর বিপদে পতিত হইতে হইবে।’ এক পা দুই পা করিয়া কেদার বাবুর সহিত বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাল্যকাল হইতে আমার যেরূপ বিশ্বাস ছিল, সে প্রকার কোনরূপ বিপদ দেখিতে পাইলাম না।

 আমি যে কি কুলগ্নে এই বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, তাহা তখন বুঝিতে পারিলাম না, পরে কিন্তু বুঝিয়াছিলাম। কেদারের উপর আমার অটল বিশ্বাস ও ভালবাসার ফল ক্রমে ফলিয়াছিল। তিন বৎসর পূর্ব্বের রোপিত বীজের অঙ্কুরের লক্ষণ অদ্য হইতে প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইল।