বিষয়বস্তুতে চলুন

তারাচরিত/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে



সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 একদা তার ও পৃথ্বীরাজ কমল মেরুতে বসিয়া আছেন এমন সময়ে তাঁহার ভগিনী শিরোহিপতি প্রভুরাওয়ের পত্নীর নিকট হইতে এক পত্র আসিয়া পৌছিল। তাহাতে তাঁহার ভগিনী অনেক কাতরতা প্রকাশ করিয়া লিখিয়াছেন যে তোমার ভগিণীপতি প্রত্যহ অহিফেণ সেবন করিয়া আমার বিস্তর অপমান করেন; আমাকে সর্ব্বদাই প্রায় পাটের নীচে ফেলিয়া রাখিয়া অনিয়ম কার্য্য সকল করিয়া থাকেন: এই দুরন্ত কৃতান্ত কর হইতে আমার নিষ্কৃতি কর; আমাকে পিত্রালয়ে লইয়া যাও। এই কথা অবগত হইয়া পৃথ্বীরাজ যেন মদোন্মত্ত সিংহের ন্যায় গর্জ্জিয়া উঠিলেন, এবং দুই চক্ষু রক্ত বর্ণ করিয়া শিরোহি অভিমুখে গমন করিবার উদযোগ করিলেন। তারা, হঠাৎ এবংবিধ কার্য্য দর্শনে চমৎকৃত হইয়া, পৃথ্বীরাজকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, নাথ অকস্মাৎ কেন ভাবের ব্যতিক্রম দেখিতেছি? কি হইয়াছে আমাকে বল শুনিয়া উত্তপ্ত প্রাণকে শীতল করি। তোমার ক্রোধের লক্ষণ দেখিয়া বোধ হইতেছে যে কোন ভয়ানক অনিষ্ট হইয়া থাকিবে। এই কথা শুনিয়া পৃথ্বীরাজ তারাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, প্রিয়ে তোমার ভয়ের কারণ নাই, তুমি কোমল নারী জাতি সকলেতেই ভয় করিয়া থাক। এই বলিয়া তিনি পত্রের আদ্যন্ত তারার নিকট ব্যক্ত করিলেন, এবং আমাকে এখনি যাইতে হইবে, এ অপমান আর সহ্য হয় না, এই বলিয়া নীরব হইলেন। তখন তারা ভাবি বিরহের আশঙ্কায় কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া তাহার পর বলিলেন, নাথ, তোমার যাওয়া হইবে না, আমি কেমন করিয়া তোমার বিচ্ছেদ সহ্য করিব! শুনিয়া পৃথ্বীরাজ বললেন, প্রিয়তমে ভাবনা কি আমি সেখানে থাকিবার নিমিত্ত যাইতেছি না, কেবল সেই দুর্বৃত্তের দমনের নিমিত্ত যাইতেছি। প্রিয়ে ভয় নাই, আমি অল্পদিনের মধ্যে আসিয়া তোমার বদন চন্দ্রিমা দর্শন করিয়া আমার নয়ন চকোরকে তৃপ্ত করিব। এই সকল শুনিয়া যখন তারা জানিলেন যে সত্যসত্যই পৃথ্বীরাজ চলিলেন, তখন তিনি সজললোচনে বলিতে লাগিলেন, নাথ অদ্য কেন আমার প্রাণ বিহঙ্গম দেহ পিঞ্জর হইতে প্রয়াণের চেষ্টা পাইতেছে? অদ্য কেন আমার দক্ষিণ আঁখি স্পন্দিত হইতেছে? আমার মন কেন বিপদের আশঙ্কা করিতেছে? নাথ কল্য যখন নিশি প্রভাত হইয়াছে তখন আমি এক অমঙ্গলকর স্বপ্ন দেখিয়াছি, তাই প্রাণনাথ এতক্ষণ তোমাকে আমি আলিঙ্গন করি নাই। দেখিলাম যেন তোমাকে হৃদয়ে লইয়া আমি অসংখ্য পর্ব্বত নদ নদী নগর গ্রাম বন উপবন সকল পরিত্যাগ করিরা পলায়ন করিতেছি; যেমন আমি তোমাকে লইয়া দ্রুতবেগে যাইব অমনি তুমি আমার হৃদয় হইতে পড়িয়া গেলে। আমি সেই অবধি আর দেখিতে পাইলাম না। নাথ আমার হৃদয় সেই জন্যই ব্যাকুল হইতেছে। আমার মন সেই জন্যই তোমাকে আর ছাড়িতে চাহিতেছে না। প্রাণনাথ তোমার নিমিত্ত আমি এক ক্ষণ ও কোথাও থাকিতে পারিতেছি না। আর, আমার মনের আজ এ ভাব হইতেছে কেন? সততই যেন ইচ্ছা করিতেছে যে তোমাকে বক্ষস্থলে ধারণ করি, তোমর পূর্ণ সুধাকর মুখ আমি দিবা রাত্রি দেখি, এবং তোমার এই অসীম সৌন্দর্য্যশালী রূপ রাশি যেন এক ক্ষণ অন্তর হইতে না অন্তর করি। আমার কর্ণ তোমার সুধা বিনিন্দিত বাক্য শুনিতে চাহিতেছে; আমার চক্ষু তোমার সৌন্দর্য্য দেখিতে লোলুপ হইতেছে; আমার নাসিকা তোমার গায়ের সুগন্ধ ঘ্রাণের ইচ্ছা করিতেছে; আমার হস্ত তোমার পদ সেবা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছে। নাথ আমার চরণ প্রতিক্ষণে তোমার সহিত ধাবমান হইবার চেষ্টা করিতেছে, আমার নিমিত্ত যাইতে পারিতেছে না। তারা এই বলিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করিলে পৃথ্বীরাজ বলিলেন প্রিয়ে তোমার অন্তর কোমল-কমল অপেক্ষায় কোমল— তুমি কেন মিছা চিন্তা তরঙ্গে মনকে বিলোড়িত করিতেছ এবং অনর্থক কষ্ট দিতেছ? এই বলিয়া তিনি তারাকে বুঝাইয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া শিরোহি অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তারা চিত্তপুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন।

