বিষয়বস্তুতে চলুন

তারাচরিত/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তারাচরিত।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 সৌরাষ্ট্র দেশে অনল্‌ওয়ারা প্রদেশে বিখ্যাত বল্‌হর বংশীয় রাজগণ বাস করিতেন। দিল্লীশ্বর আলা তাঁহাদিগকে যুদ্ধে পরাভূত করিলে পর, তাঁহারা স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া তৎসন্নিহিত প্রদেশে গিয়া বাস করিলেন।

 ঐ বংশে অতি পরাক্রমশালী অনেক রাজা জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা ভুজবলে তথায় একটী ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন। অনতিকাল মধ্যে বন্নাস-নদী-তীরবর্ত্তী টোডা টঙ্ক নগর তাহাদের অধিকার ভুক্ত হয়। এই বল্‌হর বংশে রাও সুরতন্‌ নামক একজন অতি বিচক্ষণ রাজা জন্মিলেন। তাঁহার রাজ্য শাসনের এমনি সুপ্রণালী যে টোডাবাসীরা তাঁহাকে প্রাপ্ত হইয়া আহ্লাদ সহকারে রাজকার্য্যের সহকারিতা করিতে লাগিল। ফলতঃ রাজা নিজগুণে প্রজাদিগকে এমনি বশীভূত করিয়াছিলেন যে প্রজারা তাঁহাকে স্ব স্ব পিতৃবৎ জ্ঞান করিত। মহারাজ সুরতন্‌ যেমনি বীর্য্যবান তেমনি সুপুরুষও ছিলেন, তাঁহার রূপ দেখিলে তাঁহাকে সাক্ষাৎ কন্দৰ্প বলিয়া সকলেরই মনে হইত। তাহার আজানু-লম্বিত বাহু যুগল, আকর্ণ চক্ষু,উন্নত ললাট, ও ক্ষীণ কটি দেখিলেই তাঁহাকে একজন অসামান্য বীর পুরুষ বলিয়া মনে হইত। সুরতন যুদ্ধ বিদ্যায় এমনি নিপুণ ছিলেন যে কেহই তাঁহার সহিত সম্মুখ সমরে অগ্রসর হইতে পারিত না। কিন্তু ভাগ্যের কথা কে বলিতে পারে? ভাগ্য যে কখন কাহার উপর প্রসন্ন ও কখন কাহার উপর অপ্রসন্ন তাহা বুঝিয়া উঠা মনুষ্যের সাধ্য নহে। তাহা না হইলে, পুরাকালে কত রাজাই প্রবল ছিলেন তাহা বলিয়া উঠা যায় না; এখন চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিলে তাঁহাদের কাহাকেও দেখিতে পাইবে না। প্রবল প্রতাপান্বিত পরাক্রমশালী বীর্য্যবান রাজা সকল কোথায় গেলেন। রে ভাগ্য তোমাকে ধন্য! তুমি যে কখন কাহার উপর ধাবিত হইতেছ বুঝিতে পারিতেছি না। তুমি যখন যাহার অনুকূল থাক তখন সেই ধন্য। তাহা না হইলে রাজা যুধিষ্টির কেন বনগামী হইলেন। তুমি যদি তাঁহাদের উপর সুপ্রসন্ন থাকিতে তাহা হইলে তাঁহারা কখন বনগামী হইতেন না, অনেক দুর্লঙ্ঘ্য কষ্টও ভোগ করিতেন না। যখন তুমি সদয় হইলে তখন তাঁহাদের আবার সেই হস্তিনায় একাধিপত্য স্থাপন করাইলে। তোমাকে ধন্য! তোমারই নির্দ্দয় দৃষ্টিপাতে সুরতনের রাজলক্ষ্মী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন।

