বিষয়বস্তুতে চলুন

ত্রিপুরার স্মৃতি/ধর্ম্মসাগর দীর্ঘিকা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 351 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।



ধর্ম্মসাগর দীর্ঘিকা

 দীৰ্ঘে ৮৩৪ হস্ত এবং প্রস্থে ৫৫৪ হস্ত যে এক সুবিখ্যাত সরোবর কুমিল্লা নগবীতে আছে,—তাহা খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর ত্রিপুররাজ কুলতিলক ধর্ম্মমাণিক্য-কর্ত্তৃক খনিত। এবং এই কারণ বশতঃ দীর্ঘিকাটী “ধর্ম্মসাগর” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।

 উল্লিখিত জলাশয়ের খননকারী কেবল যে শ্রীধর্ম্ম নামে অভিহিত হইযাছিলেন তাহা নহে; তাহার তুল্য ধর্ম্মপরায়ণ ও ন্যায়বান্‌ মহীপতি ত্রিপুররাজ্যে দ্বিতীয় আর কেহই জন্মগ্রহণ করেন নাই। হেন জনের বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না মনে করিয়া, তদীয় জীবনচরিতের সার মর্ম্ম সঙ্ক্ষেপে নিম্নে লিখিত হইল।

 চন্দ্রবংশেব শিরোভূষণ উক্ত ধর্ম্ম মাণিক্য, ত্রিপুরাধিপতি বহুশাস্ত্রজ্ঞ মহা মাণিক্যের জ্যেষ্ঠ তনয়। যৌবন কালেই তিনি এই নশ্বব জগতের মায়া-মোহে বিতৃষ্ণ হইযা রাজ্যবাসনা পরিত্যাগ করেন। এই জন্য তিনি তদীয় পিতৃদেবের জীবদ্দশাতেই সংগোপনে গৃহ ও স্বজন পবিত্যাগ পূর্ব্বক সন্ন্যাসিবেশে তীর্থ পয্যটনে বহির্গত হন।

 নানা তীর্থ পরিভ্রমণান্তে কুমার শ্রীধর্ম্ম দেব বারাণসীতে উপস্থিত হইলে তথায় যে এক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল বলিয়া প্রবাদ প্রচলিত আছে, তাহা এই—

 একদা মধ্যাহ্নে পথশ্রান্তিতে কাতর হইয। শ্রীধর্ম্ম দেব বাবাণসীর পথপ্রান্তে ঘোর নিদ্রাবেশে শয়ন করিতেছিলেন; এমন সময় একটা বিষধর ভুজঙ্গ ফণা বিস্তার পূর্ব্বক তদীয় মস্তক আতপতাপ হইতে রক্ষা করিতেছিল। এবংবিধ অভূতপূর্ব্ব ঘটনা জনৈক ব্রাহ্মণ পর্য্যবেক্ষণ করিয়া ভাবিল, ইনি কখনই সামান্য ব্যক্তি হইবেন না। তাহার লক্ষণ দৃষ্টে ইহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে—এই ব্যক্তি যে কোন এক কালে দেশবিশেষের অধিপতি হইবেন এই বিষয়ের কোন সন্দেহ নাই। এইরূপ অনুধাবনা করিয়া উক্ত ব্রাহ্মণ তাঁহাব জাগরণ কাল পর্য্যন্ত তথায় অপেক্ষা করিতে লাগিল।

 পরিশেষে কুমার শ্রীধর্ম্ম দেবের নিদ্রাভঙ্গ হইলে উক্ত ব্রাহ্মণ বলিল—আপনি সামান্য ব্যক্তি নহেন, জনৈক মহাপুরুষ। যাহা হউক আপনি যেই হউন না কেন, স্বদেশে গমন কালে আমাকে আপনার সঙ্গে গ্রহণ করিবেন এবং তথায় উপনীত হইলে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আপনার কুলপুরোহিত রূপে নিযুক্ত করিবেন,—এই আমার সানুনয় প্রার্থনা। আশা করি আপনি আমার উক্ত অভিলাষ পূর্ণ করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না। শ্রীধর্ম্ম দেব ব্রাহ্মণের এই কথায় কোন উত্তর প্রদান না করিয়া কেবল ঈষৎ হাস্য করেন। কথিত আছে তিনি বারাণসী হইতে ত্রিপুরাতে প্রত্যাবর্ত্তন কালে উক্ত ব্রাহ্মণকে সঙ্গে আনয়ন পূর্ব্বক তদীয় কুলপুরোহিত পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