 তারার পাণিগ্রহণের পর পৃথ্বীরাজ কত যুদ্ধেই গমন করিয়া জয় লাভ করিয়া ছিলেন। কোন কোন যুদ্ধে তারা তাঁহার সমভিব্যাহারিণীও হইয়ছিলেন; কিন্তু অনেক যুদ্ধেই তাঁহার যাওয়া ঘটে নাই। তাাঁ বলিয়া যে তিনি তাঁহার যুদ্ধ যাত্রা কালে কোন বাবে কোন প্রকার আপত্তি করিয়াছিলেন এরূপ নহে। বরং তিনি প্রতিবারেই আহ্লাদিত চিত্তে প্রাণেশ্বরের অপরিসীম উৎসাহকে অধিকতরই বর্দ্ধিত করিতেন। এবার কিন্তু তাঁহার মন ভিন্ন প্রকার চিন্তায় নিমগ্ন রহিল।

 নিশীথ সময়ে পৃথ্বীরাজ শিরোহিতে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ক্ষণকাল বিলম্ব না করিয়া প্রাচীর দিয়া কৌশলে প্রাসাদের উপরিভাগে উঠিয়া একেবারে প্রভুরাওয়ের শয়নাগারে প্রবেশ করিলেন এবং তাঁহার কণ্ঠদেশ সমীপে তরবারি ধারণ করিয়া বলিলেন, রে নরাধম তোকে এই করস্থিত তরবারি দ্বারা নিধন করিয়া ক্ষত্রিয় বংশের কলঙ্ক মোচন করি। এই বলিয়া তিনি সেই তীক্ষ্ণ ধার অসি উত্তোলন করিলেন। দেখিয়া প্রভুরাও প্রাণ ভয়ে শঙ্কিত হইয়া দয়া প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। তাঁহার স্ত্রীও সহোদর সমীপে তাঁহার প্রাণদানের প্রার্থনা করিলেন এবং স্বীয় ভ্রাতাকে নানাবিধ মিষ্ট বাক্য বলিয়া পুর্ব্বকার দোষাপনোদন করিতে লাগিলেন। শুনিয়া পৃথ্বীরাজের ক্রোধ শমিত হইল। তিনি প্রভুরাওকে বলিলনে, যদি তুমি তোমার পত্নীর পাদুকাদ্বয় মস্তকে ধারণ করিয়া তাঁহার পাদস্পর্শ পূর্ব্বক তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর তাহা হইলে আমি তোমার প্রাণদান করিব; নতুবা আমি তাহাতে অসমর্থ। প্রভুরাও শ্যালক সমীপে তাহাই করিলেন এবং বিদ্বষ বুদ্ধির বশবর্ত্তী হইয়া মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করিলেন যে যেমন পারি ইহার প্রতিফল দিব। তার পর শ্যালক ও ভগ্নিপতি আলিঙ্গন করিয়া উভয়ে মিষ্টালাপ করিতে লাগিলেন।

 প্রভুরাওয়ের যত্নাতিশয়ে পৃথ্বীরাজ তাহার বাটীতে পাঁচ দিবস অবস্থিতি করিলেন। নানা আনন্দে তাঁহাদের দিন কাটিল। একদা তিনি বসিয়া নিসর্গ সন্দর্শন করিতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার তারার সেই কাতরতা মনে পড়িল। তখন তিনি একেবারে প্রেম পারাবারে ঝম্পপ্রদান করিলেন। তাহার মন তার সেখানে থাকিতে চাহিতেছে না, তাহার চক্ষু নিয়ত তারার রূপ সন্দর্শনাভিলাষী হইতেছে। তাঁহার মন তারা বিষয়িণী চিন্তায় নিমগ্ন আছে এমন সময়ে তাহার ভগিনী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভ্রাতাকে বিষণ্ন দেখিয়া তিনি কারণ জিজ্ঞাসু হইলে পৃথ্বীরাজ বলিলেন, ভগিনি আমি অদ্য এখান হইতে রওনা হইব, তাহাই ভাবিতেছি। এই বলিবামাত্র সেই চারুনয়ন দ্রুতপদে পতির নিকট যাইয়া বলিলেন যে, আমার ভ্রাতা অদ্য এখান হইতে যাইবেন তাহার সম্মানোচিত সামগ্রী সকল প্রস্তুত করিয়া দাও। শুনিয়া প্রভু রাও স্বীয় দুষ্টাভিসন্ধির উত্তম সুযোগ পাইলেন। তখন তিনি হৃষ্টান্তকরণে তথা হইতে গমন করিলেন। প্রভুরাও এমনি এক মাজুম প্রস্তুত করিতে জানিতেন যে রাজস্থানের আর কেহই তেমন জানিত না। তখন তিনি সেই মাজুমের সহিত এমনি তীব্রতর হলাহল মিশ্রিত করিলেন যে তাহা খাওয়া দূরে থাকুক আঘ্রাণ করিলে, আর কাহার প্রাণ রক্ষার উপায় নাই। হায় তিনি এমন কাজ যে কি ভাবিয়া করিলেন তাহা মনুষ্য চিন্তার অগোচর। রে ক্ষত্রিয়াধম তোমার মনে কি এই ছিল! -রে কাপুরুষ তুমি কেন সম্মুখীন হইয়া সংগ্রাম করিলে না। তাহা হইলে ত মানুষের মনে এত ক্ষোভ থাকিত না। রে নরাধম এই কি তোমার ক্ষত্রিয়কুলোচিত কাজ হইল! এই কি তোমার বীরত্ব প্রকাশ হইল! হায় কেমন করিয়া তুমি এই অতি জঘন্য ঘৃণিত কাজ করিতে প্রবৃত্ত হইলে! তোমার শরীরে কি ভদ্রতা ও দয়ার লেশমাত্র ও নাই! তুমি কি পাষাণ হইতেও পাষাণ! তোমার অন্তর কি বিধাতা বজ্রে, গড়িয়াছিলেন! আহা তোমা হইতে যে ভারতবর্ষের কি অনিষ্ট সম্পাদন হইল তাহা তুমি কি বুঝিবে। যাহাদের ক্ষতি হইল তাহারাই জানিবে যে তুমি কি সর্ব্বনাশ করিলে!

