দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অবগুণ্ঠনবতী

 দুর্গজয়ের দুই দিবস পরে, বেলা প্রহরেকের সময় কতলু খাঁ নিজ দুর্গমধ্যে দরবারে বসিয়াছেন। দুইদিকে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া পারিষদগণ দণ্ডায়মান আছে। সম্মুখস্থ ভূমিখণ্ডে বহু সহস্র লোক নিঃশব্দে রহিয়াছে। অদ্য বীরেন্দ্রসিহের দণ্ড হইবেক।

 কএকজন শস্ত্রপাণি প্রহরী বীরেন্দ্রসিংহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া দরবারে আনীত করিল। বীরেন্দ্রসিংহের মূর্তি রক্তবর্ণ; কিন্তু তাহাতে ভীতিচিহ্ন কিছুমাত্র নাই। প্রদীপ্ত চক্ষু হইতে অগ্নিকণা বিস্ফূরিত হইতেছিল, নাসিকারন্ধ্র বর্দ্ধিতায়তন হইয়া কম্পিত হইতেছিল। দন্তে অধর দংশন করিতেছিলেন। কতলু খাঁর সম্মুখে আনীত হইলে, কতলু খাঁ বীরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ! তোমার অপরাধের দণ্ড করিব। তুমি কি জন্য আমার বিরুদ্ধাচারী হইয়াছিলে?”

 বীরেন্দ্রসিংহ নিজ লোহিত-মূর্ত্তি-প্রকটিত ক্রোধ সংবরণ করিয়া কহিলেন, “তোমার বিরুদ্ধে কোন্ কর্ম্ম করিয়াছি, তাহা অগ্রে আমাকে বল।”

 একজন পারিষদ কহিল, “বিনীতভাবে কথা কহ।”

 কতলু খাঁ বলিলেন, “কি জন্য আমার আদেশমত, আমাকে অর্থ আর সেনা পাঠাইতে অসম্মত হইয়াছিলে?”

 বীরেন্দ্রসিংহ অকুতোভয়ে কহিলেন, “তুমি রাজবিদ্রোহী দস্যু, তোমাকে কেন অর্থ দিব? তোমায় কি জন্য সেন দিব?”

 দ্রষ্টৃবর্গ দেখিলেন, বীরেন্দ্র আপনার মুণ্ড আপনি ছেদনে উদ্যত হইয়াছেন।

 কতলু খাঁর ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইয়া উঠিল; তিনি সহসা ক্রোধ সংবরণ করিবার ক্ষমতা অভ্যাস-সিদ্ধ করিয়াছিলেন; এজন্য কতক স্থিরভাবে কহিলেন,—“তুমি আমার অধিকারে বসতি করিয়া, কেন মোগলের সহিত মিলন করিয়াছিলে?”

 বীরেন্দ্র কহিলেন, “তোমার অধিকার কোথা?”

 কতলু খাঁ আরও কুপিত হইয় কহিলেন, “শোন্ দুরাত্মন্, নিজ কর্ম্মোচিত ফল পাইবি। এখনও তোর জীবনের আশা ছিল, কিন্তু তুই নির্ব্বোধ, নিজ দর্পে আপন বধের উদ্যোগ করিতেছিস্।”

 বীরেন্দ্রসিংহ সগর্ব্বে হাস্য করিলেন, কহিলেন, “কতলু খাঁ— আমি তোমার কাছে যখন শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া আসিয়াছি, তখন দয়ার প্রত্যাশ। করিয়া আসি নাই। তোমার তুল্য শত্রুর দয়ায় যার জীবনরক্ষা,—তাহার জীবনে প্রয়োজন? তোমাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া প্রাণত্যাগ করিতাম; কিন্তু তুমি আমার পবিত্রকুলে কালি দিয়াছ; তুমি আমার প্রোণের অধিক ধনকে—"

 বীরেন্দ্রসিংহ আর বলিতে পারিলেন না; স্বর বদ্ধ হইয়া গেল; চক্ষু বাষ্পাকুল হইল; নির্ভীক গর্ব্বিত বীরেন্দ্রসিংহ অধোবদন হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন।

 কতলু খাঁ স্বভাবতঃ নিষ্ঠুর; এতদুর নিষ্ঠুর যে পরপীড়ায় তাঁহার উল্লাস জন্মিত। দাম্ভিক বৈরীর ঈদৃশ অবস্থা দেখিয়া তাঁহার মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল। কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ! তুমি কি আমার নিকটে কিছুই যাচ্ঞা করিবে না? বিবেচনা করিয়া দেখ, তোমার সময় নিকট।”

 যে দুঃসহ সন্তাপাগ্নিতে বীরেন্দ্রের হৃদয় দগ্ধ হইতেছিল, রোদন করিয়া তাহার কিঞ্চিৎ শমতা হইল। পূর্ব্বাপেক্ষা স্থিরভাবে উত্তর করিলেন, “আর কিছুই চাই না, কেবল এই ভিক্ষা যে, আমার বধকার্য্য শীঘ্র সমাপ্ত কর।”

ক। তাই হইবে, আর কিছু?
উত্তর। এ জন্মে আর কিছু না।
ক। মৃত্যুকালে তোমার কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিবে না?

