দুই শিষ্য/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 রাত্রি প্রভাত হইবার কিছু পূর্ব্বে একজন কনষ্টেবল আমায় সংবাদ দিল, বলদেব নামে একজন পশ্চিমদেশীয় যুবক বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন।

 আমি নিদ্রিত ছিলাম। যখন কনষ্টেবলের কথা আমার কর্ণগোচর হইল, আমি তখনই শয্যাত্যাগ করিলাম এবং মুখাদি প্রক্ষালন করিয়া বাহিরে আসিলাম। বলদেব আমার অপেক্ষায় অফিস ঘরের সম্মুখস্থ বারান্দার একখানি বেঞ্চের উপর বসিয়াছিলেন। আমায় দেখিবামাত্র সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান হইয়া নমস্কার করিলেন। আমিও প্রতিনমস্কার করিয়া, তাহার সহিত বাহিরে আসিলাম এবং থানার ফটকের নিকট গিয়া গাড়ীর অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

 কিছুক্ষণ পরেই একজন কনষ্টেবল একখানি সেকেণ্ড ক্লাস গাড়ী লইয়া তথায় উপস্থিত হইল। আমি বলদেবকে লইয়া তাহাতে আরোহণ করিলাম। পরে বলদেবের নিকট হইতে হৃষীকেশের সন্ধান জানিয়া লইয়া, কোচমানকে নির্দিষ্ট স্থানে যাইতে আদেশ করিলাম।

 কিছুদুর গমন করিলে পর, আমি বলদেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, *শুনিয়াছি, মন্দিরের আয় অনেক, কত টাকা হইবে অনুমান করেন?”

 বলদেব ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আপনি শোনেন নাই, মাসিক প্রায় দুই সহস্র মুদ্রা কালভৈরবের সেবার জঞ্জ নির্দিষ্ট আছে।”

 আ। কিরূপে কোথা হইতে ঐ টাকা আইসে?

 ব। কালভৈরবের নামে একটা বিস্তৃত জমীদারী আছে। তাহারই আয় বার্ষিক প্রায় তেইশ হাজার টাকা।

 আ। খরচ বাদ?

 ব। আজ্ঞে হাঁ।

 আ। ঐ টাকা কাহার নিকট থাকে?

 ব। সেবায়েতের নিকট।

 আ। তিনি কি উহা যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে পারেন?

 ব। আজ্ঞে হাঁ— তবে বাৎসরিক একটা হিসাব দাখিল করিতে হয়।

 আ। কোথায়?

 ব। যিনি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন এবং দেবতার নামে এত টাকার সম্পত্তি উৎসর্গ করিয়াছেন তাঁহার নিকট। এখন তিনি নাই—হিসাব তাঁহারই বংশধরের নিকট প্রেরিত হয়।

 আ। সেবায়েত নির্ব্বাচিত হয় কিরূপে?

 ব। বর্ত্তমান সেবায়েত দ্বারাই নির্ব্বাচিত হয়। তিনিই জীবদ্দশায় একজন শিষ্যকে তাঁহার পদের উপযুক্ত করিয়া যান।

 আমার কৌতুহল বৃদ্ধি হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মনোহরগিরি কি আপনাদের মধ্যে কোন শিষ্যকে তাঁহার পদের উপযুক্ত নির্ব্বাচন করিয়াছেন?”

 বলদেব আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ — তিনি বেহারীকেই ভাবী সেবায়েত করিবেন বলিয়া মনস্থ করিয়াছেন। গুরুদেব বেহারীকে পুত্রাধিক স্নেহ করিয়া থাকেন; বেহারীও গুরুদেবের একান্ত ভক্ত।”

 কিছুক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “বেহারীর কোন শত্রু আছে আপনি জানেন?”

 আমার কথায় বলদেব চমকিত হইলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া চাহিয়া, পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন? আপনি সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? তবে কি বেহারীর কোনরূপ অনিষ্ট আশঙ্কা করিতেছেন?”

 আমি বলিলাম, “সন্দেহ করিতেছি মাত্র। আপনি কি বেহারীর কোন শত্রুকে জানেন?”

 বলদেব আমতা আমতা করিয়া বলিলেন, “পূর্ব্বে সে শত্রু ছিল বটে, কিন্তু এখন নয়। এক সময় সে বেহারীর উপর বড়ই রাগান্বিত হইয়াছিল।”

 আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন?”

 বলদেব ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “গুরুদেব বেহারীকে ভাবী সেবায়েত বলিয়া স্থির করিয়াছেন। এই অপরাধ।”

 বলদেবের মুখে এই নূতন সংবাদ পাইয়া আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সেই লোকটীর, নাম কি? তিনি কি এখনও আপনাদের গুরুদেবের শিষ্য আছেন?”

