ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

 জমীদার মহাশয়ের বাটীতে ধূম পড়িয়া গেল, চারিদিকে আনন্দের ধ্বনি উঠিতে লাগিল, বন্ধুবান্ধবগণ নিমন্ত্রিত হইলেন, আহারাদি ও নৃত্য গীত চলিতে লাগিল। জমীদার মহাশয় সকলের সহিত আলাপ সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন এবং কোন কোন ব্যক্তিকে ঐ আজ্ঞাপত্র দেখাইতে লাগিলেন। নিমন্ত্রিতগণের মধ্যে একজন এই আজ্ঞাপত্রখানি নিজের হস্তে লইলেন এবং বারম্বার মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন; ইনি হাইকোর্টের একজন কৃতবিদ্য উকীল। অন্য আর একজন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এরূপ করিয়া কি দেখিতেছেন।” উকীল মহাশয় বলিলেন, “পূর্ব্বে আমি অন্য আর একজন রাজার আজ্ঞাপত্র দেখিয়াছি, কিন্তু তাহা অন্য প্রকার; এই জন্যই আমি বিশেষ করিয়া দেখিতেছি যে, পূর্ব্বে যে প্রকার ধরণের লেখা থাকিত, এখন তাহার পরিবর্ত্তন হইয়াছে।” এই বলিয়া উহা জমীদার মহাশয়কে ফিরাইয়া দিলেন এবং বলিলেন, “মহাশয় আমি সরকারী গেজেট লইয়া থাকি; যে দিবস এই বিষয় সেই গেজেটে ছাপা হইবেক, সেই দিবসের কাগজ মহাশয়ের নিকট পাঠাইয়া দিব; আপনি সেই কাগজটীও ইহার সঙ্গে রাখিয়া দিবেন।” জমীদার মহাশয় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি গেজেটে ছাপা হইবে?” তিনি বলিলেন, “গবর্ণমেণ্ট হইতে যখন যে কোন আজ্ঞা প্রচার হয়, তখনই তাহা সরকারী গেজেটে ছাপা হইয়া থাকে; নতুবা অপর সাধারণের জানিবার সুবিধা নাই।”

 আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, সমস্ত শুনিলাম; শুনিয়া অতিশয় চিন্তিত হইলাম। যদি সরকারী গেজেটে ছাপাইবার কোন প্রকার সুযোগ না করিতে পারি, তাহা হইলে সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িবে।

 এইরূপে ক্রমে ক্রমে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, এক মাস, দুই মাস, তিন মাস অতীত হইল। সরকারী গেজেটে কিছুই ছাপা হইল না, জমীদার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেই বলিতাম, “শীঘ্র ছাপা হইবে।” কিন্তু আমি কোনও প্রকারে সুযোগ করিতে পারিলাম না, সুতরাং ছাপাও হইল না। মধ্যে একদিন জমীদার মহাশয়কে বলিলাম, “আমি ছাপাখানায় গিয়াছিলাম, সে স্থানের হেড বাবুর সহিত কথাবার্ত্তা শেষ করিয়া আসিয়াছি, এখন আর কোন প্রকার বিলম্ব হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ যাহাতে কার্য্য শীঘ্র সম্পন্ন হয়, তাহার নিমিত্ত আমি ৫০০৲ পাঁচ শত টাকা তাহাকে দিতে স্বীকার করিয়া আসিয়াছি, তিনি টাকা পাইলেই, পর সপ্তাহের কাগজে প্রকাশ করিয়া দিবেন।” বলা বলা বাহুল্য যে, এই প্রকারে আরও ৫০০৲ শত টাকা হস্তগত করিলাম। পর সপ্তাহে ছাপা না হওয়াতে জমীদার মহাশয় আবার আমাকে বলিলেন; আর এক প্রকার উত্তর দিয়া তাঁহাকে বুঝাইলাম। তিনি এইরূপে বারম্বার আমাকে বলিতে বলিতে বিরক্ত হইয়া একদিবস সেই উকীলকে ডাকাইলেন এবং তাঁহাকে ঐ আজ্ঞাপত্র দিয়া বলিয়া দিলেন, “এতদিবস পর্য্যন্ত সরকারী গেজেটে ইহা কেন ছাপা হইল না, তুমি একবার নিজে যাইয়া তাহার কারণ জানিয়া আসিও।” তিনি আজ্ঞাপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন। আমি সমস্ত জানিতে পারিলাম; ভাবিলাম, আমার সমস্ত জুয়াচুরি এখনই প্রকাশ হইয়া পড়িবে, এবং নিশ্চয়ই জমীদার মহাশয় কুপিত হইয়া আমাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিবেন; তাহা হইলে আর আমার দুর্দ্দশার শেষ থাকিবে না।

 অধিক সময়ের নিমিত্ত এই ভাবনা যে আমার হৃদয়কে অধিকার করিতে পারিল, তাহা নহে, অতি অল্প সময় ব্যতিরেকে সেই ভাবনাকে আমার হৃদয়ে স্থান দিবার প্রয়োজন হইল না।

 সেই সময় পর্য্যন্তও জমীদার মহাশয়ের শরীর উত্তমরূপে সুস্থ না হওয়ায় প্রায় প্রত্যহই তাঁহাকে আমার প্রদত্ত ঔষধ সেবন করিতে হইত। সেবন করিবার নিমিত্ত যে ঔষধ আমি তাঁহাকে প্রত্যহ প্রদান করিতাম, আজ বাধ্য হইয়া আমাকে সেই ঔষধের কিছু পরিবর্ত্তন করিতে হইল। নিজের আলমারিতে যে সকল ঔষধ ছিল, তাহারই মধ্য হইতে কয়েকটী ঔষধ বাছিয়া লইয়া আজ জমীদার মহাশয়ের নিমিত্ত নূতন ঔষধ প্রস্তুত করিলাম। রাত্রিকালে সেবন করিতে কখনও একবারের অধিক ঔষধ তাঁহাকে প্রদান করি নাই, সুতরাং সেইরূপ একবার সেবনোপযোগী ঔষধ লইয়া নিজেই জমীদার মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি উহা নিয়মিতরূপে আমার সম্মুখে সেবন করিলে, তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া সেই রাত্রির নিমিত্ত আমি আমার বাড়ীতে গমন করিলাম।

 রাত্রি ১১টার সময় জানিলাম, একটী লোক আমাদিগের বাটীর দরজার সম্মুখে, দণ্ডায়মান হইয়া আমাকে ডাকাডাকি করিতেছে। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমি বাড়ীর বাহিরে আসিলাম, দেখিলাম, যে ব্যক্তি আমাকে ডাকিতেছিল, সে অপর কেহ নহে, আমার প্রভু—জমীদার মহাশয়ের দ্বারবান্। তাহার নিকট অবগত হইলাম, আমি তাঁহার বাটী পরিত্যাগ করিবার কিয়ৎক্ষণ পর হইতেই জমীদার মহাশয়ের পীড়া ক্রমেই প্রবলরূপ ধারণ করিতেছে। সেই নিমিত্তই তিনি আমাকে সেইস্থানে গমন করিবার নিমিত্ত এই দ্বারবানের দ্বারা অনুরোধ করিয়া পাঠাইয়াছেন।

 দ্বারবানের নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র আমি আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না। দ্রুতপদে জমীদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। কিন্তু সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া কি দেখিলাম? দেখিলাম—জমীদার মহাশয়ের ইহজীবনের অভিনয় শেষ হইয়াছে, তাঁহার অন্তিম কাল উপস্থিত!

 রাত্রি ১২টার সময় সেই হতভাগ্য জমীদার মহাশয়ের সাধের রঙ্গালয় বন্ধ হইল, তাঁহার জীবনের অভিনয় শেষ হইল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, স্ত্রীপুত্ত্র প্রভৃতি সকলকে অগাধ শোকসাগরে নিমগ্ন করিয়া, দেওয়ানি আদালতে উপস্থিত হইবার বিষম কষ্টের মস্তকে পদাঘাত করিয়া, এবং এই নীচাশয়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া, তিনি ইহ জগৎ পরিত্যাগ করিলেন।

 এই অসম্ভাবিত ও নৃশংস কার্য্য আমার দ্বারা সম্পন্ন হইল সত্য, কিন্তু এই সময়ে আমার পাষাণ হৃদয়েও একটু দুঃখের সঞ্চার হইয়াছিল। ইহা দুঃখ কি আক্ষেপ, তাহা জানি না; কারণ তাঁহার মরণে আমার ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্টই অধিক হইল দেখিলাম। তবে বুঝিলাম, কেবলমাত্র ৬০০০৲ হাজার টাকার লোেভের বশবর্ত্তী হইয়াই আমি আমার চির দিবসের দ্বার রুদ্ধ করিলাম। যখন বুঝিলাম, সামান্য টাকার নিমিত্ত আমার উপার্জ্জনের প্রধান পথ রুদ্ধ হইল, তখন ভয়ানক আক্ষেপ আসিয়া আমার হৃদয় আশ্রয় করিল।

 জমীদার মহাশয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যথারীতি সমাধা হইয়া গেল। তাঁহার মৃত্যুসম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ কাহারও হৃদয়ে উপস্থিত হইল না। এদিকে আজ্ঞাপত্রের কথা লইয়া আর কোনরূপ আন্দোলনও হইল না, বা সেই বিষয়ের অনুসন্ধানের আর কোনরূপ প্রয়োজনও রহিল না। যে সকল কাগজপত্র উকীলের নিকট ছিল, তাহা তাঁহারই নিকটে রহিয়া গেল।

 এই সময় হইতে জমীদার মহাশয়ের সহিত আমার সম্বন্ধ ঘুচিল। আমার চাকরি গেল। মাসে মাসে যে ২০০৲ দুই শত টাকা বেতন পাইতাম, তাহাও বন্ধ হইল।

 আমার উপার্জ্জনের পন্থা রুদ্ধ হইল; সুতরাং গোলাপকে তাহার নিয়মিত খরচের টাকা যেরূপ ভাবে দিয়া আসিতেছিলাম, তাহার আর সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ক্রমে খরচপত্র বন্ধ হইয়া যাওয়ায় প্রথমতঃ গোলাপ যেন সততই আমার উপর ক্রোধভাব প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল ও পরিশেষে সে আমাকে তাহার বাড়ী হইতে একেবারেই বাহির করিয়া দিল। সে যে প্রকৃতই আমাকে তাহার বাড়ীতে আর প্রবেশ করিতে দিবে না, তাহা কিন্তু আমি প্রথমে বুঝিতে না পারিয়া সেই সময়ে পাঁচ সাতদিবস আমি তাহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম। কিন্তু সে আমার সহিত সেই সময়ে যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিল এবং আমি তাহার যে সকল ব্যবহার সহ্য করিয়াছিলাম, তাহা যদি পাঠকগণ প্রত্যক্ষ করিতেন, তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেন যে, আমার মত নীচাশয় নর ইহজগতে অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। রক্ত-মাংস-নির্ম্মিত মনুষ্য-দেহ লইয়া এরূপ নৃশংস ব্যবহার কেহ যে কখন সহ্য করিতে সমর্থ হন, তাহা কেহই চিন্তা করিয়াও ধারণা করিতে পারেন না। আমি কিন্তু সেই অপমান সহ্য করিয়াও কয়েকদিবস গোলাপের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম, গোলাপ অন্তরের সহিত আমার উপর এরূপ কুব্যবহার করিতেছে না। কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সত্যই গোলাপ আমাকে তাহার বাড়ীর ভিতর আর প্রবেশ করিতে দিবে না। সেই সময় ইহাও জানিতে পারিয়াছিলাম, সেইস্থানে আমার মত আর একজন হতভাগার কপাল পুড়িতেছে।

 এই সময় আমার মন স্থির ছিল না, হিতাহিত জ্ঞান একেবারেই আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল। গোলাপের ব্যবহার ভাবিয়া ভাবিয়া আমি এক প্রকার পাগলের মত হইয়াছিলাম।