 যৎকালে পৃথ্বীরাজ গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন তখন সেই দুরাত্মা ক্ষত্রকুলাঙ্গার প্রভু রাও বিশেষ যত্ন ও আদর সহকারে তাঁহাকে স্বহস্ত প্রস্তুত সেই মাজুম দিলেন। উন্নতাত্মা মহোদয় পৃথ্বীরাজ সেই মায়াকারীর কালকূট আদরে গ্রহণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

 পথিমধ্যে যাইতে যাইতে তারা বিষয়িণী চিন্তা তাহার মনকে অধিকার করিল। পৃথ্বীরাজ মনে মনে কতই কি ভাবিতে লাগিলেন। একবার মনে করিলেন যে এখনি প্রিয়তমাকে দেখিয়া হৃদয় পরিতৃপ্ত করিব; তাহার কোমল করতলে আমার কঠিন করতল স্থাপন করিরা অপার আনন্দ সলিলে ভাসমান হইব; তাঁহার সেই অপাঙ্গ ভঙ্গি সন্দর্শন করিয়া স্বীয় নয়নের সার্থকতা করিব; হায় আসিবার সময় প্রিয়া যে কি ব্যাকুল হইয়াছিলেন তাহা মনে হইলে পাষাণ হৃদয় ব্যক্তিরও হৃদয় বিগলিত হয়; আমি কি কঠিন যখন সেই মৃগনয়নার গণ্ডস্থল দিয়া অনর্গল অশ্রুধারা বহিতে লাগিল তখন সেই সব বারি যেন অগ্নির আকার ধরিয়া ঘৃতের ন্যায় আমার হৃদয়ে আহুতি প্রদান করিতে লাগিল; আমাকে সেই চারুহাসিনী যে কি মনেই করিয়াছেন তাহ কি বলিব। এখন আমি কেমন করিয়া তাহার নিকট দণ্ডায়মান হইব, এই ভাবিয়া আমার লজ্জা বোধ হইতেছে। আবার পরক্ষণেই ভাবিলেন আমি এখন প্রিয়ার নিকট অপরাধ স্বীকার করিব। এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে কমল মেরু তাহার নয়ন গোচর হইল। তখন তিনি আহ্লাদে গদগদ হইলেন। প্রিয়া সন্দর্শন লালসায় তাঁহার মন একেবারে অধীর ভাব অবলম্বন করিল। কিঞ্চিৎ শ্রম বোধ হওয়ায় অশ্ব পৃষ্ঠ হইতে প্রভুরাও প্রদত্ত সেই মাজুম গ্রহণ করিয়া সেবন করিলেন। সেবন করিবার অনতিকাল পরেই তাহার শরীর ক্রমশ অবশ হইতে লাগিল।

 ভবানী মামাদেবীর মন্দিরের সম্মুখীন হইয়া পৃথ্বীরাজ আর চলিতে পারিলেন না। তখন তিনি হঠাৎ আপনাকে ঈদৃশ ভাবাপন্ন দেখিয়া আশ্চর্য্যাম্বিত হইলেন। পরক্ষণেই তাহার সংশয়ের অপনোদন হইল। তাহার মনে পড়িল যে মাজুম খাইয়া তাহার শরীর এই রূপ হইয়াছে। তাহার পর তিনি সেই মাজুম পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন যে তাহাতে কালকূট মিশ্রিত আছে। দেখিয়া তিনি নৈরাশ্য সমুদ্রে জীবনের আশা একেবারে নিক্ষেপ করিলেন এবং অনন্ত দুঃখ সাগরে আপনার জীবন তরণী বিসর্জন দিলেন। এই সময়ে তাঁহার মনের ভাব যে কি হইল তাহা সেই ক্ষীরোদশায়ী ভগবান ভিন্ন প্রত্যক্ষ করিবার কাহারও ক্ষমতা নাই। হায় যিনি আশাকে সহায় করিয়া এতক্ষণ সুখ সলিলে সন্তরণ করিতেছিলেন, প্রিয়া সমাগম মনে করিয়া আহ্লাদে ভাসিতেছিলেন, কত রকম সুখই যাঁহার হৃদয় রাজ্যকে অধিকার করিয়াছিল, সেই ব্যক্তিই এখন আর আশাকে স্থান না দিয়া নৈরাশ্য সাগরে স্বীয় মহামূল্য জীবনকে নিক্ষেপ করিলেন।

