বিষয়বস্তুতে চলুন

দানবদলন কাব্য/ষষ্ঠ সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ স্বর্গ।

ম্রিয়মাণ ভাবে দূত কচলিয়া হাত,
ভগ্ন গদ গদ্‌ স্বরে ভাষিলা আসিয়া
দৈত্যপতি পাশে;—"রণে পড়েছে নিশুম্ভ
বীর রক্তবীজ সহ।” তাড়িতাগ্নিসম
শোকবার্ত্তা সঞ্চরিল অমনি শুম্ভের
সর্ব্বাঙ্গ শোণিতে; রাজদণ্ড আছাড়িয়া
ভাঙ্গিলা ভূপরে; রোষবিস্ফুলিঙ্গসম
খচিত রতন রাজি দীপিতে লাগিল
ছিটাইয়া পড়ি। হৃদ কাঁপিল সঘনে;
ঘুরিয়া উঠিল শির; ঝলিল আগুন
চক্ষু নাসা কর্ণ দিয়া; বিকল ইন্দ্রিয়
পড়িলা ভূতলে বলী ছাড়ি সিংহাসন!
বিলুণ্ঠিয়া কেশ জাল হস্তপদ ছুড়ি,
উড়াইলা ধূলি; মরি ধূলি ছলে যেন
ত্যজিতে লাগিল ধরা (শুম্ভ দুঃখে দুঃখী)
ঊর্দ্ধে বাস্প। উথলিয়া শোকের সাগর
ইন্দ্রিয়ের দ্বার দিয়া বহিল বীরের;—
আর্ত্তনাদে রসনায়, অশ্রু ছলে চোখে,
ঘন দীর্ঘশ্বাসরূপে নাসারন্ধ্র দ্বয়ে।
কতক্ষণে তবে বলী বক্ষে কর হানি

কহিলা কাতরে;—"ভাই কোথারে নিশুম্ভ,
সত্য ভুলেছ কি তুমি আমার সে মায়া?
সত্য আমার লাগিয়া দিয়াছ কি ভাই,
জলাঞ্জলি সাংসারিক সুখে? তবাগ্রজ
এখনও জীবিত আমি, নিশ্বাসিছি বায়ু?”
নিস্তব্ধ হইলা বীর আর না কাঁদিলা;
আর না করিলা নাম প্রিয়ানুজবর,
রক্তবীজ প্রভু ভক্তি স্মরিল না মনে।
ত্যজি ধূম রাশি যথা জ্বলয়ে অনল;
সম্বরিয়া বাস্প বীর জ্বলিলা ক্রোধেতে।
উলাঙ্গিলা অসি দর্পে; গভীর নিনাদে
আদেশিলা সৈন্যগণে সাজিতে সমরে।
অধৈর্য্য উচ্ছ্বাসে বীর ফিরিতে লাগিলা।
যথা, অগ্নি উদ্গীরণে জ্বলয়ে ভূধর;
লাগিলা সে দৈত্যাবাস যেন উদ্গীরিতে
অনল; দানব সৈন্য হুতাশন তেজ,
প্রচণ্ড প্রবেগে রড়ে বেরুতে লাগিল
বিঘোর রৌরবে দিক্‌ আকুলিয়া মরি,
পদভরে ভূকম্পনে কাঁপায়ে বসুধা!
সাজিতে লাগিল রণে যে আছিল যেথা,
একেবারে দৈত্য কুল; সাজিতে লাগিল,
পিতা পিতামহ আর, পুত্রবরসহ।

নির্ঝর সঙ্গম বারি যেন একত্রিত
হলো কোন সরিতের। মহান বিক্রমে,
চমকিলা রণ সাজে আচ্ছাদিয়া ধরা,
চলিলা অসুর বল; আচ্ছাদি আকাশ;
চলে সে তারকা দল যথা ঘোরা রাতে।
হেথা শুভ্রা বিনোদিনী,—শুম্ভের মহিষী,
বিহার কাননে ভ্রমে, সখীদল সহ,
শান্তা সহ আর, বীর নিশুম্ভের প্রিয়া,
বিলাস রঙ্গেতে সবে মত্ত কুতুহলে;
কেবল সে শান্তা সতী, বিরহ বিধুরা
সুখপথহারা, আহা, ফেরে একাকিনী!
অন্যমনা কভু ধনী দাঁড়াইছে গিয়া,
পল্লল সলিল ধারে; বিমল সলিলে,
দেখি নিজরূপ ছটা, বেশ ভূষা আর,
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি খেদে, অমনি ফিরিছে।
আবার আসিছে যথা তমাল বিটপী,
নিবিড় পল্লবে ভারি, দুখ ভারে সতী
দাঁড়াইছে তার পাশে। কহিছে অন্তরে;—
"আকুল পরাণ মোর, হয় কেন আজি?
কি জানি কি সর্ব্বনাশ ঘটিল ললাটে!
কি জানি কি হলো। হায়, ঝটিকা আগম
জানিতে পারিয়া, যথা খেচর নিকর

নামে ভূমি তলে, মন, না জানি কি জেনে,
আপনি হতেছে আজি দুখে অবনত!
না বলে গেলেন রণে হৃদয়েশ মোর
ভ্রাতৃ আজ্ঞা শিরে ধরি। হায়, নিশাভোগে,
ভুঞ্জি সুখ নিশাচর। পশে যথা গিয়া
নিবিড় গহনে, তুষাসিক্ত দুর্ব্বাদলে,
রাখি পদ চিহ্ন; স্বামী পশেছেন মোর,
গভীর সমরে, রাখি প্রেম চিহ্ন কত,
স্নেহসিক্ত, তাঁর এই হৃদদুর্ব্বাদলে!—
আর কি পাইব আমি সুখের যামিনী?”
ছাড়িলা নিশ্বাস সতী শূন্য করি বুক!
উদাস অন্তরে, মরি, চাহিতে লাগিলা!
সহসা শুনিলা রোল, মহাভয়ঙ্কর!
জলদ নির্ঘোসে যথা চমকে ময়ূরী,
চমকিলা সতী; দ্রুত আসি শুভ্রা পাশে
কহিতে লাগিলা;—"দিদি, অকস্মাৎ কেন
বাজিল দুন্দুভি, ঘোর? কি জানি কি হলো।
সাজিছেন কি রাজন্‌ আপনি সংগ্রামে?
অমঙ্গল কিবা, বুঝি ঘটিয়া থাকিবে,
জীবিতের মোর, চল দিদি যাই ত্বরা।”
ব্যস্তভাবে উত্তেজিতে লাগিলা শুভ্রায়।
নিশ্বাস ছাড়িয়া শুভ্রা কহিলা কাতরে;—

"ছার খার হলো সব, কাল সমরেতে!
চলিলা আগেতে রাণী, পিছে শান্তা সতী;
তদপরে ক্রমাগত সখী দল শ্রেণী;
বিস্তারি উজ্জ্বল পুচ্ছ, চলিলা আমরি,
যেন কোন ধূমকেতু ধরণী উপরে!
কতক্ষণে সভাতলে সবে দেখা দিলা
তাড়িত আয়ূধে যথা সাজয়ে জিমূত,
দেখিলা সেজেছে রণে অসুর ঈশ্বর?
প্রখর প্রদীপ্ত অসি, দীপে ভীম ভুজে।
উদাস গম্ভীর ভাব, শোক কোপজাত,
হেরিলা পতির, শুভ্রা; বুঝিলা অন্তরে,
যুদ্ধের বারতা। ধীরে, কহিলা শুম্ভেরে;—
"নাথ! ত্রিলোক বিজয়ী বীর, যবে রণে
দেবর আমার বীর রক্তবীজ সহ,
তবে কেন সাজ পূনঃ আপনি সংগ্রামে?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি শুম্ভ কহিলা শুভ্রায়;—
"নাহি আর ধরাতলে দেবর তোমার,
যাও প্রিয়ে অন্তঃপুরে, ছাড়ি মোর মায়া।—"
ছাড়িলা নিশ্বাস বলী, আবার হুঙ্কারে।
বজ্রাঘাত সম বাণী পড়িল শান্তীর
হৃদয় কুটীরে; ঘোর জ্বলিল শোকাগ্নি;
পুড়িল দেহের গ্রন্থি, এলাইয়া ভূমে,

পড়িলা সহসা বালা অচৈতন্য হয়ে।
কি হলো কি হলো, বলি, ধরিলা তাঁহায়
শুভ্রা; উঠ ভগ্নি, বলি ডাকিতে লাগিলা।
কে আর উঠিবে? শান্তা মহানিদ্রাগতা।
কাঁদিতে লাগিলা শুভ্রা ধরিয়া তাহায়।
কতক্ষণে তবে সাধ্বী আসি ধীরে ধীরে
দৈত্যপতি পাশে, ধরি যুগল চরণ
কহিলা কাতরে;—"নাথ ক্ষমা কর আর
যেও না সংগ্রামে। দেখ, এ শান্তার দশা
ঘটাইলা যাহা হায় দেবর আমার!
ঘটাইওনাক তুমি হেন দশা মোর।”
"হেন দশা বাঞ্ছনীয় অসুর কুলের,
জীবিত এখনো যারা (কহিলা দেবারি)।
যাও প্রিয়ে অন্তঃপুরে, পূজ গিয়ে সেথা
ইষ্ট দেবে, অগ্নিকার্য্য করগে শান্তার।
সেজেছি সমরে আমি, যাত্রাকালে মোরে
দিও নাক বাধা। বলী উঠিলা রথেতে,
আর না চাহিলা ফিরি প্রিয়পত্নী পানে।
চালাল সারথি রথ, গভীর নির্ঘোষে।
ক্ষুব্ধ চিত্তে শুভ্রা দেবী রহিলা দাঁড়ায়ে;
হতাশ নয়নে মরি হেরিতে লাগিলা,
যাবৎ দেখিতে পেলা প্রিয়পতি রূপ।

সজল নয়নে তবে সখীদল সহ,
লইয়া শান্তার দেহ গেলা অন্তঃপুরে।
অগ্নি কার্য্যে ব্রতী তথা হইল সকলে।
এদিকে অসুর দল ক্ষণে দেখা দিল
হিমাচল দেশে। ব্যূহ রচিল নিমেষে—
কাতারে কাতারে সৈন্য রকমে রকম,
দাঁড়াইল থাকে থাকে রণক্ষেত্র যুড়ি;
থাক থাক মেঘে যেন ছাইল অম্বর।
গভীর নীরবে ঘোর ডুবিল ক্ষণেক
সে সমর ক্ষেত্র—ব্যূহ নিস্পন্দ নীরব।
পার্ব্বতীয় সমীরণ সদৃশ প্রভাব,
ছুটিল সংসার মাঝে অসুর কুলের।
অপসারি অন্ধকার চলে যথা দীপ,
চালাইলা রথ আগে দনুজ ঈশ্বর—
নিবিড় অনীক কুলে ছাড়ি দিল পথ।
ফিরাইয়া আঁখি বীর নিরখিলা তবে,
বিঘোর শ্মশান মূর্ত্তি!—রাশি রাশি শবে
আচ্ছন্ন শৈকত ভূম যথা বালুস্তূপে,
কিম্বা জলধির জল তুঙ্গ ঊর্ম্মি কুলে,
হেরিলা আচ্ছন্ন বলী সে সমর ক্ষেত্র;
মর্ম্মভেদী পূতি গন্ধে গন্ধবহ ভরা।
আচ্ছন্ন হেরিলা বীর অম্বর প্রদেশ,

প্রান্তরের তরুকুল, মহীধ্র শেখর
গৃধ্র পক্ষীকুলে। শিবাকুল বসি কেহ
অগ্রপদ ভরে, গুরু ভোজনের কষ্টে
রক্তাক্ত বদন হতে বারি কার জিহ্বা,
শ্বাসে বায়ু, ফুলাইয়া কথঞ্চিত মরি,
স্ফীত সে উদর! কেহ হাঁফাইছে পড়ি
ভূমে লুঠাইয়া জিহ্বা। নূতন ক্ষুধায়
কেহবা ছিড়িছে মাংস পদে ধার শব,
ক্ষণ ক্ষণ ঊর্দ্ধশ্বাসে বিকট চীৎকারে
আকুলিয়া দিক, মন উদাস করিয়া।
বীরগণ যাহাদের তেজস্বী মানস
বিমুগ্ধ না হতো কভু অপ্সরীগণের
প্রেম আলিঙ্গনে, এবে বিগলিত মরি
যেন বসুধার প্রেমে, গৃধ্রপক্ষীগণ
অধর চুম্বনে লভে অনন্ত বিরাম।
রথীকুল হতগর্ব্ব সাক্ষীর স্বরূপ,
ভগ্নচূড় রথ কত যায় গড়াগড়ি।
কলঙ্কিত কালরক্তে ছিটাইয়া ভূমে
পড়িয়া রয়েছে কত বীর আভরণ;
যেন অপযশ নিজ ফেলি পলায়েছে,
পলাইত সেনাকুল। শিথিল চিবুক,
পড়িয়া আড়ষ্ট পদে প্রখর তুরঙ্গ,

আঁখির অনল রাগ ভস্মরাগ এবে।
বিস্তারিয়া কলেবর পড়ে গজবর,
সমর কল্লোল যেন শুনিছে নীরবে,
মক্ষিক দংশনে কাণ না নাড়ি বারেক।
কিবা ভয়ঙ্কর সেই সমর শ্মশান!—
মরি যেন নবরাজ্য বিশাল বিস্তৃত
বিজয়ী শাসিছে কাল প্রভূত প্রভাবে,
লয়ে সেনাপতি যুগ, হতাশ, বিষাদে!
ফিরাইয়া আঁখি শুম্ভ, দেখিলা বামেতে
পড়ে যে ধূম্রলোচন, গজরাজ যেন
দুর্দ্দান্ত কেশরী করে গতাসু ভূমেতে।
ব্যথিত অন্তর বীর ফিরাইয়া আঁখি
দেখিলা সম্মুখে পুনঃ, প্রলয়ের ঝড়ে
ভগ্ন যথা তুঙ্গ শৃঙ্গ, পড়ে দুই ভাই,
চণ্ডমুণ্ড, গৃধ্র কুল পক্ষের বাতাসে
বিদূরিছে রণ শ্রান্তি যেন ধরাসনে।
শেল বিদ্ধ মনে পুনঃ ফিরাইয়া আঁখি,
হেরিলা সে রক্তবীজে; আলুথালু অঙ্গ
ভূতলে পড়িয়া বীর, পড়ে যেন মরি,
প্রলয় সমর ঝড়ে বীরত্ব পাদপ!—
শুনিলে যাহার নাম চমকিত স্বর্গ,
এবে সেই জন, মরি, বিস্তারিয়া বাহু

মাঙ্গিছে কাতরে যেন ধরায় আশ্রয়!
হেরিলা দক্ষিণে বলী, (হেরিতে হেরিতে,
হারাইলা জ্ঞান মরি) প্রাণের সোদর,
পড়ে সে নিশুম্ভ বীর, ভাসিছে শোণিতে,
ভাসে হিম শিলা যথা সাগরের জলে।
উথলিল শোক সিন্ধু শুম্ভের মানসে,
অভিভূত করি মরি ধৈরজের তটে!
ঝর ঝর অশ্রু নীরে ভাসিল হৃদয়।
দীর্ঘশ্বাসে তবে খেদে কহিতে লাগিলা;—
"কি কাজ সংসারে আর, কি কাজ জীবনে,
ত্রিলোকের আধিপত্যে কি সুখই বা আর?
সুখের সাগর মোর শুকায়েছে মরি!
প্রমোদ উদ্যান ত্যেজে মরু ভূমে বাস
কে করিতে চাহে? কভু জ্বালানি না হব
সংসারের, হীন পত্র শুষ্ক তরু সম।
জ্বলিব না কভু, বন্ধু বান্ধব বিহনে
চির দুখানলে। লই প্রতিশোধ আগে,
দিই রসাতলে আগে ত্রিদিব প্রদেশ,
ছিটাই কালীর কালী জগত সংসারে।”
জ্বলিলা ক্রোধেতে বলী তবে সে বিষম;
দৃঢ় হলো কম্বুগ্রীব, ফুলিল উরস,
আঁখি পুত্তলিকা দিয়া ঝলিল আগুন।

কুটিল করিয়া ভ্রূ, রুক্ষ্ম দরশনে
হেরিলা অমর ব্যূহ তবে বীরবর।
দেখিলা সে কালিকারে; নিস্তব্ধ নিশীথে
আলেয়া আলোক যথা বিশাল প্রান্তরে
কত রঙ্গ ভঙ্গ ভ্রমে উজলি আঁধার,
ফিরিছে ভৈরবী রঙ্গে সে সমর ক্ষেত্রে,
নিস্তব্ধ বিঘোর ব্যূহ অমর সৈন্যের,
উত্তেজিত করি, মরি, দেখাইয়া সবে
নিজের জ্বলন্‌ মূর্ত্তি!—জ্বলে রক্ত আঁখি
ত্রয়; লোহিতে উজ্জ্বল অসুর শোণিতে,
ওষ্ঠাধর, শৃক্কদ্বয়, লক্‌ লকি জিহ্বা;
উলঙ্গিনী, কিন্তু অঙ্গে প্রভাব পবনে,
উড়ে যেন চেল বস্ত্র, অরি শোণিতের।
গম্ভীরে জিমূত যথা নাদে বর্ষিবারে,
ঘোর রবে দিলা শুম্ভ সমর আদেশ।
অমনি অসংখ্য ধনু টঙ্কার নিনাদে,
(ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যেন কালের পাহুড়ি)
স্বীকারিল সে নিদেশ। মহাদর্প ভরে
টলিল বিকট টাট তবে রণ আশে,
পদের রগড়ে হৃদ পিশিয়া ধরার।
মিশিল দুদলে তবে। প্রলয় তুফান
উঠিল সাগরে যেন! করিতে লাগিল

টলমল ধরা পৃষ্ঠ; তুঙ্গ ঊর্ম্মিসম,
সেনার সমষ্টি তোড়ে পশিতে লাগিল,
বিপক্ষ সেনার প্রতি এক পরে আর।
গভীর গর্জনে ঘোর সংসার পূরিল।
রক্তের প্লাবনে দিক লাগিল ভাসিতে।
কালতমে যেন দিক্‌ হইল আঁধার!—
দিবারাত্রি একাকারা হইল জীবের,
না চাহিল কেহ ফিরি চন্দ্র সূর্য্য পানে,
ত্রাসে মুদি আঁখি সবে রহিল নীরবে।
ছিন্ন ভিন্ন হলো সৃষ্টি; উড়ে গেল কোথা
ধরণীর হৃদয়ের উদ্ভিদ বসন;
কাঁদিতে লাগিলা সতী আলু থালু বেশে,
ভাসি রক্ত স্রোতে, মরি বিলুণ্ঠিত হয়ে
ব্রহ্মাণ্ডের পথে যেন দস্যু দল দ্বারা!
এবে যথা কিছুকাল প্রলয়ের ঝড়
তুমুল তোড়েতে বহি হইলে শিথিল,
বহে সে দমকা যথা রহিয়া রহিয়া,
সমর তরঙ্গ এবে বহিতে লাগিল,
ক্ষণে ক্ষণে, স্থানে স্থানে, হইয়া প্রবল।
কতক্ষণে তুলি ঘাড় তবে দৈত্যপতি,
হেরিলা ফিরায়ে আঁখি সে সমর ক্ষেত্র
দেখিলা, যুঝিছে কালী প্রলয় কারিণী,

