বিষয়বস্তুতে চলুন

তিতাস একটি নদীর নাম/এক/প্রবাস খণ্ড

উইকিসংকলন থেকে

প্রবাস খণ্ড

 তিতাস নদীর তীরে মালোদের বাস। ঘাটে-বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মট্‌কি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তক্‌লি—সুতা কাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।

 নদীটা যেখানে ধনুকের মত বাঁকিয়াছে, সেইখান হইতে গ্রামটার শুরু। মস্ত বড় গ্রামটা,—তার দিনের কলরব রাতের নিশুতিতেও ঢাকা পড়ে না। দক্ষিণ পাড়াটাই গ্রামের মালোদের।

 মাঘ মাসের শেষ তারিখে সেই মালোপাড়াতে একটা উংসবের ধূম পড়িল। এটা কেবল কুমারীদের উৎসব। নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত।

 এ-পাড়ার কুমারীরা কোনোকালে অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢোল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু এই বিবাহের জন্যে তারা দলে দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে।

 মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে; প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভাঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিঁড়ি পূজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াছে: ‘লও লও সুরুজ ঠাকুর লও ঝুটার জল, মাপিয়া জুখিয়া দিব সপ্ত আঁজল।’ আজ তাদের শেষ ব্রত।

 তরুণ কলাগাছের এক হাত পরিমাণ লম্বা করিয়া কাটা ফালি, বাঁশের সরু শলাতে বিঁধিয়া ভিত করা হয়। সেই ভিতের উপর গড়িয়া তোলা হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি-ঘর। আজিকার ব্রত শেষে ব্রতিনীরা সেই চৌয়ারি মাথায় করিয়া তিতাসের জলে ভাসাইবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢোল-কাঁসি বাজিবে, নারীরা গীত গাহিবে।


 দীননাথ মালোর মেয়ে বাসন্তী পড়িল বিষম চিন্তায়। সব বালিকারই কারো দাদা, কারো বাপ চৌয়ারি বানাইতেছে,—ফুলকাটা, ঝালরওয়ালা, নিশান-উড়ানো কত সুন্দর সুন্দর চৌয়ারি। সংসারে তার একটি ভাইও নাই যে কোনরকমে একটা চৌয়ারি খাড়া করিয়া তার মাঘব্রতের শেষ-দিনের অনুষ্ঠানটুকু সফল করিয়া তুলিবে। বাপের কাছে বলিতে গিয়াছিল, কিন্তু বাপ গম্ভীর মুখে আগুন-ভরা মালসা, টিকা-তামাক-ভরা বাঁশের চোঙা, আর দড়িবাঁধা-কল্‌কে-ওয়ালা হুকা লইয়া নৌকায় চলিয়া গিয়াছে। ‘কাঠায়’ লাগিয়া কাল তার জাল ছিঁড়িয়াছে, আজ সারা দুপুর বসিয়া বসিয়া গড়িতে হইবে।

 মেয়ের এই মর্মবেদনায় মার মন দয়ার্দ্র হইল। তার মনে পড়িয়া গেল কিশোর আর সুবলের কথা। দুইটি ছেলেতে গলায় গলায় ভাব। এইটুকু বয়সেই ডানপিটে বলিয়া পাড়াতে নামও করিয়াছে। বাসন্তীর মার ভালই লাগে এই ডানপিটে ছেলেদের। ভয় ডর নাই, কোনো কাজের জন্য ডাকিলে উড়িয়া আসে, মা বাপ মানা করিলেও শোনে না। বিশেষতঃ কিশোর ছেলেটি অত্যন্ত ভাল, যেমন ডানপিটে তেমনি বিবেচক।

 বাসন্তীর মার আহ্বানে কিশোর আর সুবল বাসন্তীদের দাওয়ায় বসিয়া এমন সুন্দর চৌয়ারি বানাইয়া দিল যে, যারা দেখিল তারাই মুগ্ধ হইয়া বলিল,—বাসন্তীর চৌয়ারি যেন রূপে ঝলমল করিতেছে। নিশানে ঝালরে ফুলে উজ্জ্বল চৌয়ারিখানার দিকে গর্বভরে চাহিতে চাহিতে বাসন্তী উঠান-নিকানো শেষ করিলে, তার মা বলিল, ‘উঠান-জোড়া আলিপনা আকমু; অ বাবা কিশোর, বাবা সুবল, তোমরা একটা হাতী, একটা ঘোড়া, আর কয়টা পক্ষী আইক্যা দেও।’

 বাল্যশিক্ষা বই খুলিয়া তাহারা যখন উঠানের মাটিতে হাতী ঘোড়া আঁকিতে বসিল, বাসন্তীর তখন আনন্দ ধরে না। সারা মালোপাড়ার কারো উঠানে হাতীঘোড়া নাই; কেবল তারই উঠানে থাকিবে। শিল্পীদের অপটু হস্তচালনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া বাসন্তী এক সময় খুশিতে হাসিয়া উঠিল।

 আলিপনার মাঝখানে বাসন্তী ছাতা মাথায় দিয়া একখানি চৌকিতে বসিল। ছাতাখানা সে আস্তে আস্তে ঘুরাইতে লাগিল এবং তার মা ছাতার উপর খই আর নাড়ু ঢালিয়া দিতে লাগিল; হরির লুটের মত ছেলেরা কাড়াকাড়ি করিয়া সে-নাড়ু ধরিতে লাগিল। সবচেয়ে বেশি ধরিল কিশোর আর সুবল।

নারীরা গীত গাহিতেছেঃ ‘সখি ঐ ত ফুলের পালঙ রইলো, কই কালাচাঁদ আইলো।’ বহুদিনের পুরানো গীত। সাত বছর আগে বাসন্তী যখন পেটে আসে, তখনও তারা এই গানই গাহিত উৎসবের এই দিনটিতে। আজও উহাই গাহিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে দুখাই বাদ্যকর ঢোল ও তার ছেলে কাঁসি বাজাইতেছে। প্রতি বছর একই রকম তালে তারা ঢোল আর কাঁসি বাজায়। আজও সেই রকমই বাজাইতেছে। সবই একই রকম আছে, পরিবর্তনের মাঝে কেবল দুখাইর ঢোলটা আরো পুরানো হইয়াছে, তার ছেলেটা আরো বড় হইয়াছে।


 বাসন্তীর মাথায় জবজবে তেল, পরনে মোটা শাড়ি। এই কালকের থেকেই যেন আজ তাকে অনেকখানি বড় দেখাইতেছে। এই ভাবেই বাসন্তী আরো বাড়িয়া উঠিবে, এই ভাবেই কিশোরও বড় হইয়া উঠিবে, সুবলও বড় হইয়া উঠিবে। তবে কিশোর ছেলেটি অনেক ভাল, বাসন্তীকে তার পাশেই ঠিক মানাইবে।—বসন্তীর মার চিন্তায় বাধা পড়িল মেয়ের ডাকেঃ ‘মা, ওমা, দেখ সুবলদাদা কিশোরদাদার কাণ্ড। আমি চৌয়ারি জলে ছাড়তে-না-ছাড়তে তারা দুইজনে ধরতে গিয়া কি কাইজ্যা। এ কয় আমি নিমু, হে কয় আমি নিমু। ডরে আর কেউ কাছেঅ গেল না। শেষে কি মারামারি! আমি কইলাম, দুইজনে মিল্যা বানাইছ, দুইজনেই নিয়া রাইখ্যা দেও। মারামারি কর কেনে? শুইন্যা কিশোর দাদা ভালামানুষের মত ছাইড়া দিল। আর সুবলদাদা করল কি—মাগ্‌গো মা, দুই হাতে মাথাত্ তুইল্যা দৌড়!’

 সেদিন মালোপাড়ার ঘাটে ঘাটে সমারোহ। ঢোল সানাই বাজিতেছে, পুরনারীরা গান গাহিতেছে, দুপুরের রোদে তিতাসের জল চিক্‌ চিক্‌ করিতেছে। মালোর কুমারীরা আন্‌কোরা শাড়ি পরিয়া, তেল-জবজবে মাথায় চিত্র-বিচিত্র চৌয়ারি তুলিয়া, জলে ভাসাইয়া দিবার উদ্যোগ করিতেছে। কিন্তু মালোর ছেলেদের তর সহিতেছে না। মেয়েরা অনুনয় করিতেছে, এখনই ধরিও না, জলে আগে ভাসাই, তখন ধরিও।

 সব চৌয়ারিই জলে ভাসিল। ছেলেরা দৌরাত্ম্য করিয়া প্রায় সব কটাকেই ধরিল, কাড়াকড়ি করিয়া ছিঁড়িল, এবং ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় মাথায় করিয়া বাড়িতে ফিরিল। কিন্তু তাহাদের দস্যুতামুক্ত হইয়া কয়েকখানা চৌয়ারি তিতাসের মন্দ স্রোতে আর মৃদু তরঙ্গে অনেক বাহির-জলে চলিয়া গেল। তীর হইতে দেখা গেল যেন জলের উপর এক একটা ময়ূর পেখম ধরিয়াছে। কিন্তু তাদের যারা ভাসাইল, তারা সুখী হইল কি? ছেলেরাই যদি ধরিতে না পারিল, তবে মেয়েদের উহা ভাসাইবার সার্থকতা কই?

 কিশোরের জন্য বাসন্তী মনে বড় ব্যথা পাইল! এমন সুন্দর চৌয়ারিটা সে পাইল না, পাইল সুবলে। কিন্তু সে ছাড়িয়া দিল কেন? এমন নির্বিবাদে, ভালোমানুষের মত ছাড়িয়া দিল। কিন্তু মনে যে কষ্ট পাইয়াছে তা ঠিক। মানুষটাই এই ধাঁচের। বন্ধু যেন আর লোকের থাকে না! মানি, বন্ধু নিতে চাহিলে কোনো জিনিস নিজে আঁকড়াইয়া থাকে না। কিন্তু বন্ধুর জন্য চোখ বুজিয়া ভাল জিনিস এমন ছাড়িয়াও কেউ দেয় না!


 সুবলের বাপ গগন মালোর কোনোকালে নাও-জাল ছিল না। সে সারাজীবন কাটাইয়াছে পরের নৌকায় জাল বাহিয়া। যৌবনে সুবলের মা ভর্ৎসনা করিত, ‘এমন টুলাইন্যা গিরস্তি কত দিন চালাইবা! নাও করবা, জাল করবা, সাউকারি কইরা সংসার চালাইবা! এই কথা আমার বাপের কাছে তিন সত্য কইরা তবে ত আমারে বিয়া করতে পার্‌ছ। স্মরণ হয় না কেনে?’

 কিন্তু নিশ্চেষ্ট লোককে ভর্ৎসনা করিয়া ফল পাওয়া যায় না।

 ‘খাইবা বুড়াকালে পরের লাত্থি উষ্ঠা; যেমন মানুষ তুমি।’

 গগন এসব কথায়ও কর্ণপাত করে নাই।

 বুড়া কাল যখন সত্যই আসিল, তখন বলিত, ‘অখন বুঝ নি?’ ইহার উত্তরে গগনচন্দ্র বলিত, ‘আমার সুবল আছে। আমি ত করতাম পারলাম না, নাও-জাল আমার সুবলে করব। অত ভেন্ ভেন্ করিস্ না।’

 কাজেই সুবলের বাপ যখন মারা যায়, সুবলকে নৌকা গড়াইয়া দিয়া যাইতে পারে নাই। সুবল ‘মাথা-তোলা’ হইয়া কিশোরের নৌকায় গিয়া উঠিল। এবং তার সঙ্গেই জাল বাহিয়া চলিল। নিজের নাও-জাল করার কথা আর তার মনেই আসিল না। কিশোর বয়সে তার মাত্র তিন বছরের বড়। আশৈশব বন্ধু তারা। তাদের মধ্যে ভাব ছিল গলায় গলায়। শৈশবে দুইজনে বর্ষাকালে সাপেভরা বটের ঝুড়িতে বসিয়া খোপের মধ্য দিয়া বঁড়শি ফেলিত। শিং মাছের জাল বুনিয়া আঁধার রাতে বুকজলভরা পাটক্ষেতের আল ধরিয়া অনেক দূরে গিয়া পাতিয়া আসিত। রাত থাকিতে উঠিয়া শিংমাছ-কৈমাছ-গাঁথা জাল তুলিয়া আনিত। এসব জালে অনেক সময় সাপ গাঁথা পড়ে। কিন্তু মালোর ছেলেরা তাতে ভয় পায় না। অনেক মালোর ছেলে এভাবে মারা পড়ে দেখিয়াও ভয় পায় না। কেননা অনেক মরিয়া গিয়াও তারা অনেক বাঁচিয়া থাকে।

 একদিন দুইজনেরই বাপ তাদের পাঠশালায় পাঠাইল। প্রথম দিন তারা চুপচাপ কাটাইল। পরের দিন ভিন্নপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করিয়া শিক্ষকের মার খাইল। তার পরের দিন নিজেদের মধ্যে মারামারি করিয়া শিক্ষকের হাতে যে মার খাইল, তাহার মাত্রা সহনাতীত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া দুইজনেই এক সঙ্গে বাহির হইয়া পড়িল। পাঠশালায় আর গেল না। গুরুজনের মার খাইল, তবু গেল না, বরং সেদিন কিশোর কলাগাছের খোল কাটিয়া চটি জুতার মতো পরিল, সাখীকে ধমকাইয়া বলিল, ‘হেই সুব্‌লা, দেখ্, আমি বৈকণ্ঠ চক্রপত্তি, তুই আমারে ভক্তি দে।’

 শিক্ষকের কাকা বৈকুণ্ঠ চক্রবর্তী চটিপায়ে উঠানে রোদে বসিয়া তামাক টানিত আর পালেরা বণিকেরা পথ চলিতে তাঁহাকে পা ধরিয়া প্রণাম করিয়া যাইত। কিশোর ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল।

 তারপর একদিন দুইজনেরই উপর তাগিদ আসিল—সূতা পাকাও, জাল বোনো।

 তিতাস নদীর প্রশস্ত তীর। সেখানে এক দৌড়ের পথ লম্বা করিয়া সূতা মেলিত। বাঁশের চরখিতে কাঠি লাগাইয়া দুইজনে এক দুই তিন বলিয়া এমন জোরে পাক লাগাইত যে, কাঠি ভাঙ্গিয়া চরখি কাত হইয়া মাটিতে পড়িয়া যাইত। বর্ষায় যে বটের ঝুরিতে বঁড়শি ফেলিত, সুদিনে তারই তলা ছিল গরমের দুপুর কাটাইবার উত্তম স্থান। জাল লইয়া দুইজনে সেখানে গিয়া বসিত। জাল পায়ের বুড়া আঙ্গুলে ঠেকাইয়া দুইজনেই সমান গতিতে তকলি চালাইত। তাতে জালে অনেক বাজে গিট পড়িত সত্য কিন্তু বোনা খুব আগাইত।

 তারপর এক সময়ে কিছুদিন আগেপিছে দুইজনেরই নাও-জালে হাতেখড়ি হইল। অল্প দিনের মধ্যেই পাকা জেলে বলিয়া পাড়ার মধ্যে তাদের নাম হইয়া গেল।


 মাছের জো ফুরাইয়া গিয়াছে। মালোদের অফুরন্ত চাহিদা মিটাইতে গিয়া, দিতে দিতে তিতাস ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে।

 দুপুর পর্যন্ত জাল-ফেলা জাল-তোলা চলিল, কিন্তু একটি মাছও নৌকায় ফেলিতে পারিল না। জালের হাতায় হ্যাঁচ্‌কা একটা টান মারিয়া কিশোর বলিল, ‘জগৎপুরের ডহরে যা সুব্‌লা, ইখানে ত জালে-মাছে এক করা গেল না।’

 কিন্তু ডহরের অতলস্পর্শী জল জালের খুঁটিতে দীর্ণ-বিদীর্ণ করিয়াও মাছের হদিস মিলিল না। কিশোর পায়ের তলা হইতে বাঁশের গুড়ি ছাড়িয়া দিয়া একটানে বাঁধ খুলিয়া ফেলিল। আচম্‌কা আঘাতে ডহরের নিস্তরঙ্গ জল কাঁপিয়া উঠিল। তারই দিকে চাহিয়া কিশোর বলিল, ‘জান্ বাঁচাইতে চাস্ ত, উত্তরে চল্ সুব্‌লা।’


 একদিন কয়েকখানা নৌকা সাজিল। উত্তরে যাইবে। প্রবাসে। তাদের সঙ্গে কিশোরের নৌকাও সাজিল।

 তারা পুরাণো ছই নূতন করিল, নৌকা ডাঙায় তুলিয়া গাবকালি মাখাইল। জালগুলিকে কড়া গাব খাওয়াইয়া তিনদিন বিশ্রাম দিল। অতিরিক্ত কিছু বাঁশ আর দড়াদড়িও যোগাড় করিল।

 কিশোরের বাপ সঙ্গে গেলে বাড়িতে থাকিবার কেউ থাকে না। বুড়া মানুষ বাড়িতে থাকিয়া সকাল সন্ধ্যা ঘাটে কিনিয়া-বেচিয়া যা পাইবে, সংসার চালাইবে। আরেকজন ভাগীদার দেখা দরকার।

 কিশোরের বাপ ভাবিয়া দেখিল, দুইজনই বালক, কোনোদিন বড় নদী দিয়া বিদেশ যায় নাই। সেখানে গিয়া অনেক কথা বলিতে হইবে। বুদ্ধি বিবেচনা খরচ করিতে হইবে। ডাকাতে ধরিয়া জাল ছিনাইয়া নিতে চাহিলে, সামান্য জাল নিয়া কেবল গরীবকেই মারা হইবে, আর কোনো লাভ হইবে না বলিয়া ডাকাতের মন ভিজাইতে হইবে। একজন বয়স্ক লোকের দরকার। জলের উপর ছয় মাস চরিয়া বেড়াইতে হইবে। তিলকচাঁদ প্রবীণ জেলে। একটু বেশী বুড়া। তা হোক। সঙ্গে দুইজন জোয়ান মানুষ ত রহিলই।

 রাব-তামাক মাখিয়া গুল করিতে করিতে কিশোরের বাপ বলিল, ‘তিলকচাঁদ জানেশুনে। তারে নে। গাঁওএর নাম শুকদেবপুর। খলার নাম উজানিনগরের খলা। মোড়লের নাম বাঁশিরাম মোড়ল।’

 একদিন ঊষাকালে তিনজনে নৌকায় উঠিল।

 বিদায় দিবার জন্য নদীর পারে যারা গেল, তাদের সংখ্যা সামান্য। একজন আধৰুড়ি–কিশোরের মা। আর একজন বাসন্তীর মা, আর তার মেয়ে বাসন্তী—এগারো বছরের কুমারী কন্যা।

 বুড়ি বলিল, ‘আ মাইয়ার মা, জোকার দেও না।’

 বুড়ির ঠোঁটে জোকার বাজে না। বাসন্তী ও তার মা জোকার দিল। দেড়জনের উলুধ্বনি বলিয়া তাহা ঊষার বাতাসকে কাঁপাইল মাত্র। কলরব তুলিল না। কিশোরের বাপ নদীতীরে যায় নাই। ঘরে বসিয়া ঘনঘন কেবল তামাক টানিতেছিল। ছেলেকে বিদায় দিয়া ঘরে আসিয়া বুড়ি কাঁদিয়া উঠিল।

 পাঁচপীর বদরের ধ্বনি দিয়া প্রথম লগি-ঠেলা দিল তিলক। সুবল হালের বৈঠা ধরিল। তার জোর টানে নৌকা সাপের মতো হিস্ হিস্ করিয়া ঢেউ তুলিয়া ঢেউ ভাঙ্গিয়া চলিল। তিলকচাঁদ গলুইয়ে গিয়া দাঁড় ফেলিয়াছে। কিন্তু তার দাঁড়ে জোর বাঁধিতেছেনা। শুধু পড়িতেছে আর উঠিতেছে। ছইএর উপর একখানা হাত রাখিয়া কিশোর মাঝ-নৌকায় দাঁড়াইয়া ছিল। দেখিতেছিল তাদের মালোপাড়ার ঘরবাড়ি গাছপালাগুলি, খুঁটিতে বাঁধা নৌকাগুলি, অতিক্রান্ত ঊষার স্বচ্ছ আলোকেও কেমন অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে সারাটি গ্রাম, আর গোচারণের মাঠ। অদৃশ্য হইতেছে কালীসীমার ময়দান আর গরীবুল্লার বটগাছ দুইটি। জলের উষ্ণতায় শীতের প্রভাতী হাওয়াও কেমন মিষ্টি। গলুইর দিকে আগাইয়া গিয়া কিশোর বলিল, ‘যাও তিলক, তামুক খাও গিয়া। দাঁড়টা দেও আমার হাতে।’


 তিতাস যেখানে মেঘনাতে মিলিয়াছে, সেইখানে গিয়া দুপুর হইল। কিশোর দাঁড় তুলিয়া খানিক চাহিয়া দেখিল। অনুভব করিল মেঘনার বিশালত্বকে, আর তার অতলস্পর্শী কালো জলকে। এপারের শক্ত মাটিতে এক সময়ে ভাঙন হইয়া গিয়াছে। এখন আর ভাঙিতেছে না। কিন্তু ভাঙনের জয়পতাকা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে পর্বতের মতো খাড়া পাড়টা। ছোট ছোট ঢেউয়ে মসৃণ হইয়া রহিয়াছে বড় বড় মাটির ধ্বস্। ওপারে—অনেক দূরে, যেখানে গড়ার সমারোহ—দেখা যায় সাদা বালির ঢালা রূপালি বিছানা। ভাঙিয়াছে গাছে-ছাওয়া জনপদ, গড়িয়াছে নিষ্ফলা ধু ধু বালুচর।

 তিলককে ভাত চাপাইতে বলিয়া কিশোর গলুইয়ে একটু জল দিয়া প্রণাম করিল। তারপর আবার দাঁড় ফেলিল।

 সন্ধ্যা হইল ভৈরবের ঘাটে আসিয়া।

 এখানে কয়েকঘর মালো থাকে। ঘাটে খুঁটি-বাঁধা কয়েকটি নৌকা, পাড়ে বাঁশের উপর ছড়াইয়া দেওয়া কয়েকটি জাল, এখানে-সেখানে মাটিতে কালো চারকোণা গর্তে গাবের দাগ, পাশে গাবের মট্‌কি গামলা বেতের ঝুড়ি—দেখিলেই চেনা যায় এখানে মালোরা থাকে।

 গ্রামের পাশে সূর্য ঢাকা পড়িলেও আকাশে একটু একটু বেলা আছে। নৌকা বাহিলে আরো একটা বাঁক ঘোরা যাইত কিন্তু সম্মুখে রাত কাটাইবার ভাল জায়গা তিলক স্মরণ করিতে না পারায় কিশোর বলিল, ‘এই জাগাত্‌ই রাইত্ থ্যাইক্যা যাই রে সুব্‌লা।’

 এখান হইতে বাড়িগুলিও দেখা যায়। গ্রাম আগে বড় ছিল। মালোদের অনেক জায়গা রেলকোম্পানি লইয়া গিয়াছে। বৃহত্তর প্রয়োজনের পায়ে ক্ষুদ্র আয়োজনের প্রয়োজন অগ্রাহ্য হইয়া গিয়াছে। তবু এ গায়ের মালোরা গরীব নয়। বড় নদীতে মাছ ধরে। রেলবাবুদের পাশে থাকে। গাড়িতে করিয়া মাছ চালান দেয়। তারা আছে মন্দ-না।

 ‘কিশোরদাদা, ভৈরবের মালোরা কি কাণ্ড করে জান নি? তারা জামা-জুতা ভাড়া কইরা রেলকম্পানির বাবুরার বাসার কাছ দিয়া বেড়ায়, আর বাবুরাও মালোপাড়ায় বইআ তামুক টানে আর কয়, পোলাপান ইস্কুলে দেও,—শিক্ষিৎ হও, শিক্ষিৎ হও।’

 তিলক ক্ষেপিয়া উঠিয়া বলিল, ‘হ, শিক্ষিৎ হইলে শাদি-সম্বন্দ কর্‌ব কি না! আরে সুব্‌লা, তুই বুঝ্‌বি কি! তারা মুখে মিঠা দেখায়, চোখ রাখে মাইয়া-লোকের উপর।’

 ব্যাপারটার মীমাংসা করিয়া দিল কিশোর; হাসিয়া বলিল, ‘না তিলকচাঁদ, না। চোখ রাখে বড় মাছের উপর। যা শোনা যায় তা না। তা হইলে কি জাইন্যাশুইন্যা নগরবাসী এই গাঁওএ সমন্দ ঠিক করত।’

 ‘কিশোরদাদা, চল মাইয়ারে একবার দেইখ্যা যাই। বাড়ি চিন নি?’

 ‘বাড়ি চিনি না, কেবল নাম জানি,—ডোলগোবিন্দর বাড়ি।’

 মেয়েরা দিনের শেষে জল ভরিতে আসিয়াছে। দলে দেখা গেল কয়েকটি কুমারী কন্যাকে।

 কিশোর চোখ টিপিয়া বলিল, ‘গিয়া কি করবি? এর মধ্যে থাইক্যা দেইখ্যা রাখ’।


 সারারাত সুখে ঘুমাইয়া তারা ঊষার আলোকে নৌকা খুলিয়া দিল।

 ভৈরব খুব বড় বন্দর। জাহাজ নোঙর করে। নানা ব্যবসায়ের অসংখ্য নৌকা। কোনো নৌকাই বেকার বসিয়া নাই। সব নৌকার লোক কৰ্ম-চঞ্চল। নৌকার অন্ত নাই। কারবারেরও অন্ত নাই। লাভের বাণিজ্যে সকলেই তৎপর, আপন কড়াগণ্ডা বুঝিয়া পাইবার জন্য সকলেই ব্যস্ত। যারা পাইয়াছে তারা আর অপেক্ষা করিতেছে না। আগের যারা অবেলায় পাইয়াছে, তারা রাতটুকু কাটাইয়া কিশোরের নৌকা খোলার সময়েই নৌকা খুলিয়াছে। বেশির ভাগ গিয়াছে—যে দিক হইতে আসিয়াছে সেই দিকে; কিশোরেরা যাইতেছে সামনের দিকে। বন্দরের এলাকা পর্যন্তই কর্মচাঞ্চল্য। এর সীমা অতিক্রম করিতেই দেখা গেল সকল প্রাণস্পন্দন থামিয়া গিয়াছে।

 বন্দরের কলরব ধীরে ধীরে পশ্চাতে মিলাইয়া গেল। সম্মুখে বিরাট নদী তার বিশালতা লইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। শীতের নদী। উত্তরের হাওয়া সরিয়া গিয়াছে। দক্ষিণের বাতাস এখনো বাহির হয় নাই! নদীতে ঢেউ নাই, স্রোতের বেগও নাই। আছে কেবল শান্ত তৃপ্ত স্বচ্ছ অবাধ জলরাশি। এই অনন্তের ধ্যান ভাঙিয়া, এই প্রশান্তের মৌনতা বিঘ্নিত করিয়া কিশোরের নৌকার দুইখানা দাঁড় কেবল ওঠানামা করিতেছে।

 এতক্ষণ কূল ঘেঁষিয়া চলিতেছিল। ঢালা বালিরাশির বন্ধ্যা কূল। লোকের বসতি নাই, গাছপালা নাই, ঘাট নাই। কোনোখানে একটি নৌকার খুঁটিও নাই। এমনি নিষ্করুণ নিরালা কূল। রোদ চড়িলে, শীত অন্তৰ্হিত হইল। সুদূরের ইশারায় এই নির্জনতার মাঝেও কিশোরের মনে যেন আনন্দের ঢেউ উঠিল। নদীর এই অবাধ উদার রূপ দেখিতে দেখিতে অনেক গানের সুর মনে ভাসিয়া উঠিল। অদূরে একটা নৌকা। এদিকে আসিতেছে। কিশোর গলা ছাড়িয়া গান জুড়িল—

উত্তরের জমিনে রে,  সোনা-বন্ধু হাল চষে,
লাঙ্গলে বাজিয়া উঠে খুয়া।
দক্ষিণা মলয়ার বায়  চান্দমুখ শুখাইয়া যায়,
কার ঠাঁই পাঠাইব পান গুয়া।

 নৌকাটা পাশ কাটাইবার সময় তারা কিশোরের গানের এই পদটি শুনিল—

নদীর কিনার দিয়া  গেল বাঁশি বাজাইয়া,
পরার পীরিতি মধু লাগে।
কু-খেনে বাড়াইলাম পা’  খেয়াঘাটে নাইবে না,
খেয়ানীরে খাইল লঙ্কার বাঘে।

 একজন মন্তব্য করিল, ‘বুড়ারে দাঁড় টানতে দিয়া জোয়ান বেটা খাড়ইয়া রইছে, আবার রস কেমুন, পরার পীরিতি মধু লাগে।’

 কিশোর আঘাত পাইয়া বলিল, ‘যাও তিলকচাঁদ, তুমি গিয়া ঘুমাইয়া থাক।’

 তিলক নৌকার মালিকের আদেশ অগৌণে পালন করিল।

 আবার নির্জনতা। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল।

 দাঁড়ের উপর মনের পুলক ঢালিয়া কিশোর বলিল, ‘বা’র গাঙ্ দিয়া ধর্‌ত দেখি সুবলা। খালি বালু দেখতে আর ভাল লাগেনা। ধর্ কোণাকুনি ধর্। পার বাইবি ত অই পার দিয়া ধর্। এই পারে কিচ্ছু নাই।’

 কিন্তু ও-পার তখনো চোখের আড়ালে। যা দৃষ্টির বাহিরে, তারই হাতছানির মায়ায় তারা বিপদে পা দিল। কিশোরের বুক একবার একটু কাঁপিয়াছিল একটা গান মনে পড়িয়া ‘মাঝিভাই তোর পায়ে পড়ি, পার দেখিয়া ধর পাড়ি।’ কিন্তু শেষের কথাগুলি সুন্দর, ‘পিছের মাঝি ডাক দিয়া কয় নৌকা লাগাও প্রেম-তলায়। হরি বল তরী খুল সাধের জোয়ার যায়।’ কিশোর নিজের মনকে প্রবোধ দিল, বৈঠার আওয়াজ বেসুরা হইতেছে দেখিয়া সুবলকেও সাহস দিল, ‘না সুবলা, ডরাইস্‌না। গাঙের ডর মাইঝ গাঙে না, গাঙের বিপদ পারের কাছে। বা’র গাঙে মা-গঙ্গা থাকে, বিপদে নাইয়ারে রক্ষা করে।’

 তিলকচাঁদের ঘুম ভাঙ্গিল। বাহিরে আসিয়া দেখে বেলা নাই। নৌকার লক্ষ্য যে তীরের দিকে, সে-তীরের ভরসা নাই, পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে যে তীর, তারও ভরসা নাই।

 শীতের বেলা ফুরাইল ত একেবারেই শেষ হইয়া গেল। নদীর উপর যাও বা একটু আলো ছিল তাও অদৃশ্য হইল। তারপর তারা কুলহারা হইয়া কেবল মেঘনার বুকেই নিরুদ্দেশ হইল না, আঁধারের বুকেও আত্মসমর্পণ করিল।

 সুবল বৈঠা রাখিয়া ছইয়ের ভিতর আসিল, টিমটিমে একটা আলো তিলক জ্বালাইয়াছিল, সেটা রাগ করিয়া নিভাইয়া ফেলিল। তিলক তামাক টানিতেছিল, সেটা একটানা টানিয়া চলিল। শুধু কিশোর নিরাশ হইল না। সুবলের পরিত্যক্ত হালখানা হাতে লইয়া জোরে কয়েকটা টান দিল। হঠাৎ নৌকাটা কিসের উপর ঠেকিল, ঠেকিয়া একেবারে নিশ্চল হইয়া গেল। আতঙ্কিত হইয়া তিলক বলিয়া উঠিল, ‘আর আশা নাই সুব্‌লা, কুমীরের দল নাও কান্ধে লইছে।’

 ‘আমার মাথা হইছে। নাও আটকাইছে চরে। বাইর অইয়া দেখ না।’

 বাহির হইয়া দেখিয়া তিলক বলিল, ‘ইখানে পাড়া দে।’

 রাত পোহাইলে দেখা গেল এখানে নদীর বুকে একটুখানি চর জাগিয়াছে, তারই উপরে লোকে নানা জাতের ফসল বুনিয়াছে। চারাগুলিতে ফুল ধরিয়াছে। মাছিমাকড়েরা ইহারই মধ্যে বাসা করিয়াছে। পাখ্‌পাখালিরাও খোঁজ পাইয়া সকাল বেলাতেই বসিয়া গিয়াছে। মেলার মতো।


 ভোরের রোদে নৌকা খুলিয়া দুপুর নাগাদ অনেক পথ আগাইয়া তারা পূবপার ধরিল। ঘাটে নৌকা বাঁধা, পারে জাল টাঙানো—সেখানেও এক মালো পাড়া।

 ‘চিন নি তিলক, ইটা কি গাঁও?’

 তিলক চিনিতে পারিলনা।

 ‘ইখানেই নাও রাখ্ সুবলা। দুপুরের ভাত ইখানেই খাইয়া যাই।’

 ‘হ, খাওয়াইবার লাইগ্যা তারা তৈয়ার হইয়া রইছে।’

 ‘ভাত খামু নিজে রাইন্ধা, পরের আশা করি নাকি?’

 ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। তারই একটার পাশে সুবল নৌকা ভিড়াইল।

 একজন নৌকায় বসিয়া ছেঁড়া জাল গড়িতেছিল। কৌতূহলী হইয়া আগন্তুক-নৌকার দিকে তাকাইল। মালোদের নৌকা, দেখিলেই চেনা যায়। ভিড়িতেই, কোন্ গ্রামের নৌকা, কোথায় যাইবে জিজ্ঞাসা করিল।

 তারাও জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, গ্রামের নাম নয়াকান্দা। ত্রিশ-চল্লিশ ঘর মালো থাকে। নয়া বসতি করিয়াছে। আগে ছিল পশ্চিম পারের এক শিক্ষিত লোকের গ্রামে। নদীর পারে যেখানে তারা নৌকা বাঁধিত জাল ছড়াইত, জমিদার সে-জমি তাদের নিকট হইতে জোর করিয়া ছিনাইয়া অন্য জাতের কাছে বন্দোবস্ত দিয়াছে। তাই তারা সেই অবিচারের গ্রাম ছাড়িয়া এখানে আসিয়া নূতন বাড়ি বাঁধিয়াছে। এখানে জমিদার নাই। বেশ শান্তিতে আছে। হাটবাজার দূরে। কিন্তু ঘাটে নৌকা আছে, দেহে ক্ষমতা আছে। তার দূরকে সহজেই নিকট করিতে পারে।

 কিশোর মুগ্ধ হইয়া শুনিতে শুনিতে হাতের হুকা তার দিকে বাড়াইয়া দিল।

 ‘আমার হুক্কাও আইতাছে। দেও আগে তোমারটাই খাই।’

 এই সময়ে একটি ছোট দিগম্বরী হৃষ্টপুষ্ট মেয়ে আসিতেছে দেখা গেল। বাড়ি থেকে হুকা লইয়া আসিয়াছে। শরীরের দুলানির সঙ্গে সঙ্গে হুকাটা ডাইনে-বাঁয়ে দুলিতেছে। নৌকাব কাছে আসিয়া ডাকিল, ‘বাবু, আমারে তোল্।’

 মেয়ের হাত হইতে হুকা লইয়া কিশোরের দিকে বাড়াইয়া লোকটি বলিল, ‘আমি খাই তোমার হুক্কা, তুমি খাও আমার ঝিয়ের হুঙ্কা। —আমার ঝি।’

 মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি গো মা, জামাই দেখছ নি? বিয়া দিয়া দেই?’

 ‘কার ঠাঁই?’

 ‘এই বুড়ার ঠাঁই।’

 ন্‌না, বুড়ার ঠাঁই না। আমার জামাই হইব যবুনার জামাইর মত সুন্দর। মায় কইছে।’

 ‘তা অইলে এই জামাইর ঠাঁই দেই?’

 কন্যাকর্তা সুবলের দিকে হাতের তক্‌লি বাড়াইল। সুবল কিশোরের দিকে চাহিয়া মুচকিয়া হাসিল।

 ‘নাও লইয়া আইছ, নিয়া যাইবায় বুঝি?’

 সুবল বলিল, ‘হ, লইয়া যামু অনেক দূর। এই দেশের কাওয়ার মুখও দেখ্‌তে পারবা না।’

 মেয়ের চিন্তিত মুখ দেখিয়া বাপের দয়া হইল, ‘না না আমার মায়েরে যাইতে দিমু না। জামাই আম্‌রা ঘর-জামাই রাখমু।’

 বাড়ি যাইবার সময় লোকটি কিশোরকে বলিয়া গেল, ‘শোন মালোর পুত্, তোমরার পাক আমার বাড়িতে হইব। আমার ঝি তোম্‌রারে নিমন্তন করল। —কি কও?’

 ‘না না, আম্‌রা নাওই রান্ধমু। তুমি খাও গিয়া। রাইতের জালে যাও বুঝি।’

 ‘ইখানে রাইতের জাল বাওন লাগে না। বেহানে কটা বিকালে কটা খেউ দিলেই হয়। অদৈন্য মাছ। কত মাছ ধরবায় তুমি।’

 লোকটি মেয়েকে স্নান করাইল, নিজে স্নান করিল, গামছা পরিয়া কাপড় নিংড়াইয়া কাঁধের উপর রাখিল। তারপর মেয়েকে কোলে তুলিয়া গ্রামপথে পা বাড়াইল। কিশোরের চোখে ভাসিয়া উঠিল সুন্দর একটি পরিবারের ছবি, যে-পরিবারে একটি নারী আছে একটি নন্দিনী আছে, আর পুরুষকে সারারাত নদীতে পড়িয়া থাকিতে হয় না। তার মনে একটা ঔদাস্যের সুর খেলিয়া গেল। নির্লিপ্তকণ্ঠে বলিল, ‘কইরে সুবলা, কি করবে কর। —নাও ভাসাইয়া দিমু।’


 কিছুই করিতে হইল না। গলায় মালা কপালে তিলক একজনকে পল্লীপথে বাহির হইয়া আসিতে দেখা গেল। তার মুখময় হাসি। কোনো ভূমিকা না করিয়াই বলিল, ‘দেখ মালোর পুত। দোহাই তোমার দোহাই তোমার বাপের। আমার ঘাটে যখন নাও লাগাইছ, সেবা না কইরা যাইতে পারবায় না।’

 সবল তার কথা বলার ভঙ্গী। প্রত্যেকটি কথা আত্মপ্রত্যয়ে সুদৃঢ়। কিশোরের মৃদু প্রতিবাদ তৃণের মতো উড়িয়া গেল।

 খাইতে বসিলে, সেই নন্দিনী-গর্বিত পাত্রান্বেষী লোকটি বলিল, ‘এ-ই। তখনই আমি মনে কর্‌ছিলাম, আমার হাতে ছাড়া পাইলেও সাধুর হাতে ছাড়ান নাই। তাই ঘাটে কিছু না কইয়া জানাইয়া দিলাম সাধুরে।’

 খাওয়ার পর সাধু ধরিল, আজ রাতটুকু থাকিয়া যাও। একটু আনন্দ করিবার বাসনা হইয়াছে।

 তিলক বলিল, ‘আম্‌রা ত বাবা গান জানি না।’

 ‘জান না! কোন্ জায়গাতে বিরাজ কর তোমরা?’

 ‘গ্রামের নাম গোকনঘাট—’

 ‘আমি সেই কথা কই না। আমি কই, তোমরা বিরাজ কর বৃন্দাবনে না কৈলাসে—তোমরা কৃষ্ণমন্ত্রী না শিবমন্ত্রী।’

 তিলকের সেই কোন যৌবনকালে গুরুকরণ হইয়াছিল। গুরু তার কানে কৃষ্ণমন্ত্রই দিয়াছে। যদিও সে দীক্ষা অনুযায়ী কোন কাজই আজ পর্যন্ত করিয়া উঠিতে পারিল না, তবু গুরুর তিন আখরের মূলমন্ত্র ভোলে নাই। সাধুর প্রশ্নে সে একটুও ইতস্তত না করিয়াই বলিল, ‘আম্‌রা বাবা কিষ্ণমন্ত্রী।’

 ‘এই দেখ, গুরু মিলাইছে। আনন্দ করার গানে ত জানা-অজানার কথা উঠে না বাবা, কেবল নামের রূপ-মাধুরী পান করতে হয়। ষোল নাম বত্রিশ আখরের মাঝে প্রভু আমার বন্ধন-দশায় আছে। শাস্ত্রে কয় বৃন্দাবনে অপ্রাকৃত মদনমোহন। বিবর্তবিলাসের কথা। সে হইল নিত্য-বুন্দাবনের কথা। তিনি লীলা-বৃন্দাবনে আইসা সুবলাদি সখা আর ললিতাদি সখীসহ আদ্যাশক্তি শ্রীমতী রাধিকারে লইয়া লীলা কইরা গেছে। সেই লীলা-বৃন্দাবনে অখন আর তান্‌রা নাই। আছেন নিত্য-বৃন্দাবনে। সেই নিত্য-বৃন্দাবন আছে এই দেহেরই মধ্যে। তবেই দেখ—তান্‌রা এই দেহের মধ্যেই বিরাজ করে। তারপর নদীয়া নগরের প্রভু গৌরাঙ্গ-অবতারের কথাখান ভাব না কেনে। পদকর্তা কইছেঃ আছে মানুষ গ সই, আছে মানুষ গওরচান্দের ঘরে, নিগুঢ় বৃন্দাবনে গ সই, আছে মানুষ॥ এক মানুষ বৈকুণ্ঠবাসী, আরেক মানুষ কালোশশী, আরেক মানুষ গ’ সই, দেহের মাইঝে রসের কেলি করে —নিগুঢ় বৃন্দাবনে গ সই আছে মানুষ॥’

 কথাগুলির অর্থ তিলক কিছু কিছু বুঝিল। কিশোর ও সুবল মুগ্ধ আনুগত্যের দৃষ্টি দিয়া বক্তার কথাগুলি উত্তমরূপে শুনিয়া লইয়া মনে মনে বলিল, এসব তত্ত্বকথা, অত্যন্ত শক্ত জিনিস। যে বুঝে সেই স্বর্গে যায়। আমি তুমি পাপী মানুষ। আমরা কি বুঝিব!

 অনেক রাত পর্যন্ত গান হইল। সাধু নিজে গাহিল। পাড়ার আরো দু’চারজন গাহিল। তিলকও তাহার জানা ‘উঠান-মাটি ঠন্‌ঠন পিড়া নিল সোতে, গঙ্গা মইল জল-তিরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে’, গানটি গাহিল। সাধুর নির্বন্ধাতিশয্যে কিশোর আর সুবল দুইজনে তাহদের গাঁয়ের সাধুর বৈঠকে শোনা দুই-তিনটা গান গাহিয়া সাধুর চোখে জল আনিল।

 তাদের গান শুনিয়া সাধু মুগ্ধ হইল। ততোধিক মুগ্ধ হইল তাদের সরল সাহচর্যে। মনে মনে বলিলঃ বৃন্দাবনের চির কিশোর তোমরা, কৃষ্ণে তোমাদের গোলকের আনন্দ দান করুক। আমাকে যেমন তোমরা আনন্দ দিলে তোমরাও তেমনি আনন্দময় হও।

 পরদিন তারা এখান হইতে নৌকা খুলিল। ছপ্ ছপ্ ছলাৎ শব্দ করিয়া নৌকা দুই তরুণের দাঁড়ের টানে ঢেউ ভাঙ্গিয়া আগাইয়া চলিল। তীরে দাঁড়াইয়া সাধু। নৌকা যতই দূরে যাইতেছে, তার দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে। তার কেউ নাই। সকলের মধ্যে থাকিয়াও সে একা। তারা আনন্দ করিতে জানে না, আনন্দ দিতে জানে না। যারা আনন্দ দিতে পারিল, তাকে একটানা দৈনন্দিনতার মধ্যে ফেলিয়া তারা ঐ দূরে সরিয়া যাইতেছে।

 অকুল মেঘনার অবাধ জলরাশির উদার শুভ্র বুকের উপর একটি কালো দাগের মতো ছোট হইতে হইতে তারা এক সময় মিলাইয়া গেল।

 সাধুর বুক ছাপাইয়া বাহির হইল একটি দীর্ঘনিশ্বাস। তারা দিয়া গেল অনেক কিছু, কিন্তু নিয়া গেল তার চাইতেও অধিক।


 এইখানে পাড়টা ধনুকের মত বাঁকিয়া গিয়াছে। বাঁকা অংশ জুড়িয়া স্রোতের আবর্ত এত জোরে পাক খাইয়া চলিতেছে যে, তীরে লাগিয়া অমন শক্ত মাটিকেও যেন করাতকাটা করিতেছে, ছিন্নমূল তালগাছের মত ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এক একটা অতিকায় মাটির ধ্বস। ভাঙ্গনের এই সমারোহে পড়িয়া পাড়টা খাড়া উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। দেখিলে ভয় হয়! ইহার নিকট দিয়া নৌকা চালাইতে বিপদের আশঙ্কা আছে। যদি একটি ধ্বস ভাঙ্গিয়া নৌকার উপরেই পড়ে। যা স্রোত! আগানো বড় কঠিন। তবু আগাইতে হইবে।

 সকাল হইতে নৌকা বাহিয়া সুবল দুপুরে খাইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। একটানা রাতের-জালে যাওয়ার এমনি অভ্যাস। জালে না গেলেও রাতে চোখে ঘুম আসে না। দুপুরে চোখে ঘুম আসে, ঘুমাইতে হয়। তিলক সে কাজ দুপুরের আগেই সারিয়াছে। হুকা হাতে শুইয়া ছিল। হাতের হুকা হাতেই ছিল। দেখিয়া মনে হইয়াছিল যেন চাহিয়াই আছে। চোখ খোলা। অথচ এরই মধ্যে ঘুমাইয়া নিয়াছে। এখন গলুইয়ে বসিয়া ঝপাঝপ দাঁড় ফেলিতে ফেলিতে জলের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘এইবার যা মাছ পড়ব কিশোর! জলের রূপখান চাইয়া দেখ্।’

 মেঘনার বিশালতা এখানে অনেক কমিয়া গিয়াছে। ভাঁটিতে থাকিতে এপার হইতে ওপার একটা রেখার মতো দেখা যাইত। এখন উজানে আসিয়া, এপারে থাকিয়া ওপারের খড়ের ঘরগুলি পর্যন্ত সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।

 বিকালে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া সুবল অবাক হইল।

 তিলক, ইটা কোন্ গাঙ্?’

 ‘কোন্ গাঙ্ আবার। যে-গাঙ্ দিয়া আসা অইছে।’

 ‘ইখানে মেঘনা অত ছোট?’

 ‘যত উজানে যাইবা ততই ছোট।’

 ‘আরো কত উজানে যাইতে হইব? উজানি-নগরের খলা আর কতদূর? শুকদেবপুরের বাঁশিরাম মোড়লের বাড়ি আর কতদূর?’

 ‘আবার ঘুমাইয়া থাক। একেবারে তাঁর ঘাটে নাও ভিড়াইয়া ডাক দিমু, হুক্কা হাতে লইয়া।’

 ‘যাও আর ঠিসারা কইর না।’

 দূরে একখানা ছায়াচ্ছন্ন পল্লী। গাছপাতায় সবুজ। তাকে পাশে রাখিয়া যেন অকস্মাৎ নদী টানা ধনুকের মত বাঁকিয়া সোজা পশ্চিম দিকে অদৃশ্য হইয়াছে। পশ্চিম পারের আড়ালে পড়ায় এখান হইতে তাকে আর দেখা যাইতেছে না। বাঁকানো ঢালা পার। পড়ন্ত রোদে তার বালিরাশি চিক্‌চিক করিতেছে। সেই বালিঢালা পারের উপর একস্থানে দশ-বারখানি বড় বড় খড়ের ঘর। গাছপালা একটিও নাই; কোনোখানে সবুজের চিহ্নমাত্র নাই। কেবল বালি আর কয়েকখানা ঘর—মরুর বালুকায় পান্থ-নিবাসের মত। ব্যতিক্রম কেবল সচল অজগরের মত এলাইয়া পড়া নদীটি।

 আরো একটু স্পষ্ট হইয়া উঠিলে তিলক তার বৃদ্ধ চক্ষু দুইটির প্রতি অসীম করুণায় কিঞ্চিৎ আবেগের সঙ্গে বলিল, ‘ঐ দেখা যায় শুকদেবপুর আর ঐ উজানিনগরের খলা।’

 কিশোর আর কোন কথা বলিল না। যেখানটার পরে নদী আর দেখা যাইতেছেনা সেই দিকে চাহিয়া রহিল।


 বাঁশিরাম মোড়লের ঘাটে যখন নৌকা ভিড়িল, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে।

 মোড়ল খুব প্রতাপশালী লোক। এখানে নদীর পাঁচ মাইল তাঁর শাসনে। এখানে মাছ ধরিতে হইলে তাঁরই সঙ্গে বন্দোবস্ত করিতে হয়।

 পরদিন সকালে মোড়লের বাড়ি হইতে নিমন্ত্রণ আসিল, দুপুরে তাঁর বাড়িতে সেবা করিতে হইবে।

 দুপুরে স্নান করিয়া তিনজনে সেখানে উপস্থিত হইল।

 মোড়লের বাড়িতে চার ভিটাতে চারিটি খড়ের ঘর। সংস্কারাভাবে জীর্ণ। তারই একটার বারান্দায় বসিয়া সে এক বাক্স রূপার টাকা গুনিতেছে। তার শরীর পাথরের মত নিরেট, অসুরের মত শক্ত। রঙ কালো। বয়স পঞ্চাশের উপর। কিন্তু মাংসে চামড়ায় বার্ধক্য ধরে নাই। কণ্ঠার দুইপাশের মোটা হাড়ে অজস্র দৈহিক বলের পরিচয়। কিশোর মনে মনে বলিল, ‘তোমার মত মুনীসের পঁচিশটায় শ’। তোমার চরণে দণ্ডবৎ।’

 মোড়ল তার নূতন জেলেদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল।

 ‘নাম ত জান্‌লাম কিশোর। পিতার নাম ত জান্‌লাম না।’

 ‘পিতার নাম রামকেশব।’

 ‘হ, চিনতে পারছি। তোমরা ক’ ভাই।’

 ‘ছোট এক ভাই আছিল; মারা গেছে। অখন আমি এক্‌লা।

 ‘পুত্রসন্তান কি?’

 ‘আমার পুত্রসন্তান আমিই।’

 ‘হ, বুঝলাম। বিয়া করছ কই?’

 কিশোর চুপ করিয়া রহিল। কথা বলিল সুবল। এইবার দেশে গিয়া করিবে। সম্বন্ধ নিজ গ্রামেই ঠিক হইয়া আছে।


 রান্না যা কিছু হইয়াছে সবই বড়মাছের। কিশোরেরা ছোট মাছের জেলে। বড়মাছ বড় একটা মুখে পড়ে না, কেন না এ সব মাছ তারা ধরিতে পারে না। কোনোদিন কোনো বড় মাছ পথ ভুলিয়া তাদের জালে আসিয়া পড়িলেও পয়সার জন্য বেচিয়া ফেলিতে হয়।

 মোড়ল খায় যেমন বেশি খাওয়ার উপর তার মনোযোগও তেমনি অখণ্ড। খাওয়ার ফাঁকে একবার তার অতিথিদের কথা মনে পড়িল।

 ‘জাল্লা ভাই, যা খাইবা কেবল হাতের জোরে।’

 কিশোর কোন উত্তর দিতে পারিল না। কারণ আয়োজনের এত প্রাচুর্যের মধ্যে পড়িয়া তার খুব লজ্জা করিতে লাগিল। রুইমাছের মাথার খানিকটা চিবাইতে চিবাইতে উত্তর দিল তিলক, ‘কি যে তুমি কও মোড়ল।’

 কিশোরেরও একটা কিছু বলা দরকার। নৌকার মহাজন সে। কিন্তু এসব উত্তর চাতুর্যপূর্ণ ভাষায় দিতে হয়। সে-ভাষা কিশোরের জানা নাই। সরল মানুষ সে। তার কথাও সরল; ‘আমার দেশে অত বড় মাছ পাওয়া যায় না। বড়মাছ অত বেশি আম্‌রা খুব কম খাই।’

 শুনিয়া মোড়ল গিন্নি আর এক বাটি মাছ আনিল। কিশোর প্রবল আপত্তি জানাইল, ‘না না, না না।’

মোড়ল-বৌ বুদ্ধিমতী। কিশোরের এঁটো পাতে বাটিটা শব্দ করিয়া ঠেকাইল। এবার কিশোরকে মাছগুলি খাইতেই হইবে।

 মোড়ল-বৌ লম্বা ঘোমটা টানিয়া পরিবেশন করিয়াছে। মুখ দেখা যায় নাই। মুখ দেখা গেল খাওয়ার পর তারা বারান্দায় বসিলে যখন পান দিয়া গেল, তখন। মোড়ল চৌকির উপর বীরাসনে বসিয়াছে। তাকে ছেলেবেলার গল্পে-শোনা হনুমান ভীমাদি কোন বীরের মত দেখাইতেছে। কিশোর তাকে চোরা দৃষ্টিতে দেখিতেছে আর ভাবিতেছে, রাগ নাই অহংকার নাই, মানুষটার আছে কেবল শক্তি। উহার বুকের কাছটিতে একবার বসিতে পারিলে ঝড়তুফানেও কিছু করিতে পারিবে না।

 এমন সময় গিন্নি স্বামীর হাতে হুকা দিয়া গেল। একটু পরে পানের বাটা সাজাইয়া আনিয়া চারিজনের মাঝখানে রাখিতেই তার ঘোমটা সরিয়া গেল। কিশোর মুহূর্তের জন্য তার মুখখানা দেখিতে পাইল। শ্যামাঙ্গী ক্ষীণকায়া তরুণী। ভৈরবকায় মহাদেবের পাশে বালিকা-বধূ গৌরীকে যেমনটি দেখাইত এ-বৌ তাঁর পাশে বসিলে ঠিক তেমনই দেখাইবে। কিশোর চিন্তিত মনে বসিয়া রহিল।

 মোড়ল বলিল, ‘কি ভাবছ, আমার স্তিরাচার।’

 কিশোর আঘাত পাইল, ‘আমি বুঝি এই ভাবছি।’

 ‘আর কি ভাব্‌বা। আমার ঘরে এই ছাড়া আর কেউ নাই। আর যে ছিল, মারা গেছে সে। থাকলে তোমারে লইয়া অখন কত ঠার-ঠিসারা করত!’