 লিল্লা নামক দুৰ্দ্ধান্ত আফগান সসৈন্যে আগমন করিয়া টোডা টঙ্ক অধিকার করিয়া তথায় একাধিপত্য স্থাপন করিল। সুরতন এইরূপ দুর্দ্দশাপন্ন হইয়া অরবলী পর্ব্বতের পাদদেশে মিওরার রাজ্যের অন্তর্গত বেডনোর নগরে আসিয়া বাস করিলেন। সেই সময়ট যে তাঁহার পক্ষে কি দুঃসময় তাহা মনে করিলে ব্যক্তিমাত্রেরই অনিবার্য্য শোকের উদ্রেক হইয়। থাকে। অসীম রাজ্যাধিকারী যে এমন করিয়া দুর্দ্দশাপন্ন হইবেন তাহা মনুষ্যের বুদ্ধির অগোচর। কিন্তু জগতে কাহার ভাগ্য সকল সময়ে সমান থাকে না। তিনি এত দুঃখে পড়িলেও পরমেশ্বর তাঁহাকে নিতান্ত নিরাশ করিলেন না। তিনি বেডনোর প্রদেশের সর্দারি প্রাপ্ত হইলেন। সুরতনের সহধর্ম্মিণী অতি অল্প কালেই কালের করাল গ্রাসে প্রবেশ করিয়াছিলেন। সুতরাং তাহার সন্তান সন্ততি অধিক হয় নাই, কেবল তিনি তারা নামে এক অসামান্য সুন্দরী কন্যা প্রসব করিয়াছিলেন। তারা মাতৃহীন হইলেও পিতার যত্নে দিন দিন শশি-কলার ন্যায় বাড়িতে লাগিলেন। তারা পিতৃ বংশের পূর্ব্বাবস্থা স্মরণ ও বর্তমান অবস্থা অবলোকন করিয়া বাল্যকাল অবধি অবলারঞ্জন বেশ ভূষা পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা করিতে লাগিলেন। তিনি যে কুমারীজনোচিত বেশ ভূষা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন তাহাতে তাঁহার রূপ বরং সমধিক উজ্বল ভাবই ধারণ করিয়াছিল। তাঁহাকে যে দেখিত সেই বলিত যে আহা কি মনোহর রূপ! এরূপ মোহিনী মূর্ত্তি কখন কাহার নয়ন দর্পণে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে কি না সন্দেহ! সকলেই ভাবিতেন এ রূপ কল্পিত না প্রকৃত তাহা স্থির করা সহজ নহে। তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত যে পূর্ণিমার চন্দ্রের ন্যায় তিনি বিরাজ করিতেছেন। কি আকর্ণ বিস্তারিত লোচন দ্বয়! কি অলৌকিক স্বগঠিত ভুজ চরণ অঙ্গুলি নিকর! কি অসাধারণ মনোহর আনন। তাঁহার সেই চম্পক বিজয়ী বর্ণ শারদীয় চন্দ্রমার ন্যায় শোভা পাইতেছে দেখিয়া কাহার না মনে হইত যে ইনি মুরপুরবাসিনী কোন দেবকন্যা মর্ত্যলোকে আসিয়া সুরতন মহাশয়ের বংশ অলঙ্কৃত করিতেছেন। তারাকে দেখিয়া টোডা নগরের সকলেই বলিতেন, তারা বিধাতার মানস সরোবরের স্বর্ণকমল। বস্তুতঃ একে এই রূপরাশি তারাতে বিরাজ করিতেছে, তাহাতে আবার তিনি দিন দিন যুদ্ধ-বিদ্যায় বিশারদ হইয়া উঠিলেন। এদিকে প্রকৃতিদেবীও নম্রতা, উদারতা ও মধুরতাদিগুণ নিচয়ে তাঁহাকে সুশিক্ষিত করিলেন। তারা অতি অল্পকালেই বিবিধ বিদ্যায় বিলক্ষণ পারদর্শিনী হইয়াছিলেন। তিনি অশ্বারোহণে এমনই পটু হইয়াছিলেন যে, অতি বেগগামী একটী অশ্ব হইতে আর একটী অশ্বে অনায়াসে যাইতে পারিতেন। তাহার বীরত্বের কথা অধিক কি বলিব তিনি এমনি তীর নিক্ষেপ করিতে জানিতেন যে, যাহাকে লক্ষ্য করিতেন তাহা প্রায় ব্যর্থ হইত না।