 ব। আজ্ঞে তাহার নাম কেদারনাথ ভট্টাচার্য্য। তিনি এক সময়ে গুরুদেবের বড় প্রিয়-শিষ্য ছিলেন, কিন্তু কিছুদিন হইল, তিনি আর আমাদের মন্দিরে আইসেন না।

 আ। আপনাদের গুরুদেব কি এ সকল কথা জানেন?

 ব। বোধ হয় না। তবে তিনি জানেন যে, কেদারনাথ এখন আর তাঁহার শিষ্য নহেন।

 আ। কেমন করিয়া জানিলেন?

 ব। কেদারনাথ একদিন গুরুদেবকে পত্র লিখিয়াছিলেন। সেই পত্রে তিনি গুরুদেবকে জানাইয়াছিলেন যে, তিনি আর তাহার শিষ্য থাকিতে ইচ্ছা করেন না।

 আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনাদের মন্দিরে যত গুণি শিষ্য দেখিতে পাইলাম, তাঁহারা সকলেই পশ্চিম দেশবাসী ব্রাহ্মণ। কিন্তু কেদারনাথ নাম শুনিয়া ও তাঁহার ভট্টাচার্য্য পদবী জানিয়া বোধ হইতেছে, তিনি বাঙ্গালী। আপনাদের মন্দিরে কি আর কোন বাঙ্গালী শিষ্য আছেন?

 ব। আজ্ঞে না। গুরুদেব এক কেদারনাথ ভিন্ন আর কোন বাঙ্গালীকে তাঁহার শিষ্য করেন নাই এবং আর করিবারও ইচ্ছা নাই। যখন কেদারনাথ তাঁহার শিষ্যত্ব লাভ করিবার জন্য বারম্বার অনুরোধ করেন, তখন গুরুদেব স্পষ্টই বলিয়াছিলেন যে, তিনি কোন বাঙ্গালীকে শিষ্য করিতে অভিলাষ করেন না। কিন্তু অবশেষে কেদারের নির্ব্বন্ধাতিশয় দেখিয়া অগত্যা সম্মত হন।

 আ। তিনি কি এখনও জীবিত আছেন?

 ব। আজ্ঞে হাঁ।

 আ। তাঁহার নিবাস কোথায় জানেন?

 ব। আজ্ঞে ঠিক জানি না। কেদারনাথ পূর্ব্বে যে স্থানে বাস করিতেন, সে বাড়ী আমার জানা আছে বটে, কিন্তু তিনি এখন সেই বাড়ীতে বাস করেন কি না, বলিতে পারি না।

 আ। বেহারীর সহিত কি তাহার মৌখিক বিবাদ হইয়াছিল?

 বলদেব কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে না। তবে তিনি বেহারীর সহিত কিছুদিন বাক্যালাপ করেন নাই।”

 আ। কতদিন?

 ব। প্রায় এক বৎসর।

 আ। তাহার পর?

 ব। আবার উভয়ের সদ্ভাব হইয়াছিল।

 আ। কোন্ সুত্রে?

 ব। সে কথা বলিতে পারিলাম না। তবে বেহারী যেরূপ সরল প্রকৃতির লোক, তাহাতে হয়ত কেদারনাথের মিষ্ট কথায় ভুলিয়া গিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়াছিলেন।

 আ। এ সকল কথা কি আপনাদের গুরুদেব জানেন?

 বলদেব ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে না। বিশেষ অবশ্যকীয় কথা না হইলে আমরা তাঁহাকে অপর কোন বিষয় অবগত করি না।”

 আ। কেদারনাথের সহিত আপনাদের সদ্ভাব আছে?

 ব। আজ্ঞে সদ্ভাব নাই—আলাপ পরিচয় আছে মাত্র। তিনি কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিলে আমরা উপযাচক হইয়া কোন কথা বলি না।

 আ। আপনাদের সহিত কি তাঁহার প্রায়ই দেখা হয়?

 ব। মধ্যে মধ্যে—মাসে অন্তত একবার।

 আ। কিরূপে সাক্ষাৎ হয়? তিনি কি আপনাদের মন্দিরে আইসেন?

 ব। আজ্ঞে না—সে কথা ত পূর্ব্বেই বলিয়াছি। দেখা করিবার ইচ্ছা হইলে তিনি মন্দিরের নিকট অপেক্ষা করেন।

 আ। আপনাদের গুরুদেব কি সে অবস্থায় তাঁহাকে দেখিতে পান নাই?

 ব। সম্ভব নহে—কেন না, গুরুদেব সদাই নিজের গৃহে থাকেন; কদাচ কখন মন্দিরের দ্বারে যান।

 এইরূপ নানা কথায় গাড়ীখানি হৃষীকেশের বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইল। তখন বলদেব যথাস্থানে কোচমানকে গাড়ী থামাইতে আদেশ করিলেন। শকট স্থগিত হইলে আমরা উভয়েই অবতরণ করিলাম। কোচমানকে একস্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমি বলদেবের সহিত হৃষীকেশের বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম।