বিষয়বস্তুতে চলুন

তরুণের স্বপ্ন/সমাজ-সেবা ও কুটীর শিল্প

উইকিসংকলন থেকে
সমাজ-সেবা ও কুটীর-শিল্প
[দক্ষিণ-কলিকাতা সেবক-সমিতির সহ-সম্পাদক শ্রীযুক্ত অনিলচন্দ্র বিশ্বাসের নিকট মান্দালয় জেল হইতে লিখিত পত্রগুলি অপ্রাসঙ্গিক অংশ বাদ দিয়া প্রকাশিত হইল।]
মানন্দালয় জেল

সবিনয় নিবেদন,

 আপনার পত্র পাইয়া ও সকল সমাচার অবগত হইয়া আনন্দিত হইলাম। কার্য্যকরী সমিতির খুব বেশী সভ্য সেবাশ্রমের কাজের দিকে দৃষ্টি দেন না বলিয়া আপনারা নিরাশ বা চিন্তিত হইবেন না। অধিকাংশ কার্য্যকারী সমিতিরই এইরূপ অবস্থা। আপনাদের নিজেদের সেবা ও আগ্রহাতিশয্যের দ্বারায় অপরের আগ্রহ ও সেবাপ্রবৃত্তি জাগাইতে হইবে। গ্রামের মধ্যে অপরের দুঃখে সমবেদনা ও সহানুভূতি না জাগিলে সেবাকার্য্য সম্ভবপর হয় না। অন্ততঃ সম্ভবপর হইলেও সার্থক হয় না। আপনাদের আত্যন্তিক সেবা ও জনপ্রীতির ফলে সমাজে অপরের হৃদয়েও তাদৃশভাব জাগরিত হইবে—ইহাই আমার ভরসা ও আকাঙ্ক্ষা।

 সেবাশ্রমের বাড়ীর সঙ্গে বাগান করিবার মত জমি আছে কি?

 মাসিক ১৪০৲ টাকা পর্য্যন্ত চাঁদা আদায় হয় শুনিয়া সুখী হইলাম। বাড়ী-ভাড়া এখন কত দিতে হয়? বাড়ী কয় তালা এবং মোট কয়খানা ঘর আছে? কর্পোরেসনের প্রাইমারি স্কুলে কয়জন ছাত্র হয় এবং কোন জাতির ছাত্র পড়িতে আসে? সেবাশ্রমের বালকদের কি শিক্ষা দেওয়া হয় তার বিস্তৃত বিবরণ আমাকে পাঠাইবেন, সেবাশ্রমের কোনও চাকর আছে কিনা এবং থাকিলে কয়জন চাকর আছে তাহা জানাইবেন। দৈনিক রন্ধন কে করে? বালকদের মধ্যে কয়জন তাঁতের ও Sewing machine-এর কাজ শিখিতেছে? কত দিনের মধ্যে অন্ততঃ একটী বালক কাপড় বুনিতে ও সেলাইর কাজ (মোটামুটি কোট ও পাঞ্জাবী তৈয়ারী করা) শিখিতে পরিবে বলিয়া ভরসা করেন?

 বালকদের average intelligence কি রকম? সেবাশ্রম সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব বিস্তৃত বিবরণ পাঠাইবেন, আমি তাহা পড়িয়া কিছু পরামর্শ দিবার চেষ্টা করিব। বালকদের আহারের কি রকম ব্যবস্থা আছে তার বিস্তৃত বিবরণও পাঠাইবেন। অসুখ-বিসুখ হইলে চিকিৎসার কিরূপ ব্যবস্থা আছে? চিকিৎসা বা ঔষধের জন্য খরচ লাগে কি না? ইতি—


মান্দালয় জেল

 আপনি বোধ হয় ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছেন যে, আমাদের অনশন-ব্রত একেবারে নিরর্থক বা নিষ্ফল হয় নাই। গভর্ণমেণ্ট আমাদের ধর্ম্ম বিষয়ে দাবী স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন এবং অতঃপর বাঙ্গলা দেশের রাজবন্দী পূজার খরচ বাবদ বাৎসরিক ত্রিশ টাকা allowance পাইবেন। ত্রিশ টাকা অতি সামান্য এবং ইহা দ্বারা আমাদের খরচ কুলাইবে না; তবে যে principle গভর্ণমেণ্ট এতদিন স্বীকার করিতে চান নাই তাহা যে এখন স্বীকার করিয়াছেন, ইহাই আমাদের সব চেয়ে বড় লাভ—টাকার কথা সর্ব্বক্ষেত্রে সর্ব্বকালে অতিতুচ্ছ কথা। পূজার দাবী ছাড়া আমাদের অন্যান্য অনেকগুলি দাবীও গভর্ণমেণ্ট পূরণ করিয়াছেন। বৈষ্ণবের ভাষায় কিন্তু বলিতে গেলে আমাকে বলিতে হইবে “ইহ বাহ্য”। অর্থাৎ অনশন-ব্রতের সব চেয়ে বড় লাভ, অন্তরের বিকাশ ও আনন্দ লাভ—দাবীপূরণের কথা বাহিরের কথা, লৌকিক জগতের কথা। Suffering ব্যতীত মানুষ কখনও নিজের অন্তরের আদর্শের সহিত অভিন্নতা বোধ করিতে পারে না এবং পরীক্ষার মধ্যে না পড়িলে মানুষ কখনও স্থির নিশ্চিন্ত ভাবে বলিতে পারে না, তাহার অন্তরে কত অপার শক্তি আছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে আমি নিজেকে এখন আরও ভালভাবে চিনিতে পারিয়াছি এবং নিজের উপর আমার বিশ্বাস শতগুণে বাড়িয়াছে।

* * * *

 Social Service-এর ভিতর দিয়া গৃহ-শিল্প প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আমাদিগকে করিতে হইবে। Commercial Museum, Bengal Home Industries Association প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বা দোকান ঘুরিয়া দেখিলে আমাদের মনে নূতন ভাব আসিতে পারে। বাঙ্গলা গভর্ণমেণ্টের শিল্প-বিভাগের বাৎসরিক বিবরণী (Administration Report of the Department of Home Industries) কয়েক বৎসর পাঠ করিলেও উপকার হইতে পারে। সর্ব্বোপরি যেখানে গৃহশিল্প চলিতেছে সেখানে গিয়া স্বচক্ষে কার্য্যপ্রণালী দেখা ও শিক্ষা করা প্রয়োজন। কুটার-শিল্প চালাইতে হইলে যে খুব বেশী টাকার প্রয়োজন হইবে তাহা আমার মনে হয় না। সর্ব্ব প্রথমে আমাদের দরকার সভ্যদের মধ্যে অন্ততঃ একজন ভদ্রলোক পাওয়া যিনি শুধু এই বিষয়ে চিন্তা করিবেন, খবর লইবেন এবং পুস্তকাদি পড়িবেন। তারপর যে সব কুটীর-শিল্প চালাইবার কিছু সম্ভাবনা আছে তিনি সেগুলি নিজে দেখিয়া আসিবেন। যখন শেষে কুটীর-শিল্পবিশেষ চালাইবার প্রস্তাব স্থির হইবে তখন কর্ম্মীকে পাঠাইয়া কাজ শিখাইয়া লইতে হইবে। Polytechnic Institute-এ আগাগোড়া কাহাকেও পড়াইবার প্রয়োজন দেখি না। Electroplating প্রভৃতি শিল্প সেখানে শিখিবার কোন প্রয়োজন আমি দেখি না। কারণ সেলাই-এর বিভাগ আমাদের নিজেদেরই আছে এবং কামারের কাজ অথবা Electroplating-এর কাজ আপাততঃ সমিতির কর্ম্মীকে শিখাইয়া কোনও লাভ হইবে না। আমার যতদূর স্মরণ আছে (আমি মাত্র একবার Polytechnic-এ গিয়াছি) Polytechnic-এর সমস্ত শিল্পের মধ্যে একমাত্র বেতের কাজ অথবা মাটীর পুতুলের কাজ আমরা কুটীর-শিল্প হিসাবে চালাইতে পারি—ইহার মধ্যেও আমি বেতের কাজ সম্বন্ধে কতকটা সন্দিহান, কারণ স্ত্রীলোকদের দ্বারা একাজ আমরা করাইতে পারিব কি না ঠিক বলিতে পারি না। এখন যদি শেষে মাটীর পুতুলের কাজ চালাইবার প্রস্তাব গৃহীত হয় তবে যে-কোনও কর্ম্মী কয়েকদিনের মধ্যেই এ-কাজ শিখিয়া আসিতে পারে। খরচ কিছুই লাগিবে না এবং আমরা যখন কুটীর-শিল্প আরম্ভ করিব তখন মাত্র রংএর জন্য কিছু নগদ টাকা খরচ হইবে। ইহা ব্যতীত আর খুব কম খরচই লাগিবে। মোট কথা, একজনকে শুধু এই সমস্যা লইয়া পড়িয়া থাকিতে হইবে—He must become mad over it.

 আর একটা কথা আমার বার বার মনে আসে-পূর্ব্বেও বোধ হয় এ বিষয়ে লিখিয়াছি—ঝিনুকের বোতাম তৈরী করা। ঢাকা জেলার অনেক গ্রামে এই শিল্প ঘরে ঘরে চলিতেছে। গরীব গৃহস্থের বাড়ীর স্ত্রী-পুরুষেরা তাহাদের অবসর সময়ে এই কাজ করিয়া থাকে। একজন কর্ম্মীকে খুব অল্পদিনের মধ্যে এই কাজ শিখান যাইতে পারে। অথবা এই কাজ জানে এবং শিখাইতে পারে এমন একজন নূতন কর্ম্মীকে আপনারা নিযুক্ত করিতে পারেন।

 খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া আপনারা এরূপ কর্ম্মীকে আকর্ষণ করিতে পারেন। আমার নিজের মনে হয় যে, পাথরের গায়ে ঘসিয়া বোতাম তৈরী করা যায়—আমরা নিজেরা ইচ্ছা করিলে তৈয়ার করিতে পারি। শুধু সরু যন্ত্র একটা থাকিলে গর্ত্ত করা যায় এবং হয় তো গোল করিয়া কাটিবার জন্য একটা ধারাল যন্ত্রের প্রয়োজন হইতে পারে। সমিতি হইতে কয়েকটা যন্ত্র এবং এক বস্তা ঝিনুক আনাইয়া দিলে কাজ আরম্ভ করিতে পরিবেন। কাজটা সাহায্য-প্রার্থীদের মধ্যে আবদ্ধ হইবে কিন্তু একবার কৃতকার্য্য হইলে দেখিবেন যে, সাধারণ গরীব গৃহস্থের নিজেদের আয় বাড়াইবার জন্য এই কাজ আরম্ভ করিবে। সমিতি শুধু সস্তা দরে raw materials প্রভৃতি জোগাইবে এবং প্রস্তুত জিনিষ বেশী দরে বিক্রয় করিবার ব্যবস্থা করিবে। এই বিষয়ে কাজ আরম্ভ করিতে হইলে প্রথম দিকটা খুব বেশী সময় দিতে হইবে। ইতি—
মান্দালয় জেল

 আপনি পূর্ব্বে যে সব কাগজ পাঠাইয়াছিলেন, (মহাত্মাজীর অভ্যর্থনা-পত্র, দেশবন্ধুর স্মৃতিভাণ্ডারের জন্য যে সম্মিলনী হইয়াছিল তাহার কার্য্যসূচী ইত্যাদি) তাহা যথাসময়ে পাইয়াছিলাম। গত কাল আবার আপনার প্রেরিত লাইব্রেরীর পুস্তক-তালিকা (Variety Entertainment-এর কার্য্যসূচী ইত্যাদি) পাইয়াছি। সমিতির কাজ যে দিন দিন প্রসার লাভ করিতেছে, তাহাতে আমি যে কিরূপ আনন্দিত হইয়াছি তাহা লিখিয়া জানাইতে পারি না।

* * *

 আপনারা যে খরচ বাদে এত টাকা পাইয়াছেন, তাহা জানিয়া সুখী হইলাম। চরকা সূতা কাটা প্রভৃতি বিষয়ে আপনি যাহা লিখিয়াছেন সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত। তবে এখনও চেষ্টা ত্যাগ করিলে চলিবে না। আপনি পূর্ব্ব পত্রে লিখিয়াছিলেন যে, তুলার চাষ করিতে পারিলে এক ভদ্রলোক আশী বিঘা জমি ছাড়িয়া দিতে পারেন। সেরূপ জমি পাইবার যদি সম্ভাবনা থাকে, তবে তুলার চাষের বেশী খরচ অগ্রিম লাগিবে না। দু’একজন মালীর বেতন ও তুলার বীজের দাম জোগাইতে পারিলে আমরা এক বৎসরের মধ্যে ফল পাইতে পারি। জমিটা পতিত হইলে চাষোপযোগী করিবার জন্য বেশী খরচ লাগিতে পারে। অবশ্য কৃষি-বিভাগের (Agricultural Department) সহিত পরামর্শ করিয়া স্থির করিতে হইবে কোন্‌ জাতীয় তুলার বীজ লাগান উচিত। যে সব কুটীর-শিল্প আরম্ভ করিয়াছেন, (যেমন ঠোঙা তৈরী করা) সেগুলিতে যদি লোকসান না হয়, তবে অল্প লাভ হইলেও চালাইবেন। পরে অপেক্ষাকৃত লাভজনক শিল্প চালাইতে পারিলে আমরা এগুলি বর্জ্জন করিব। এখন যাহারা সাহায্য গ্রহণ করে, তাহাদিগকে অন্ততঃ যে কোনও প্রকারের কাজ করান দরকার। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়িয়া তাহারা যখন কাজ করিতে শিখিবে তখন লাভজনক শিল্পে তাহাদিগকে লাগাইয়া দিতে পারিলে খুব ভাল ফল পাওয়া যাইবে! এখনকার কুটীর-শিল্পগুলি যদি financial success না হয় তবে কর্ম্মে প্রবৃত্তি ও dignity of labour জাগাইয়া তুলিলেও সমাজের প্রভূত কল্যাণ হইতে পারে। কুটীর শিল্প সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত মদনমোহন বর্ম্মণ মহাশয়ের অনেক রকম ধারণা আছে। আপনি যদি এই বিষয় সম্পর্কে তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে পারেন তাহা হইলে লাভ হইতে পারে।

 বড়ি, আচার, চাটনি প্রভৃতি তৈরী করিতে পারিলে না চলিবার কোনও কারণ নাই। স্ত্রীলোকেরা, বিশেষত বিধবারা এ কাজ ভাল করিতে পারিবে। কিন্তু শিখাইবার লোক পাইবেন কি? বাজারে চালাইতে গেলে এই জিনিষগুলি খুব ভাল হওয়া চাই। যদি ভাল জিনিষ প্রস্তুত করাইবার সম্ভাবনা থাকে তবে এ বিষয়ে experiment করিতে পারেন। Raw materials আপনারা supply করিয়া তৈয়ারী মাল পাইতে পারেন—(বিক্রী করার ভার আপনাদের অবশ্য) অথবা তাহারা নিজেরাই Raw materials কিনিয়া এবং মাল প্রস্তুত করিয়া আপনাদের নিকট বিক্রয় করিয়া যাইতে পারে। কাজ আরম্ভ করবার পূর্ব্বে দোকানদারের সহিত কথা বলা প্রয়োজন—তাহারা আমাদের মাল চালাইতে পারিবে কি না। Raw materials ভাল হইলে অবশ্য জিনিষ ভাল হইতে পারে কিন্তু অপর দিকে চুরির সম্ভাবনা খুব বেশী। যাহারা এই কাজ করিবে তাহারা গরীব সুতরাং আম, নেবু, তেল, লঙ্কা প্রভৃতি পাইলে যে তাহারা সংসারের কাজে লাগাইবে না তা কে বলিতে পারে? অপর দিকে তাহারা যদি Raw materials ক্রয় করিয়া মাল তৈয়ারী করিয়া supply করে তবে খারাপ উপাদানে (যেমন তেল) মাল ভৈয়ারী হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ সব বিষয়ে আপনি স্বপক্ষের ও বিপক্ষের কথা চিন্তা করিয়া কর্ত্তব্য স্থির করিবেন। আর একটি কথা, এই সব বস্তুর বাজারের চাহিদা কি রকম তা জানা দরকার। আমার নিজের মনে হয় যে, খুব conscientious recipients না পাইলে এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হওয়ার ভরসা কম। গরীব ভদ্র পরিবারদের দ্বারা এ কাজ চলিতে পারে। মাল তৈয়ারী হইয়া আসিলে সঙ্গে সঙ্গে তার দাম অথবা পারিশ্রমিক চুকাইয়া দিতে হইবে এবং বিক্রয় না হওয়া পর্য্যন্ত মালগুলি আমাদের ভাণ্ডারে রাখিতে হইবে।

 সমিতির পক্ষে আর একটী কাজে হাত দেওয়া বিশেষ দরকার।

 কলিকাতায় দুইটী জেল আছে, প্রেসিডেন্সী ও আলিপুর সেণ্ট্রাল। জেলের হাসপাতালে কোনও হিন্দু কয়েদী মারা গেলে আর তার যদি আত্মীয়-স্বজন কলিকাতায় না থাকে তবে তার উচিতমত সৎকার হয় না, পয়সা দিয়া ডোম বা মেথর শ্রেণীর লোক দিয়া সৎকারের ব্যবস্থা করিতে হয়। এদিকে মুসলমানদের Burial Association আছে এবং মুসলমান-কয়েদী মারা গেলে তার খবর পাওয়া মাত্র সৎকারের ব্যবস্থা করে। এরূপ একটা organization হিন্দু কয়েদীদের জন্য করা প্রয়োজন। এ কাজের ভার কি সেবক-সমিতি লাইতে পারে? যদি আপনাদের মত হয় তবে বসন্তবাবুকে দিয়া জেল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে পত্র দিতে পারেন যে, সেবকসমিতি এ-কাজের ভার লইতে প্রস্তুত আছে। আপনারা যদি এখন ব্যবস্থা না-ও করিতে পারেন তবে আমি বাইরে গেলে নিজে এ বিষয়ে চেষ্টা করিব। আমি নিজে লোকাভাব ঘটিলে অনেক সৎকার করিয়াছি, সুতরাং এরূপ কাজে আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করিতে স্বয়ং প্রস্তুত।

* * *

কুটার-শিল্প যদি চালাইতে চান তবে একটা কাজ করা দরকার। একটি উপযুক্ত যুবককে কাশীমবাজার polytechnic অথবা ঐ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানে কিছু কাজ শিখিয়া লইতে হইবে। কাশীমবাজারের স্কুলে মাটীর পুতুল ও দেবদেবীর মূর্ত্তি খুব সুন্দর তৈয়ারী হয়। এইরূপ শিল্প যদি সমিতির সাহায্য প্রার্থীদের মধ্যে চালাইতে পারেন তবে তাহাদের প্রস্তুত মাল বাঙ্গালার সর্ব্বত্র, (বিশেষত মেলা ও উৎসবের সময়) বিক্রয় হইতে পারে। আর একটী শিল্পের প্রচার এ দেশে আছে,—রঙীন কাগজ হইতে নানা প্রকার ফুল, তোড়া ও ফুল সমেত গাছ এবং Chinese lantern তৈয়ারী করা। জিনিষগুলি এত সুন্দর হয় যে, হঠাৎ দেখিলে চিনিবার উপায় থাকে না যে, এগুলি কাগজের তৈয়ারী! ভদ্রঘরের ছোট ছেলেমেয়েরাও এ কাজ খুব সুন্দর করিতে পারে।

ঢাকার বোতাম তৈয়ারী কুটার-শিল্পহিসাবে চলিতেছে। অনেকের ধারণা যে ঢাকায় বোতাম বুঝি ফ্যাক্টরীতে তৈয়ারী হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা হয় না। পল্লীগ্রামের ঘরে ঘরে অবসর সময়ে, এমন কি রান্নার ফাঁকের মধ্যে মেয়েরা এই কাজ করিয়া থাকে—সেই জন্য এত সস্তায় জিনিষ পাওয়া যায়। বোতামের শিল্প কলিকাতায় প্রচার করা সম্ভব কি না সে বিষয়ে একটু চিন্তা করিবেন। হয় তো কিভাবে এই শিল্প কুটীরে কুটীরে চলিতেছে তাহা দেখিবার জন্য কাহাকেও ঢাকা জেলায় পাঠাইতে হইবে।

স্বাস্থ্যবিষয়ক বক্তৃতা এবং ছায়াচিত্রের বন্দোবস্ত ভবানীপুর অঞ্চলে করিতে পারিলে ভাল হয়। যেখানে গরীবদের বস্তী—বক্তৃতা হওয়া বেশী দরকার সেখানে। যদি সম্ভব হয় তবে সেবক-সমিতির জন্য একটা ম্যাজিক লণ্ঠনের আসবাব ও ছবি কিনিবার চেষ্টা করিবেন। ছায়াচিত্রের সাহায্যে স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় বক্তৃতা দিলে ঢের বেশী কাজ হইবে! ছবিগুলি না কিনিয়া কোন স্থানীয় চিত্রকরকে দিয়া আঁকাইয়া লইলে বোধ হয় ভাল হইবে। ইতি—

[দক্ষিণ-কলিকাতা সেবক-সমিতির অন্যতম কর্ম্মী শ্রীমান্‌ হরিচরণ বাগচীকে লিখিত পত্রাংশ।]

মান্দালয় জেল

৩-৭-২৫

তোমার তিনখানা পত্র আমি যথাসময়ে পাইয়াছি। উত্তর দিবার সুযোগ পাই নাই; তা ছাড়া শরীর ভাল নাই। কোনও প্রকার কাজ করিতে (এমন কি লেখা পড়া করিতে) মন লাগে না। পূর্ব্বে মাত্র দুইখানি পত্র সপ্তাহে লিখিতে পারিতাম—এখন একখানা লিখিতে পারি। ফলে দু'তিন মাসের চিঠি জমা হইয়া থাকে—উত্তর দিবার সুযোগ পাই না বলিয়া।

Social Service বিভাগের প্রধান উদ্দেশ্য—গরীবকে সাহায্য করিয়া তাহার দ্বারা কাজ করানো। শুধু দান করা Organised Charity-র উদ্দেশ্য হইতে পারে না। প্রতিদান না দিলে দান গ্রহণ করা যে আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর—এই ভাবটা গরীব সাহায্যপ্রার্থীদের মনে জাগান উচিত। সুতরাং যদি কেহ সাহায্য গ্রহণ করিয়া কাজ করিতে প্রস্তুত না হয়—তবে তাহার সাহায্য বন্ধ করা ভাল। তবে এ-ক্ষেত্রে দু'একটি কথা বিবেচনা করা উচিত—

১। যে সাহায্য গ্রহণ করে তার কাজ করিবার অবসর থাকা উচিত। অর্থাৎ যদি কোনও বিধবা সাহায্য গ্রহণ করে এবং গৃহস্থালী কাজ করিয়া তাহার যদি অন্য কাজ করিবার অবসর না থাকে তাহা হইলে সে ক্ষেত্রে কাজ করাইবার জন্য জিদ করা উচিত নয়। আমাদের শুধু দেখা চাই যে, সাহায্য গ্রহণ করিয়া কেহ আলস্যে সময় কাটাইতেছে কি না। এই জন্য inspection বা স্থানীয় তদন্ত করিয়া সংবাদ লওয়া উচিত। সময় বা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যাহার কাজ করে না তাহাদের সাহায্য করিয়া আলস্যের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

২। যাহাদের শারীরিক সামর্থ্য নাই ও যাহাদের সংসারের অন্য কোন কার্য্যক্ষম লোক নাই তাহাদের কাজ করাইবার জন্য জিদ করা উচিত নয়।

৩। কাজ করাইতে হইলে variety of choice থাকা চাই, কারণ সব লোকের দ্বারা সব রকম কাজ হয় না। আগে সহজ কাজ লইয়া আরম্ভ করিবে, যেমন পুরাতন খবরের কাগজ দিয়া ঠোঙা প্রস্তুত করান—তারপর কঠিন কাজ শিখাইবে।

৪। যাহাদের কাজ করাইতে চাও তাহাদের কাজ শিখাইবার ব্যবস্থা করা চাই। অনেক কাজ আছে যাহা মানুষে ভয় করে—না শেখা পর্য্যন্ত সে-ক্ষেত্রে প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা কাজ করিতে রাজী হইবে না, কিন্তু একবার কাজ শিখিলে তাহারা ক্রমশঃ কাজে মন দিবে।

আমরা ভিক্ষুকের জাতে পরিণত হইয়াছি, সুতরাং ভিক্ষুকের মনোভাব একদিনে পরিবর্ত্তিত হইবে না। যদি তোমরা আশা কর যে, একদিনে ভিক্ষুকের প্রবৃত্তি বদলাইবে তাহা হইলে তোমরা হতাশ হইবে। Social service-এ অসীম ধৈর্য্য দরকার।

মোটের উপর তোমাদের কাজের প্রোগ্রাম এই—raw materials (যেমন খবর-কাগজ, তুলা অথবা ঝিনুক) তোমরা যোগাইবে। যাহারা সাহায্য গ্রহণ করে তাহার সাহায্যের বিনিময়ে raw materials হইতে জিনিষ প্রস্তুত করিয়া দিবে। সে জিনিষগুলি বিক্রয় করিবার ভার তোমাদের এবং সেই উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন দোকানের সঙ্গে তোমাদের বন্দোবস্ত করা উচিত যাহাতে তোমাদের জিনিষ তাহারা ক্রয় করিয়া লয়। এই সব জিনিষ তাহারা বিক্রয় করিয়া খরচ খরচা বাদে যে লাভ থাকিবে তাহা হইতে সাহায্য দানে খরচ (অন্তত আংশিক ভাবে) উঠিয়া যাইবে। Public Charity-র উপর চিরকাল নির্ভর না করিয়া সমিতির একটা স্বতন্ত্র আয়ের ব্যবস্থা তোমাদের করা উচিত! অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ ও আয়াস-সাধ্য।

লাইব্রেরীর জন্য টাকা খরচ করিয়া বই না কিনিয়া author এবং অন্যান্য ভদ্রলোকদের নিকট হইতে বই সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিও।

অনিলবাবুকে বলিও যে, লাইব্রেরীর জন্য hap-hazardly কতকগুলো বই সংগ্রহ না করিয়া একটা method অনুসারে বই সংগ্রহ যেন করেন। অবশ্য বিনা খরচে যে সব বই পাইবে—সেগুলিও গ্রহণ করিবে। কিন্তু তথাপি একটা প্রণালী থাকা উচিত। সর্ব্বাগ্রে বাঙ্গালা, ইংরাজী এবং ইউরোপীয় (Continental) সাহিত্যের নামকরা বই সংগ্রহ করিবে। তারপর ভারতের ইতিহাস, ইংলণ্ডের ইতিহাস এবং পৃথিবীর সকল দেশের ইতিহাসের বই সংগ্রহ করিবে। তারপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় পুস্তক এবং মহাপুরুষদের জীবনী সংগ্রহ করিও। সঙ্গে সঙ্গে অর্থ ও রাজনীতি, কৃষি ও বাণিজ্য সম্বন্ধীয় বই সংগ্রহের চেষ্টা করিও। যদি একসঙ্গে সব রকম বই সংগ্রহ করিতে পার তাহা হইলে ভাল হয়। মোট কথা, প্রত্যেক বিষয়ের অন্তত কতকগুলি বই রাখা চাই—যাহাতে যে কোনও রুচির লোক আসুক না কেন সে পড়িবার বই পাইবে। বাজে উপন্যাস রাখার প্রয়োজন নাই—তবে ভাল ভাল উপন্যাস রাখা উচিত। অল্পের মধ্যে একটা আদর্শ লাইব্রেরী করা চাই।

· · · · ·

দূরদেশে যদি সুতা কিনিতে হয় তাহা হইলে তোমরা weaving depot. বেশী দিন রাখিতে পারিবে না। যাহাদের সাহায্য করিবে তাহাদের ঘরে এবং সমিতির সভ্যদের ঘরে সূতা উৎপাদনের চেষ্টা করা চাই। যদি অন্তত খানিকটা সূতা ভবানীপুরে কিংবা তার আশে পাশে তৈয়ারী না হয় তবে তোমাদের পরিশ্রম ব্যর্থ। আর একটি কথা তোমাদের মনে রাখা উচিত। যদি স্থানীয় লোকেদের মধ্যে সূতা প্রস্তুত হয়—তবে জানিবে যে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্থানীয় লোকদের প্রকৃত সহানুভূতি আছে। স্থানীয় সহানুভূতির অভাবে কোনও প্রতিষ্ঠান বেশী দিন চলিতে পারে না।

স্থানীয় লোকেদের মধ্যে এমন লোক পাইবে যাহারা সূতা কাটিবে অথচ সূতা বিক্রয় করিবে না। তাহাদের সূতায় যদি ধুতি বা শাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিতে পার—তবে তাহারা সূতা কাটিতে পারে। পূর্ব্বে অনেক লোক এইভাবে সমিতিতে ধুতি এবং শাড়ী প্রস্তুত করাইত। এখানকার অবস্থা আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় যে, সমিতিতে সূতা লইয়া ধুতি শাড়ী প্রস্তুত করিবার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। সভ্যদের বাড়ীতে বাড়ীতে যাহাতে সূতা প্রস্তত হয় সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখিবে। ইতি—