ঘোর ঘূর্ণাবায়ু সম ঘূরি রণস্থলে,
বিকীর্ণ মূর্দ্ধজা জাল, চঞ্চল চরণ।
ভীষণ বরাহী যথা বিকট গর্জনে
খেদায় শৃগাল কুলে, রক্ষিতে শাবক,
খেদাইছে ঘোর রাবা অসুর নিকরে,
ভৈরব হুঙ্কার রবে, রক্ষিতে স্ববল;
আবার আস্ফালি অসি তাড়িতের গতি,
(গভীর সমর যথা) পশি মহাদর্পে,
নিমেষে অসুর শবে রচিছে পাহাড়,
রক্তের নির্ঝর শত ঝরায়ে উহায়।
ভঙ্গ দেয় দৈত্যকুল যেখানেতে কালী।
জ্বলিল বিষম ক্রোধ শুম্ভের লোচনে,
যুগ্ম কুজ গ্রহ যেন বিকাশি ললাটে।
কুটিল হইল ভ্রূ, আরক্ত কপোল
আকুল হইল মন, অধৈর্য্য উচ্ছ্বাসে।
(চালাওরে রথ ত্বরা) ভৈরব নিনাদে
আদেশিলা সারথিরে চালাইতে রথ।
অমনি হানিলা কশা সঙ্কেতিয়া বাগ
সারথি, অশ্বের পৃষ্ঠে; ছুটিল তুরঙ্গ,
খসিয়া পড়িল যেন আকাশের তারা,
ঘুরিল রথের চক্র উছলিয়া মাটি,
উড়িল বিমানে ধ্বজ ফড় ফড় ফড়ে।

নিমিষে আসিয়া বলী উত্তরিলা তবে
চামুণ্ডার আগে; দৃষ্টি মিশিল দোঁহার;
আগুনে আগুন যেন মিশিল সহসা।
পড়িলা লাফায়ে বলী ভূমে, রথ হতে;
পদভরে ঘন ধরা কাঁপিয়া উঠিল,
উঠিল তরঙ্গ মালা সাগরের জলে,
নড়িল পর্ব্বত চূড়া, নড়িল চূচক
যুবতীর হৃদে, খুলি গেল স্তন্যপায়ী
শিশুর বদন, উহা হতে। দণ্ড হস্তে
আরম্ভিলা মহামার তবে মহাবলী।
লগুড় আঘাতে যথা ভাঙ্গি ঢেলা কৃষী
সমতল করে ক্ষেত্র, নিমেষে শূরেশ
সপাটে অমর সৈন্যে লুঠাইলা ভূমে।
ভয়ঙ্করা বেশে কালী তবে দিলা হানা,
লট্ট পট্ট কেশ জাল ঘূর্ণিত নয়ন,
চঞ্চল স্থূলাঙ্গ মরি ক্রোধের উত্তেজে!
হানিলা সুতীক্ষ্ণ বাণ টঙ্কারিয়া ধনু,
শুম্ভের স্কন্ধেতে; অঙ্গে বিন্ধিয়া ফলক,
কাঁপিতে লাগিল শর; মরি, (ভয়ে যেন,)
ছুঁয়েছে এ হেন বীর তেজস্বী শরীর।
রোষে ভূমে পদাঘাতি, দর্পে নাড়ি ঘাড়,
রুক্ষ্ম দৃষ্টে চাহি ক্ষণ হেরিলা ভীমায়

অমরারি; টান দিয়া ফেলি দিলা বাণ;
ঝরিল ঝর্ঝরে রক্ত তিতাইয়া তনু।
ভীষণ কেশরী যথা গভীর গজনে
পড়ে করিণীর শিরে, হুহুঙ্কারে বীর
আক্রমিলা কালিকায় অনিবার্য্য তেজে।
করিলা ভৈরবী হৃদে ঘোর মুষ্ঠ্যাঘাত;
কম্পিত শারীর যন্ত্র, স্তম্ভিত শোণিত,
অমনি পড়িলা দেবী মূর্চ্ছিতা ধরায়।
আলু থালু কেশ জাল লুঠাইল ভূমে।
ধরিয়া কেশের মুষ্টি, প্রচণ্ড বেগেতে
ঘুরাতে লাগিলা শুম্ভ আকাশে ভীমায়;
মরি, মহামেঘ যেন ঘুরিতে লাগিল
ঘোর ঘূর্ণাবায়ুভরে। ঘূর্ণিত সংসার
হেরিলা নয়নে সতা; গণিলা প্রমাদ;
শুকাইল মুখচন্দ্র, উড়ে গেল প্রাণ;
আকুল পরাণে তবে স্মরিলা রুদ্রেরে;—
"নাথ, কোথা ওহে চিন্তামণি, মহাযোগী,
যোগ ভঙ্গ করি ক্ষণ নিরখ দাসীরে!
বিষম সমরে প্রভো হয়েছি কাতর,
দুর্ম্মদ দৈত্যের করে বুঝি প্রাণ যায়।
তব বলে বলা দেত্য অনিবার্য্য তেজ,
(শক্তি আমি,) মোর শক্তি লাঘবে হেলায়।

অবশ হয়েছে অঙ্গ তব প্রেমাধার,
শুকায়েছে কণ্ঠ নাথ, তব প্রেম পায়ী,
শূন্যময় দেখি দিক, আঁধার সংসার,
মহাকাল, মহাশূলী, তুমি হৃদয়েশ
থাকিতে আমার। দেহ মোরে বল শুম্ভ,
পতির বলেতে বলী ভার্য্যা চিরকাল।
এহেন লাঞ্ছনা আর সহিতে না পারি,
কেশে ধরে দৈত্যরাজ ঘুরায় আমায়।”
দীর্ঘশ্বাসে মনানল তেয়াগিলা সতী।
তাড়িত বারতাবহ তার যন্ত্র যথা,
নড়িলে এখানে, নড়ে দূরগত যন্ত্র,
ব্যাকুল সতীর মন আকুলিল মরি,
দূরগত যোগেশের তপঃমগ্ন মন।
কেনবা না আকুলিবে? মন তার যোগে,
প্রেমের তড়িত যাহে ঝলে অবিরত।
মেলিলা অমনি আঁখি ত্যজি যোগ যোগী,
আকুল নয়নে ক্ষণ হেরিলা সংসার
শূন্যময়; শূন্যময় হৃদয় আগার।
লট্ট পট্ট জটাজুট, অমনি উঠিয়া
লইলা ত্রিশূল করে, ত্রিফল ফলিত
শত সূর্য্য তেজে, দ্বন্দ্বে জ্যোতি পরস্পর
উছলি কালাগ্নি মরি প্রত্যেক ভঙ্গিতে!

