বিষয়বস্তুতে চলুন

তরুণের স্বপ্ন/চরিত্র-গঠন ও মানসিক উন্নতি

উইকিসংকলন থেকে

[দক্ষিণ-কলিকাতা সেবক সমিতির অন্যতম কর্ম্মী শ্রীমান্‌ হরিচরণ বাগচীকে লিখিত পত্রাংশ]

মান্দালয় জেল

তুমি যাহা লিখিয়াছ তাহা সত্য—খাঁটি কর্ম্মীর অভাব বড় বেশী। তবে যেরূপ উপাদান জোগাড় হয় তাহা লইয়াই কাজ করিতে হইবে। জীবন না দিলে যেমন জীবন পাওয়া যায় না—ভালবাসা না দিলে যেমন প্রতিদান ভালবাসা পাওয়া যায় না—তেমনি নিজে মানুষ না হইতে মানুষ তৈয়ারী করাও যায় না।

রাজনীতির স্রোত ক্রমশঃ যেরূপ পঙ্কিল হইয়া আসিতেছে, তাহাতে মনে হয় যে, অন্ততঃ কিছু কালের জন্য রাজনীতির ভিতর দিয়া দেশের কোনও বিশেষ উপকার হইবে না। সত্য এবং ত্যাগ—এই দুইটি আদর্শ রাজনীতি-ক্ষেত্রে যতই লোপ পাইতে থাকে, রাজনীতির কার্য্যকারিতা ততই হ্রাস পাইতে থাকে। রাজনীতিক আন্দোলন নদীর স্রোতের মত কখনও স্বচ্ছ, কখনও পঙ্কিল; সব দেশে এইরূপ ঘটিয়া থাকে। রাজনীতি অবস্থা এখন বাঙ্গলা দেশে যাহাই হউক না কেন, তোমরা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া সেবার কাজ করিয়া যাও।

· · · · ·

তোমার মনের বর্ত্তমান অশান্তিপূর্ণ অবস্থার কারণ কি তাহা তুমি বুঝিতে পারিয়াছ কি না জানি না—আমি কিন্তু বুঝিতে পারিয়াছি। শুধু কাজের দ্বারা মানুষের আত্মবিকাশ সম্ভবপর নয়। বাহ্য কাজের সঙ্গে সঙ্গে লেখা-পড়া ও ধ্যান-ধারণার প্রয়োজন। কাজের মধ্য দিয়া যেমন বাহিরের উচ্ছৃঙ্খলতা নষ্ট হইয়া যায় এবং মানুষ সংযত হয়, লেখা-পড়া ও ধ্যান-ধারণার দ্বারা যেরূপ inernal discipline; অর্থাৎ ভিতরের সংযম প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিতরের সংযম না হইলে বাহিরের সংযম স্থায়ী হয় না। আর একটি কথা, নিয়মিত ব্যায়াম করিলে শরীরের যেরূপ উন্নতি হয়—তেমনি নিয়মিত সাধনা করিলেও সদ্বৃত্তির অনুশীলন ও রিপুর ধ্বংস হইয়া থাকে। সাধনার উদ্দেশ্য দুইটি:—(১) রিপুর ধ্বংস, প্রধানতঃ কাম, ভয় ও স্বার্থপরতা জয় করা, (২) ভালবাসা, ভক্তি, ত্যাগ, বুদ্ধি, প্রভৃতি গুণের বিকাশ সাধন করা।

কামজয়ের প্রধান উপায় সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে মাতৃরূপ দেখা ও মাতৃভাব আরোপ করা এবং স্ত্রী-মূর্ত্তিতে (যেমন দুর্গা কালী) ভগবানের চিন্তা করা। স্ত্রী-মূর্ত্তিতে ভগবানের বা গুরুর চিন্তা করিলে মানুষ ক্রমশঃ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে ভগলানকে দেখিতে শিখে। সে অবস্থায় পৌঁছিলে মানুষ নিস্কাম হইয়া যায়। এই জন্য মহাশক্তিকে রূপ দিতে গিয়া আমাদের পূর্ব্ব-পুরুষেরা স্ত্রী-মূর্ত্তি কল্পনা করিয়াছিলেন। ব্যবহারিক জীবনে সকল স্ত্রীলোককে “মা” বলিয়া ভাবিতে ভাবিতে মন ক্রমশঃ পবিত্র ও শুদ্ধ হইয়া যায়।

ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা মানুষ নিঃস্বার্থ হইয়া পড়ে। মানুষের মনে যখনই কোন ব্যক্তি বা আদর্শের প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি বাড়ে তখন ঠিক সেই অনুপাতে স্বার্থপরতাও কমিয়া যায়। মানুষ চেষ্টার দ্বারা ভক্তি ও ভালবাসা বাড়াইতে পারে এবং তার ফলে স্বার্থপরতাও কমাইতে পারে। ভাল বাসিতে বাসিতে মনটা ক্রমশঃ সকল সঙ্কীর্ণনতা ছাড়াইয়া বিশ্বের মধ্যে লীন হইতে পারে। তাই ভালবাসা, ভক্তি বা শ্রদ্ধার যে-কোন বস্তু-বিষয়ের ধ্যান বা চিন্তা করার দরকার। মানুষ যাহা চিন্তা করে ঠিক সেইরূপ সে হইয়া পড়ে। নিজেকে 'দুর্ব্বল পাপী' যে ভাবে সে ক্রমশঃ দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, যে নিজেকে শক্তিমান ও পবিত্র বলিয়া নিত্য চিন্তা করে সে শক্তিমান ও পবিত্র হইয়া উঠে। “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।”

ভয় জয় করার উপায় শক্তিসাধনা। দুর্গা, কালী প্রভৃতি মূর্ত্তি শক্তির রূপবিশেষ। শক্তির যে কোন রূপ মনে মনে কল্পনা করিয়া তাঁহার নিকট শক্তি প্রার্থনা করিলে এবং তাঁহার চরণে মনের দুর্ব্বলতাও মলিনতা বালস্বরূপ প্রদান করিলে মানুষ শক্তিলাভ করিতে পারে। আমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি নিহিত হইয়াছে, সেই শক্তির বোধন করিতে হইবে। পূজার উদ্দেশ্য—মনের মধ্যে শক্তির বোধন করা। প্রত্যহ শক্তিরূপ ধ্যান করিয়া শক্তিকে প্রার্থনা করিবে এবং পঞ্চেন্দ্রিয় ও সকল রিপুকে তাঁহার চরণে নিবেদন করিবে। পঞ্চপ্রদীপ অর্থ পঞ্চেন্দ্রিয়। এই পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে মায়ের পূজা হইয়া থাকে। আমাদের চক্ষু আছে তাই আমরা ধূপ, গুগ্‌গুল প্রভৃতি সুগন্ধি জিনিষ দিয়া পূজা করি ইত্যাদি। বলির অর্থ রিপু বলি—কারণ ছাগই কামের রূপবিশেষ।

সাধনার একদিকে রিপু ধ্বংস করা, অপর দিকে সদ্‌বৃত্তির অনুশীলন করা। রিপুর ধ্বংস হইলেই সঙ্গে সঙ্গে দিব্যভাবের দ্বারা হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিবে। আর দিব্যভাব হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিলেই সকল দুর্ব্বলতা পলায়ন করিবে।

প্রত্যহ (সম্ভব হইলে) দুইবেলা এইরূপ ধ্যান করিবে। কিছুদিন ধ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তি পাইবে, শান্তিও হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবে।

আপাততঃ স্বামী বিবেকানন্দের এই বইগুলি পড়িতে পার। তাঁহার বই-এর মধ্যে 'পত্রাবলী' ও বক্তৃতাগুলি বিশেষ শিক্ষাপ্রদ। 'ভারতে বিবেকানন্দ' বই-এর মধ্যে এ সব বোধ হয় পাইবে। আলাদা বইও বোধ হয় পাওয়া যায়। 'পত্রাবলী' ও বক্তৃতাগুলি না পড়িলে অন্যান্য বই পড়িতে যাওয়া ঠিক নয়। 'Philosophy of Religion', 'Jnan-Yoga' বা ঐ জাতীয় বইতে আগে হস্তক্ষেপ করিও না। তারপর সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত' পড়িতে পার। রবিবাবুর অনেক কবিতার মধ্যে খুব inspiration পাওয়া যায়। ডি, এল, রায়ের অনেক বই আছে (যেমন 'মেবার পতন', 'দুর্গাদাস') যা পড়িলে বেশ শক্তি পাওয়া যায়। বঙ্কিমবাবুর ও রমেশ দত্তের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিও খুব শিক্ষাপ্রদ; নবীন সেনের 'পলাশীর যুদ্ধ'ও পড়িতে পার। 'শিখের বলিদান'ও (বোধ হয় শ্রীমতী কুমুদিনী বসু লিখিত) ভাল বই; Victor Hugoর 'Les Miserables' পড়িও (বোধ হয় লাইব্রেরীতে আছে), খুব শিক্ষা পাইবে। তাড়াতাড়িতে এখন বেশী নাম দিতে পারিলাম না। আমি অবসরমত চিন্তা করিয়া একটী তালিকা করিয়া পাঠাইব। ইতি—

মান্দালয় জেল

স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য তুমি যদি প্রত্যহ কিছু ব্যায়াম-চর্চ্চা কর, তবে খুব উপকার পাবে। Muller-এর “My System” বই জোগাড় ক'রে যদি তদনুসারে ব্যায়াম কর তবে ভাল হয়। আমি নিজে মধ্যে মধ্যে Muller-এর ব্যায়াম ক'রে থাকি এবং উপকার ও পেয়েছি। Muller-এর ব্যায়ামের বিশেষত্ব এই:—(১) কোনও খরচ লাগে না এবং ব্যায়াম করবার জন্য জায়গা খুব কমই লাগে, (২) ব্যায়াম করলে অতিরিক্ত পরিশ্রম হয় না এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে কোনও বিপদের আশঙ্কা নাই, (৩) শুধু অঙ্গবিশেষের পরিচালনা না হয়ে সমস্ত শরীরের, মাংসপেশীর চালনা হয়, (৪) পরিপাক-শক্তি বৃদ্ধি হয়।

আমার মনে হয় যে, আমাদের দেশে—বিশেষতঃ ছাত্র-সমাজে—যদি মুলারের ব্যায়ামের বহুল প্রচলন হয় তা হইলে খুব উপকার হবে!

মানুষের দৈনন্দিন কাজ করেই সন্তুষ্ট বোধ করলে চলবে না। এই সব কাজ-কর্ম্মের যে উদ্দেশ্য বা আদর্শ অর্থাৎ আত্মবিকাশ-সাধন—সে কথা ভুললে চলবে না। কাজটাই চরম উদ্দেশ্য নয়; কাজের ভিতর দিয়ে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং জীবনের সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করতে হবে। মানুষকে অবশ্য নিজের ব্যক্তিত্ব ও প্রবৃত্তি অনুসারে এক দিকে বৈশিষ্ট্য লাভ করতে হবে; কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের মূলে (specialization) একটা সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশ চাই। যে ব্যক্তির সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি হয় নাই সে অন্তরে কখনও সুখী হতে পারে না; তার মনের মধ্যে সর্ব্বদা একটা শূন্যতা বা অভাববোধ শেষ পর্য্যন্ত রয়ে যায়। এই সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য চাই:—(১) ব্যায়াম-চর্চ্চা (২) নিয়মিত পাঠ (৩) দৈনিক চিন্তা বা ধ্যান। কাজের চাপে মধ্যে মধ্যে এ সব দিকে দৃষ্টি থাকে না বা দৃষ্টি থাকলেও সময় হয়ে ওঠে না। কিন্তু কাজের চাপ কমলেই আবার এই সব দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দৈনিক কাজ-কর্ম্ম করে নিশ্চিন্ত হলে চলবে না; তার মধ্যে ব্যায়ামের সময় এবং লেখা-পড়া ও ধ্যান-ধারণারও সময় করে নিতে হবে। এই তিনটী অতি প্রয়োজনায় কাজের জন্য মানুষ যদি অন্ততঃপক্ষে প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা বা দু' ঘণ্টা সময় দিতে পারে, তা হ'লে খুব উপকার হবে। মুলার বলেন যে, যদি কোনও ব্যক্তি নিয়মিতভাবে প্রতিদিন পনর মিনিট করে তাঁর উপদেশানুসারে ব্যায়াম করে তা হলেই যথেষ্ট। তারপর মানুষ যদি প্রতিদিন পনর মিনিট করে নির্জ্জনে চিন্তা বা ধ্যান করে—তবে মোট সময় লাগবে আধা ঘণ্টা। এর সঙ্গে যদি আর এক ঘণ্টা লেখা-পড়ার জন্য রাখা যায় (খবর-কাগজ পড়া নয়—খবর-কাগজ পড়বার সময় আলাদা ধরতে হবে)—তবে দিনের মধ্যে মোট সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। অন্ততঃপক্ষে এই দেড় ঘণ্টা সময় করে নিতে হবে—তার পর “অধিকন্তু ন দোষায়"—যত বেশী সময় দিতে পার—তত ভাল। প্রত্যেককে নিজের সুবিধা অনুসারে এই সময় করে নিতে হবে। ধ্যান ধারণার বিষয়ে আমি বোধ হয় পূর্ব্ব পত্রে কিছু লিখেছি—তাই সে সম্বন্ধে এখানে আর কিছু লিখলাম না। বইগুলির নাম আমি এই পত্রে দিচ্ছি। প্রথমে যে বইগুলি সমিতির লাইব্রেরীতে পাবে তার নাম দিচ্ছি—তারপর অন্যান্য বইয়ের নাম দিচ্ছি:—

(ক) ধর্ম্মসম্বন্ধীয়

(১) 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত'; (২) 'ব্রহ্মচর্য্য'—সুরেন্দ্র ভট্টাচার্য্য; ঐ—রমেশ চক্রবর্ত্তী; ঐ—ফকিরচন্দ্র দে; (৩) 'স্বামী-শিষ্য সংবাদ'—শরৎ চক্রবর্ত্তী; (৪) 'পত্রাবলী'—বিবেকানন্দ; (৫) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য—বিবেকানন্দ; (৬) 'বক্তৃতাবলী'—বিবেকানন্দ; (৭) ভাব্‌বার কথা'—ঐ; (৮) 'ভারতের সাধনা'—স্বামী প্রজ্ঞানন্দ; (৯) 'চিকাগো (chicago) বক্তৃতা'—স্বামী বিবেকানন্দ।

(খ) সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস প্রভৃতি:—

(১) 'দেশবন্ধু গ্রন্থাবলী' (বসুমতী সংস্করণ); (২) 'বাঙ্গলার রূপ' —গিরিজাশঙ্কর রায় চৌধুরী; (৩) 'বঙ্কিম গ্রন্থাবলী'; (৪) নবীন সেনের 'কুরুক্ষেত্র', 'প্রভাস', 'রৈবতক” ও 'পলাশীর যুদ্ধ'; (৫) 'যোগেন্দ্র গ্রন্থাবলী' (বসুমতী সংস্করণ); (৬) রবি ঠাকুরের 'কথা ও কাহিনী', 'চয়নিকা', 'গীতাঞ্জলি', 'ঘরে বাইরে', 'গোরা'; (৭) ভূদেববাবুর 'সামাজিক প্রবন্ধ' ও 'পারিবারিক প্রবন্ধ; (৮) ডি, এল্‌, রায়ের 'দুর্গাদাস', 'মেবার পতন', 'রাণা প্রতাপ', (৯) 'ছত্রপতি শিবাজী'—সত্যচরণ শাস্ত্রী; (১০) 'শিখের বলিদান'—কুমুদিনী বসু; (১১) রাজনারায়ণ বসুর 'সেকাল ও একাল'; (১২) সত্যেন দত্তের কুহু ও কেকা' (কবিতা গ্রন্থ); (১৩) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের 'আত্মজীবনচরিত' (১৪) 'রাজস্থান' (বসুমতী সংস্করণ); (১৫) 'নব্য জাপান'—মন্মথ ঘোষ; (১৬) 'সিপাহী-যুদ্ধের ইতিহাস'—রজনীকান্ত গুপ্ত; (১৭) উপেনবাবুর 'নির্ব্বাসিতের আত্মকথা' ও অন্যান্য পুস্তক; (১৮) 'কর্ণেল সুরেশ বিশ্বাস'—উপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুপাঠ্য ৶৹ আনা সংস্করণের ভারতের অনেক মহাপুরুষের ছোট ছোট জীবনী পাবে।

এই বইর তালিকা যথেষ্ট। অন্ততঃপক্ষে এক বৎসরের খোরাক এর মধ্যে পাবে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু বলি।

প্রাথমিক শিক্ষার সহিত উচ্চ শিক্ষার একটা বড় প্রভেদ এই যে প্রাথমিক শিক্ষার নূতন facts শিখাবার চেষ্টাই বেশী প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষার নূতন facts যেরূপ শিখাতে হয় তার সঙ্গে সঙ্গে reasoning faculty-র অনুশীলনও সেইরূপ করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় ইন্দ্রিয়শক্তির উপর বেশী নির্ভর করতে হয়, কারণ তখন চিন্তা করবার বা মনে রাখবার শক্তি ভাল রকম জাগে। সে জন্য কোনও বিষয় শেখাতে গেলে যেমন গরু, ঘোড়া, ফল, ফুল, সেই জিনিষগুলি চোখের সামনে না ধরলে শেখান মুস্কিল। উচ্চ শিক্ষায় এমন বিষয় বা বস্তু শেখান হয় যা ছাত্র কখনও দেখে নাই এবং ছাত্র সেই বস্তু না দেকেও নিজের চিন্তা-শক্তির বলে তা বুঝতে পারে। আর একটা কথা—শেখাবার সময়ে যত বেশী ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নেওয়া যায়—তত সহজে শেখান সম্ভব। বাঁশী বা কোনও রকম বাজনা সম্বন্ধে যদি কিছু বোঝাতে চাও—তবে ছাত্র যদি জিনিষটা চোখে দেখে, হাতে স্পর্শ করে এবং বাজিয়ে তার আওয়াজ কানে শোনে, তবে সেই বিষয়ে তার জ্ঞান খুব শীঘ্র লাভ হবে। কারণ দৃষ্টিশক্তি, স্পর্শশক্তি, এবং শ্রবণশক্তি সে এক সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। কোলের শিশু যে-কোনও জিনিষ দেখবামাত্র স্পর্শ করতে চায় এবং মুখে দিতে চায়—তার কারণ এই যে, শিশু সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বাহ্য বস্তুর জ্ঞান লাভ করতে চায়। অতএব প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে আমরা যদি সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জ্ঞান জন্মাতে পারি তবে ফল লাভ খুব শীঘ্র হবে। পাটীগণিত শেখাবার সময়ে শুধু মুখস্থ না করিয়ে যদি কড়ি, marble অথবা ইট পাথরের টুকরা দিয়ে আমরা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ প্রভৃতির উদাহরণ দেখাতে পারি তবে সেই সব জিনিষ শিশুরা খুব শীঘ্র শিখতে পারবে।

আর একটা বড় কথা—শুধু মানসিক শিক্ষা না দিয়ে শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে করা চাই। পুতুল তৈয়ারী করা, মানচিত্র মাটী দিয়ে তৈরী করা, ছবি আঁকা, রঙের ব্যবহার, সহজ গান শিক্ষা—এ সবের ব্যবস্থা করা চাই। ইহা দ্বারা শিক্ষাটা যে শুধু সর্ব্বাঙ্গীন হবে তা নয়—সঙ্গে সঙ্গে লেখা-পড়ারও বিশেষ উন্নতি হবে। পাঁচ রকম জিনিষ শেখাতে পারলে ছেলেদের মনটা সজাগ হয়, বুদ্ধি বাড়ে, লেখা-পড়ায় মন লাগে—এবং লেখা-পড়ার নাম শুনলে ভীতির উদ্রেক হয় না। পাঁচ রকম জিনিষ না শিখে ছাত্র যদি কেবলি মুখস্থ ক’রে লেখা-পড়া শিখিতে আরম্ভ করে, তবে সে লেখা-পড়ার মধ্যে রস পায় না, লেখা-পড়াকে ভয় করতে শেখে এবং তার বুদ্ধি বিকশিত হয় না। শিশুর চোখ, কান, হাত, জিহ্বা, নাক যদি উপভোগের এবং জানবার বস্তু পায়, তবে এই সব ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে, এর ফলে মনেও বুদ্ধি জাগরিত হয় এবং সকল রকম জ্ঞান সংগ্রহের ফলে লেখা-পড়ার সে রস পায়। Manual training না হ'লে শিক্ষার গোড়ায় গলদ রয়ে যায়। নিজের হাতে কোনও জিনিষ প্রস্তুত করলে যেরূপ আনন্দ পাওয়া যায়, সেরূপ আনন্দ পৃথিবীতে খুব অল্পই পাওয়া যায়। সৃষ্টির মধ্যে গভীর আনন্দ নিহিত রয়েছে। সেই joy of creation শিশুরা অল্প বয়সেই উপভোগ করে যখন তারা নিজের হাতে কোনও বস্তু তৈয়ারী করে। বাগানে বীজ পুঁতে গাছের সৃষ্টির দ্বারাই হোক, অথবা নিজের হাতে পুতুল তৈয়ারী করেই হোক, যে-কোনও বস্তু নূতন করে সৃষ্টি করতে পারলে শিশুরা গভীর আনন্দ উপভোগ করে। যে সব উপায়ে ছাত্রেরা এই আনন্দ অল্প বয়সেই উপভোগ করতে পারবে তার ব্যবস্থা করা চাই। এর দ্বারা তাদের originality বা ব্যক্তিত্বের বিকাশের সুবিধা হবে এবং লেখা-পড়াকে ভয় না করে তারা উপভোগ করতে শিখবে। বিলাতে অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রেরা বাগানের কাজ শেখে, ব্যায়াম-চর্চ্চা করে, drill করে, পড়ার মাঝখানে খেলাধূলা করে, গান বাজনা শেখে, route march ক'রে পথে পথে সঙ্ঘবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়ায়, clay-modelling (মাটি দিয়ে পুতুল প্রভৃতি তৈয়ারী করা) শেখে, গল্পচ্ছলে নানা বিষয় এবং নানা দেশের কথা শেখে। গল্পচ্ছলে শেখান সব চেয়ে বেশী দরকার। ছাত্রেরা যেন না বুঝতে পারে যে তারা লেখা-পড়া শিখছে, তারা যেন অনুভব করে যে, তারা গল্প শুনছে অথবা খেলা করছে। প্রথমাবস্থায় Text Book-এর আদৌ প্রয়োজন নাই। গাছ-পালা, ফুল প্রভৃতি সম্বন্ধে যখন শেখাবে তখন যেন সামনে গাছ-পালা এবং ফুল থাকে। আকাশ, তারা প্রভৃতি সম্বন্ধে যখন শেখাবে তখন মুক্ত আকাশের তলে নিয়ে গিয়ে তাদের শিক্ষা দিবে। যে জিনিষই শেখাবে তা যেন সকল ইন্দ্রিয়ের সামনে উপস্থিত থাকে। যখন ভূগোল শিখাবে তখন মানচিত্র, globe প্রভৃতি যেন থাকে, ইতিহাস যখন শেখাবে তখন সুবিধামত museum প্রভৃতি স্থানে নিয়ে যাবে। খুব গরীব চালেও গান শিক্ষা, painting, drawing প্রভৃতি শিক্ষা, gardening শিক্ষা প্রভৃতি চাই। তা না হলে প্রাথমিক শিক্ষা একেবারে ব্যর্থ। বস্তুজ্ঞানই বেশী দরকার। পাঠ মুখস্থের তত বেশী প্রয়োজন নাই।

আমি প্রাথমিক শিক্ষার principles বা নীতি বিষয়ে কিছু বললুম। Text Book-এর কথা হচ্ছে ক'রেই বলি নাই। Text Book-এর প্রয়োজন কম এবং পাঠ্যপুস্তক যেগুলি রাখতে হবে সেগুলির importance কম, ভাল শিক্ষক না হলে প্রাথমিক শিক্ষা সার্থক হতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষার fundamental principles সর্ব্বপ্রথমে শিক্ষককে বুঝতে হবে। তারপর তিনি নূতন প্রণালীতে শিক্ষা-প্রবর্ত্তন করতে পারবেন। শিক্ষকের অন্তরের ভালবাসা ও সহানুভূতির দ্বারা শিক্ষককে ছাত্রের দিক থেকে সব জিনিষ দেখতে হবে। ছাত্রের অবস্থা যদি শিক্ষক নিজেকে কল্পনা না করতে পাবে, তবে সে কি করে ছাত্রের difficulty এবং ভুলভ্রান্তি বুঝতে পারবে? সুতরাং personality of teacher হচ্ছে সব চেয়ে বড়। শিক্ষার প্রধান উপাদান তিনটী:—(১) শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব (২) শিক্ষার প্রণালী (৩) শিক্ষার বিষয় ও পাঠ্য-পুস্তক। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব না থাকলে কোনও শিক্ষা সম্ভবপর নয়। চরিত্রবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া গেলে তারপর আমাদের শিক্ষার প্রণালী নির্দ্ধারিত হয়, তবে যে-কোনও বিষয়ক পুস্তক সহজে শেখান যেতে পারে।