 ‘মোড়ল!’

 ‘কি জাল্লা!’

 ‘তোমার দিকে চাইয়া আমার শিবঠাকুরের কথা মনে পড়ে। তোমার আত নামডাক, কিন্তু বাড়ি-ঘরের ছিরি নাই। তাজ্জবের কথা।’

 মোড়ল তার আয়ত চোখ দুটি মেলিয়া তার স্নিগ্ধ দৃষ্টি কিশোরের চোখ দুটির মধ্যে ডুবাইয়া দিল।

 ‘আমার মনে পড়ে আরও একজন শিবের কথা। সে-শিব বুড়া। সকলের দরবারে তার নামডাক। কিন্তু ঘরে তার দৈন্যদশা।’

 শিশুর মত বাধিত হইয়া মোড়ল বলিল, ‘তুমি আমারে শিব ঠাকুর বানাইলা। না জাল্লা, তুমি আমারে বুড়া শিব বানাইলা, আমার গৌরী বড় ভাল, তারে আবার নাচাইও না। আর, আম্‌রা ত শিবমন্ত্রী না, আম্‌রা কিষ্ণমন্ত্রী। তোম্‌রা কোন্ দেশের দেশী।’

 জবাব দিল তিলক, ‘বিন্দাবনের।’

 ‘অ, বুঝলাম, তোমরাও কিষ্ণমন্ত্রী। কিষ্ণে মিলাইছে। রাইতে আনন্দ করা চাই, মনে থাকে যেন। অখন একটু গড়াইয়া যাও।’

 উত্তম ভোজন পাইলে তিলকের পেট উঁচু হইয়া উঠে, নির্লজ্জভাবে অস্তিত্ব সপ্রমাণ করে। উহার সম্বন্ধে সচেতন হইয়া তিলক বলিল, ‘ঠিক কথাই কইছ মোড়ল। যা খাওয়াইছ, গড়াইয়াই যাইতে লাগ্‌বে, খাড়া হইয়া যাওয়ার ভর্‌সা খুব কম।’

 রসিকতা। মোড়ল শশব্যস্তে প্রতিবাদ করিল, ‘সে কথা কই না জাল্লা, আমি কই পাটি বিছাইয়া দেউক, একটু গড়াইয়া লও, তারপর যাইও। রাইতে আবার উজাগর করতে লাগব।’

 ‘অ, একটা শীতলপাটি বিছাইয়া দিলে গড়াইয়া যাইতে পারি।’

 ‘তুমি জাল্লা বড় ঢঙ্গী। তোমারে আমার বড় ভাল লাগে।’


 সেদিন তারা আর নৌকাতে ফিরিল না। শীতলপাটিতে গড়াইয়া বিকালে পাড়া বেড়াইতে বাহির হইল। তিলক বুড়া মানুষ। তার কাপড় হাঁটুর নিচে নামে না। কিন্তু কিশোর সুবল ধুতি পায়ের পাতা অবধি ঢিলা করিয়া কার্তিকের মত কোমরে গেরো দিয়াছে। কাঁধে চড়াইয়াছে এক একখানা গামছা।

 সুবলের বয়সের দোষ। সে শুধু দেখিল কার বাড়িতে ডাগর পাত্রী বিবাহের দিন গুনিতেছে। অনেককে দেখিল এবং সকলকেই মনে ধরিল। ইহাদের বাপ-মা সুবলকে লক্ষ্য করিতেছে এবং ওগো ছেলে, যাওয়ার পথে আমার মেয়েকে নিয়া যাইও, বাতাসে ভর করিয়া সুবলের কানে এই কথা পাঠাইতেছে, ইহা কল্পনা করিয়া সুবল মনে মনে পুলকিত হইয়া উঠিল।

 কিশোর ভাবিতেছে আর একরকম কথা। এগাঁয়ের লোকগুলি কি স্বাস্থ্যবান! নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়া, সকলের গায়েই জোরের জোয়ার বহিয়া চলিয়াছে, আটকায় সাধ্য কার। সকলেরই রঙ্ কালো। তবে হালকা রঙ্‌চটা কালো নয়, তেলতেলে পাথরের সুগঠিত মূর্তির মত কালো। কিশোরদের গাঁয়ের লোকও বেশির ভাগই কালো। কিন্তু মাঝে মাঝে পরিষ্কার লোকও আছে। নারীরাও অনেকেই কালো আবার অনেকেরই রঙ্ ফরসা। বাসন্তীর রঙ্ তো রীতিমত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের মেয়ের মত। কিন্তু এ গাঁয়ের নারী-পুরুষ সকলেই কালো।

 আর একটা ভাল জিনিস কিশোরের চোখে পড়িয়াছে। এখানে ঘরেঘরে জাল যেমন আছে তেমনি হালও আছে। প্রত্যেক বাড়িতেই একপাশে জালের সরঞ্জাম, আর এক পাশে হালের সরঞ্জাম। একদিকে আছে গাবের মট্‌কি, জালের পুটলি, দড়াদড়ি, ঝুড়ি ডোলা আরেকদিকে লাঙ্গল-জোয়াল, কাঁচি নিড়ানি, মই। অযত্নরক্ষিত ঘর দুখানার একখানাতে যেমন দুই এক পুরুষের পুরানো জালের পুটলি পুরাতন পঞ্জিকার মত জমিয়া উঠিয়াছে, তেমনি অন্যখানাতে বিভিন্ন বয়সের গরুবাছুরের ঘাসে ফেনে গোবরে থম্‌থম্ করিতেছে। ইহাদের জীবনদেবতা আকাশের আদমসুরতের মত দুই দিকে আঙ্গুল বাড়াইয়া রাখিয়াছে। একদিকে নদী মাছে ভরভর আর আরেকদিকে মাঠ ফসলে হাসি-হাসি। কোনোদিন কোন অদৃশ্য শয়তান যদি ইহাদের জালের গিঁটগুলি খুলিয়া দেয়, নৌকার লোহার বাঁধগুলি আলগা করিয়া ফেলে, আর নদীর জল চুমুক দিয়া শুষিয়া নেয়, ইহারা মরিবে না। ক্ষেতে শস্য ফলাইবে। এক হাতে ক্ষেতে শস্য ফলাইবে আরেক হাতে জালগুলি, নৌকাগুলি আগের মত ঠিক করিয়া লইবে। যথাকালে বর্ষার ঢল নামিয়া নদীটাকে আবার যৌবনবতী করিয়া দিবে। ইহারা মরিবে না। কিন্তু আমরাও কি মরিব! আমাদের গাঁয়ের মালোদের কারো খেত খামার নাই। কিন্তু তিতাস নদী আছে। তাকে শোষণ করিবে কে!

 ‘আরে, অ কিশোর, তামুক পাওয়া যায় কই! এক ছিলুম তামুক।’ তিলক এই বলিয়া কিশোরের ধ্যান ভঙ্গ করিল।


 সন্ধ্যার পর গানের আসর বসিল।

 প্রথম গান তুলিল তিলক। সুবল গোপীযন্ত্র বাজাইল। কিশোর কেবল হাততালি দিয়া মাথা দুলাইয়া তাল রাখিয়া চলিল।

 কৃষ্ণমন্ত্রী শিবমন্ত্রী দুই মতের লোকই আসিয়াছে। প্রথমে আসর-বন্দনা গাওয়ার পর দেখা গেল, এক কোণে কয়েকজন গাঁজার কল্‌কে সাজাইতেছে। তিলক ও-জিনিস কালেভদ্রে গ্রহণ করিয়া থাকে। এবারও এক টান কসিল। নাক দিয়া ধোঁয়া ছাড়িল। তারপর সুবলের দিকে রক্তচক্ষু করিয়া বলিল, ‘বাজাও’।

 সুবল গোপীযন্ত্র পেটে ঘসিয়া তাল ঠুকিল।

 মোড়ল মাঝ-আসরে বসিয়া ছিল। তার দিকে হাত বাড়াইয়া তিলক গান জুড়িল, ‘কাশীনাথ যোগিয়া—তুমি নাম ধর নিরাঞ্জন, সদাই যোগাও ভূতের মন, ভূত লইয়া কর খেলন, শিঙ্গা ডম্বুর কান্ধে লয়ে নাচিয়া’—

 অপর পক্ষের একজন বলিল, ‘গান বড় বে-ধারায় চল্‌ছে মোড়ল। ইখানে এই গানটা মানাইত—এক পয়সার তেল হইলে তিন বাতি জ্বালায়। জ্বেলে বাতি সারা রাতি ব্রজের পথে চলে যায়।’

 মোড়ল নিষেধ করিতে যাইতেছিল, ‘বিদেশী মানুষ, ছন্দি ধর কেনে?’ কিন্তু তাহার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। অনেক দিনের অনভ্যাসের পর তিলকের মগজে গাঁজার ধোঁয়া গিয়াছে। সামলাইতে পারিল না। অনেক কষ্টে মাথা খাড়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া এক সময় মোড়লের কোলের উপর এলাইয়া পড়িল। নেতৃহারা হইয়া কিশোরেরা আর গান গাহিল না। কেবল শুনিয়া চলিল। বিরোধী দল অনেক রকম গান গাহিবার পর যখন রাধাকৃষ্ণের মিলন গাহিয়া আসর শেষ করিল, তখন মোড়লের একটা লোক বাতাসার হাঁড়ি হাতে আগাইয়া আসিয়া কিশোরকে বলিল, ‘লও’। কিশোর স্বপ্নোত্থিতের মত সচেতন হইয়া হাত পাতিল, তারপর তিলককে ডাকিয়া তুলিল। তিলক যখন চোখ মেলিল, আসরে তখন ভাঙ্গন ধরিয়াছে।


 নদীর বুকে সকাল বড় সুন্দর। তখনো সূর্য উঠে নাই। আকাশে নীলাভ স্বচ্ছতার আভাস। চারি দিকে নীলাভ শুভ্রতা। এ শুভ্রতা মাখনের মত স্নিগ্ধ। চারিদিকের অবাধ নির্মুক্তির মাঝে এ-স্নিগ্ধতার আলাপন মনের আনাচে কানাচে সুরধ্বনি জাগায়। নদীর বুকে লক্ষ লক্ষ তরঙ্গ-শিশুর অস্ফুট করতালি জাগায় যে মুক্ত বাতাস, তারই মৃদু স্পর্শ তিলকের বৃদ্ধ সঙ্কুচিত বুকখানাও পূর্ণতায় প্রসারিত করিয়া তুলিল।

 পূবদিকে মোড়লদের পল্লী। গাছগাছালিতে ঢাকা উত্তরদিকে নদীটা বাঁকিয়া বাঁ দিকে অদৃশ্য হইয়াছে। দক্ষিণ দিকে নদী একেবারে তীরের মত সোজা, যতদূর দৃষ্টি চলে কেবল জল আর জল। দুইটি তীরের বাঁধনে পড়িয়া সে-জল দৈর্ঘ্যে অবাধ। তিলকের দৃষ্টি, যেখানে নদীর জলে আর আকাশের কোলে একাকার হইয়া মিশিয়াছে, সেইখানে। তারও অনেক দক্ষিণ হইতে ভাসিয়া আসিতেছে ফাল্গুন মাসের এই মৃদুমন্দ হাওয়া। সেই দিকে চাহিয়া তিলক বুক ভরিয়া নিশ্বাস লইল। বড় উদার আর অকৃপণ সে হাওয়া।

 নৌকার পিছন দিক খুঁটিতে বাঁধা। গলুই বাতাসের অনুকূলে উত্তর দিকে লম্বমান। মাঝ নৌকায় দাঁড়াইয়া তিলক কথা বলিল, ‘কিশোর, জাল লাগাইবার সময় হইছে।’

 অন্ধকার পাতলা হইয়া আসার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরের ঘুমও পাতলা হইয়া আসিয়াছে। তিলকের ডাকে তার শেষ সুতাটুকু ছিঁড়িয়া গেল।

 কিশোর ক্ষিপ্র হাতে হুকা ধরাইয়া সুবলকে ডাকিয়া তুলিল। সুবল ঘুমের গাধা। কিন্তু হুকার আওয়াজ পাইয়া তারও ঘুম টুটিয়া গেল।

 পাড়াটার আওতা ছাড়াইয়া তারা দক্ষিণে আগাইয়া গেল। পারের খানিকটা ঢালু। একটু উপর দিয়া সোজা একটা পায়ে-চলা পথ। তার ওপাশে ধানজমি। যতদূর চোখ যায় কেবল ধানগাছ। ভোরের বাতাসে তাদের শিশুশিরগুলি দুলিতেছে, তাতে একটানা একটা শব্দ হইতেছে। আকাশ বাতাস ঢেউ সব কিছুর প্রাতঃকালীন কোমলতার সহিত তাল রাখিয়া এ শব্দের সুরও ক্রমাগত কোমলে বাজিয়া চলিয়াছে। কিশোরের চোখ জুড়াইয়া গেল। মোড়লের গ্রামের লোকেরা এ সকল ধানের জমি লাগাইয়াছে। ধান হইলে ইহারাই সব কাটিয়া নিয়া ঘরে তুলিবে। বাত্যা-বাদলায় নদীতে নামিতে না পারিলেও কিশোরের দেশের মালোদের মত ইহাদের উপবাস করিতে হইবে না।

 ‘বাঁশটা আস্তে চালাইও তিলক। ধানগাছ নষ্ট না হয়। কার জানি এই ক্ষেত। মনে কষ্ট পাইব।’

 ‘তোমার যত কথা। কত রাখালে পাঁজনের বাড়ি দিয়া ক্ষেত নষ্ট করে, কত গাই-গরু চোরা-কামড় দিয়া ধানগাছের মাথা ভাঙে, আম্‌রারে চিন্‌ব কোন্—’

 তিলকের অর্বাচীনতায় কিশোর চটিয়া উঠিত। কিন্তু এই স্নিগ্ধ সকালবেলার সহিত চটিয়া ওঠা বড় বেমানান। কিশোরের মনের গোপনতায় যে সূক্ষ্ম শিল্পবোধ সব সময় প্রচ্ছন্ন থাকে, তারই ইঙ্গিত এবার তাকে চটিতে দিল না। সে আগেই তীরে নামিয়াছিল। তিলকের ছুঁড়িয়া-ফেলা বাঁশের আগাটা ক্ষিপ্রগতিতে ধরিয়া তার গতিরোধ করিল এবং তার উদ্যত আঘাত হইতে অবোলা ধানগাছগুলিকে বাঁচাইল।

 জাল লাগানো শেষ হইলে কিশোর নৌকায় উঠিয়া বাঁশের গোড়ায় পা দিল। সুবল পাছার কোরায় হাত দিলে গলুইয়ে গিয়া তিলক লগি ঠেলিয়া নৌকা ভাসাইল। নৌকা মাঝ নদীতে গেলে কিশোর জাল ফেলিল এবং এক আঁজল জল মুখে পুরিয়া কুলি করিয়া জালে ‘বুলানি’ দিল।

 কিছুক্ষণ ডুবাইয়া রাখিয়া কিশোর তাহার প্রথম খেউ তুলিল। ইঞ্চিপরিমাণ সরু সরু মাছ—রূপার মত রঙ্, ছোট ছোট ঢেউয়ের মত জীবন্ত। কিশোর ক্ষিপ্রহস্তে টানিয়া এক ঝট্‌কায় ‘ডরা’তে ফেলিল, মাছগুলি অনির্বচনীয় ভঙ্গিতে নাচিতে লাগিল। প্রথম খেউয়ের মাছ দেখিয়া কিশোরের চক্ষু জুড়াইয়া গিয়াছে। মাছগুলি দেখিতে এই সকাল বেলার মতই স্নিগ্ধ।

 এক সময়ে ধা করিয়া সূর্য উঠিল। নদীর উপর রোদ বিছাইয়া দিল। তাপের আভাস পাইয়া মাছ একযোগে অথই জলে ডুবিয়া গেল। এখন আর তারা জালে ধরা দিবে না। একবার কিশোর জালটা ধপাস করিয়া ফেলিল। এই রকমে ফেলার অর্থ—আজ এই পর্যন্তই। তিলক কোরা গুটাইয়া আগাইয়া আসিল। তারপর দুইজনে মিলিয়া দড়াদড়ির বাঁধাছাঁদা খুলিয়া ফেলিল।

 মোড়ল আগেই ঘাটে বসিয়াছিল। প্রথম দিনের মাছ দেখিয়া খুশি হইল। বলিল, ‘ছোট জাল্লা, তোমার ত খুব সাইৎ। চল, মাছ ডাঙ্গিতে লইয়া যাই।’


 সাঁ সাঁ করিয়া বসন্তের বাতাস বহিয়া যায়, স্বচ্ছ জলের উপর ঢেউ তুলিয়া। কিশোর ক্ষণে ক্ষণে উন্মনা হইয়া যায়। নদীর তাতা থৈ থৈ নাচনের সঙ্গে তার বুকখানাও নাচিয়া উঠে। আকাশে রোদ বাড়ে। সে রোদ যেন নৌকার উপর, তিলকের সুবলের মাথার উপর, আর কিশোরের বুকের উপর সোনা হইয়া ঝরিয়া পড়ে। কোন্ অদৃশ্য শিল্পী এক না-দেখা মোহের তুলি বুলাইয়া তার মনের মাঝখানে অদৃশ্য আনন্দের এক একটা ছোপ লাগাইয়া যায়; থাকিয়া থাকিয়া তার মনে সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম চিন্তার আবির্ভাব হয়। শুকদেবপুর পল্লীটা কখনো সুবলকে লইয়া একপাক ঘুরিয়া আসে। অনেক গাছগাছালি আছে শুকদেবপুরে। তাতে অনেক আগে পাতা ঝরিয়া গিয়াছিল। এখন নূতন পাতা মেলিয়াছে। কি তুলতুলে মসৃণ পাতা। কিশোরের হৃদয়ের পরদার মত মসৃণ। চাহিয়া থাকিতে খুব ভাল লাগে। একটি বাড়িতে তুলসীতলার পাশে বেড়া দিয়া ফুলের গাছ করিয়াছে। অনেক সুন্দর ফুল ধরিয়াছে। পাপড়িগুলিতে কি সুন্দর বর্ণ-সমাবেশ। কি ফুল চিনিতে না পারিয়া কিশোর দাঁড়াইল। সামনা দিয়া এক কুমারী কন্যা যাইতেছে একগোছা সুতা হাতে করিয়া। কিশোর চলমান সুবলকে হাত ধরিয়া থামাইয়া বলিল, ‘দাঁড়া, ফুলেরে আগে দেইখ্যা লই। বড় রঙ্গিলা ফুল। কিন্তু চিন্‌তে পারলাম না। এই মাইয়ারে জিগা, ইটা কি ফুল কইয়া যাক্।’

 অকবি সুবল, মনে রঙ-ধরা কিশোরের সমজদার সাথী হওয়ার অনুপযুক্ত সুবল, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলিল, ‘তুমি জিগাও না, আমারে লইয়া টানাটানি কর কেনে?’

 ‘বেশ, আমিই জিগাই।’

 বিচারকের সামনে আসামীর মত, এক ফোঁটা মেয়েটার সামনে জোয়ান কিশোর এতটুকু হইয়া গিয়া কোনো রকমে বলিল, ‘বিদেশী মানুষ। এ দেশের এই ফুলেরে চিন্‌লাম না। নামখান নি কইয়া যাইতে পার।’

 মেয়েটি লজ্জায় উচ্ছলিত হইয়া বলিল, ‘মুগরাচণ্ডী। এর নাম মুগরাচণ্ডী ফুল।’ বলিয়া, কিশোরের চোখের দিকে চাহিল। কিন্তু চোখ আর নামাইতে পারিল না। সর্পমুগ্ধের মত চাহিয়া থাকিয়াই পরনের বসন-আঁচলে বুকের শিশু স্তনদুটিকে ঢাকিয়া দিল। তারপর ভয়-পাওয়া হরিণীর মত বড় বড় পা ফেলিয়া একটা ঘরের আড়ালে চলিয়া গেল।

 সুবল কিছু টের পাইয়া বলিল, ‘যা কও দাদা, তোমার বাসন্তীর মত একটা মাইয়াও কিন্তু শুকদেবপুরে দেখলাম না।’

 ‘আমার বাসন্তী! তুই কি কইলি সুব্‌লা?’

 ‘তোমার সঙ্গে বিয়া হইব। এই ক্ষেপের টাকা লইয়া দেশে গেলেই তোমার সঙ্গে বিয়া হইব। তোমার বাসন্তী কমু না, তবে কি আমার বাসন্তী কমু?’

 কিশোর হাসিলঃ ‘নারে সুব্‌লা, না, ঠিসারার কথা না। বাসন্তীরে আমার, তোর লগেই সাতপাক ঘুরাইয়া দেমু।’

 ‘মনরে চোখ ঠার’ কেনে কিশোর দাদা? বাসন্তী যে তোমার হাঁড়িত্ চাউল দিয়া রাখ্‌ছে—তুমি ত কম জান না।’

 ‘নারে সুব্‌লা, আমার মন যেমন কয়, কথাখান ঠিক না। যারে লেংটা থাইক্যা দেখতাছি—ছোটকালে যারে কোলে পিঠে লইছি—হাসাইছি, কাঁদাইছি, ডর দেখাইছি, ভেউরা বানাইয়া দিছি—তারে কি বিয়া করন যায়! বিয়া করন যায় তারে, যার লগে কোনোকালে দেখাসাক্ষাৎ নাই। দেখাসাক্ষাৎ খালি মুখাচণ্ডীর সময়—গীত-জোকারের লগে পিড়ির উপর শাড়ীর ঘোমটা তুইল্যা যখন চোখ মেইল্যা চায়।—সে হয় সত্যের স্তিরি। আর সগল তো ভইন।’

 সুবল ভাবে, কিশোরের মাথার ঠিক নাই। কিন্তু যদি সত্যই বাসন্তীর সহিত কিশোরের বিবাহ না হয়, তবে বাসন্তীর বিবাহ হইবে কাহার সহিত। সুবল ভাবে।

 মনের ভিতর একটা কিছু হইতেছে টের পাইয়া কিশোর কিছু লজ্জিত হয়। বলে, ‘আর পাড়া বেড়াইবার দরকার নাই সুব্‌লা, চল্ ফিরা যাই।’

 সে-অজানা ভাব অধিকক্ষণ থাকে না। থাকিলে কিশোর পাগল হইয়া যাইত।


 সেই স্নিগ্ধ নীলাভ ফাল্গুনী প্রভাত আসে। জাল লাগাইয়া মৃদু নৃত্যপরা তটিনীর বুকের গহনে গুঁজিয়া দেয় সেই জাল। তুলিয়াই দেখে মাছ। রূপার মত শাদা, ছোট ছোট প্রাণচঞ্চল অজস্র মাছ। এক একটা মাছে এক একটা প্রাণ। নৌকার ডরাতে জলের উপর ভাসিতে ভাসিতে কেমন খেলা করে। দুই মিনিটেই যাদের মৃত্যু, তারা মরণকে অবহেলা করিয়া এমন শান্তচিত্তে ভাসে কি করিয়া। কিন্তু বড় ভাল লাগে দেখিতে। দ্রুততালে জাল তোলা-ফেলার মাঝে কিশোর আত্মহারা হইয়া যায়। তার মনের সকল রকম অস্বস্তি কোথায় আত্মগোপন করে।


 চৈত্রের মাঝামাঝি। বসন্তের তখন পুরা যৌবন। আসিল দোল পূর্ণিমা। কে কাকে নিয়া কখন দুলিয়াছিল। সেই যে দোলা দিয়াছিল তারা তাদের দোলনায়, স্মৃতির অতলে তারই ঢেউ। অমর হইয়া লাগিয়া গিয়াছে গগনে পবনে বনে বনে, মানুষের মনে মনে। মানুষ নিজেকে নিজে রাঙায়। তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। প্রিয়জনকে রাঙায়, তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না—তখন তারা আত্মপর বিচার না করিয়া, সকলকেই রাঙাইয়া আপন করিয়া তুলিতে চায়।

 তেমনি রাঙাইবার ধূম পড়িয়া গেল শুকদেবপুরের খলাতে।

 তারা ঘটা করিয়া দোল করিবে, দশজনকে নিয়া আনন্দ করিবে। শুকদেবপুর গ্রামের সকলকেই তার নিমন্ত্রণ করিল। মোড়লের গাঙের রায়ত হিসাবে কিশোররাও নিমন্ত্রিত হইল। কাল সকাল থেকে রাত অবধি হোলি, গানবাজনা, রঙখেলা, খাওয়া-দাওয়া হইবে।

 ‘খলাতে দোল-পুন্নিমায় খুব আরব্বা হয়। মাইয়া লোকে করতাল বাজাইয়া যা নাচে! নাচেত না, যেন পরীর মত নিত্য করে। পায়ে ঘুঙ্‌রা, হাতে রাম-করতাল। এ নাচ যে না দেখ্‌ছে, মায়ের গর্ভে রইছে।’

 তিলকের এই কথায় সুবলের খুব লোভ হইল। কিন্তু তার মন অপ্রসন্ন। ধুতি গামছা দুইই তার ময়লা।

 কিশোর সমাধান বাতলাইয়া দিলঃ নদীর ওপারে হাট বসে। সাবান কিনিয়া আনিলেই হয়।

 কিন্তু এক টুকরা সাবানের জন্য এত বড় নদী পাড়ি দেওয়া চলেনা।

 শেষে সমাধান আপনা থেকেই হইয়া গেল।

 ভাটিতে বেদের বহর নোঙর করিয়াছে। বেদেনীরা আয়না চিরুনী সাবান বঁড়শি, মাথার কাঁটা, কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা লইয়া নৌকা করিয়া শুকদেবপুরের ঘাটে ঘাটে বেসাত করিয়া যায়। সাপের ঝাঁপিও দুই একটা সঙ্গে থাকে।

 কিশোরেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত। বেলা বাড়িয়াছে। আর একটু বাড়িলে মাছেরা অতলে ডুব দিবে। এখনি যত ছাঁকিয়া তোলা যায় নদী হইতে। উঠিতেছেও খুব। এমন সময়ে এক বেদেনী ডাক দিল, ‘অ দাদা, মাছ আছে?’

 কিনিতে আসিয়া তারা বড় বিরক্ত করে। তিলক ঝামু লোক। বলিল, ‘না মাছ নাই।’

 বেদেনীর বিশ্বাস হইল না। বৈঠা বাহিয়া তার বাবুই পাখির বাসার মত নৌকাখানা কিশোরদের নৌকার সঙ্গে মিশাইল। সে তার নিজের নৌকার দড়ি হাতে করিয়া লাফ দিয়া কিশোরের নৌকায় উঠিল, ডরার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি জাল্লা, মাছ না নাই! চাইর পয়সার মাছ দেও।’

 কিশোরের জালে অনেক মাছ উঠিয়াছে। বাঁশের গোড়ায় পা দিয়া, জালের হাতায় টান মারিয়া সে বুক চিতাইল; তার পিঠ ঠেকিল বেদেনীর বুকে।

 বেদেনী তরুণী। স্বাস্থ্যবতী। তার স্তনদুইটি দুর্বিনীতভাবে উঁচাইয়া উঠিয়াছে। তার কোমল উন্নত স্পর্শ কিশোরের সর্বশরীরে বিদ্যুতের শিহরণ তুলিল। বাঁশের গুড়ি হইতে পড়িয়া গিয়া, হাত পা ভাঙ্গিয়া সে হয়ত একটা কাণ্ড করিয়া বসিত। বেদেনী এক হাত ডান বগলের তলায় ও অন্য হাত বাম কাঁধের উপরে দিয়া বুক পর্যন্ত বাড়াইয়া কিশোরকে নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল। অবলম্বন পাইয়া কিশোর পড়িয়া গেল না। কিন্তু দিশা হারাইল। বেদেনীর বুকটা সাপের মত ঠাণ্ডা। তারই চাপ হইতে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, পড় কেনে। আমারে ধরবার পার না?’

 তিলক গলুই হইতে ডাকিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার নাওয়ে যাও।’

 ‘তুমি বুড়া মানুষ, তোমার সাথে আমার কি? আমার বেসাতি এই জনার সাথে।’ সে কিশোরের কাঁধের উপর হাত দিয়া আবার তার বুকখানা কিশোরের পিঠে ঠেকাইতে গেল।

 ‘এ জনা তোমার কোন্ জনমের কুটুম গো?’

 ‘শকুন্যা বুড়া, উকুইন্যা বুড়া, তুই কথা কইস্‌না, তুই কেম্‌নে জান্‌বি এজনা আমার কি?’

 নিজের লোককে গাল দিতেছে। উভয়সঙ্কটে পরিয়া কিশোর বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি অখন তোমার নাওয়ে যাও।’

 ‘মাছ দিলেই যাই। বাস করতে কি আইছি?’

 ‘এই নেও চাইর পয়সার মাছ। এইবার যাও।’

 ‘মাছ পাইলাম, কিন্তু মানুষ ত পাইলাম না। তুমি মনের মানুষ।’

 ‘নাগরালি রাখ। আমার তিলকের বড় রাগ।’

 ‘রাগের ধার ধারি না। মনের মানুষ থুইয়া যাই, শেষে বুক থাপড়াইয়া কান্দি। অত ঠকাঠকির বেসাতি আমি করি না।’

 কিশোরের হাসি পাইল। বলিল, ‘এক পলকে মনের মানুষ হইয়া গেলাম। তোমার আগের মনের মানুষ কই?’

 ‘উইড়া গেছে, সময় থাকতে বান্ধি নাই, তোমারে সময় থাকতে বান্ধ্‌তে চাই।’

 ‘কি তোমার আছে গো বাদ্যানী, বান্ধ্‌বা কি দিয়া?’

 ‘সাপ দিয়া। ঝাঁপিতে সাপ আছে—’

 বেদেনী ঝাঁপি খুলিয়া দুই হাতে দুইটা সাপ বাহির করিয়া আনিল। আগাইয়া দিল কিশোরের গলার কাছে।

 কিশোর ভয় পাইয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার সাপ সরাও। বড় ডর করে।’

 ‘সরাইতে পারি, যদি আমার কথা রাখ।’

 ‘কি কথা, কও না।’

 ‘আর দুইটা মাছ ফাও দেও—’

 ‘এই নেও!’ কিশোর অপ্রসন্ন মুখে কতকগুলি মাছ তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘এইবার তুমি যাও।’

 ‘যাই। তুমি বড় ভাল মানুষ। তুমি আমার নাতিন-জামাই।’

 কিশোর স্বর্গের ইন্দ্রসভা হইতে একঠেলায় মাটিতে পরিয়া গেল!

 বেদেনী বিজয়িনীর বেশে চলিয়া যাইতেছিল, এমন সময় সুবল ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তোমার কাছে সাবান আছে? আমারে দুই পয়সার সাবান দিয়া যাও।’


 গান শুরু হওয়ার আগেই তিন জনে সাজ-গোজ করিয়া খলায় উপস্থিত হইল। সাজের মধ্যে, ধুতি ঢিলা করিল, গামছা কাঁধ হইতে কায়দা করিয়া বুকে ঝুলাইল। পেশীবহুল বাহু বুক এই সজ্জাতেই শ্রীসম্পন্ন হইয়াছে। গিয়া দেখে অপরূপ কাণ্ড।

 মোড়লের বড় বড় চারিটা বিল আছে। বর্ষাকালে চারিদিক জলে একাকার হইয়া যায়। তখন দেশদেশান্তরের মাছ এই সব বিলে আসর জমায়। জল কমিয়া আসিলে মোড়লের লোকেরা বিলগুলিতে বাঁধ দেয়। সব মাছ তখন বন্দী হয়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ রুই কাতলা নান্দিল মৃগেল মাছ। দূরদূরান্তরের গ্রাম হইতে মালোদের অনেক নৌকা আসে। একএকটি নৌকাতে থাকে চার পাঁচজন পুরুষ ও পনর কুড়িজন স্ত্রীলোক। এমনিভাবে বারো গাঁয়ের বারো রকম মালোনরনারী এক জায়গায় জড়ো হয়। ছয় মাসের স্থায়ীত্ব নিয়া বড় বড় চালাঘর উঠিতে থাকে। একেকটা চালা একদৌড়ের পথ লম্বা।

 কারোর সঙ্গে কারোর কোনোকালে দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। এখানে আসিয়া সকলে এক সংসারের লোক হইয়া গিয়াছে। এক সঙ্গে খায়, থাকে, কাজ করে। মহোৎসবের রান্নার মত স্তূপাকারে ভাত তরকারি রান্না হয়। ঢালা পংক্তিতে বসিয়া খায়। মুখ ধুইয়া আবার কাজে বসে।

 কি অত কাজ? না, মেয়ের বটি মেলিয়া কাতারে কাতারে বসিয়া যায়। পুরুষেরা মাছের ঝুড়ি ধরাধরি করিয়া আনিয়া তাহাদের পাশে স্তূপ করিতে থাকে। মেয়েদের হাত চলে ঠিক কলের মত। এতবড় মাছটাকে পলকে ঘুরাইয়া পেটে পিঠে গলায় তিন পোচ দিয়া ঘাড়ের উপর দিয়া ছুঁড়িয়া মারে, সে-মাছ যথাস্থানে জড় হয়। আরেক দল পুরুষ সেখান হইতে নিয়া ডাঙ্গিতে তোলে শুকাইবার জন্য। দিনের পর দিন এই ভাবে তিন মাস কাজ চলে। ছয় মাসের প্রবাস সারিয়া তারা যার যার দেশে পাড়ি জমায়। ইহাকে বলে ‘খলা-বাওয়া।’


 তারা ঝুড়িভরা আবির আনিয়াছে! গামলাভরা রঙ্ গুলিয়াছে। চৌকোণা চার-থাকের একটা মাটির সিঁড়ির উপর দুই পাশে পোঁতা দুইখানা বাঁশের সঙ্গে দড়ি বাঁধিয়া একখণ্ড সালু কাপড়ে একটি ছোট গোপাল ঝুলাইয়াছে। নিতান্তই নাড়ুগোপাল। পাশে রাধা নাই। হামা দিয়া হাত বাড়াইয়া লাল কাপড়ের বাঁধনে লট্‌কাইয়া একা একাই ঝুলিতেছে। এক-একজন আসিয়া তার গায়ে মাথায় আবির মাখাইয়া একটা করিয়া দোলা দিয়া যায়। তারই দোলনে সে অনবরত দুলিয়া চলিয়াছে।