চলিলা ধূর্জ্জটি রড়ে মহাকাল দেব;
গতির তোড়েতে সৃষ্টি আকুল হইল;—
জটাজুট বাঘছাল দিয়া মহাত্রাসে
পলাতে লাগিল বায়ু; প্রতি পাদক্ষেপে
কাঁপিয়া উঠিতে ঘন লাগিল বসুধা;
খসিয়া পড়িতে শৃঙ্গ লাগিল শৈলের;
মহাসাগরের বারি হলো সচঞ্চল।
অদৃশ্য জীবের চক্ষে নিমেষে ত্রিশূলী
আসি উপস্থিত, যথা বিস্তারিয়া বপু,
শুম্ভের প্রভাবে সতী ঘুরেন আকাশে।
ঘুরিলা আমরি মন অমনি শুম্ভের
কালিকার সাথে, (শেল বিদ্ধ হয়ে যেন)।
কালানল রুক্ষ্ম দৃষ্টে হেরিলা শুম্ভেরে।
যথা রৌদ্র তেজে উড়ে সাগরের বারি,
রুদ্র কোপাতপে শুম্ভ হারাতে লাগিলা
বল আপনার; রক্ত শুকাল দেহের।
অবসন্ন কলেবর ছাড়ি দিলা বীর
কালিকার কেশ মুষ্টি; পড়িলা ভূতলে,
পদযুগ ভরে ভীমা; ধ্বনিল নূপুর
ঝন ঝনে; অস্ত্র লেখা ধ্বনিল অঙ্গেতে,
দেখাতে শুম্ভেরে যেন নূতন প্রভাব।
হতাশ অন্তর বীর, বিবর্ণ বরণ,

নিরস নীরদ সম ফিরিতে লাগিলা
মৃদুগতি, এবে রণে; নাহি আর মরি,
সে প্রখর তেজ অনিবার্য্য, নাহি আর
স্তনিত নিনাদ সম সে ঘোর হুঙ্কার!
চলি গেলা মহাদেব। শীতল সমীরে
ঘনীভূত যথা বাষ্প, ঘোর ঘন ঘটা
রূপে হয় পরিণত, শিবের সস্নেহ
দৃষ্টে, শিব কামনায়, ভয়ঙ্করা কালী।
দেবগণে লয়ে তবে আক্রমিলা শুম্ভে,
চামুণ্ডা; জ্বলন্ত অগ্নি এবে রুদ্র তেজে।
লট্ট পট্ট কেশ জাল ঘন আন্দোলিত,
ফুটে পড়ে রোষ রশ্মি ঘূর্ণিত নয়নে,
গভীর গর্জনে ঘোর আকুলি সংসার,
আরম্ভিলা মহামার তবে প্রলয়িনী।
ছিন্ন ভিন্ন দৈত্য ব্যূহ করিলা নিমেষে।
পলাল অসুর সৈন্য ত্রাসে ইতস্ততঃ।
কাতর নয়নে শুম্ভ, দেখে সে ব্যাপার,
অন্তর আগুণে মরি দহি অন্তরেতে,
রক্ষিতে না পারি নিজ প্রিয় সেনাকুলে!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি তবে কহিলা কাতরে;—
"ছায়, জানিলাম এবে সংসারের মায়া!
চির স্থির কিছু নহে এ ভব মণ্ডলে!

চিরোন্নতি অনিবার নাহি পায় কেহ!
চির অধোগতি কার না হয় কখন।
সাগরের বারি যথা ফিরিছে সংসারে,—
কভু বা আকাশে চড়ি ঘোর ঘন ঘটা,
কভু বা পড়িয়া ভূমে, মৃদু দু গতি,
ফিরিতেছে জীবকুল সম্পদ উপরে,
কভু মহা আড়ম্বর, ফেরে দ্বারে দ্বারে,
কভু বা দারিদ্র্য বেশে, ম্রিয়মাণ মুখ।
দৈত্যকুল দর্পানল পাইলা নির্ব্বাণ
এবে, বৃথা কিছুকাল জালায়ে অমরে।”
সখেদে নিশ্বাস ছাড়ি দাঁড়াইল বলী।
শান্তার সৎকার্য্য সারি হেথা অন্তঃপুরে,
পতির মঙ্গল লাগি পূজে শুভ্রা সতী,
স্থাপিয়া মঙ্গল ঘট, শঙ্করের পদ।
উপচার কত মত বিবিধ বিধান
সাজায়েছে স্তরে স্তরে; সাজাইয়া যথা,
অযুত কুসুম স্তর নানা সুবর্ণের,
পূজিতে বসন্ত রাজে বসেন বসুধা।
বিমল কোমল করে কুসুম অঞ্জলি,
সুরাগ প্রতিফলিত, মরি এ উহায়!
গল বস্ত্রে ভক্তিভাবে মহাদেব পদে,
যেমন দিবেক সতী সে পূর্ণ অঞ্জলি,

অমনি চলকি হাত ছিটাইয়া ভূমে
পড়ে গেল ফুল রাশি; সহসা আপনি
পড়িল মঙ্গল ঘট, ঢালি দিয়া ভূমে
দৈত্য শুভাদৃষ্ট সম পবিত্র উদক।
কাঁপিয়া উঠিল বুক ভয়েতে শুভ্রার
দেখি হেন অলক্ষণ। আকুল হইলা;
ভাবিলা, কেন বা আজি না লইলা পূজা
মোর, রুদ্রেশ্বর; কিবা অমঙ্গল, নাহি
জানি, ঘটিল ললাটে; কেন বা আপনি
পড়িল মঙ্গল ঘট। ছাড়িলা নিশ্বাস।
বিষাদে ক্ষণেক রৈলা নামাইয়া মুখ।
করষোড়ে তবে সাধ্বী আরম্ভিলা স্তব;—
"হে দেব ত্রিপুরঅরি, দেব আদি দেব,
কেনবা নিরখি তব এত অবহেলা
দৈত্যকুল প্রতি; কেন কৈলে ছারখার
এ অসুর কুল। প্রভো! শারদ সমীরে
নিবিড় পল্লব পুঞ্জে সমৃদ্ধি শালিনী
যথা ধরা, তেমতি হে শুভ আকাঙ্ক্ষায়
তব, ছিল দৈত্যকুল, মহোন্নতি শীল।
এবে তব কৃপা সর শুখায়েছে নাথ,
দুঃখের পঙ্কেতে মোরা কত যে যাতনা
সহিতেছি, মীনসম, বলিতে না পারি!