 কুমার শ্রীধর্ম্ম দেব গৃহ পরিত্যাগ করিবার কিয়দ্দিবস পর ত্রিপুরেশ মহা মাণিক্য মানবলীলা সংবরণ করিলে তদীয় রাজ্য-লোলুপ পুত্রগণমধ্যে রাজ্য অধিকারের জন্য বিরোধ সঙ্ঘটিত হয়। পরিশেষে অদৃষ্ট পরীক্ষার নিমিত্ত তাঁহারা সকলে রণভূমিতে অবতীর্ণ হন। তখন রাজ্য-মধ্যে ঘোর সমরানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, এবং রাজ্যলাভের পরিবর্ত্তে সর্ব্বকনিষ্ঠ রাজকুমার ব্যতীত আর সমস্ত রাজপুত্রই সেই সমরানলে জীবনাহুতি প্রদান করেন।

 এবস্তৃত ভ্রাতৃবিরোধ-হেতু রাষ্ট্রবিপ্লব সংঘটিত হইয়। রাজ্যময় অশান্তি ও অরাজকতা ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। তদ্দৃষ্টে কনিষ্ঠরাজপুত্র বিমর্ষচিত্তে ভাবিলেন—পাপময় লোভের পরিণাম ফলে যাহা ঘটিয়া থাকে তাহা সংঘটিত হইয়াছে। এইক্ষণ ত্রিপুররাজ্যের প্রকৃত অধিকারীর অনুসন্ধান করিয়া পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা কর্ত্তব্য। এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি তদীয় অগ্রজ শ্রীধর্ম্ম দেবের অনুসন্ধানার্থে নানা দিগদেশে দূত প্রেরণ করিলেন।

 দৈববশতঃ ত্রিপুরার জনৈক দূত বারাণসীতে উপস্থিত হইয়া তথায় সন্ন্যাসিবেশ ধারী শ্রীধর্ম্মকে দেখিলে ইনি-ই মহা মাণিক্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীধর্ম্ম দেব এবংবিধ সন্দেহ তাহার অন্তকরণে উদিত হয়। তখন দূত তাঁহাকে প্রতিজ্ঞা পাশে আবদ্ধ করিয়া তদীয় পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে এই বিষয় গোপন করা ন্যায় সঙ্গত নহে বিবেচনায় তিনি দূতের নিকট স্বীয় প্রকৃত পরিচয় প্রদান করেন।

 এই প্রকারে দূত শ্রীধর্ম্ম দেবের পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া তৎসমীপে ত্রিপুররাজ্যের সমস্ত অবস্থা বিস্তারিত রূপে জ্ঞাপন পূর্ব্বক অনুনয় বিনয় সহকারে প্রার্থনা করে—যদি তিনি স্বীয় জন্মভূমিতে গমন করিয়া রাজদণ্ড ধারণ করতঃ শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন না কবেন, তাহা হইলে সুপ্রাচীন রাজ্যটী চিরকালেব জন্য উচ্ছন্ন যাইবে।

 দূত-মুখে তিনি পৈতৃক রাজ্যের এবংবিধ শোচনীয় দশা অবগত হইলে বাধ্য হইয়া তাঁহাকে ত্রিপুরাতে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে হয়। এবং ৮১৭ ত্রিপুরাব্দে তদীয পিতৃদেব-পরিত্যক্ত শূন্য সিংহাসনে আরোহণ করতঃ ন্যায় ও সুশাসনের দ্বারা রাজ্যমধ্যে সুখ ও শান্তি স্থাপন পূর্ব্বক প্রজাপালন করিয়া পরিশেষে ৮৪৮ ত্রিপুরাব্দে বসন্তরোগে মানবলীলা সংববণ কবেন।

 কথিত আছে—এবম্প্রকার একত্রিংশ বর্ষ ব্যাপী তদীয রাজত্বকালে দুর্ভিক্ষ, মহামারই প্রভৃতি কোনরূপ মাবাত্মক ব্যাধি কিংবা রাষ্ট্রবিপ্লব বা অশান্তি রাজ্যমধ্যে সঙ্ঘটিত হয নাই। এই জন্য তৎকালে জনসাধারণ-কর্ত্তৃক কথিত হইত ধর্ম্মময় ত্রিপুরাধিপতি ধর্ম্ম মাণিক্যের পুণ্যবলে তদীয় রাজ্য মধ্যে এবংবিধ সুখ শান্তি বিবাজ করিয়াছিল।

 তিনি যে কেবল ধার্ম্মিক ছিলেন এমন নহে, শৌর্য্যে বীর্য্যে অদ্বিতীয় এবং ন্যায়বান সুশাসক বলিযাও প্রসিদ্ধি লাভ কবিযাছিলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি একজন গুণগ্রাহী পুরুষও ছিলেন। গুণবান ব্যক্তি সর্ব্বদা তৎকর্ত্তৃক আদৃত হইত। জাতি ও ধর্ম্মের কোনরূপ বৈলক্ষণ্য হইত না। কালে খাঁ ও গগন খাঁ নামক আরাকান নিবাসী যবনদ্বয়ের কার্য্য দক্ষতা ও নানাবিধ সদ্গুণ পর্য্যবেক্ষণ করিয়া তিনি তাহাদিগকে ত্রিপুরোরাজ্যে মন্ত্রী নিযুক্ত কবিয়াছিলেন। ইহাই সর্ব্ব প্রথম ম্লেচ্ছ জাতীয় দুই ব্যক্তি উক্ত রাজ্যে এবংবিধ উচ্চ ও গৌরবান্বিত রাজকর্ম্মচারী পদে নিযুক্ত হইয়াছিল। ইহার পূর্ব্বে আর কখনও এইরূপ হইযাছে বলিয়া অবগত হওযা যায় না।

 নৃপতি ধর্ম্ম মাণিক্য ন্যায়দণ্ড-ধারণপূর্বক রাজ্যশাসন করিবার কালেই তদীয়পিতৃপুরুষগণের কীর্ত্তি কাহিনী শ্রবণকরিতে অভিলাষ জ্ঞাপন করিলে “দুৰ্লভেন্দ্র নামক চন্তাই” উপাধিধারী চতুর্দ্দশ দেবতাব সর্ব্ব প্রধান পূজক কর্ত্তৃক তৎপূর্ব্ববর্ত্তী ত্রিপুরেশগণের ইতিবৃত্ত আদ্যন্ত বিবৃত হয়। সেই সমস্ত কথা তৎকালের রাজসভা পণ্ডিত শুক্রেশ্বরবাণেশ্বর নামক দুই ব্রাহ্মণ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন।

 যে প্রথিতনামা পুণ্যশ্লোক ত্রিপুরেশ ধর্ম্ম মাণিক্যের জীবন চরিত সংক্ষেপে বর্ণিত হইল, তৎকর্ত্তৃকই কুমিল্লা নগরিস্থ ধর্ম্মসাগর নামক সুপ্রসিদ্ধ দীর্ঘিকাটী খনিত হইয়াছিল। ১৩৮৭ শকাব্দীর (১৪৫৮ খৃষ্টাব্দ) বৈশাখ মাসে সোমবার শুক্লা ত্রয়োদশীতে দীর্ঘিকাটী উৎসর্গ করিবার সময় তিনি তাম্রশাসন দ্বারা উনবিংশতি দ্রোণ শস্যপূর্ণ ভূমি কৌতুকাদি অষ্ট ব্রাহ্মনকে বিতরণ করিয়াছিলেন।

 তাম্রশাসনটী এই—

“চন্দ্রবংশোদ্ভবঃ স্বাপ মহামাণিক্যজঃ সুধী।
শ্রীশ্রীমদ্ধর্ম্ম মাণিক্য ভূপশ্চন্দ্র কুলোদ্ভবঃ॥
শাকে শূন্যাষ্ট বিশ্বাব্দে বর্ষে সোমদিনে তিথৌ।
ত্রয়োদশ্যাং সিতে পক্ষে মেষে সূর্য্যস্য সংক্রমে॥
কৌতুকাদি দ্বিজাগ্র্যেষু পূজিত্যেষু চ চাষ্টসু।
ভূমিং দদৌ শস্য পূর্ণাং দ্রোণ বিংশ নবাধিকাং॥
জলাশয়ং দ্বিজায়েমং ধর্ম্মসাগরমাখ্যয়া।
সভূমি ফল বৃক্ষাদি ভূষিতং দত্তবানহং॥
মমবংশ পরিক্ষীণে যঃ কশ্চিদ্ভূপতির্ভবেৎ।
তস্য দাসস্য দাসোহং ব্রহ্ম বৃত্তিং ন লোপয়ৎ॥”

 বর্ণিত দীর্ঘিকার উত্তরতীরে অধুনা যে দুইটী মনোজ্ঞ ভবন অবস্থিত, তাহা সুপ্রসিদ্ধ অশ্বপরিচালন নিপুণ ও মৃগয়া-কুশল ত্রিপুরাধিপতি কাশীচন্দ্র মাণিক্য কর্ত্তৃক নির্ম্মিত হইয়াছিল।