দায়ে খুন/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই ব্যক্তিকে কহিলাম, “মনে করুন, আমি যদি আমার চাকরী পরিত্যাগ করিয়া আপনাদিগের কার্য্য করিতেই প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে কোন্ তারিখ হইতে আমাকে সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইতে হইবে?”

 আগন্তুক। এখন হইতেই আমি আপনাকে নিযুক্ত করিব, আজ হইতেই আপনি আমাদিগের কার্য্য করিতে আরম্ভ করিবেন।

 আমি। দেখুন মহাশয়! আমি যে ফারমে চাকরী স্বীকার করিয়াছি, সেই ফারম জগদ্বিখ্যাত ও বহুদিবসের পুরাতন ফারম। আপনার পরামর্শে সেই স্থান হইতে চাকরী পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্থানে গমন করা কি যুক্তিসঙ্গত?

 আগন্তুক। আমাদিগের ফারম যদি সামান্য ফারম হইত, তাহা হইলে আপনার চাকরী পরিত্যাগ করিতে আমি কখনই পরামর্শ প্রদান করিতাম না। আপনি যে কারমের কথা বলিতেছেন, সেই ফারম অপেক্ষা ধনবান্ ও উৎকৃষ্ট ফারম এ দেশে যদি কাহারও থাকে, তাহা আমাদিগের। যে ফারমের শাখা ভারতবর্ষের সমস্ত প্রধান প্রধান নগরীতে আছে, সেই স্থানে চাকরী করা শ্লাঘার বিষয়। বিশেষতঃ আপনি আমাদিগের ফরমের নিয়ম প্রভৃতি অবগত নহেন বলিয়াই, এইরূপ কথা বলিতেছেন। আমাদিগের ফারমের কর্মচারীগণ তাঁহাদের কার্য্যদক্ষতা দেখাইয়া আপনাদের কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিলে, মূল ফারমের লভ্য অংশ হইতে কমিশন বলিয়া বাৎসরিক একটী অংশও পাইয়া থাকেন। সে অংশ শুনিতে অতি সামান্য হইলেও, কার্য্যে কিন্তু সামান্য নহে। এমন কি, এক একজন কর্মচারী বৎসর বৎসর তাঁহার বেতনাদি বাদে পাঁচ ছয় সহস্র পর্যন্ত টাকা পাইয়া থাকেন। তদ্ব্যতীত আমাদিগের কার্য্যের আর একটী প্রধান সুবিধা আছে, যে সুবিধা কেবলমাত্র আমাদিগের ফারম ব্যতীত এ পর্যন্ত অপর কোন স্থানেই পরিলক্ষিত হয় নাই। যিনি যে স্থানেই চাকরী করুন না কেন, একমাস চাকরী পূর্ণ না হইলে সেই মাসের বেতন কেহই প্রাপ্ত হন না; কিন্তু আমাদিগের নিয়ম সেরূপ নহে। আমরা সকলেই অগ্রিম বেতন পাইয়া থাকি, অর্থাৎ যেমন মাস পড়িবে, অমনি আমরা সেই মাসের বেতন অগ্রিম প্রাপ্ত হইব। এরূপ অবস্থায় আপনি সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, আপনি আমাদিগের সরকারে কার্য্য করিতে প্রস্তুত আছেন কি না? যদি আপনি আমাদিগের প্রস্তাবিত চাকরী গ্রহণ করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি কল্য আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। এখন আমি আপন স্থানে প্রস্থান করিতেছি।

 এই বলিয়া তিনি প্রত্যাগমন করিতে উদ্যত হইলে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! আমি কল্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া, কাহার অনুসন্ধান করিব? মহাশয়ের নাম ত আমি এ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই।”

 আগন্তুক। আমার নাম মাণিক চাঁদ। আপনি আমার নাম করিয়া অনুসন্ধান করিলেই আমাকে দেখিতে পাইবেন।

 আমি। কোন্ স্থানে গমন করিলে, আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হইব?

 মাণিক। আমার বাসায়। —না, আমার বাসায় যাইবার প্রয়োজন নাই, বেলা দশটা হইতে পাঁচটা পর্যন্ত আমি আমার বাসায় থাকিব না। নির্জ্জনে একটী ঘর লইয়াছি, সেই স্থানে বসিয়া আমি কি প্রণালীতে কার্য্যের বন্দোবস্ত করিব, তাহাই ঠিক করিতেছি। আপনি সেই স্থানে গমন করিবেন, সেই স্থানেই আমার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে।

 আমি। সে স্থান কোথায়?

 মাণিক। বড়বাজার রাজার কাটরা। রাজার কাটারায় দোতালার উপর পঁচিশ ছাব্বিশ নম্বরের ঘর।

 আমি। আচ্ছা মহাশয়! অদ্য আমি এ বিষয় একটু সবিশেষরূপে বিবেচনা করিয়া দেখি, এবং আমার দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিয়া দেখি। পরামর্শ করিয়া আমি যেরূপ সাব্যস্ত করিব, তাহা আমি আপনার নিকট গমন করিয়া বলিয়া আসিব। যদি আপনাদিগের নিকট চাকরী করি, তাহাও গিয়া বলিয়া আসিব, আর না করি, তাহাও আপনাকে জানাইব।

 আমার সহিত এইরূপ কথাবার্ত্তা হইবার পর, মাণিকবাবু আমার বাড়ী হইতে প্রস্থান করিলেন। সেই চাকরী গ্রহণ করা আমি একরূপ স্থিরই করিয়াছিলাম। তথাপি দুই একজন বন্ধু বান্ধবকে একবার জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য মনে করিলাম।

 সেই দিবস রাত্রিতেই আমি আমার দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিলাম, সকলেই আমাকে মাণিকাচাঁদের প্রস্তাবিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে পরামর্শ প্রদান করিলেন। আমিও তাহাই স্থির করিয়া পরদিবস মাণিকবাবুর নিকট গমন করিয়া তাঁহাদিগের ফারমেই কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম।

 পরদিবস বেলা আন্দাজ এগারটার সময় আমি রাজার কাটরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজার কাটারার প্রত্যেক ঘরই আমি পূর্ব্ব হইতে জানিতাম। দোতালার উপর গমন করিয়া পঁচিশ ছাব্বিশ নম্বরের গৃহের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই দুইটী ঘর অনেকদিবস হইতে খালি ছিল। সেখানকার প্রত্যেক ঘরেরই বারান্দার দিকে দুইটী করিয়া দরজা আছে মাত্র। কোন কোন ঘরের মধ্যে এক ঘর হইতে অপর ঘরে যাতায়াত করিবার নিমিত্ত একটী একটী দরজা আছে। কোন ব্যক্তি দুইটী ঘর একত্র গ্রহণ করিলে উভয় ঘরের মধ্য দিয়া যাতায়াতের নিমিত্ত প্রায়ই সেই দরজা খুলিয়া রাখেন। আর যদি কেবলমাত্র একটী ঘর গ্রহণ করেন, তাহা হইলে সেই দরজা বন্ধ থাকে।

 আমি পঁচিশ নম্বরের ঘরের সম্মুখে গিয়া দেখিলাম, উহার বাহিরের দুইটী দরজাই ভিতর হইতে বন্ধ। ছাব্বিশ নম্বরের ঘরেরও একটী দরজা ভিতর হইতে বন্ধ; কিন্তু একটা দরজা খোলা। সেই দরজার উপর একখানি পরদা ঝোলান আছে। সেই পরদার বাহিরে দ্বারবান্ সদৃশ একটী লোক বসিয়া আছে। আমি সেই স্থানে গমন করিয়া প্রথমেই সেই দ্বারবান‍্কে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মাণিকচাঁদ বাবু নামে কোন ব্যক্তি এই স্থানে আছেন কি?’ তখন সেই দ্বারবান্ সেই ঘর দেখাইয়া দিয়া উত্তরে আমাকে কহিল, ‘হাঁ মহাশয়! বাবুসাহেব এই ঘরেই থাকেন, তিনি এখন ইহার ভিতরেই আছেন।’

 দ্বারবানের এই কথা শুনিয়া সেই পরদা ঠেলিয়া আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, মাড়োয়ারীগণ সর্ব্বদা যেরূপ স্থানে বা যেরূপ ভাবে বসিয়া আপন আপন কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, ইনি কিন্তু সেরূপ ভাবে বসিয়া আপন কার্য্যে প্রবৃত্ত নহেন। ঘরের মেঝের উপর কোনরূপ বিছানা বা যেরূপ ভাবে মাড়োয়ারীগণ গদি বিছাইয়া তাহার উপর উপবেশন করেন, সেই ঘরের ভিতর সেইরূপ ভাবের কোন দ্রব্যই নাই। যাহা আছে, তাহা মাড়োয়ার-পদ্ধতির সম্পূর্ণরূপ বিপরীত। সেই ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে একথানি টেবিল রহিয়াছে, একখানি চেয়ারে বসিয়া মাণিকচাঁদ সেই টেবিলের উপর কাগজ-পত্র বিছাইয়া লেখাপড়া করিতেছেন, এবং তাঁহার বাম ও দক্ষিণ দুই পার্শ্বে দুইখানি খালি চেয়ার রাখা আছে।

 টেবিলের উপর যে সকল কাগজ-পত্র ছড়ান রহিয়াছে, তাহার মধ্যে মাডোয়রীদিগের ব্যবহার-উপযোগী কোনরূপ খাতাপত্র নাই, কতকগুলি সাদা ও লেখা ফুলিকেপ কাগজ।

 আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই মাণিকচাঁদ বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তখন তিনি সবিশেষ অভ্যর্থনা করিয়া আমাকে তাঁহার বামপার্শ্বের চেয়ারের উপর বসাইলেন। তাহার নির্দ্দেশানুসারে আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কতক্ষণ এখানে আগমন করিয়াছেন?”

 আমি। এখনই আসিতেছি।

 মাণিক। আমার এই স্থান অনুসন্ধান করিয়া লইতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হয় নাই ত?

 আমি। কোন কষ্ট হয় নাই; কারণ, এই স্থান আমি উত্তমরূপে চিনি। সুতরাং আপনার এই স্থান অনুসন্ধান করিয়া লইতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই।

 মাণিক। আপনি এ পর্যন্ত কিছু ঠিক করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি?

 আমি। আমার চাকরী করা সম্বন্ধে?

 মাণিক। হাঁ।

 আমি। স্থির না করিলে আর আমি এ স্থানে আসিব কেন?

 মাণিক। কি স্থির করিলেন, আমাদিগের নিকট চাকরী করা স্থির করিলেন, কি পূর্ব্ব হইতে যে স্থানে চাকরী পাইয়াছেন, সেই স্থানেই গমন করাই স্থির হইল?

 আমি। না মহাশয়! আমি আর সেই স্থানে গমন করিতেছি না। আপনাদিগের অধীনেই চাকরী করাই আমি স্থির করিয়াছি। এখন কোন্ সময় হইতে এবং কোথায় আমাকে কার্য্যে নিযুক্ত হইতে হইবে, তাহা আপনি আমাকে বলিয়া দিন, আমি সেই স্থানে গমন করিয়া কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হই।

 মাণিক। আমি পূর্বেই বলিয়াছি, কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়ায আপাততঃ আপনাকে কোন স্থানেই গমন করিতে হইবে। এই স্থান হইতেই সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ হইবে; কেবলমাত্র মফঃস্বলের যখন যে স্থানে আমাদিগের মনিব একটী করিয়া শাখা-ব্যবসায় স্থাপন করিবেন, সেই সময় কেবলমাত্র একবার সেই স্থানে গমন করিলেই চলিবে। তৎপরে সেই স্থানের কার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, পুনরায় আপনি এই কলিকাতায় আগমন করিবেন।

 আমি। কোন্ তারিখ হইতে আমি এই কার্য্যে নিযুক্ত হইব?

 মাণিক। অদ্য হইতেই আপনি আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। বেতন অদ্য হইতে আপনি পাইবেন; কিন্তু নিয়োগপত্র আজ আমি আপনাকে প্রদান করিতেছি না। আপনি কল্য এই সময় একবার এখানে আগমন করিবেন, সেই সময়ে আমাদিগের কার্য্যের নিয়ম অনুসারে আমি আপনাকে একমাসের অগ্রিম বেতন সহ আপনার নিয়োগ-পত্র আপনাকে প্রদান করিব, এবং আপাততঃ আপনাকে কি কি কার্য্য করিতে হইবে, তাহাও আপনাকে বলিয়া দিব। বোম্বাই সহরের যে মহাজনের নিকট আপনি চাকরী পাইয়াছিলেন, তাঁহার লিখিত যে সকল চিঠিপত্র আপনার নিকট আছে, এবং নূতন কার্য্যে নিযুক্ত হইবার যে নিয়োগ-পত্র আপনি প্রাপ্ত হইয়াছেন, কল্য যে সময় আপনি আমার নিকট আগমন করিবেন, সেই সময় সেই সকল আপনার সঙ্গে করিয়া আনিবেন।

 আমি। সেগুলিতে আপনার প্রয়োজন?

 মাণিক। প্রয়োজন আছে বলিয়াই বলিতেছি। আনিলেই দেখিতে পাইবেন।

 আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে।

 এই বলিয়া আমি সে দিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া, আপন স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। একবার মনে করিলাম, আমার নিয়োগ-পত্র বা চিঠিপত্রে উঁহার প্রয়োজন কি? কেন আমি সেই সকল দ্রব্য তাঁহার নিকট লইয়া যাইব। আবার ভাবিলাম, আমি যে অপর স্থানে চাকরী সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তাহা হয় ত তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করেন নাই, এই নিমিত্তই সেই কাগজ দেখিতে চাহিয়াছেন। আমি তাঁহার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছি, তাহা প্রকৃত, কি মিথ্যা, তাহাই মাণিকচাঁদ বাবু, বোধ হয়, জানিতে চাহেন। সে যাহাই হউক, সেই সকল কাগজপত্র তাঁহাকে দেখাইতে আমি কোনরূপ অনিষ্ট-জনক বলিয়া বুঝিতে পারিতেছি না।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া পরদিবস আমি আমার নিয়োগপত্রের সহিত পুনরায় সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, দ্বারবান্ সেইরূপ ভাবেই বসিয়া আছে, মাণিকাচাঁদ বাবু সেই স্থানে সেইরূপ ভাবে বসিয়া সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কার্য্যে নিযুক্ত আছেন।

 পূর্ব্ব দিবসের ন্যায় আমি মাণিকচাঁদ বাবুর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলে, তিনি আমাকে সেই চেয়ারের উপর উপবেশন করিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি তাঁহার হস্তস্থিত লেখনী সেই টেবিলের উপর রাখিয়া আমার দিকে একটু ঘূরিয়া বসিলেন ও আমাকে কহিলেন, “কেমন মহাশয়! আপনি আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছেন ত?”

 আমি। হাঁ মহাশয়! সে কথা আমি গত কল্যই ত আপনাকে বলিয়াছি।

 মাণিক। আমি যে সকল কাগজ-পত্র আনিতে বলিয়াছিলাম, তাহা আপনি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন, না ভুল-ক্রমে আপনার বাসায় রাখিয়া আসিয়াছেন?

 আমি। না মহাশয়! আমি ভুল-ক্রমে উহা রাখিয়া আসি নাই, সঙ্গে করিয়াই আনিয়াছি। উহা আমি আপনার হস্তে এখনই প্রদান করিব কি?

 মাণিক। না, এখন নয়, একটু অপেক্ষা করুন। যখন আমার প্রয়োজন হইবে, তখনই আপনি উহা আমাকে প্রদান করিবেন। এখন আপনি আপনার অগ্রিম বেতন গ্রহণ করিয়া আপনার কার্য্যে নিযুক্ত হউন।

 এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ তাঁহার টেবিলের দেরাজ হইতে দশখানি দশ টাকা হিসাবের নোট বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “এই নিন্ মহাশয়! আপনার অগ্রিম বেতন।”

 আমি নোট দশখানি আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া কহিলাম, “ইহার নিমিত্ত আমার কোনরূপ রসিদ দিতে হইবে কি?”

 মাণিক। না, বেতনের টাকা পাইলেন, তাহার আর রসিদ কি? দেখি, আপনি কি কাগজ-পত্র আনিয়াছেন।

 মাণিকাচাঁদের এই কথা শুনিয়া আমার নিয়োগ-পত্রখানি ও একখানি চিঠি যাহা আমি বোম্বাই হইতে কয়েকদিবসমাত্র অগ্রে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম।

 মাণিকাচাঁদ নিয়োগ-পত্রখানি ও চিঠিখানি একবার পড়িয়া দেখিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, “আপনি এই পত্রের উত্তর লিখিয়াছেন কি?”

 আমি। না।

 মাণিক। নিয়োগ-পত্রখানি পাইবার পর, কোন পত্র লিখিয়াছেন?

 আমি। না, সর্ব্বপ্রথমে আমি যে একখানি দরখাস্ত করিয়াছিলাম, তদ্ব্যতীত আমি আর কোন পত্রাদি সেই স্থানে লিখি নাই।

 মাণিক। এখন এই পত্রের উত্তর আপনাকে প্রদান করা কর্ত্তব্য।

 আমি। উত্তর আর কি লিখিব?

 মাণিক। কেন, আপনি সেই চাকরী গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক নহেন, একথা লিখিয়া দেওয়া উচিত নয় কি?

 আমি। না লিখিলেই বা ক্ষতি কি? আমি সেই স্থানে গমন না করিলেই, তাঁহারা জানিতে পারিবেন যে, আমি সেই কার্য্য করিতে প্রস্তুত নহি। তখন তাঁহারা অপর লোকের বন্দোবস্ত করিয়া লইতে পারিবেন।

 মাণিক। না, উহা কর্ত্তব্য বা ভদ্রোচিত ব্যবহার নহে। কাগজ, কলম প্রভৃতি সমস্তই আপনার সম্মুখে পড়িয়া রহিয়াছে, এখনই একখানি পত্র লিখিয়া ডাকে ফেলিয়া দিন। আপনার পত্র পাইয়া যখন তাঁহারা জানিতে পারিবেন যে, আপনি তাঁহাদিগের চাকরী করিতে অভিলাষী নহেন, তখন তাঁহারা অপর লোকের বন্দোবস্ত করিতে সমর্থ হইবেন। নতুবা তাঁহাদিগের কার্য্যের সবিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা।

 মাণিকচাঁদের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নিতান্ত যুক্তি-সঙ্গত। সুতরাং এ সম্বন্ধে তাঁহাকে আর কিছু না বলিয়া, তাঁহারই টেবিলের উপর হইতে একখানি কাগজ লইয়া, সেই স্থানেই বসিয়া আমি একখানি পত্র লিখিলাম। সেই পত্রে অধিক কোন কথা লিখিলাম না, কেবল এইমাত্র লিখিলাম, “আপনারা অনুগ্রহ করিয়া আপনাদিগের ফারমে যে একটী চাকরী প্রদান করিয়াছিলেন, আমি আপাততঃ সেই চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেছি না। আপনারা আমাকে যে বেতন প্রদানে সম্মত আছেন, তাহার দ্বিগুণ বেতনে আমি এই স্থানেই একটা চাকরী প্রাপ্ত হইয়াছি। সুতরাং আপনাদিগের প্রদত্ত চাকরী গ্রহণ করিতে পারিলাম না বলিয়া, আমার অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন।”

 পত্র লেখা সমাপ্ত হইলে মাণিকচাঁদ একখানি অর্দ্ধ আনা মূল্যের খাম আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই খামের ভিতর আমার লিখিত পত্রখানি পূরিয়া উহাতে শিরোনাম লিখিয়া সেই টেবিলের উপর রাখিলাম। টেবিলের উপর একটা পাত্রে একটু জল রাখাছিল, মাণিকচাঁদ নিজে তাঁহার অঙ্গুলিতে একটু জল লইয়া আমার সম্মুখে উহা বন্ধ করিয়া দিলেন, এবং আমাকে কিছু না বলিয়া তাঁহার দ্বারবান‍্কে ডাকিলেন। সে পূর্ব্ব হইতে সেই ঘরের বাহিরে বসিয়াছিল, ডাকিবামাত্র সে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। মাণিকচাঁদ বাবু আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই পত্রখানি সেই দ্বারবানের হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “এই পত্রখানি এখনই তুমি ডাকঘরে দিয়া আইস।”