 এই প্রশ্ন শুনিয়া দ্রষ্টৃবর্গ পরিতাপে নিঃশব্দ হইল। বীরেন্দ্রের চক্ষে আবার উজ্জ্বলাগ্নি জ্বলিতে লাগিল।

 “যদি আমার কন্যা তোমার গৃহে জীবিত থাকে, তবে সাক্ষাৎ করিব না। যদি মরিয়া থাকে, লইয়া আইস, কোলে করিয়া মরিব।”

 দ্রষ্টৃবর্গ একেবারে নীরব, অগণিত লোক এতাদৃশ গভীর নিস্তব্ধ যে, সূচীপাত হইলে শব্দ শুনা যাইত। নবাবের ইঙ্গিত পাইয়া, রক্ষিবর্গ বীরেন্দ্রসিংহকে বধ্যভূমিতে লইয়া চলিল। তথায় উপনীত হইবার কিছু পূর্ব্বে একজন মুসলমান বীরেন্দ্রের কাণে কাণে কি কহিল; বীরেন্দ্র তাহা কিছু বুঝিতে পারিলেন না। মুসলমান তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিল। বীরেন্দ্র ভাবিতে ভাবিতে অন্য মনে ঐ পত্র খুলিয়া দেখিলেন যে, বিমলার হস্তের লেখা! বীরেন্দ্র ঘোর বিরক্তির সহিত লিপি মর্দ্দিত করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। লিপি-বাহক লিপি তুলিয়া লইয়া গেল। নিকটস্থ কোন দশক বীরেন্দ্রের এই কর্ম দেখিয়া অপরকে অনুচ্চৈঃস্বরে কহিল, “বুঝি কন্যার পত্র?”

 কথা বীরেন্দ্রের কাণে গেল। সেই দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই!”

 পত্রবাহক পত্র লইয়া গেল। রক্ষিবর্গকে কহিয়া গেল, “আমি গতক্ষণ প্রত্যাগমন না করি, ততক্ষণ বিলম্ব করিও।”

 রক্ষিগণ কহিল, “যে আজ্ঞা প্রভো!”

 স্বয়ং ওস্মান পত্রবাহক, এইজন্য রক্ষিবর্গ ‘প্রভু' সম্বোধন করিল।

 ওস্মান লিপিহস্তে প্রাচীরমধ্যে গেলেন; তথায় এক বকুল-বৃক্ষের অন্তরালে এক অবগুণ্ঠনবর্তী স্ত্রীলোক দণ্ডায়মান আছে। ওস্মান তাহার সন্নিধানে গিয়া চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণ করিয়া যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা বিবৃত করিলেন। অবগুণ্ঠনবতী কহিলেন, “আপনাকে বহু ক্লেশ দিতেছি, কিন্তু আপনা হইতেই আমাদের এ দশা ঘটিয়াছে। আপনাকে আমার এ কার্য্য সাধন করিতে হইবে।”

 ওস্মান নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন।

 অবগুণ্ঠনবতী মনঃপীড়া-বিকম্পিত-স্বরে কহিতে লাগিলেন, “না করেন—না করুন, আমরা এক্ষণে অনাথা; কিন্তু জগদীশ্বর আছেন।”

 ওস্মান কহিলেন, “মা! তুমি জান না যে, কি কঠিন কর্ম্মে আমায় নিযুক্ত করিতেছ। কতলু খা ঁজানিতে পারিলে আমার প্রাণান্ত করিবে।”

 স্ত্রী কহিল, “কতলু খাঁ? আমাকে কেন প্রবঞ্চনা কর? কতলু খাঁর সাধ্য নাই যে, তোমার কেশ স্পর্শ করে।”

 ও। কতলু খাঁকে চেন না—কিন্তু চল, আমি তোমাকে বধ্যভূমিতে লইয়া যাইব।

 ওস্মানের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অবগুণ্ঠনবতী বধ্যভূমিতে গিয়া নিস্তব্ধে দণ্ডায়মানা হইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ তাঁহাকে না দেখিয়া একজন ভিখারীর বেশধারী ব্রাহ্মণের সহিত কথা কহিতেছিলেন, অবগুণ্ঠনবতী অবগুণ্ঠনমধ্য হইতে দেখিলে, ভিখারী অভিরাম স্বামী।

 বীরেন্দ্র অভিরাম স্বামীকে কহিলেন, “গুরুদেব! তবে বিদায় হইলাম! আমি আর আপনাকে কি বলিয়া যাইব? ইহলোকে আমার কিছু প্রার্থনীয় নাই; কাহার জন্য প্রার্থনা করিব?”

 অভিরাম স্বামী অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা পশ্চাদ্বার্তনী অবগুণ্ঠনবতীকে দেখাইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ সেই দিকে মুখ ফিরাইলেন। অমনি রমণী অবগুণ্ঠন দূরে নিক্ষেপ করিয়া বীরেন্দ্রের শৃঙ্খলাবদ্ধ পদতলে অবলুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। বীরেন্দ্র গদ্গদ্স্বরে ডাকিলেন, “বিমলা!”

 “স্বামী! প্রভু! প্রাণেশ্বর?” বলিতে বলিতে উন্মাদিনীর ন্যায় অধিকতর উচ্চৈঃস্বরে বিমলা কহিতে লাগিলেন, “আজ আমি জগৎসমীপে বলিব, কে নিধারণ করিবে? স্বামী! কণ্ঠরত্ন! কোথা যাও! আমাদের কোথা রাখিয়া যাও।”

 বীরেন্দ্রসিংহের চক্ষে দরদর অশ্রুধারা পতিত হইতে লাগিল। হস্ত ধরিয়া বিমলাকে বলিলেন, “বিমলা? প্রিয়তমে! এ সময়ে কেন আমায় রোদন করাও। শত্রুরা দেখিলে আমায় মরণে ভীত মনে করিবে।”

 বিমলা নিস্তব্ধ হইলেন। বীরেন্দ্র পুনর্ব্বার কহিলেন, “বিমলা! আমি যাই, তোমরা আমার পশ্চাৎ আইস।”

 বিমলা কহিলেন, “যাইব।”

 আর কেহ না শুনিতে পায় এমত স্বরে কহিতে লাগিলেন, “যাইব, কিন্তু আগে এ যন্ত্রণার প্রতিশোধ করিব।”

 নির্ব্বাণোন্মুখ প্রদীপবৎ বীরেন্দ্রের মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল; কহিলেন, “পরিবে?”

 বিমলা দক্ষিণ হস্তে অঙ্গুলি দিয়া কহিলেন, “এই হস্তে! এই হস্তের স্বর্ণ ত্যাগ করিলাম; আর কাজ কি!” বলিয়া কঙ্কণাদি খুলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন, “শাণিত লৌহ ভিন্ন এ হস্তে অলঙ্কার আর পরিব না।” বীরেন্দ্র হৃষ্টচিত্তে কহিলেন, “তুমি পারিবে, জগদীশ্বর তোমার মনস্কামনা সফল করুন।”

 জল্লাদ ডাকিয়া কহিল, “আর বিলম্ব করিতে পারি না।”

 বীরেন্দ্র বিমলাকে কহিলেন, “আর কি? তুমি এখন যাও।”

 বিমলা কহিলেন, “না, আমার সম্মুখেই আমার বৈধব্য ঘটুক। তোমার রুধিরে মনের সঙ্কোচ বিসর্জন করিব।” বিমলার স্বর ভয়ঙ্কর স্থির।

 “তাহাই হউক”, বলিয়া বীরেন্দ্রসিংহ জল্লাদকে ইঙ্গিত করিলেল। বিমলা দেখিতে পাইলেন, উর্দ্ধোত্থিত কুঠার সূর্য্যতেজে প্রদীপ্ত হইল; তাঁহার নয়ন-পল্লব মূহুর্ত জন্য আপনি মুদ্রিত হইল; পুনরুন্মীলন করিয়া দেখেন, বীরেন্দ্রসিংহের ছিন্ন শির রুধির-সিক্ত ধূলিতে অবলুণ্ঠন করিতেছে।

 বিমলা প্রস্তরমূর্ত্তিবৎ দণ্ডায়মানা রহিলেন, মস্তকের একটি কেশ বাতাসে দুলিতেছে না। এক বিন্দু অশ্রু পড়িতেছে না। চক্ষুর পলক নাই, একদৃষ্টে ছিন্ন শির প্রতি চাহিয়া আছেন।