 যৎকালে দুরাত্মা আফগান তারার পিতা সুরতন মহাশয়ের নিকট হইতে টোডা কাড়িয়া লয়, তখন তারা অতি বালিকা ছিলেন; তথাপি তাঁহার এমনি বীরত্ব যে, তিনি অনেক গুলি অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া টোডার উদ্ধারের চেষ্টা করেন। বীর বংশীয় বীর স্বভাবা তারা নিজে অনেকবার সৈন্য দলের সমভিব্যাহারিণী হইয়াছিলেন। তিনি তাহাদের সহিত এমনি নিপুণতা সহকারে যুদ্ধ করিয়াছিলেন যে, তাহার তখনকার মূর্ত্তি দেখিলে কাহার না মনে বীররসের উদয় হইত? তাঁহার সেই মোহিনী মূর্ত্তিতে বীর বেশ কি অপূর্ব্ব শোভাই ধারণ করিয়াছিল! তিনি যখন যুদ্ধ করিতেন, তখন তাঁহার নিকট অগ্রসর হইতে পারে কাহার সাধ্য! এক দিন তারা যুদ্ধে গমন করিতেছেন, কতকদূর যাইয়া দেখিলেন অতি সমারোহে কোন রাজা আসিতেছেন। তাহার পর অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন যে, তিনি মিওয়ারের অধিপতি রায়মলের কনিষ্ঠ পুত্র জয়মল। জয়মল আসিতেছেন জানিয়া তিনি প্রথমে কিছু ভীত হইলেন। কারণ তাহার মনে হইল যে, আবার কোন দুরাত্মা যুদ্ধ করিতে আসিতেছে। কিন্তু তাহার মনের এই ভাবটী কেবল বিদ্যুতের ন্যায় ক্ষণমাত্র স্থায়ী হইয়াছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ ধীর ভাবে নিঃশঙ্ক হৃদয়ে ক্রমশঃ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তাঁহার আকর্ণ লোচন প্রফুল্ল হইতে লাগিল, বাহুযুগল ক্রমশঃ বিষ্ফারিত হইল, হৃদয় আহলাদে নৃত্য করিতে লাগিল। যুবরাজ জয়মল দূর হইতে তারার অপূর্ব্ব রূপরাশির সহিত বীরবেশ দেখিয়া বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হইয়া পড়িলেন। নিকটে আসিয়া দেখিলেন যে এক অসামান্য রমণীকুলরত্ন অশ্বে বিহার করিতেছেন। দেখিবামাত্র তারার সেই ভাব তাঁহার হৃদয় পটে অঙ্কিত হইল। জয়মল মনে মনে বিধাতাকে এই ৰলিয়া শত শত ধন্যবাদ ও প্রশংসা করিলেন যে, এরূপ  অমূল্য রত্ন বিধাতা তাহার নিমিত্ত পথি মধ্যে রাখিয়াছেন। পরিশেষে রাজপুত্র জয়মল খানিকক্ষণ তারার রূপরাশি দর্শন করিয়া মুগ্ধ হইয়া কহিলেন সুন্দরি তুমি আমাকে স্বামিত্বে বরণ কর আমি তোমার পাণি গ্রহণ করিয়া মানব জন্মের সার্থকতা লাভ করি, তোমার নয়ন প্রীতিকর রূপে আমি মুগ্ধ হইয়াছি এবং বীরত্ব দর্শন করিয়া চমৎকৃত হইয়াছি। তারা এই সকল কথা শুনিয়া ক্ষণকাল অবিচলিত নয়নে গম্ভীরভাবে রহিলেন কিছু বলিলেন না। পরে গুণবতী সুশীলা তারা এই উত্তর করিলেন যে, হে মহাত্মন যদি তুমি স্বীয় বাহুবলে টোডা নগরের উদ্ধার সাধন করিতে পার তাহা হইলে আমি তোমার সহধর্ম্মিণী হইতে পারিব, তাহা হইলে তুমি অনায়াসে আমার পাণি গ্রহণ করিতে পারিবে। রাজপুত্র জয়মল তারার মুখনিঃসৃত মধুর বাক্যপরম্পরা শ্রবণ করিয়া অসীম আনন্দরসে নিমগ্ন হইলেন এবং মনে মনে আপনাকে বহুভাগ্যশালী জ্ঞান করিতে লাগিলেন। তিনি যে এত অল্পকাল মধ্যে এরূপ সর্ব্বগুণ সম্পন্ন রমণী রত্ন লাভ করিবেন তাহা তাঁহার হৃদয় মধ্যে একবারও উদয় হয় নাই। যাহা হউক তিনি ক্ষণবিলম্ব ব্যতিরেকে যুদ্ধ যাত্রায় গমন করিলেন। তাহার যুদ্ধ সজ্জা দেখিয়া লোক মাত্রে এই বলিতে লাগিল যে এইবার বুঝি রায় সুরতনের রাজলক্ষ্মী প্রসন্ন হইলেন; এমন সুন্দর বীর্য্যশালী বীর পুরুষ কোথ। হইতে আসিল। এদিকে জয়মলের সহিত আফগানদের যুদ্ধ হইতে লাগিল। যুদ্ধের কথা কি বলিব, এমন যুদ্ধ কেহ কখন দেখে নাই, প্রায় ক্রমাগত সপ্তাহ যুদ্ধ হইতে লাগিল; কোন পক্ষেরই কিছুই হইতেছে না দেখিয়া সকলে বিস্ময়াপন্ন হইল। সকলে বলিতে লাগিল রাজপুত্র জয়মলের যুদ্ধে জয় হইবে। কিন্তু লোকের কথায় কি হইতে পারে। পরিশেষে শুনা গেল যে জয়মল যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন। শুনিয়া সকলে ক্ষুব্ধ ও নিস্তব্ধ হইল। পরিশেষে যুদ্ধে জয় লাভ করিতে না পারিয়া জয়মল সসৈন্যে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। তখন রাজ্যশুদ্ধ সকলে একবাক্য হইয়া বলিতে লাগিল যে, জয়মলের যেরূপ উত্তম বংশে জন্ম গ্রহণ করা হইয়াছে তদনুরূপ কার্য্য হইল না। তিনি যদি টোড উদ্ধার সাধন বিষয়ে কৃত সঙ্কল্প হইয়া বিশিষ্টরূপ যত্নবান হইতেন তাহা হইলেই তাঁহার কর্ত্তব্য কাজ করা হইত ও সকলের চিরকালের মনোরথ পূর্ণ হইত। বিদ্যাবতী রূপবতী গুণবিশারদ তারা তাহার প্রেয়সী হইতেন। এদিকে হতভাগ্য জয়মল জয়লাভে নিরাশ হইয়া বেদবিহিত শাস্ত্র-সম্মত সন্মার্গ পরিত্যাগ করিয়া অবৈধ প্রকারে তারাধিকারী হইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। রায় সুরতন, তাহার এই ধর্ম্মবিরুদ্ধ ব্যবহার শ্রবণ করিয়া জলন্ত অনল প্রায় হইলেন এবং তাহার এই দুষ্ট চেষ্টার প্রতিফল দিবার নিমিত্ত তিনি জয়মলের প্রাণকুসুম হরণ করিলেন।

 ক্রমে রাজ্যময় রাষ্ট্র হইল যে প্রসিদ্ধ মহারাজ রায়মলের পুত্র জয়মল মরিয়াছেন। সকলেই তাহার ঘৃণিত কর্ম্মের উপর দোষারোপ করিতে লাগিলেন। এই সকল শুনিয়া মুগ্ধ স্বভাব। তারা করতলে কপোল বিন্যাস করিয়া বসিয়া আছেন। দিনমণি অস্তাচলাবলম্বন করিলে ক্রমে রাত্রি প্রায় যামার্দ্ধ হইল। নক্ষত্রমালা বিভূষিত চন্দ্রমা আকাশ মণ্ডলে পরিভ্রমণ করিতেছেন। ঝিল্লীরব ঘনীভূত হইয়াছে। মধ্যে মধ্যে বর্ত্ম বিহারী আম্রকানন বিচরণশীল জম্বুক সমূহের প্রচণ্ড রব শ্রুত হইতেছে। মন্দ মন্দ ললিত সমীরণ স্পর্শে তারার কোমল গাত্র জুড়াইতেছে। পিককুল-কুহরিত-সঙ্কুল-নিকুঞ্জ বিহগকুলললিত তানহিল্লোলে আপ্লুত হইয়া রাত্রির রমণীয়তা সম্পাদন করিতেছে। ফুলদল বিগলিত নির্ম্মল পরিমলে উপবন আমোদিত করিতেছে। তারা কতই কি ভাবিতেছেন। এমন সময়ে একটী নবীনা বালিকা অবগুণ্ঠনবতী হইয়া রাজবাড়ী