 ক্রমে ক্রমে শরীর অবশ হইতেছে দেখিয়া পৃথ্বীরাজ তারার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন। এই বলিয়া দিলেন যে, আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাত কর, আমি ইহলোক হইতে বিদায় হইতেছি। অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া দূত অতি দ্রুতবেগে গমন করিল এবং কুম্ভমেরুতে উপস্থিত হইল। অবিলম্বে অনুমতি লাভ করিয়া সে অবরোধে প্রবেশ করিল এবং কৃতাঞ্জলিপুটে তারার নিকট প্রভুর আদেশ জানাইল। তাহার মুখে সেই মর্মান্তিক সংবাদ শুনিবা মাত্র পতিপ্রাণ তারা একেবারে হত চেতন হইলেন এবং কি করিবেন তাহা ঠিক করিতে পারিলেন না। কিয়ৎক্ষণ পরে আলু লায়িতকেশে পাগলিনীর ন্যায় তিনি কমল মেরু হইতে যাত্রা করিলেন। এদিকে সেই মাজুমের অন্তর স্থিত কালসম কাল কূট পৃথ্বীরাজের শরীরকে অধিকতর অবশ করিয়া দেলিল। তার পৌঁছিবার পূৰ্বেই সেই অসীম সদগণ সম্পন্ন বীর্য্যশালী উন্নতাত্মা মহাপুরুষ মানবলীলা সম্বরণ করিলেন। তারা আসিয়া দেখিলেন যে তাঁর জীবন সর্ব্বস্ব ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া গমন করিয়াছেন। দেখিবামাত্র তিনি চীৎকার করিয়া পৃথ্বীরাজের চরণোপান্তে পড়িয়া গেলেন এবং পৃথ্বীরাজের মৃতদেহ বক্ষঃস্থলে ধারণ করিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন।

 পৃথ্বীরাজের সহিত একটী বাহক ছিল সে তারাকে উঠাইল। চেতনা পাইয়া তারা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন হে অনুচর আমার . প্রাণ সর্ব্বস্ব কি বলিয়া ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন? শুনিয়া সে বলিল মহারাজ এই বলিয়া নয়নতারা মুদ্রিত করিলেন যে আমার তারা কই তারা কই তারা কই। তারা এই কথা শুনিবামাত্র আর থাকিতে পারিলেন না, চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, নাথ উঠ উঠ তোমার তারা আসিয়াছে, একবার নয়ন উন্মীলন করিয়া দেখ যে তোমার আদরের তারার কি গতি হইতেছে। কেন উত্তর দাও না, আমার অসিতে বিলম্ব দেখিয়া কি আমার উপর রাগ করিয়াছ? প্রাণবল্লভ কত শত গুরুতর অপরাধ ক্ষমা করিয়াছ, আজ এ তুচ্ছ অপরাধে আমাকে ক্ষমা করিতে সাহসী হইলে না! নাথ আমি প্রাণ দান করিলেও কি এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত নাই? প্রাণ সখা তুমি আমাকে ত্যজিয়া কোথায় চলিলে? আর কি এ জন্মে তোমাকে দেখিতে পাইব না? মনের দুঃখে যে বুক ফাটিয়া যাইতেছে! আমাকে এই অসীম যাতনা পারাবারে ফেলিয়া যাইতে কি তোমার দয়া হইল না! নাথ আমাদের মন যে প্রেম পাশে বাঁধা ছিল, মনে করিয়াছিলাম যে জীবন থাকিতে আর কখন বিচ্ছেদ হইবে না। প্রাণনাথ আমার হৃদয় যে তোমার বিশ্বাসের বাস স্থান ছিল, আমার মন যে তোমাকে ও সেইরূপ ভাবিত। তা- কেন গোপনে গোপনে পলায়ন করিলে? নাথ এই প্রেমের বন্ধন চ্ছেদন করিয়া যাইতে তোমার চরণযুগল কেমন করিয়া চলিল? নাথ তোমার সেই সরল মনে কেমন কবিয়া এ ভাবের উদয় হইল? হায় সেই দয়ার সাগর হৃদয় কেমন করির এত কঠিন হইল? আমার ভাগ্য দোষেই হইয়াছে, তোমার দোষ নাই। হায়, তোমার সেই সরল স্বভাব এখন কোথায় রহিল! কোথায় সেই সাগর সদৃশ ভালবাসা রহিল! প্রভু সকলি যে নিশার সঙ্গের তুল্য মনে হইতেছে। আমরা দুই জনে বিরলে বসিয়া ভাবপূর্ণ যে সকল কথা বলিতাম সেই সকল কথা মনে পড়িয়া যে হৃদয় দগ্ধ হইতেছে! যদি কখন আমাকে বিষাদিত দেখিতে তাহা হইলে যে তোমার ক্ষোভের সীমা থাকিত না। আমাদের দুইজনকে দেখিয়া সকলে বলিত যে এমন বিশুদ্ধ প্রণয় আর ধরাতলে নাই। ভাবিত যে ইহারা বুঝি অভেদ আত্মা হইবে। নাথ সে সকল এখন স্মরণ করিয়া যে হৃদয় দগ্ধ হইতেছে! যে প্রেমে আমাকে নিজ জীবনের অধিক ভাবিতে, আর যে প্রেমে আর আর সকলি তোমার অলীক মনে হইত, যে প্রেমে তোমাকে আমি বাঁধিয়া ছিলাম, নাথ সেই প্রেম এখন কোথায় রহিল! হৃদয়বল্লভ, তুমি যদি আমাকে প্রবঞ্চনা করিয়া পলায়ন করিলে তবে আর এই বিফল জীবন ধারণে আমার কি সুখ! উঃ আমি আর কাহার মুখ দেখিয়া নয়নকে চরিতার্থ করিব। আর কাহার বাকো আমার কর্ণ সুশীতল হইবে। নাথ রসনা আর কাহার সহিত কথা কহিয়া বাসনা পুরাইবে। আমার সুখ দুঃখের ভাগী আর কে হইবে। নাথ আর আমাকে সুধা বিনিন্দিত বচনে প্রেয়সী বলিয়া কে সম্বোধন করিবে! আমার নিকট প্রেমেতে গদগদ হইয়া আর কে উপবেশন করিবে! আমার এই চির তাপিত মন আর কে সুশীতল করিবে! তোমা বিনা যে চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতেছি। নাগ সেই বিদায় কি তুমি আমার নিকট হইতে জন্মের মতন গ্রহণ করিয়াছিলে। ইহজন্মে আর দেখা হইবে না বলিয়া কি আমার মন এত ব্যাকুল হইয়াছিল! এই বলিতে বলিতে সেই পতিপ্রাণা রমণীশিরোমণি চিতা প্রস্তুত করিতে আজ্ঞা দিলেন এবং মালতীকে লইতে পাঠাইলেন।

 এদিকে চিতা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন তারা মালতীকে পিতৃরাজ্য দান করিয়া স্বীয় হৃদয়েশ্বরকে হৃদয়ে ধারণ করিলেন এবং সেই প্রজ্জ্বলিত চিতায় আরোহণ করিলেন। দেখিয়া সকলে হাহাকার করিয়া বলিতে লাগিল যে আজ সত্য সত্যই কি আমাদের সুখতারা চিরদিনের মত অস্তমিত হইল।

 যখন পৃথ্বীরাজ পরলোকগামী হন তখন তাহার বয়ঃক্রম তেইস বৎসর মাত্র হইয়াছিল। তাঁহা হইতে যে রাজপুতানার ও ভারতবর্ষের কতই উন্নতি সাধন হইত তাহা কে বলিতে পারে।

 মামাদেবীর মন্দিরের সম্মুখে তারা ও পৃথ্বীরাজের শেষাস্থিগুলি অদ্যাপি একটা সুদৃশ্য মধ্যমাকার মন্দিরের নিম্নদেশে নিহিত রহিয়াছে।

 হায় পুত্রশোক কি ভয়ানক বিষ! পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই মহারাজ রায়মলের মৃত্যু হইল।


সম্পূর্ণ