· · · · ·

আশা করি তোমাদের কুশল। ইতি—

মান্দালয় জেল ইং ৬।২।২৬

তোমার পত্র যথাসময়ে পাইয়াছি। উত্তর দিতে বিলম্ব হইল বলিয়া কিছু মনে করিও না। আশা করি তুমি সকল প্রকার মানসিক অশান্তি দূর করিয়া প্রফুল্লভাবে সকল কর্ত্তব্য করিয়া যাইবে। Milton বলিয়াছেন—"The mind is its own place and can make a hell of heaven and a heaven of hell.” অবশ্য এ কথা কার্য্যে পরিণত করা সব সময়ে সম্ভব হয় না; কিন্তু আদর্শ সব সময় চোখের সামনে না রাখিলে জীবনে অগ্রসর হওয়া একেবারে অসম্ভব। জীবনের কোনও অবস্থাই অশান্তিহীন নহে—এ কথা ভুলিলে চলিবে না।

আমার মুক্তির কথা আমি আর ভাবি না—তোমরাও ভাবিও না। ভগবানের কৃপায় আমি এখানে মানসিক শান্তি পাইয়াছি। প্রয়োজন হইলে এখানে সমস্ত জীবন কাটাইয়া দিতে পারি—এরূপ শক্তি পাইয়াছি বলিয়া মনে হয়। আমার শুভ ইচ্ছার কোনও প্রভাব নাই; কিন্তু বিশ্বজননীর শুভ ইচ্ছা ও আশীর্ব্বাদ তোমাকে বর্ম্মের মত সর্ব্বদা আচ্ছাদন করিয়া রাখুক—ইহাই আমার একান্ত প্রার্থনা। আমি কি লিখিব—বিশ্বজননীতে বিশ্বাস ও ভরসা রাখিও—তুমি তাঁর কৃপায় সকল বিপদ ও মোহ উত্তীর্ণ হইতে পরিবে। মনের মধ্যে সুখ ও শান্তি না থাকিলে কোনও অবস্থায় (বাহিরের অভাব দূর হইলেও) মানুষ সুখ হইতে পারে না। সুতরাং সাংসারিক সকল কর্ত্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজননীর চরণে হৃদয় নিবেদন করা চাই। ইতি—

৪

[তদানান্তর 'আত্মশক্তি'-সম্পাদক শ্রীযুক্ত গোপাললাল সান্যালকে লিখিত পত্রাংশ]

ইনসিন জেল ৫ই এপ্রিল, ১৯২৭

পরম প্রীতিভাজনেষু,

আপনার ৫ই চৈত্রের পত্র পাইয়া আনন্দিত হইয়াছি। অনেক প্রশ্ন করিয়াছেন—কি উত্তর দিব জানি না। অনেক কথাই ত লিখিতে ইচ্ছা! করে, কিন্তু লেখা যায় কি?

শরীরের সম্বন্ধে নূতন কিছু বলিবার নাই—"যথা পূর্ব্বং তথা পরং"। পরিণামে কি দাঁড়াইবে, জানি না—এখন আর শরীরের কথা ভাবি না। গত কয়েক মাসের মধ্যে আমার মনের গতি কোনও কোনও দিকে দ্রুতবেগে চলিয়াছে। আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হইতেছে যে, জীবনে ষোল আনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত না হইলে মেরুদণ্ড ঠিক রাখা মুস্কিল হইয়া পড়ে। জীবন-প্রভাতে এই প্রার্থনা বুকে লইয়া কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলাম—"তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।” ভবিষ্যতের কথা জানি না, তবে এখন পর্য্যন্ত ভগবান সে প্রার্থনা সফল করিয়া আসিতেছেন। তাই আমি বড় সুখী—সময়ে সময়ে মনে হয়, আমার মত সুখী জগতে আর কয়জন আছে? এখন এই বৃত্তাকার উন্নত প্রাচীরের বাহিরে যাইবার আশা যে পরিমাণে সুদূরপরাহত হইতেছে, সেই পরিমাণে আমার চিত্ত শান্ত ও উদ্বেগশূন্য হইয়া আসিতেছে। অন্তরের মধ্যে বাস করা ও অন্তরের আত্মবিকাশের স্রোতে জীবনতরী ভাসাইয়া দেওয়ার মধ্যে পরম শান্তি আছে এবং বেশী দিন রুদ্ধ অবস্থায় বাস করিতে হইলে অন্তরের শান্তিই একমাত্র সম্বলি—তাই সুদীর্ঘ কারাবাসের সম্ভাবনায় আমি এক অপূর্ব্ব শান্তি পাইতেছি। Emerson বলিয়াছেন, “We must live wholly from within.” এ-কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য এবং এই সত্যের উপর আমার বিশ্বাস দিন দিন দৃঢ়তর হইতেছে।