প্রবেশ করিলেন। তারা দেখিতে পাইয়া অমনি ব্যস্তভাবে প্রাসাদের উপরি হইতে অবতরণ করিয়। দেখিলেন একটী বৃদ্ধা সেই নবীন যুবতীকে লইয়া আসিয়াছে। রাজকুমারী তার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কোথা হইতে আসিলে? বৃদ্ধা উত্তর করিল আমি সৌরাষ্ট্র হইতে আসিতেছি। এই কথা শ্রবণে রাজনন্দিনী তারার মুখ কালিমা ধারণ করিল, তাহার মনোমন্দিরে আনুপূর্ব্বিক সকলই উদয় হইল। তারা সে ভাব গোপন করিয়া কহিলেন তোমরা সৌরাষ্ট্রের কাহার নিকট হইতে আসিলে এবং এই কন্যাই বা কাহার? তখন বৃদ্ধা মৃদু মৃদু ভাবে কহিতে লাগিলেন, মাতঃ শ্রবণ কর, এই কন্যাট সৌরাষ্ট্রের পূর্বকার রাজার মন্ত্রীর প্রপৌত্রী। এই কথা শ্রৰণ করিয়া তারার হৃদয় যেমনি আনন্দরসে ভাসমান হইল আবার ততোধিক তাঁহার দুঃখ ও হইল। তখন তিনি তাঁহাকে, সখি তোমার নাম কি,জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহার মুখের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিলেন। দেখিলেন, যে কিছু দুঃসহ চিন্তার উদয় হইয়াছে; নয়নযুগল অপ্রশস্ত, অধরোষ্ঠ নিমীলিত, মধ্যে ঈষৎ বক্র হইতেছে; মুখ কমল ঈষৎ নত, যেন অকালে পূর্ণ শশধরকে মেঘজলে লুক্কায়িত করিতেছে। তারা দেখিয়া প্রথমতঃ বিস্ময়াপন্ন হইলেন পরক্ষণেই তাহার সে ভাব দূরীভূত হইয়। অন্তঃকরণে প্রণয় সঞ্চার হইতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিলেন ভগিনি তোমার নাম কি? তিনি উত্তর করিলেন রাজনন্দিনি আমার নাম মালতী, আমার ন্যায় দুঃখিনী এই জগতমগুলে আর দ্বিতীয় নাই। আমাকে বিধাতা চিরদুঃখিনী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। আমার দুঃখের কথা শুনিলে পাষাণ হৃদয় ব্যক্তিরও মনে দয়া হয়। আমি সৌরাষ্ট্র দেশের রাজার মন্ত্রীর প্রপৌত্রী। শুনিয়াছি দুর্দ্দৈব বশতঃ দেশ পাঠান কর্তৃক অপহৃত হইলে রাজা দেশ পরিত্যাগ করিলেন। সেই শোকে আমার প্রপিতামহ কালের করাল গ্রাসে পতিত হইলেন এবং সেই অবধি আমাদের বংশের ক্রমেই ক্ষীণদশা হইতে লাগিল। এক্ষণে আমাদের সকলেই মরিয়া গিয়াছেন; কেবল আমি এই অসীম কষ্ট ভোগ করিতে রহিয়াছি। যতদিন বালিকা ছিলাম ততদিন গৃহে ছিলাম। এখন যৌবন সীমায় পদার্পণ করিয়াছি আর একাকী থাকা বিধেয় নয় জানিয়া আমার এই ধাত্রী আমাকে আপনার নিকট আনিলেন। তারা শুনিয়া আহলাদ সাগরে ভাসিলেন এবং বলিতে লাগিলেন সখি অদ্যাবধি তুমি আমার সমদুঃখভাগিনী সহচরী হইলে। মালতী শুনিয়া বলিলেন আমাকে আপনি নিজ ঔদার্য্যগুণে সকলই বলিতে পারেন।