 এ-পক্ষ প্রস্তুত। শুকদেবপুরের দল এখনো আসিয়া পৌঁছায় নাই। আপ্যায়নকারীদের একজন তিলকদিগকে ঠাকুরের কাছে নিয়া ঝুড়ি হইতে কয়েক মুঠা আবির একখানা ছোট পিতলের থালিতে তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘ঠাকুরের চরণে আবির দেও।’

 প্রেমের দেবতা কোথায় কার জন্য ফাঁদ পাতিয়া রাখে কেউ কি বলিতে পারে? উজানীনগরের খলাতে কিশোর এমনি একটা ফাঁদে ধরা পড়িল। কার সঙ্গে কার জোড়বাঁধা হইয়া থাকে তাও কেউ বলিতে পারে না। যাকে জীবনে কখনো দেখি নাই হঠাৎ একদিন তাকে দেখিয়া মনে হয় সে যেন চিরজনমের আপন। প্রেমের দেবতা অলক্ষ্যে কার সঙ্গে কখন কার গাঁটছড়া বাঁধিয়াছেন কেউ জানে না।

 তারাত তিন জনে গোপালকে আবিরে রঞ্জিত করিল। তারপর কয়েকজন পুরুষ মানুষ তাহাদের গালে মাথায় আবির দিয়া রাঙাইবার পর তিন চারজন স্ত্রীলোক আবিরের থালা লইয়া আগাইয়া আসিল। কয়েকজন কিশোরের কাছে মাতৃসমা। তারা কিশোরের কপাল রাঙাইল। আশীর্বাদের মত সে-আবির গ্রহণ করিয়া কিশোর নিজে তাদের পায়ে আবির মাখাইয়া কপালে পায়ের ধূলা ঠেকাইল।

 কয়েকজন তরুণী। বোন বৌদিদের বয়সী। তারা আবির লাগাইল গালে আর কপালে। কিশোর নীরবে গ্রহণ করিল। গোলমালে ফেলিল আর একজন।

 অবিবাহিত মেয়ে। দেহে যৌবনের সব চিহ্ন ফুটিয়াছে। সে-সব ছাপাইয়া বহিয়াছে রূপের বান। বসন্তের এই উদাত্ত দিবসে মনে লাগিয়াছে বাসন্তী রঙ্। প্রাণে জাগিয়াছে অজানা উন্মাদনা। পঞ্চদশী। বড়ই সাংঘাতিক বয়স এইটা। মনের চঞ্চলতা শরীরে ফুটিয়া বাহির হয়। হইবেই। মালোর মেয়েরা বিবাহের আগে অত বড় থাকে না। অতখানি বড় হয় বিবাহের দুই তিন বছর পরে। কোথা হইতে কেমন করিয়া এই অনিয়ম এখানে আসিয়া পড়িয়াছে।

 কিশোরের গালে আবির দিতে মেয়েটার হাত কাঁপিল; বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তার ছন্দময় হাতখানার কোমল স্পর্শ কিশোরের মনের এক রহস্যলোকের পদ্মরাজের ঘোমটাঢাকা দলগুলিকে একটি একটি করিয়া মেলিয়া দিল। সেই অজানা-স্পর্শের শিহরণে কাঁপিয়া উঠিয়া সে তাকাইল মেয়েটির চোখের দিকে। সে-চোখে মিনতি। সে-মিনতি বুঝি কিশোরকে ডাকিয়া বলিতেছেঃ বহুজনমের এই আবিরের থালা সাজাইয়া রাখিয়াছি। তোমারই জন্যে। তুমি লও। আমার আবিরের সঙ্গে তুমি আমাকেও লও।

 থালা সুদ্ধ তার অবাধ্য হাত দুইটি কাঁপিতেছে। লজ্জায় লাল হইয়া সে চোখ নত করিল। তাকে বাঁচাইল তার মা। মাথার কাপড় একটু টানিয়া সলজ্জভাবে তার মেয়েকে নিজের বুকে আশ্রয় দিল।

 কিশোরের ধ্যান ভাঙ্গিল সুবল। হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, গানের আসরে চল।’


 শুকদেবপুরের অর্ধেক পুরুষ মাছধরায় গিয়াছে। মোড়ল গিয়াছে একটা শুক্‌না বিল লইয়া বাসুদেবপুরের লোকদের সঙ্গে পুরানো একটা বিবাদ মিটাইতে। শুকদেবপুরের নারীরা আসিয়া খলার নারীদের সহিত মিশিল। পুরুষেরাও আসিল ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া।

 পুরুষেরা কতক্ষণ রঙ-মাখামাখি করিয়া শ্রান্তদেহে চাটাইয়ের উপর বসিয়াছে। ওদিকে মেয়েদের রঙ-মাখামাখির পালা চলিতেছে, এদিকে পুরুষদের হোলি-গান শুরু হইয়াছে। একজনকে সাজাইয়াছে হোলির রাজা। তার গলায় কলাগাছের খোলের মালা, মাথায় কলাপাতার টোপর, পরণে ছেঁড়া ধুতি, গায়ে ছেঁড়া ফতুয়া। মাঝে মাঝে উঠিয়া কোমর বাঁকাইয়া নাচে, আবার বসিয়া বিরাম নেয়। বুড়া মানুষ।

 বহুদিন পরে আনন্দের আমেজ পাইয়া তিলকের এইরূপ হোলির রাজা হইবার ইচ্ছা করিতেছিল। কিশোরের কানে কানে বলাতে উত্তর পাইল, ‘আম্‌রা বিদেশী মানুষ। সভ্য হইয়া বইসা থাকাই ভাল। নাচানাচি করলে তারা পাগলা মনে করব।’ কিন্তু তিলক দমিবার লোক নয়। সে প্রতীক্ষা করিয়া থাকিল। গানের সম যখন চড়িবে, ঝুমুরের তাল উঠিবে, তখন সে কোনোদিকে না চাহিয়া আসরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া নাচিবে। একবার কোনোরকমে উঠিয়া কয়েক পাক নাচিতে পারিলে, লজ্জা ভাঙ্গিয়া যায়, কোনো অসুবিধা হয় না।

 গায়কেরা দুই দলে পৃথক হইয়া গান জুড়িল। রাধার দল আর কৃষ্ণের দল।


 রাধার দল ভদ্রভাবে গান তুলিলঃ

সুখ-বসন্তকালে, ডেকোনারে
অরে কোকিল বলি তুমারে॥
বিরহিনীর বিনে কান্ত হৃদাগ্নি হয় জ্বলন্ত,
জলে গেলে দ্বিগুণ জ্বলে হয়নারে শান্ত।
সে-যে ত্যজে’ অলি কুসুম-কলি রইল কি ভুলে॥

 কৃষ্ণের দল সুর চড়াইলঃ

বসন্তকালে এলরে মদন—
ঘরে রয় না আমার মন॥
বিদেশে যাহার পতি,
সেই নারীর কিবা গতি,
কতকাল থাকিবে নারী বুকে দিয়া বসন॥

 রাধার দল তখনও ধৈর্য ঠিক রাখিয়া গাহিলঃ

বনে বনে পুষ্প ফুটে,
মধুর লোভে অলি জুটে,
কতই কথা মনে মনে উঠে সই—
ব্যথা কার বা কাছে কই॥
দারুণ বসন্তকাল গো,
নানা বৃক্ষে মেলে ডাল গো,
প্রবাস করে চিরকাল সে এল কই॥
বসিয়া তরুর শাখে কুহু কুহু কোকিল ডাকে,
অরে সখিরে এ-এ-এ—

 কৃষ্ণের দল এবার অসভ্য হইয়া উঠিলঃ

আজু শুন্ ব্রজনারী,
রাজোকুমারী, তোমার যৌবনে করব আইন-জারি।
হস্তে ধরে নিয়ে যাব,
হৃদ্‌কমলে বসাইব—রঙ্গিনী আয় লো—
হস্তে ধরে নিয়ে যাব, হৃদ্‌কমলে বসাইব।
বসন তুলিয়া মারব ঐ লাল-পিচোকারী—

 রাধার দল এই গানের কি উত্তর দিবে ভাবিতেছে, এমন সময় মেয়েদের তরফ হইতে আপত্তি আসিল, পুরুষদের গান এখানেই শেষ হোক। দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। এখন মেয়েদের গান আরম্ভ করিতে হইবে।

 রসাল প্রসঙ্গ পাইয়া তিলক মনে মনে উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল। ভাবিয়াছিল রাধার দল কৃষ্ণপক্ষকে কড়া একটা উত্তর দিয়া আরও চেতাইবে, তারপর কৃষ্ণপক্ষের মুখ দিয়া যাহা বাহির হইবে, তাহার সঙ্গে সঙ্গে সে নাচিতে উঠিবে। তার আশাভঙ্গ হইল।


 দোল-মণ্ডলের চারিদিকে খলার ও শুকদেবপুরের মেয়েরা সেদিন একাকার হইয়া গিয়াছে। কারো হাতে একজোড়া রাম-করতাল। কারো বা শুধু-হাত।

 একসঙ্গে অনেকগুলি করতাল বাজিয়া উঠিল। ঝা ঝা ঝম্ ঝম্ ঝা ঝা ঝম্ ঝম্ শব্দে আকাশ ফাটাইয়া দিল। তার সঙ্গে অনেকগুলি কাঁকনপরা হাতের মিলিত করতালি। তারপর অনেকগুলি মেয়ের পা একসঙ্গে নাচিয়া উঠিল। অনেকগুলি মেয়ের কণ্ঠ একসুরে গাহিয়া উঠিল। কিশোরের মন এক অজানা আনন্দ-সাগরে ডুবিয়া গেল।

 দলের ভিতরে সেই মেয়েটিকেও দেখা গেল। মার পায়ের দিকে তাকাইয়া সেও তালে তালে পা ফেলিতেছিল। কিশোরের সহিত চোখাচোখি হইয়া সে তাল-কাটা পড়িল। পা আর উঠিতে চাহিল না। মা সস্নেহে মুখ ঘুরাইয়া চাহিয়া দেখে, মণ্ডলের মধ্যে থাকিয়া মেয়ের পা দুটি স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। আর ঘনঘন লাজে রাঙা হইয়া উঠিতেছে। কারণ কি, না, অদূরে দাঁড়াইয়া কিশোর তাহাকেই দুই চোখের দৃষ্টি দিয়া যেন গ্রাস করিতেছে।

 মণ্ডলের তালভঙ্গ হইতেছে দেখিয়া মা তাহাকে ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিল। মণ্ডল-ছাড়া হইয়া সে আরও বিপন্ন বোধ করিল। এইবার সে কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময় এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটিল। দম্‌কা হাওয়ার মত একটা আকস্মিক শব্দে মেয়েদের কণ্ঠপদ স্তব্ধ হইয়া গেল। মৃদু তরঙ্গায়িত তরাগে যেন সহসা জাগিল ঝঞ্ঝার বিক্ষোভ। শুকদেবপুরের পুরুষ যারা উপস্থিত ছিল, চক্ষুর পলকে উঠিয়া মালকোঁচা মারিয়া রুখিয়া দাঁড়াইল। যে-ঘরে লাঠিসোঁটা থাকে সে ঘরে ঢুকিয়া কয়েকজন বিদ্যুতের গতিতে লাঠির তাড়া বাহির করিয়া অনিল। সাজ সাজ রবে খলা তোলপাড় হইয়া উঠিল।

 ততক্ষণে বাসুদেবপুরের ওরা ঢুকিয়া পড়িয়াছে।

 মেয়েদের মধ্যে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। আক্রমণকারীদের কয়েকজন লাঠি হাতে মেয়েদের দলে পড়িয়া লাফালাফি করিতেছে। একজন সেই বিমূঢ়া মেয়েটার দিকে আগাইয়া আসিতেছে যেন। এইবার কিশোরের চৈতন্য হইল। সে লাফাইয়া মেয়েটার সামনে পড়িয়া দুর্বৃত্তের গতিরোধ করিল। তার লাঠি তখন আকাশে আস্ফালন করিয়া কিশোরের মাথায় পড়ে আর কি। ঠিক সেই মুহূর্তে শুকদেবপুরের একজনের বিপুল এক লাঠির ক্ষিপ্ত আঘাত আক্রমণকারীকে ধরাশায়ী করিল। তার হাতের লাঠি লক্ষ্যচ্যুত হইয়া কিশোরের মাথায় না পড়িয়া হাতে পড়িল। মুহূর্ত মধ্যে মুমূর্ষুর হাত হইতে সেই লাঠি ছিনাইয়া লইয়া সে আগাইয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে টান পড়ায় ফিরিয়া দেখে তার ধুতির খুঁট দুই হাতে মুঠা করিয়া ধরিয়া মেয়েটা মূর্ছা যাইতেছে।

 তারপর শত শত কণ্ঠের সোরগোলের মধ্যে শত শত লাঠির ঠকাঠক্ ঠকাঠক্‌ শব্দ হইতে লাগিল। কারো হাত ভাঙ্গিল, পা ভাঙ্গিল, কারো মাথা ফাটিল। আক্রমণকারীদের অনেকেই আর ফিরিয়া গেল না। রক্তাক্ত দেহে এখানেই পড়িয়া রহিল। অন্যেরা লাঠি ঘুরাইয়া পিছু হটিতে হটিতে খোলা মাঠে নামিয়া দৌড় দিল।

 ইহারই পটভূমিকায় কিশোর মূৰ্ছিতা মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করিয়া তুলিয়া ঘন ঘন হাঁকিতে লাগিল, ‘এর মা কই, এর মা কই! ডরে অজ্ঞান হইয়া গেছে। জল আন, পাংখা আন।’

 মেয়েটার চুলগুলি আল্‌গা হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে। গলা টান হইয়া মাথাটা এলাইয়া পড়িয়াছে। বুকটা চিতাইয়া এতখানি উঁচু হইয়াছে যে, কিশোরের নিঃশ্বাস লাগিয়া বুঝিবা আবরণটুকু খসিয়া যায়।

 মা এক জায়গায় দাঁড়াইয়া তখন কাঁপিতেছিল। কিশোরের ডাকে সম্বিৎ পাইয়া ভাঁড়ারঘর হইতে তেলজল পাখা আনিয়া দিল। কিশোর তেলে-জলে এক করিয়া গায়ের জোরে ঘুঁটিয়া দিয়া হাতের তালুতে চাপিয়া চাপিয়া মাথায় দিতে দিতে মেয়েটা চোখ মেলিয়া চাহিল।

 ‘আপনের মাইয়া আপ্‌নে নেন’, বলিয়া কিশোর ত্যাগ দেখাইল।

 কথা কয়টি ঠিক জামাইর মুখের কথার মত হইয়া মেয়ের মার কানে গিয়া ঝঙ্কার তুলিল।


 সেইদিন হইতে এক মহাযুদ্ধের সূত্রপাত হইয়া রহিল। বাসুদেবপুরের ওরাও কম নয়। সংখ্যায় তারা বেশি, দাঙ্গাতেও খুব ওস্তাদ। শুকদেবপুরের মালোরাও বিপদ আসিলে পিছ-পা হয় না। বিশেষত, তাহাদের মোড়লকে ইহারা আটকাইয়া রাখিয়াছে। ঝগড়াটা ছিল অনেক দিন আগের। বিনা রক্তপাতে যাহাতে মীমাংসা হয় তারই চেষ্টা করিতে মোড়ল তাহদের গ্রামে গিয়াছিল। আর ফিরিয়া আসে নাই। কাজেই শুকদেবপুরের মালোরা স্থির থাকিবে কি করিয়া? একটা মহাপ্রলয়ের আভাস লইয়া প্রহরগুলি অতিক্রান্ত হইতে থাকিল। পুরুষদের প্রস্তুতির আড়ম্বর আর নারীদের আতঙ্কের নিঃশ্বাসে শুকদেবপুরের বাতাস ভারী হইয়া উঠিল। প্রতি ঘর হইতে বাহির হইতে লাগিল লাঠির তাড়া, চোখাচোখা মুলিবাঁশের কাঁদি, এককেঠে, কোচ, চল্ প্রভৃতি নানাবিধ সরঞ্জাম। সবকিছু সাজাইয়া গোছাইয়া লইয়া মালোরা একটিমাত্র ইঙ্গিতের অপেক্ষায় প্রস্তুত হইয়া রহিল।


 কিশোরের মনে একটা অস্বাভাবিক আশা জাগিয়াছে। সেই মেয়েটির সঙ্গেই তার বিবাহ হইবে। আশাটা আরও অস্বাভাবিক এইজন্যঃ সে নিজে কাউকে কিছু বলিতে পারিবে না, তাকেই বরং কেউ আসিয়া বলুক। মনে মনে সে কল্পনার রঙ ফলায়ঃ আচ্ছা এমন হয় না, মেয়েপক্ষ কেউ অসিয়া তাকে বলে, ‘অ কিশোর, এই কন্যা তোমারে দিলাম, লইয়া গিয়া বিয়া কর।’


 খলার কাছে নদী-স্রোতের একটা আড় পড়িয়াছে। বিকালে সেখানে জাল ফেলিতে যাইয়া কিশোর বলিল, ‘আজ জাল লাগামু গিয়া খলার ঘাটে।’

 খলার ঘাটে গিয়া কিশোর বাঁশের আগায় জাল জুড়িতেছে আর তৃষিতের দৃষ্টিতে ঘরগুলির দিকে তাকাইতেছে।

 তাহারই সমবয়সের একটি তরুণকে খলার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখা গেল। লোকটা কিশোরের নৌকার দিকেই আসিতেছে। তার এদিকে আসার কি হেতু থাকিতে পারে?