আমার মত যাঁহাদের অবস্থা তাঁহারা যদি বাহিরের ঘটনার দ্বারা জীবনের সার্থকতা বা বিফলতা নির্দ্ধারণ করেন তবে—"মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ"। যে মাপকাঠির দ্বারা আমাদের (অর্থাৎ বন্দীদের) বিচার করিতে হইবে—তাহা অন্তরের, বাহিরের নয়। কারণ বাহিরের মাপকাঠিতে হয় তো আমাদের জীবনের মূল্য শূন্যবৎ। এইখানেই যদি যবনিকাপাত হয় তবে বাস্তব সংসারের উপর আমাদের জীবনের স্থায়ী ছাপ না থাকিতেও পারে। কিন্তু জীবনে যদি আর কোনও কাজ না করিতে পারি—আদর্শকে বাস্তবের ভিতর দিয়া যদি ফুটাইয়া তুলিবার সুযোগ না পাই—তাহা হইলেও আমার জীবন ব্যর্থ হইবে না। মহান্‌ আদর্শ যদি প্রাণের মধ্যে গ্রহণ করিয়া থাকি—কায়মন যদি সেই মহান্‌ আদর্শের সুরে বাঁধিয়া থাকি—আদর্শের সহিত নিজের অস্তিত্ব যদি মিশিয়া থাকে—তাহা হইলে আমি সন্তুষ্ট—আমার জীবন জগতের কাছে ব্যর্থ হইলেও, আমার (এবং বোধ হয় ভাগ্যবিধাতার) কাছে ব্যর্থ নয়। জগতে সব কিছুই ক্ষণ-ভঙ্গুর—শুধু একটা বস্তু ভাঙ্গে না বা নষ্ট হয় না—সে বস্তু,—ভাব বা আদর্শ। আমাদের আদর্শ, সমাজের আশা আকাঙ্ক্ষা আমাদের চিন্তাধারা—অবিনশ্বর। ভাবকে প্রাচীরের দ্বারা কি কেহ। ঘিরিয়া রাখিতে পারে?

ষোল আনা দিতে হইলে অপর দিকে আদর্শকে ষোল আনা পাওয়া চাই। অথবা আদর্শকে ষোল আনা পাইতে হইলে নিজের ষোল আনা দেওয়া চাই। ত্যাগ ও উপলব্ধি—renunciation and realisation একই বস্তুর এ-পিঠ আর ও-পিঠি। এখন এই ষোল আনা পাওয়া ও ষোল আনা দেওয়ার জন্য আমার মনপ্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে।

যিনি এত দুর্ব্বলতার মধ্য দিয়া আমাকে শক্তির উচ্চ শিখরে লইয়া আসিয়াছেন—তিনি কি দয়া করিবেন না? উপনিষদে বলে, “যমেবৈষবৃণুতে তেন লভ্যঃ"—এখন দেখা যাক্‌।

Systematic study অনেক দিন হইল ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছি। জাতীয়তার ভিত্তিস্বরূপ কয়েকটা মূল-সমস্যার সমাধানের জন্য লেখা-পড়া ও গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলাম। আপাততঃ কাজ বন্ধ আছে। কবে আবার আরম্ভ করিতে পারিব জানি না। বাহিরে গেলে এই কাজ চাপা পড়িবে—তাই এখানে থাকিতে থাকিতেই কাজ শেষ করিবার ইচ্ছা ছিল। আমার কারাবাসের কাজ বোধ হয় এখনও সমাপ্ত হয় নাই—তাই বোধ হয় যাইবারও বিলম্ব আছে।

· · · · ·

ভগবান আপনাদের সকলকে কুশলে রাখুন এবং আপনাদের ক্রিয়াকলাপের উপর তাঁহার শুভ আশীষ নিরন্তর বর্ষিত হউক—ইহাই আমার একান্ত প্রার্থনা। ইতি—