 ক্রমে ক্রমে মেওয়ারে রাষ্ট্র হইল যে জয়মল বেডনোরে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন। মহারাজ রায়মলকে এ সংবাদ কে শুনাইবে এই এক হুলস্থূল গোলযোগ পড়িয়া গেল। এই মহা বিপদের সংবাদ তিনি কেমন করিয়া সহিবেন। তাহার এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি কেমন করিয়া পুত্র শোক সহ্য করিয়া থাকিবেন এবং তিনি তাহার প্রতিফল দিবার নিমিত্ত যত্নবান হইবেন কি না এই ভাবনাই সকলের মনে বলবতী হইতে লাগিল। আবার অনেকে ভাবিতে লাগিল যে, সুরতন এমন কাজ কেন করিলেন; হয়ত তাহাকে আবার দুর্দশাপন্ন হইতে হইবে। এইরূপ রাজ্যমধ্যে আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। কথা আর কতকাল ছাপা থাকিবে। একদিন মহারাজ সন্ধ্যা সমীরণ সেবনার্থে পুষ্প উদ্যানে পাদ চারণ করিতেছেন এবং স্বীয় রাজ্যের বহুবিধ কুশল ভাবিতেছেন। যখন সন্ধ্যাদেবী নীলাম্বরাবগুণ্ঠনে ধরায় আগমন করিতেছিলেন, যখন কুলায়মুখগামী বিহঙ্গমদল কোলাহল করোলিত সায়ংকাল উপস্থিত হইল দেখিয়া দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল, পশ্চিম গগনাঙ্গনে কাঞ্চন ছটা প্রকাশী সূর্য্যপ্রভা ক্রমে ক্রমে বিলীন হইতে লাগিল,কুসুমচয়শোভনা সরসীর গর্ব্বভূতা সূর্যভামিনী কমলিনী ঈষন্মুদিত হইয়া মস্তক নত করিলেন, কুমুদ কলাপ বিকশিত হইতে লাগিল, মন্দীভূত সমীর ধীরে ধীরে বহিতে লাগিল, শশধর নিজ কিরণ বিস্তার করিয়া ধরাতলকে স্নিগ্ধ করিতে লাগিলেন, চক্রবাকবধূ কান্ত বিচ্ছেদে করুণ স্বরে রব করিতে লাগিল, এমন সময় একজন লোক আসিয়া মহারাজ গমনোন্মুখ হইতেছেন দেখিয়া বলিল মহারাজের জয় হউক। রায়মল দেখিয়া প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন কোথা হইতে আসিতেছ? শুনিয়া যুবক উত্তর করিলেন আমাকে মন্ত্রী মহাশয় পাঠাইলেন। তখন রাজা বলিলেন যাহা বলিতে হয় অসঙ্কুচিত চিত্তে বল। যুবক এই সাহস পাইয়া আনুপূর্ব্বিক জয়মলের সকল বিবরণ তাঁহাকে শ্রবণ করাইলেন। তিনি শুনিয়া ক্ষণেক শাল তরুর ন্যায় অচল এবং নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরক্ষণে দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, ওহে যুবক ইহা কি সত্য না আমাকে প্রতারণা করিলে? যদি এই কর্ম্ম রায় সুরতন অকপট হৃদয়ে করিয়া থাকেন তাহা হইলে আমি তাহাকে শত শত ধন্যবাদ দিতেছি, তিনিই মনুষ্য; তাহার হৃদয় এতদিনে রাজপুতের বলিয়া প্রতীয়মান হইল। এই বলিয়া পরক্ষণে একটা হুঙ্কার ছাড়িয়া বলিলেন, যে বংশে পুণ্যকীর্তি সূর্য্যবংশীয়েরা জন্ম গ্রহণ করিয়া গিয়াছেন, সেই মহৎ বংশ কলঙ্কিত করিতে পাপাশয় দুরাত্মা জয়মল আমার ঔরসে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিল। আমাকে যে আর তাহার মুখ দর্শন করিতে হইল না ইহাই ভাল। এই রূপ বলিতে বলিতে মহারাজ দুর্গাভিমুখে যাত্রা করিলেন এবং পর দিন প্রাতঃকালে বিচক্ষণ মন্ত্রির সহিত পরামর্শ করিয়া রাও সুরতনকে বেডনোর উপহার দিলেন।