 দ্বারবান্ দ্বিরুক্তি না করিয়া, সেই পত্র হস্তে দ্রুতপদে সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সে দিবস আর যতক্ষণ আমি সেই স্থানে ছিলাম, তাহার মধ্যে সেই দ্বারবানকে আমি আর দেখিতে পাইলাম না।

 দ্বারবান্ প্রস্থান করিলে পর, মাণিকচাঁদ বাবু আমার প্রদত্ত সেই নিয়োগ-পত্র ও বোম্বাইয়ের যে পত্রখানি আমি তাহার হস্তে প্রদান করিয়াছিলাম, তাহা তিনি তাঁহার টেবিলের দেরাজের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন, এবং আমাকে কহিলেন, “এগুলি এখন আমার নিকট রহিল।”

মাণিকচাঁদ বাবুর এই কথার কোনরূপ উত্তর দিবার পূর্ব্বেই তিনি কহিলেন, “এখন আমি অতিশয় ব্যস্ত; আপনি এখন আপনার বাসায় গমন করিতে পারেন। আপনাকে আমি একটী কার্য্য প্রদান করিতেছি, যে কয়দিবসে পারেন, সেই কার্য্যটী আপনি সম্পন্ন করুন। চারিদিবস পরে একবার আপনি এই স্থানে আসিয়া আমাকে বলিয়া যাইবেন যে, সেই কার্য্য কতদূর পর্য্যন্ত আপনি সম্পন্ন করিতে পারগ হইয়াছেন। সবিশেষ তাড়াতাড়ি করিবার প্রয়োজন নাই।

 আমি। কি কার্য্য করিতে হইবে?

 মাণিক। বঙ্গদেশের মধ্যে কোন্ কোন্ নগরে আমাদিগের শাখা-কার্য্যস্থান করিবার প্রয়োজন, তাহারই একটী তালিকা প্রস্তুত করুন। তাহার পর আর যাহা যাহা করিতে হইবে, তাহা আমি পরে বলিব।

 আমি। আমি কিরূপে সেইরূপ তালিকা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইব?

 মাণিক। কেন, আপনি বহুদিবস পর্য্যন্ত কলিকাতায় থাকিয়া একটী ভাল ফারমেই কর্ম্ম করিয়া আসিতেছিলেন। সেই ফারমের সহিত বঙ্গদেশের যে যে স্থানের কারমের কার্য্য ছিল, তাহা আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন। সুতরাং একটু চিন্তা করিয়া, আপনি সেই সকল স্থানের একটী তালিকা অনায়াসেই প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইবেন। তদ্ব্যতীত এই কলিকাতায় আরও অনেক ফারমের কর্মচারীগণের সহিত যে আপনার সবিশেষরূপ আলাপপরিচয় আছে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আবশ্যক হইলে আপনি তাহাদিগকেও জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।

 আমি। আচ্ছা তাহাই হইবে। আপনার আদেশানুযায়ী একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া, চারিদিবস পরে আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।

 মাণিক। আমি আপনার উপর যে কার্য্য করিবার ভার অর্পণ করিলাম, তাহা শুনিতে যেরূপ সহজ বোধ হইতেছে, কার্য্যে কিন্তু ততদূর সহজ নহে। চারিদিবসের মধ্যেই যে আপনি সেই কার্য্য শেষ করিতে পারিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি যতদূর সম্ভব, সেই কার্য্য করিয়া, চারিদিবস পরে পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। অপর আর কোন্ কোন্ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবার আপাততঃ প্রয়োজন হইবে, তাহাও আমি সেইদিবস আপনাকে বলিয়া দিব।

 এই বলিয়া মাণিকাচাঁদ আপন কার্য্যে তাঁহার মন নিযুক্ত করিলেন।

 তাঁহার অবস্থা দেখিয়া আমি মনে মনে ভাবিলাম, এ সম্বন্ধে তিনি এখন আর অধিক সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছুক নহেন। সুতরাং তাঁহাকে আর কিছু না বলিয়া, আমি আস্তে আস্তে সেইদিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম, এবং ক্রমে আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।