 কিশোর ভাবিয়া রোমাঞ্চিত হইলঃ এ বোধ হয় তারই কোনো ভাই হইবে। আসিতেছে সম্বন্ধের কথা চালাইতে। এ না হইয়া যায় না।

 সত্যই লোকটা কিশোরের নিকট আসিয়া আত্মীয়তার ভঙ্গিতে কথা বলিল।

 ‘আপ্‌নেরার দেশ নাকি সুদেশ। দেখতে ইচ্ছা করে। কায়স্থ আছে, বরাহ্মন্ আছে, শিক্ষিৎ লোক আছে। বড় ভাল দেশে থাকেন আপ্‌নেরা।’

 সময় নাই। এখনই জাল ফেলিতে হইবে। শিক্ষিৎ লোকের দেশে থাকার যে কি কষ্ট, আর এদের মত দেশে থাকার যে কি সুখ, এ কথাগুলি অনেক যুক্তিপ্রমাণ দিয়া বুঝাইয়া দিবার কিশোরের সময় নাই। কিশোর কেবল শুনিয়া গেল।

 আপ্‌নের সাথে একখান্ কুটুম্বিতা করতে চাই।’

 কিশোরের সকল শিরা-উপশিরা একযোগে স্পন্দিত হইতে লাগিল।

 বলিল, ‘আম্‌রা গরীব মানুষ, আম্‌রার সাথে কি আপ্‌নেরার কুটুম্বিতা মানায়?’

 ‘গরীব ত আম্‌রাও। গরীবে গরীবেই কুটুম্বিতা মানায়। কি কন্ আপ্‌নে?’

 এই কুটুম্বিতার জন্য কিশোর যে কতখানি ব্যাকুল, এই অনভিজ্ঞ ছেলেটাকে কিশোর সে কথা কি করিয়া বুঝাইবে। না বলিয়া দিলেও সে কি নিজেনিজেই বুঝিয়া লইতে পারে না?

 কিশোরের মনের আকাশে রঙ্ ধরিল। জানিয়া শুনিয়াও কেবল পুলকের তাড়নায় জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি কুটুম্বিতা করতে চান্।’

 ‘বন্ধুস্তি, আপ্‌নের-আমার মধ্যে বন্ধুস্তি। কত দেশে ঘুরলাম, মনের মত মানুষ পাইলাম না। আপ্‌নেরে দেইখা মনে অইল, এতদিনে পাইলাম।’

 ‘আচ্ছা, বন্ধুস্তি করলাম, বেশ।’

 মুখে-মুখের বন্ধুস্তি না। বাদ্য-বাজনা বাজাইয়া কাপড়-গাম্‌ছা বদল কইরা—’

 বাদ্য-বাজনা বাজাইয়া একটা আড়ম্বর করা যায় কি রকম কাজে—সে কেবল, ঐ মেয়েটাকে লইয়া করা যায়। মিতালি করা মুখের কথাতেই হয়। ওকাজে কি বাদ্য-বাজনা জমে, না, ভাল লাগে? কিশোর খুশির স্বৰ্গ হইতে মরুর বালিতে পড়িয়া বলিল, ‘আমার সাথে না, সুব্‌লার সাথে গিয়া আপ্‌নে বন্ধুস্তি করেন।’


 একদিন দুপুরের রোদ ঠেলিয়া বিলের পার দিয়া মোড়লকে ফিরিয়া আসিতে দেখা গেল।

 মোড়লের মুখের দিকে তাকানো যায় না। পর্বতপ্রমাণ কাঠিন্য আসিয়া আশ্রয় করিয়াছে। ভয়ঙ্কর একটা-কিছু যে ঘটিতে যাইতেছে তাহাতে কাহারে দ্বিমত রহিল না।

 এইরূপ সময়ে একদিন মোড়লের বাড়িতে কিশোরের ডাক পড়িল।

 কিশোর ছিল অন্যরকম চিন্তায় বিভোর। সে রাতদিন কেবল ভাবিয়া চলিয়াছিলঃ কোনো-একটা অলৌকিক উপায়ে ঐ মেয়েটির সহিত তাহার বিবাহের আয়োজন হইতে পারে কিনা। তাহা না হইলে কিশোরের বাঁচিয়া থাকিয়া লাভ কি? কে তাহার পক্ষ হইতে উহাদের কাছে কথাটা তুলিবে।

 মোড়লের কাছে খুলিয়া বলা যাইত। কিন্তু তার মনের যা অবস্থা।

 এমন সময় মোড়লের ডাকে কিশোর ভয়ে ভয়ে তাঁহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। মোড়লের কথা বলিবার সময় নাই। হাতে ইসারা করিয়া মুখে শুধু বলিল, ‘আমার স্তিরাচারে ডাক্‌ছে।’

 এখানে কাজ এত আগাইয়া রহিয়াছে, অথচ কিশোর ইহার কিছুই জানে না। সে মোড়ল-গিন্নির পায়ের ধূলা লইয়া দাঁড়াইতেই, গিন্নি তাহাকে একটা ঘরের ভিতরে লইয়া গেল। সেখানে নূতন একটা শাড়ি পরিয়া, পানের রসে ঠোঁট রাঙা করিয়া, এবং গালে-মুখে তেলের ছোপ লইয়া সেই মেয়েটা বারবার লাজে রাঙা হইয়া উঠিতেছে।

 মোড়ল গিন্নির হাতে দুইটি ফুলের মালা। একটি কিশোরের হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘শাস্ত্র মতে বিয়া কইর দেশে গিয়া। অখন মালাবদল কইরা রাখ।’

 মালাবদল হইয়া গেলে, মোড়ল-গিন্নি হঠাৎ ঘরের বাহির হইয়া শিকল তুলিয়া দিল।

 মেয়েটি ভয় পাইয়াছিল। দরজা বন্ধ, অন্ধকার ঘর। কারো মুখ কেউ দেখিতে পায় না। অবশেষে কিশোর তাহার ভয় দূর করিল।

 পরে মোড়লগিন্নি শিকল খুলিয়া বন্দীকে মুক্তি দিয়া বাহির করিয়া দিল; আর বন্দিনীকে ভগিনীস্নেহে স্নান করাইয়া দিয়া রান্নাঘরে নিয়া বসাইল। কিশোরকে বলিয়া দিল, ‘দেখ জাল্লা উতলা হইয়া পাখির মত পাখ বাড়াইও না, রইয়া-সইয়া আগমন কইর।’

 পরের দিন মেয়ের মা দেখিতে আসিল। মোড়ল-গিন্নিকে বলিল, ‘মালাবদল হইয়া গেছে ত?’

 ‘হ, হইয়া গেছে।’

 ‘আর দেখাসাক্ষাৎ করাইও না মা। অমঙ্গল হয়। দেশে গিয়া আগে শাস্ত্রমতে বিয়া হোক। কপালের কি গরদিস মা। জামাই পাইয়া মাইয়া আমার পর হইয়া গেল। আমার ত তাতে কোন অনাহ্লাদ নাই। অখন ঘরের মানুষেরে নিয়া কথা। সে-মানুষে না জানি কি করে।’

 সকল কথা শুনিয়া সুবল আনন্দে লাফাইয়া উঠিয়া বলে, ‘দাদা, তা অইলে বাসন্তীরে তুমি ইখানেই পাইয়া গেলা। অখন দেশের বাসন্তীরে কার হাতে তুইল্যা দিবা কও।’

 ‘তোর হাতে দিয়া দিলাম।’

 সুবলের মনে একটা আশার রেশ গুন্ গুন্ করিয়া উঠে।


 যে-মেঘ একটু একটু করিয়া আকাশে দানা বাঁধিতে ছিল, তাহাই কাল-বৈশাখের ঝড়ের আকারে ফাটিয়া পড়িল।

 মোড়লের মোটে সময় নাই। এক ফাঁকে দুই এক কথায় জানাইয়া দিল, খলার পরবাসীদিগকে দুই একদিনের মধ্যেই খলা ভাঙ্গিয়া যার যার দেশের দিকে পাড়ি দিতে হইবে। কিশোরকেও মোড়ল ভুলিল না। মেয়ের বাপের সামনে তাহাকে ডাকাইয়া নিয়া বলিল, কন্যা পাইয়াছ। দেশে নিয়া ধর্মসাক্ষী করিয়া বিবাহ করিও। সে তোমার জীবনের সাথী, ধর্মকর্মের সাথী, ইহকাল পরকালের সাথী। তাকে কোনদিন অযত্ন করিও না। —আর, কাল তোমার শুক্‌না মাছ বিক্রি হইয়া যাইবে। খলাভাঙ্গার দলের সাথে তুমিও দেশের দিকে নাও ভাসাইও। আমার সঙ্গে আর দেখা হইবে না।

 মোড়লের সত্যই সময় নাই। মোড়ল উঠিয়া পড়িল।

 মেয়ের বাপ সামনে বসিয়া আছে। রাগী মানুষ। তাহার কাছে কিশোর নিজেকে অপরাধী মনে করিতে লাগিল।

 বাপ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘নাম কি আপ্‌নের?’

 ‘শ্রীযুক্ত কিশোরচান মূল্যব্রহ্মণ। পিতা শ্রীযুক্ত রামকেশব মূল্যব্রহ্মণ। নিবাস গোকন্নঘাট, জিলা ত্রিপুরা।’

 লোকটা এক টুক্‌রা কাগজে টুকিয়া লইল।

 কিশোর নত হইয়া তাহার পায়ের ধূলা লইয়া দাঁড়াইয়া দেখে, লোকটা খলার দিকে চলিয়া যাইতেছে।

 খলার ঘাটে সবগুলি নৌকা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইল। ওপারে বাসুদেবপুরবাসীরা এরই মধ্যে লাঠি কাঁধে ফেলিয়া মালকোঁচা মারিয়া পথে নামিয়া পড়িয়াছে। এপারে খলার ঘাট হইতে তাহাদিগকে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে; কিশোরের মনে হইতেছিল, আকাশকোণের কোনো মেঘলোক হইতে একখণ্ড কালো মেঘ যেন ঝটিকার আভাস লইয়া দ্রুত ছুটিয়া আসিতেছে। অতদূর হইতেও ইহাদিগকে কি ভীষণ আর কি কালো দেখাইতেছে। মোড়লকে ফেলিয়া যাইতে হইবে ভাবিয়া কিশোরের মনে বড় কষ্ট হইল। তাহার কেবল মনে হইতে লাগিল, এত লোকজন, এত টাকাপয়সা, কাজকারবারের মধ্যে থাকিয়াও লোকটা কত অসহায়। আর মোড়ল-গিন্নি! সে আরও অসহায়। কিন্তু যাইতেই হইবে, মোড়লের কড়া হুকুম—গাঙের বিদেশী রায়তদের সে কিছুতেই বিপদে জড়াইবে না।


 আজ বিলের পারে প্রলয় কাণ্ড হইবে। তার আগেই নৌকাবিদায়ের পালা।

 নৌকা বিদায় বড় মর্মস্পর্শী। নববধূকে নৌকায় তুলিয়া দিতে আসিয়া মোড়লগিন্নি কাঁদিয়া ফেলিল। তার চোখে জল দেখিয়া কিশোরেরও বুক ফাটিয়া কান্না বাহির হইতে চায়।

 বধূ পা ধুইয়া নমস্কার করিয়া নৌকায় উঠিলে, দুইখানা নৌকা একসঙ্গে বাঁধন খুলিয়া দিল। একটি কিশোরের অন্যটি মেয়ের বাপের।

 কতক্ষণ তাহারা পাশাপাশি চলিল। তারপর মেঘনার পশ্চিম পারের একটা শাখানদীর মুখ লক্ষ্য করিয়া উহাদের নৌকার মুখ ঘুরাইল। উহাদের নৌকাখানা দূরে সরিয়া যাইতেছে। এখনো অনেক দূরে যায় নাই। এখনো মানুষগুলিকে চেনা যায়। এখনো স্পষ্ট দেখা যাইতেছে ও-নৌকায় একটি যৌবনোত্তীর্ণা নারী চোখে আঁচল-চাপা দিয়া কাঁদিতেছে। এখন গলা ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছে। আর ওই যে কঠিন-হৃদয় পুরুষ মানুষটি, তারও কাঠিন্য গলিয়া জল হইয়া গিয়াছে। সে কাঁধের গামছা তুলিয়া নিয়া দুই চোখে চাপা দিয়াছে।

 তাহাদিগকে আর চেনা যায় না। কিশোরের নৌকার একটি নারী-হৃদয়ের তখন সকল বাঁধ ভাঙ্গিয়া কান্নার প্লাবন ছুটিয়াছে।


 সারা বেলা নৌকা বাহিয়া, বিকাল পড়িলে তিলকের মাথায় এক সমস্যা আসিয়া ঢুকিল। খানিক ভাবিয়া নিয়া, নিজেনিজেই সেই সমস্যার সমাধান করিয়া বলিল, ‘ডাকাইতের মুল্লুক দিয়া নাও চালামু, তার মধ্যে আবার মাইয়ালোক। আমি কই, কিশোর, তুমি একখান কাম কর। পাটাতনের তলে বিছ্‌না পাত। কেউ যেমুন না দেখে, না জানে।’

 কিশোর নৌকার তলায় কাঁথা বালিশ দিয়া বধূর প্রবাসজীবনের স্থায়ী শয্যা রচনা করিল।

 রাত্রি হইলে এক স্থানে নৌকা বাঁধিয়া রান্না-খাওয়া সারিল, বৌকে তুলিয়া খাওয়াইল, আবার সেইখানেই লুকাইয়া রাখিল।

 শুইবার সময় কিশোরের হাবভাব লক্ষ্য করিতে করিতে তিলক এক ধমক দিয়া বলিল, ‘আমি বুড়া-মাইন্‌ষে একখান কথা কইয়া থুই কিশোর, নাওয়ের ডরার ভিত্‌রে নজর লাগাইও না কিন্তুক্।’

 লজ্জা পাইয়া কিশোর সুবলকে লইয়া এক বিছানায় শুইয়া পড়িল।

 পরের দিন আবার আঁধার থাকিতে নাও খুলিয়া দিল।

 তিলকের এমনই কড়া শাসন যে, তাহাকে স্পর্শ করাত দূরের কথা তাহাকে চোখে দেখার পর্যন্ত উপায় নাই। খাওয়ানো-শোওয়ানোর ভার পড়িয়াছে সুবলের উপর। কিশোর নিজে নৌকার মালিক হইয়াও এ বিষয়ে তিলকের আইন মানিয়া লইতে বাধ্য হইল।

 নৌকার পাছায় কোড়া টানিতে টানিতে সুবল জিজ্ঞাসা করিল, ‘অ দাদা, বৌ তুমি মনের মতন পাইছ ত?’

 কিশোর সলজ্জভাবে হাসিয়া বলিল, ‘কি কইরা কইরে ভাই। ভাল কইরা দেখলাম না, জানলাম না। কোন্ দিন দেখছিলাম, মনেঅ নাই। বিস্মরণ হইয়া গেছে। অখন আর চেহারা-নবুনা মনেই পড়ে না। কেউ বদলাইয়া দিয়া গেলেও চিন্‌তে পারুম না।’


 চৈত্রমাস গিয়াছে। গ্রীষ্মের বৈশাখেই এ নদীতে জল বাড়িতে থাকে আর উজানি স্রোত বহিতে শুরু করে। নদীর তীরে ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত। তার সরু আল অবধি জল লুটাইয়া পরিয়াছে। গুণের কাঠি হাতে লইয়া কিশোর লাফ দিয়া তীরে নামিল।

 কিশোর অমানুষিক শক্তিতে গুণ টানে আর নৌকা সাপের মত সাঁতার দিয়া স্রোত ঠেলিয়া চলে। লম্বা গুণ। অনেক দূরে থাকিয়া টানিতেছে। সুবল হাল ঠিক রাখিয়া তাহার দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছে। তাহাকে ছোট দেখাইতেছে। একটি জায়গা হইতে নদীর পার ডুবিতে আরম্ভ করিয়াছে। পাতা-জল ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে এক সময়ে হাঁটু-জলে গিয়া পড়িল। হাঁটু-জল ক্রমে কোমড়-জলে গিয়া দাঁড়াইল। কটির কাপড় ভিজাইয়া কিশোর কোমড় জল ভাঙ্গিয়াই গুণ টানিতেছে। সুবল চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল। কিন্তু লক্ষ্য ছিল না। যখন লক্ষ্য হইল, সে হা হা করিয়া উঠিল, ‘অ কিশোর দাদা, তুমি করতাছ কি? গুণ মার, গুণ মার। নাইল্যা ক্ষেতে অখন পানক সাপ থাকে। তুমি গুণ মাইরা নাওএ উঠ।’

 চৈতন্য পাইয়া কিশোর গুণ মারিয়া নৌকায় উঠিল।

 সুবল তিরস্কার করিল, ‘দাদা, তোমারে কি মধ্যে মধ্যে ভূতে আমল করে?’

 সে-কথার জবাব না দিয়া কিশোর বলিল, ‘ভাই, আর কদিনের পথ সামনে আছে?’

 ‘ইখান থাইক্যা আগানগরের খাড়ি একদিনের পথ। আর একদিন একটানা নাও বাইতে পারলে ভৈরব ছাড়াইয়া নাও রাখুম নিয়া কলাপুড়ার খাড়িতে। সেইখান থাইক্যা তিতাসের মুখ আর এক দুপরের পথ।’

 হিসাব মত একদিনে আগানগরের খাড়ি পাওয়া গেল। সেখানে রাত কাটাইয়া নৌকা খোলা হইল। কিন্তু একদিনের স্থলে দুই দিন গত হইয়া যায়, ভৈরব বাজার আর দেখা দেয় না।

 সামনা হইতে হু হু করিয়া জোরালো বাতাস আসিতেছে। মেঘনার বুক জুড়িয়া ঢেউয়ের তোলপাড় চলিয়াছে। নৌকা এক হাত আগায়, তো আর এক হাত পিছাইয়া যায়। দুইটি প্রাণী গলুইয়ে বসিয়া দাঁড় টানিতেছে। বড় বড় ঢেউয়ের মুখে পড়িয়া নৌকা একবার শূন্যে উঠিতেছে, আবার ধপাস্ ধপাস্ আছড়াইয়া পড়িতেছে। গলুইয়ে দাঁড় হাতে প্রাণী দুইটি এক একবার কোমর অবধি ডুবিয়া যাইতেছে। ঝলকে ঝলকে নৌকায় জল উঠিতেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়টানা বন্ধ করিয়া কিশোর সে-জল সেঁউতিতে করিয়া সেচিয়া ফেলিতেছে। নাওয়ের পাছায় সুবল বাতাসের ঝাপ্‌টায় আর জলের ছাঁটে ভেজা কাকের মত হইয়া গিয়াছে। তবু এক একবার গায়ের সবটুকু জোর নিংড়াইয়া লইয়া চাপ দিতেছে। দম-দেওয়া কলের মত নৌকাটা সে-চাপে একটু আগাইয়া গিয়াই দমভাঙ্গা হইয়া পিছনে সরিয়া আসিতেছে। তিলকের মুখে কথা নাই। কিশোর স্খলিতস্বরে বলিল, ‘ভাইরে সুবল, আর বুঝি দেশে যাওয়া হইল না।’

 শুনিয়া, ব্যথিত সুবল আরও জোর খাটাইল; একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিল।

 রাঁধা খাওয়ার সময় নাই। বিশ্রামের অবসর নাই। এক ছিলিম তামাক খাওয়ারও অবকাশ নাই। কোথাও নৌকা বাঁধিয়া বিশ্রাম নিবে, তারও উপায় নাই। নদীর দুইদিকে চাহিলে বুক শুখাইয়া যায়। কেবল জল। কোথাও এতটুকু তীর নাই। অবলম্বন নাই, অথৈ, অপার জল, নির্ভরসায় বুক শুখাইয়া যায়। একটা খালের মুখও চোখে পড়িতেছে না।


 এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে ঝাড়া তিনদিন লড়াই চলিল শেষে তারা ঝিমাইয়া পড়ার আগে দুর্যোগ নিজেই ঝিমাইয়া পড়িল। যে বাতাস দৈত্যের নাসিকা গর্জনের মত বহিতেছিল, তাহা এখন প্রজাপতির পাখার হাওয়ার মত কোমল হইয়া গেল। মেঘনার বুকের আলোড়ন থামিয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেল।

 এইত ভৈরবের বন্দর। এখানে আসিয়া মনে হইল বাড়ির কাছেই আসিয়াছি। স্রোতের আড় পাইয়া নৌকা অল্প মেহনতেই হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। ভৈরব বন্দরের মালোপাড়া দেখিতে দেখিতে অনেক পিছনে পড়িয়া গেল। তাহাদিগকে সমুখে আগাইবার নেশাতে পাইয়াছে। এই কলাপুড়ার খাড়ি। নৌকা বাঁধিবার চমৎকার জায়গা। কিন্তু আকাশের কোণে আরও একটু বেলা রহিয়াছে। কিশোর বলিল, ‘চলুক নাও। রাখুম গিয়া একেবারে নয়া গাঙের খাড়িতে। যত আগাইতে পার আগাও।’

 সূর্য ডুবিবার আগেই নয়া গাঙ দেখা দিল।

 এখানে নয়া গাঙের এক দূরন্ত ইতিহাস মনে পড়ে।

 মেঘনা সরল হইয়া চলিতে চলিতে এই খানটায় একটু কোমর বাঁকাইয়াছিল। পশ্চিম পারে ছিল একটা খালের মুখ। বর্ষায় জলে ভরিয়া উঠিত আর সুদিনে শুখাইয়া ঠন্‌ঠনে হইয়া যাইত। কখনো কখনো সামান্য একটু জল থাকিলে তাহাতে বৈকুণ্ঠপুর আর তাতারকান্দী গাঁয়ের ছেলেরা গামছায় ছাঁকিয়া পুঁটিমাছ ধরিত। সেই খালেরই মুখ। একদিন সে মুখে ফুলচন্দন পড়িল। কি করিয়া মেঘনার এইখানটাতে একটা স্রোতের বড় আবর্তের সৃষ্টি হইল, আর খালের মুখে ধরিল সর্বনাশা ভাঙ্গন। ভাঙ্গিয়া চুড়িয়া মুচড়াইয়া দুমড়াইয়া মেঘনার অকৃপণ জলরাশি আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল খালের দুই দিকের পাড়ে। তাতেও ধরিল ভাঙ্গন। হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিল স্রোত। সাঁই সাঁই করিয়া ফুটিল আবর্ত। হিস্ হিস্ করিয়া জাগিল উচ্ছ্বাস। হুস্ হুস্ করিয়া পড়িতে লাগিল মাটির ধ্বস। মাটি ক্ষেত প্রান্তর ভাঙ্গিয়া, ছোট বড় পল্লী নিশ্চিহ্ন করিয়া, রাশি রাশি গাছপালা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া সে জলধারা দিনের পর দিন উদ্দাম গতিতে ছুটিয়া চলিল। কার সাধ্য তার গতিরোধ করে। দুর্বার, দুর্মদ, প্রলয়ঙ্কর এ গতি। চাষীরা প্রমাদ গণিয়া অকালে ফসল কাটিয়া ঠাঁই করিয়া দিল, পল্লীবাসীরা সন্ত্রাসে বিমূঢ় হইয়া তৈজসপত্র বাঁধিয়া ছাঁদিয়া, গরুবাছুর হাঁকাইয়া লইয়া, অনেক পশ্চিমে গিয়া ডেরা বাঁধিল। কালক্রমে অনেক কিছু হইয়া গেল। যে ছিল একদা একটা খাল, সে এখন স্বয়ং মেঘনা হইতেও অনেক প্রশস্তা, অনেক বেগবতী, সমধিক ভয়ঙ্করী হইয়া উঠিয়াছে। সবিস্তারে এই কাহিনী বর্ণনা করিতে করিতে তিলকের চোখ দুইটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। কথা কিছু নূতন নয়। তাদের গাঁয়ের মালোরা অনেকেই এখানে মাছ ধরিতে আসে। আর নয়া গাঙের নয়া স্রোতে মাছও ধরা পড়ে অনেক। কিশোর সুবলেরাও নয়া গাঙের এই কালান্তক, দিগন্তবিসারী মোহনাটি কয়েকবার দেখিয়াছে, কাহিনীটিও শুনিয়াছে। তবু তিলক তাহা আবেগপূর্ণ ভাষা দিয়া বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিল। ইহাই জেলেদের রোমান্স। নদীর রহস্য তারা শুনিয়াও আনন্দ পায়, শুনাইয়াও আনন্দ পায়। আর স্রোতা যদি ইতিপূর্বে না শুনিয়া থাকে, অধিকন্তু শ্রোতা যদি বক্তার কাছে নূতন মানুষ কেউ হয়, তাহা হইলে বক্তার বলার উদ্দীপনা বাঁধ মানে না। পাটাতনের তলার মানুষটির সম্বন্ধে তিলক খুবই সজাগ। নয়া গাঙের এই রহস্যময় কাহিনী সে নিশ্চয়ই কান পাতিয়া শুনিতেছে।

 পরিশেষে তিলক বলিল, এত কাণ্ড করিয়াও শেষে নয়া গাঙ কিনা মূল মেঘনাতেই গিয়া পড়িয়াছে!

 মোহনাটি সত্যই ভয়ঙ্কর। এপার হইতে ওপারের কূলকিনারা চোখে ঠাহর করা যায় না। হু হু করিয়া চলিতে চলিতে স্রোত এক একটা আবর্তের সৃষ্টি করিয়াছে। দুই ধারের স্রোত মুখোমুখি হইয়া যে ঝাপটা খাইতেছে, তাহাতে প্রচণ্ড শব্দ করিয়া জল অনেক উপরে উঠিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। একটানা একটা সোঁ সোঁ শব্দ দূর হইতেই কানে ভাসিয়া আসিতেছে।

 এই ভয়ঙ্করের একপাশে খাড়িটি বড় সুন্দর। বড় নিরাপদ স্থান। খালের মত একটা সরু মুখ দিয়া ঢুকিয়া অল্প একটু গেলেই এক প্রশস্ত জলাশয়ের বুক পাওয়া যায়। শান্ত শিষ্ট জলাশয়। প্রচণ্ড বাতাসেও বড় ঢেউ উঠে না।


 তারা ভেতরে ঢুকিয়া দেখে, সেখানে অনেক নৌকার সমারোহ। তার বেশির ভাগ ধান-বেপারী, কাঁঠাল-বেপারী পাতিল বেপারীর নৌকা। সকলেই এখানে এক রাতের জন্য আশ্রয় নিয়াছে। ভোর হইলে চলিয়া যাইবে।

 তারাও শ্রান্ত ক্লান্ত। খাইয়া দাইয়াই শুইবে। কিন্তু বাংলা দেশের পূর্বাঞ্চলের এই নদী-বিহারীদের কতকগুলি নিজস্ব সম্পদ আছে। অমনিতেই তারা শুইয়া পড়ে না। সেই সম্পদগুলিকে বুক দিয়া ভোগ করিয়া নিয়া তবে নিদ্রার কোলে আশ্রয় নেয়। কোনো নৌকোয় মুর্শিদা বাউল গান হইতেছেঃ—

এলাহির দরিয়ার মাঝে নিরাঞ্জনের খেলা,
শিল পাথর ভাসিয়া গেল শুক্‌নায় ডুবল ভেলা।
জলের আসন জলের বসন দেইখ্যা সারাসারি,
বালুচরে নাও ঠেকাইয়া পলাইল বেপারী।

 কোনো নৌকায় হইতেছে বারোমাসিঃ—

এহী ত আষাঢ় মাসে বরিষাগম্ভীর,
আজ রাত্রি হবে চুরি লীলার মন্দির।

 কোনো নৌকায় টিমটিমে কেরোসিনের আলোর কাছে আগাইয়া জরাজীর্ণ একখানা পুঁথি সুর করিয়া পড়িতেছেঃ—

হাম্মক রাজার দেশেরে—
উত্তরিল শেষে রে।

 কোনো নৌকায় কেচ্ছা হইতেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে গান ভাসিয়া আসিতেছেঃ—

আরদিন উঠেরে চন্দ্র পূবে আর পশ্চিমে।
আজোকা উঠ্‌ছেরে চন্দ্র শানের বান্ধান ঘাটে।

 স্বচ্ছ আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ মাথার উপর অবধি পাড়ি দিয়াছে। সাদা ছেঁড়া মেঘ তাহাকে ধরিবার জন্য ছুটাছুটি করিতেছে। কিন্তু নাগাল পাইতেছে না।

 দেখিতে দেখিতে কিশোরদের চোখে ঘুম আসিয়া পড়িল।

 পা টিপিয়া টিপিয়া চলার শব্দ, আর চাপা গলার ফিস্‌ফাস্ কথা বলার আওয়াজ প্রথমে তিলকের মনোযোগ আকৃষ্ট করিল। নাঃ, কিশোরটা বেহায়ার হদ্দ। তাকে নিয়া আর পারা যাইবে না। বিরক্ত হইয়া তিলক পাশ ফিরিয়া শুইতেছিল। এমন সময় পায়ে জোরে একটা টান পড়ায় তার তন্দ্রা পাতলা হইতে হইতে একেবারে ভাঙ্গিয়া গেল। পুরা সম্বিত পাইয়া দেখে, ছইয়ের ভিতরে শুইয়াছিল, তারা তিনজনেই এখন ছইয়ের বাইরে। আর তিনজনেরই পা নৌকার গুরার সঙ্গে দড়ি দিয়া বাঁধা। নৌকা আর সেই খাড়ির ভিতরে নাই। হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে নয়া গাঙের সেই সর্বনাশা মোহনার দিকে।

 তিলক চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘অ কিশোর, আর কত ঘুমাইবা, চাইয়া দেখ, সর্বনাশ হইয়া গেছে।’

 এক ঝটিকায় পায়ের বাঁধন ছিঁড়িয়া, কিশোর এক নিঃশ্বাসে ছইয়ের ভিতরে গিয়া পাটাতন খুলিল। সে নাই।

 ‘অ তিলক! সে নাই আমার! হাওরে-ডাকাতি হইয়া গেছে।’

 একটা হাত বাক্সে বেসাতের মুনাফা দুই শত টাকা ছিল। তালাস করিতে গিয়া তিলক দেখিতে পাইল না। বাক্স সুদ্ধ তাহাও লইয়া গিয়াছে।

 ‘হায়, কি হইল রে’ বলিয়া কিশোর পাগলের মত গলা ফাটাইয়া এক চীৎকার দিল। চারিপাশের জলোচ্ছ্বাসের উপর দিয়া সেই চীৎকার-ধ্বনি ধীরে ধীরে ডুবিয়া গেল। কোনো প্রতিধ্বনিও আসিল না।

 এদিকে মাঝ-মোহানার জলের উচ্ছ্বাস-ধ্বনি ক্রমেই নিকটবর্তী হইতেছে। নৌকাটা চুম্বকের মত আকৃষ্ট হইয়া সেদিক লক্ষ্য করিয়া চলিয়াছে। আর আকাশে তখন অজস্র জ্যোৎস্না।

 তিলক সচেতন হইয়া বলিল, ‘সুব্‌লা, পাছায় গিয়া হালের কোরায় হাত দে।’

 প্রবলভাবে আপত্তি জানাইয়া কিশোর বলিল, ‘না না তিলক, নাও আর ফিরাইও না। যার দিকে রোখ করছে তার দিকেই যাউক।’

 সুবল ও তিলকের আপ্রাণ চেষ্টায় নৌকাখানা কোনমতে আসন্ন ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পাইল। রাত্রির বিভ্রান্তিতে কূল-কিনারা দেখা যাইতেছিল না; তাহাও শেষে পাওয়া গেল। রাতটা বিশ্রী রকমের দীর্ঘ। ফুরাইতেছিল না। অবশেষে তাহাও ফুরাইয়া সকাল হইল। কিন্তু রাতের ঝড়ে পাখির সেই যে ডানা ভাঙ্গিল, সে-ডানা আর জোড়া লাগিল না।

 কিশোর দাঁড়ে গিয়া বসিয়াছিল। বার বার হাত হইতে দাঁড় খসিয়া পড়িতেছে দেখিয়া তিলকের দয়া হইল, ‘যাও কিশোর, দাঁড় তুইল্যা ছইয়ার তলে যাও।’

 কিশোর ছইয়ের ভিতরে আসিয়া পাটাতনের উপরে বসিল। পাটাতনের নীচেই সে ছিল। এখন সে কোথায়!

 সুবলের হাতে হালের বৈঠাও নিস্তেজ হইয়া আসিল। কেবল তিলকের বৃদ্ধ হাতের দাঁড়টানাকে সম্বল করিয়া নৌকা মন্থরগতিতে আগাইতে লাগিল।


 এখানে তিতাসের মোহনা। মেঘনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকাইয়া এখন ইহারই মুখ দিয়া প্রবেশ করিতে হইবে। যাইবার সময় মুখটা আরো সংকীর্ণ ছিল। এখন বর্ষার জলে সে-মুখ অনেক বড় হইয়া গিয়াছে।

 তিতাসের মুখের ভিতর ঢুকিয়া খানিক আগাইবার পর সুবল দুত্তোরি বলিয়া দাঁড় তুলিয়া ফেলিল। বাঁশের খুঁটিটা একটানে তুলিয়া লইয়া মাটিতে ঠেকাইয়া কয়েকটা পাড় দিল। তারপর তার সঙ্গে নৌকার দড়ি বাঁধিয়া ছইয়ের ভিতরে ঢুকিয়া শুইয়া পড়িল। আরো একটু বেলা ছিল। আরো একটু আগানো যাইত। কিন্তু তিলক মুখ খুলিয়া একথা বলিতে সাহস পাইল না।

 আবার রাত আসিল। রাত গভীর হইল। এবং এক সময়ে ফুরাইয়া গেল।

 পূবদিকের আকাশ খোলাসা হইয়া আসিতেছে। কিশোর কি ভাবিয়া উঠিল। মাঝ নৌকায় দাঁড়াইয়া সেদিকে কতক্ষণ তাকাইয়া রহিল। তারপর গলুইয়ে গিয়া হাত বাড়াইয়া জল স্পর্শ করিল।

 হাত জলে লাগে নাই। কিসে যেন লাগিয়াছে। কিন্তু বড় নরম। আর কি ভীষণ ঠাণ্ডা। ঘার বাড়াইয়া চাহিয়া দেখিল, স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। দেখিয়া কিশোর খুব জোরে একটা চিৎকার দিল।

 একটা নারীদেহ ভাসিয়া রহিয়াছে। কোমর হইতে পা অবধি একেবারে খাড়া জলের নীচে। বুকটা চিতাইয়া ভাসিয়া উঠিয়াছে। গলা টান হইয়া মাথা পিছন দিকে ঢলিয়া রহিয়াছে। লম্বা চুলগুলিকে লইয়া তিতাসের মৃদু স্রোত টানাটানি করিতেছে।

 ‘অ তিলক, দেইখ্যা যাও!’

 চোখ কচলাইয়া তিলক বলিল, ‘কি কিশোর।’

 ‘তারে পাওয়া গেছে।’

 তিলক উঠিয়া আসিয়া মড়াটাকে দেখিয়া, রাম রাম বলিতে বলিতে সুবলকে ডাকিয়া তুলিল। তারপর কালবিলম্ব না করিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিল।


 কিশোর ছইয়ের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়াছিল।

 দাঁড় টানিতে টানিতে ক্লান্ত হইয়া তিলক ছইয়ের ভিতরে আসিয়া বসিল। আগে লক্ষ্য ক’রে নাই। মালসার আগুনে টিকা ডুবাইয়া তামাকের চোঙ্গাটা কোথায় কিশোরকে জিজ্ঞাসা করিয়া যখন কোন সাড়া পাইল না, তখন লক্ষ্য করিল। কিশোরের চোখ দুইটা অস্বাভাবিক রকমের বড় আর জবাফুলের মত লাল হইয়া গিয়াছে। মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে ভীষণ এক দানবীয় ভাব। মাঝে মাঝে ডাইনে বাঁয়ে নীচে উপরে চোখ ঘুরাইতেছে।

 আঁতকাইয়া উঠিয়া তিলক চিৎকার দিল, ‘অ সুব্‌লা দেই্খ্যা যা, কিশোর পাগল হইয়া গেছে।’