প্রলয় সমর ঝড়ে ভেঙ্গেছে মোদের
দেব, আশার জাহাজ; এক মাত্র শুম্ভ-
রূপ কাষ্ঠখণ্ড, এবে, আশ্রয় মোদের
দুর্দ্দশা তরঙ্গে মহা? ডুবাইও নাক
নাথ, যেন কাল তলে সে কাষ্ঠ আশ্রয়,
ভাসাইও নাক যেন দৈত্য নারীগণে
অপার দুখ সাগরে! এই নিবেদন।”
মুদিলা নয়ন সতী করিবারে ধ্যান।
কোথা আশুতোষ মূর্ত্তি?—হেরিলা কাতরে,
প্রভাতের চন্দ্র যথা বিবর্ণ বরণ,
তারা-দল-হারা, রণে ফিরিতেছে যেন
জীবিত ঈশ্বর তার, তেজ হীন তনু,
হতাশ অন্তর মরি স্বদল বিচ্ছেদে!
আকুল পরাণে সতী মেলিলা নয়ন।
হেরিলা সংসার শূন্য, শূন্য চতুর্দ্দিক।
কি হলো আমার হায়, বলি উঠি ত্বরা
ধাইলা বিবশা ভাবে লক্ষ্মীর মন্দিরে।
আছাড়িয়া পদতলে পড়িলা পদ্মার,
জড়াইয়া ধরি পদ ব্যাকুল ভাবেতে
কহিলা সখেদে;—"মাতঃ সুমঙ্গলময়ি,
বলগো ত্বরায় মোর কি হবে উপায়?
কেন দেখিলাম আজি হেন বিভীষিকা?—

ত্রিলোক বিজয়ী বীর হতাশ রণেতে
শুনেছি মলয়াচল হতে বহে সদা
সগন্ধ সমীর, বহে সৌভাগ্য পবন
সদা, চপলা গো তুমি, অচলা যেখানে।
তবে কেন দেখি হেন বিপরীত ভাব?—
ছার খার হলো কেন, তুমি বিদ্যমানে
এ দৈত্য আবাস। বারি ধারা পতনে গো,
সরস ঘে স্থান সদা, জনমে তথায়
সুকোমল তৃণ; মাতঃ, কোমল-কমল-
দলবাসিনী গো তুমি, তবে কেন দেখি
তব কঠিন হৃদয়, বিগলিত আহা,
হতেছে না কেন উহা মোসবার দুখে!
তোমার চির সেবক, এ অসুর কুল।
এই কি সেবার ফল? কি দোষে দোষিয়া,
আমা সবা প্রতি বাম, হলে গো জননি?”
নীরবিলা সতী, স্থাপি শির পদ্মাপদে,
ভাসাইয়া মরি উহা নয়নের জলে!
টলিল রমার মন; আর না পারিলা
ধৈরজ ধরিতে সতী শুভ্রার দুখেতে।
অনুতাপ দংশিল সে কোমল হৃদয়!
ভাবিলা অন্তরে সতী;—"আমিইত উঠেছি
আগে, দিতে হেন দুখছড়া, দৈত্যাবাস-

ময়। অকারণে হায়, অপরাধ দূরে
রোক, মহাদরে এত কাল সেবিলা যে,
হলাম তাহার আমি সর্ব্বনাশ মূল।
যাহোক এখনো দেখি তাহার উপায়।
তোলালা শুভ্রায় দেবী; অঞ্চলে মুছায়ে
দিলা নয়নের জল। কহিলা;—"বৎসে!
আর না কাঁদিহ, চল যাই রণ ক্ষেত্রে,
দেখিগে কি হলো আজি ত্রিলোক জিতের,”
(সকলি জানিছে সতী আপনার মনে)।
উঠিলা উজ্জ্বল রথে নীরবে দোঁহায়।
চালালা সারথি রথ, দুঃখ ভারে ভারী!
হেথা দৈত্যাঙ্গনা কুল, প্রিয় বিয়োগেতে
বিবশা আছিল যারা, সহসা শুনিল,
চলিলা মহিষী রণে; জানিয়া কেমনে,
শুম্ভের বিপদ বার্ত্তা; অমনি সকলে
আলু থালু বেশে উঠি, যে যেমনে ছিল,
ধাইল রাণীর পিছে, ক্রমান্বয় শ্রেণী,
মুখে হাহাকার রব; মরি, শোকনদী
প্রবাহিল যেন এক বিলাপ কল্লোলে!
কতক্ষণে দেখা দিল দৈত্য নারী দল
হিমাচল দেশে। রণ রঙ্গে মত্ত ইন্দ্র,
সঙ্কোচি সহস্র আঁখি প্রথমে হেরিলা

দূরে, সে রমণী শ্রেণী। দেখালা পবনে;—
"দেখ ওহে প্রভঞ্জন, আসিছে বাসুকী
কেন আজি রণ স্থলে? ত্রিদিব রাজ্যের
চাপে, ধরণীর ভার বহিতে না পারি,
কাতরতা জানাইতে আসিতেছে বুঝি।”
কহিলা পবন স্বনে, বিস্মিত অন্তরে,
দেখায়ে উজ্জ্বল রথে কমলা শুভ্রায়;—
"ঐ বুঝি উজ্জ্বল ফণা; ঐ বুঝি জ্বলে
তাহে দীপ্ত মণি যুগ; ওই বুঝি দীর্ঘ
দেহ পশ্চাতে নিরথি ক্রমাগত, যাহে
জড়িত মন্দর নিজে ক্ষীরদ মন্থনে?”
বিস্ময়ে চমকি পুনঃ কহিলা বাসব;—
"একি দেখি, আসেন যে পদ্মালয়া, সঙ্গে
লয়ে দৈত্য নারী কুলে; ওই দেখ বামে
বসি, শুভ্রা সীমন্তিনী, দীপ্ত রথোপরে;
কি জানি ফিরিল বুঝি মতি কমলার।”
অবাক্‌ হইয়া সবে দাঁড়াইলা রণে।
ক্ষণ মাত্রে আসি রথ উপস্থিত সেথা।
মহা সমরের গোল অভ্যন্তর দিয়া,
হেরিলা শুম্ভেরে; শুভ্রা, নিরাশ্রয় বীর,
নাহি নিজ বল কেহ, ঘেরেছে শত্রুতে!
মেঘেতে বিদুৎ যথা খেলিতে খেলিতে,

পড়ে শৃঙ্গ ধরে ছুটে, আসিছেন ছুটি
কালী, ত্যজি সৈন্য নাশ, আস্ফালিয়া শূল
বধিতে শুম্ভেরে। আস্তে ব্যস্তে, হাহাকারে,
অমনি ধাইলা শুভ্রা, ঠেলি সেনা কুলে,
কালিকার দিকে, নাহি করি প্রাণে ভয়।
পড়িলা আসিয়া পদে; বাহুলতা দ্বারা
বাঁধিলা চরণ যুগ; আকুল পরাণে।
কহিতে লাগিলা;—"রক্ষ, রক্ষ, রক্ষাকালি,
জীবিত ঈশ্বরে মোর; ক্ষম ক্ষেমঙ্করি;
বধো না আমার, মাতঃ, প্রাণের ঈশ্বরে!
বধিবে তাঁহারে যদি, বধ আগে মোরে
ঘুচায়ে জঞ্জাল; লতা পাতা কাটি আগে,
কাটে কাটুরিয়া তরুবরে। গলায় পা,
দেহ গো আগেতে মোর, পরে করো যাহা
হয়, অভিরুচি তব।” কাঁদিতে লাগিলা,
রাণী লুঠাইয়া মাথা, মহা আর্ত্তনাদে।
ধীরে ধীরে আসি লক্ষ্মী, ভাষিলেন তবে;—
"মাগো, ক্ষান্ত হও মহামায়া, বধোনাক
আর শুম্ভে; না চাহি গো, মুক্তি আর।
থাকিব গো চির বদ্ধ, সেও মোর ভাল,
দৈত্য নারী কুল দুখ সহিতে না পারি।”
বিস্ময়ে তুলিয়া মুখ, হেরিলেন চণ্ডী

সম্মুখে কেশব প্রিয়া, বিনীত ভাবেতে,
মাঙ্গিছেন কৃপা সতী শুম্ভের লাগিয়া।
অসুর অঙ্গনা কুল এ দিকে সকলে
যুটিলা আসিয়া ক্রমে রণক্ষেত্র মাঝে।
হাহাকার রবে দিক পূরিলা সকলে।—
পড়িলা আছাড়ি কেহ বিবশা হইয়া
ছিন্ন মূল তরু সম মৃত পতি দেহে।
কেহ প্রাণ পুত্র মুণ্ড কুড়াইয়া লয়ি
চুম্বি পুনঃ পুনঃ উহা, কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে।
কেহ প্রিয় সহোদর ধরি গলদেশ
ভাসায় শরীর মরি, নয়নের নীরে!
উচ্চৈঃস্বরে ঝোরে কেহ স্বজনের গুণ।—
ঘোর আর্ত্তনাদে দিক্‌ ভাসিয়া উঠিল!
স্তম্ভিতা হইলা কালী দেখেন সে ভাব।
টলিল দারুণ মন বামাদল দুখে;
ছাড়িয়া নিশ্বাস সতী নামাইলা মুখ।
গভীর চিন্তায় মরি হইলা অচল!
দেখি শঙ্করীর ভাব হতাশ নয়নে
চাহিতে লালিলা ইন্দ্র তবে চারি দিকে।
ভাবিতে লাগিলা মনে;—"দয়া উপজিল
পুনঃ বুঝি কালিকার, বামাদল দুঃখে।
এসেছেন দেখি লক্ষ্মী লয়ে ইহাদের;

চঞ্চলা স্বভাব যাঁর, কেন বা থাকিবে
মতি স্থির তাঁর। হলো বিষম বিপদ!
গেলা ধীরে ধীরে বীর যথায় প্রচেতা,
অনল, পবন আর; দেখালা তাঁদের
কালীর নিশ্চেষ্ট ভাব; জানালা বিপদ।
দেব যক্ষ রক্ষ কুল গণিল প্রমাদ।
মাথা তুলি পুনঃ শুভ্রা, কহিলা বিনয়ে;—
"মাতঃ, শুভদে গো তুমি, জগদম্বা তাহে;
এই কি তোমার কাজ? বিনা অপরাধে,
আপন সন্তান গণে করিলে বিনাশ।
তব কি উচিত মাতঃ, একেরে তুষিতে
অপর সন্তানে বধা? কি দোষে গো দোষী,
বল এ অসুর কুল, এ কমল পদে?
কি দোষ পাইয়া, বল গো জননী, তুমি
ধরিলে সংহার মূর্ত্তি দৈত্য কুল প্রতি?
কি জানি তোমার ধর্ম্ম; যা হোক তা হোক,
বরদে গো, আর কিছু নাহি চাহি আমি,
দেহ মোরে ভিক্ষা মোর জীবিতের প্রাণ।
ত্রিলোকের আধিপত্য না চাহি গো মোরা;
দেহ উহা ইন্দ্রে; মোরা রব চিরকাল,
অনুগত হয়ে তাঁর। এই ভিক্ষা মোর।”
ধীরে ধীরে আসি শুম্ভ কহিলা শুভ্রায়;—

"হেন নীচ অভিলাষ কেন দৈত্য রাণী,
বীরত্ব রতন খনি? থাকিবারে চাহ
চিরকাল হীন ভাবে ইন্দ্রের অধীনে?—
মরিতে ত হবে, কিবা স্থির সংসারেতে?
না ভাঙ্গি পর্ব্বত চূড়া, কভু অবনত
নহে ধরাতলে; তবে কেন অধীনতা
স্বীকারিব বাসবের, জীবন থাকিতে।
দৈত্য কুল চূড়া আমি, ত্রিলোকের প্রভু।
আসি কালিকার পাশে কহিতে লাগিল;—
"মাতঃ, কেন গো ভাবিছ আর? বধ মোরে,
না চাহি ধরিতে আমি এ জীবন আর।
দেখ পুড়ে থাক মোর হয়েছে হৃদয়,
স্বজন বিয়োগ শোকে। কি সুখে গো আর
রব এ সংসার মাঝে। মরিতে ত হবে;
মরি তবে এই বেলা তোমার হাতেতে।
গুরুপত্নী তুমি মাতঃ, মোর; তব হাতে
মরিলে যাইব চলি বৈকুণ্ঠ লোকেতে।
শুনেছি প্রতিজ্ঞা তুমি করেছ জননি,
বিনাশিবে দৈত্য কুল; পাল সে প্রতিজ্ঞা
না পালিলে প্রতিজ্ঞা গো ঘোসিবে কলুষ
তোমার, জগৎ; ধর অস্ত্র, আমি তব
ছেলে, রাখি তব পণ, নিজ প্রাণ দিয়ে।

সাধি গো সন্তান কাজ সংসার মাঝারে।”
সখেদে নিশ্বাস ছাড়ি তুলি তবে ঘাড়
চাহিলা শুম্ভের পানে কাতরে ভবানী।
সম্মতি হইল ভাবি যেন দৈত্যরাজ,
প্রচণ্ড বেগেতে আসি পড়িলা লাফায়ে
কালিকার শূলে, হৃদে পশিল ফলক;
ঝর ঝর রক্ত ধারা বহিল প্রবেগে;
অচৈতন্য বীরবর পড়িলা ধরায়,
মুদিয়া তেজস্বী আঁখি; নিবিল সহসা
মরি যেন কাল ঝড়ে দৈত্য কুল বাতী!
কতক্ষণে শুভ্রা সতী পাইয়া চেতন,
দেখিলা মুদেছে আঁখি হৃদয়েশ তাঁর,
পড়ে ভূমি তলে, হৃদে বিদ্ধ মহা শূল।
অমনি আছাড়ি পড়ি দেহের উপর,
চীৎকার নিনাদে দিক্‌ ফাটাইলা মরি!—
হায় কি হইল মোর, হায় কি হইল,
কি হবে আমার হায়, কি হবে আমার!
কাঁদিতে লাগিলা সতী অজস্র বিলাপে।
ধীরে ধীরে আসি লক্ষ্মী ধরিলেন তায়,
কহিলেন;—"ক্ষান্ত হও সাধ্বী শুভ্রা, বৃথা
আর বিলাপে কি ফল, চল মোর সাথে;
আমি সশরীরে তোমা লয়ে যাই স্বর্গে;

মিলাইগে সেথা তোমা তব পতিসহ।
তোষিব তোমারে আমি সহচরী ভাবে
সদা। উঠ, আর কেন কাঁদ অকারণ।”
গম্ভীর ভাবেতে তবে ডাকিলেন কালী,
ইন্দ্রে; কহিলেন তাঁরে;—"দেখ ইন্দ্র, আমি
তোমাদের লাগি, রণে করিলাম হত
এ অসুর কুল; মরি, ভাসালাম কত
অগণ্য অসুরনারী, দুখের সাগরে।
কর তুমি, বলি আমি উপায় এদের
যাহা হয়; ডাকি ত্বরা এখনি আদেশ
গড়িতে স্বতন্ত্র স্বর্গ ইহাদের লাগি,
প্রভাষ তনয়ে; রবে, সশরীরে গিয়া
যথা দৈত্যাঙ্গনা কুল, মিলি নিজ নিজ
স্বজন সহিত। আনি শত শত রথ,
নিজে তুমি ইহাদের লয়ে যাবে সেথা।”
ডাকিলা ভবানী তবে, আর দেবগণে;
যুটিলা সকলে আসি বিনীত ভাবেতে।
কহিলা অগ্নিরে, আর বরুণ, পবনে।
"বলি আমি, শুন অগ্নি, বরুণ, পবন,
তোমরা এ তিন জন দৈত্য নারীগণে
সাহায় অন্ত্যেষ্টি কার্য্য, যেন তারা পারে
অনায়াসে দাহিবারে স্বজনের শব।

আর দেবগণে সবে থাক হামে হাল।
চলিলাম আমি এবে কৈলাস শেখরে।”
অদৃশ্য হইলা কালী সকলের চোখে।
হেথা গেল লেগে ত্বরা মহাহুলস্থূল!
পাঠালেন আগে ইন্দ্র প্রভাষ তনয়ে
নির্ম্মিতে নূতন স্বর্গ; পাঠালেন ত্বরা
মাতুলীরে আনিবারে শত শত রথ।
এ দিকে পবন, অগ্নি, বরুণেতে মিলি
রচিলা বিচিত্র চিতা শুম্ভের লাগিয়া।
আনিলা সুগন্ধি কাষ্ট বা যেখানে ছিল,
পবন; জ্বালিলা অগ্নি, আপনি সে চিতা;
পবন আয়াসে চিতা জ্বলিল বিষম!
শোক ভরে ভারি তনু, সজল নয়নে,
ধীরে ধীরে শুভ্রাসতী, প্রদক্ষিণ করি,
নমিলা চিতাগ্নি; ভষ্ম, নিমেষে হইল
শব। বরুণ আসিয়া ধুইলেন চিতা।
রচিল অপর চিতা তদপরে সবে,
বীর নিশুম্ভের লাগি। অগ্নি কার্য্য তার
করিলা আপনি শুভ্রা কাতর অন্তরে।
রণ ক্ষেত্র যুড়ি তবে একেবারে সবে,
সাজালা অসংখ্য চিতা প্রতিবীর লাগি।
রাশি রাশি কাষ্ট ভাঙ্গি আনেন পবন,

আর দেবগণে চিতা রচেন যতনে,
দাহন করেন অগ্নি, বরুণ তা ধোন;
ক্ষণ মাত্রে পুড়ে শেষ হলো শব রাশি।
এদিকে অসংখ্য রথ নামিতে লাগিল,
ক্রমে স্বর্গ হতে; রণ ক্ষেত্র যুড়ি গেল
রথে; ধরিয়া শুভ্রার হাত উঠিলেন
বিমানে, কমলা; রথ, চালালা মাতুলী।
একে একে রথে তবে সসম্ভ্রমে তুলি,
দিইতে লাগিলা দেব, দৈত্যাঙ্গনাগণে।
উজ্জ্বল রথের শ্রেণী উঠিতে লাগিল
ক্রমে ধরা হতে; মরি, তারার ফোয়ারা
উদ্গারিতে যেন ধরা লাগিল একটি
দিগন্ত ব্যাপিয়া। চলি গেল দেবগণ
নিজ নিজ স্থানে সবে, শূন্য হলো ধরা!

সমাপ্ত।