দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় খণ্ড

আয়েষা

 জগৎসিংহ যখন চক্ষুরুন্মীলন করিলেন, তখন দেখিলেন যে, তিনি সুরম্য হর্ম্ম্যমধ্যে পর্য্যঙ্কে শয়ন করিয়া আছেন। যে ঘরে তিনি শয়ন করিয়া আছেন, তথায় যে আর কখন আসিয়াছিলেন, এমত বোধ হইল না; কক্ষটি অতি প্রশস্থ, অতি সুশোভিত; প্রস্তরনির্ম্মিত হর্ম্ম্যতল পাদস্পর্শ-সুখজনক গালিচায় আবৃত; তদুপরি গোলাবপাশ প্রভৃতি স্বর্ণরৌপ্য-গজদন্তাদি নানা মহার্য-বস্তু-নির্ম্মিত সামগ্রী রহিয়াছে; কক্ষদ্বারে বা গবাক্ষে নীল পরদা আছে; এজন্য দিবসের আলোক অতি স্নিগ্ধ হইয়া কক্ষে প্রবেশ করিতেছে; কক্ষ নানাবিধ স্নিগ্ধ সৌগন্ধে আমোদিত হইয়াছে।

 কক্ষমধ্য নীরব, যেন কেহই নাই। একজন কিঙ্করী সুবাসিতবারিসিক্ত ব্যজনহস্তে রাজপুত্ত্রকে নিঃশব্দে বাতাস দিতেছে, অপর একজন কিঙ্করী কিছুদূরে বাক্শক্তিবিহীন। চিত্র-পুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান আছে। যে দ্বিরদ-দন্ত-খচিত পালঙ্কে রাজপুত্ত্র শয়ন করিয়া আছেন, তাহার উপরে রাজপুত্ত্রের পার্শ্বে বসিয়া একটি স্ত্রীলোক; তাহার অঙ্গের ক্ষতসকলে সাবধানহস্তে কি ঔষধ লেপন করিতেছে। হর্ম্ম্যতলে

 গালিচার উপরে উত্তম পরিচ্ছদবিশিষ্ট একজন পাঠান বসিয়া তাম্বুল চর্ব্বণ করিতেছে ও একখানি পারসী পুস্তক দৃষ্টি করিতেছে। কেহই কোন কথা কহিতেছে না, বা শব্দ করিতেছে না।

 রাজপুত্ত্র চক্ষুরুন্মীলুন করিয়া কক্ষের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। পাশ ফিরিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু তিলাৰ্দ্ধ সরিতে পারিলেন না; সর্ব্বাঙ্গে দারুণ বেদনা।

 পর্য্যঙ্কে ষে স্ত্রীলোক বসিয়াছিল, সে রাজপুত্রের উদ্যম দেখিয়া অতি মৃদু, বীণাবৎ মধুর স্বরে কহিল, “স্থির থাকুন, চঞ্চল হইবেন না।”

 রাজপুত্র ক্ষীণস্বরে কছিলেন, “আমি কোথায়?”

 সেই মধুর স্বরে উত্তর হইল,—“কথা কহিবেন না, আপনি উত্তম স্থানে আছেন। চিন্তা করিবেন না, কথা কহিবেন না।”

 রাজপুত্র পুনশ্চ অতি ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাস করিলেন,—“বেলা কত?”

 মধুরভাষিণী পুনরপি অস্ফূট-বচনে কহিল,—“অপরাহ্ন। আপনি স্থির হউন, কথা কহিলে আরোগ্য পাইতে পরিবেন না। আপনি চুপ না করিলে, আমরা উঠিয়া যাইব।”

 রাজপুত্র কষ্টে কছিলেন,—“আর একটি কথা; তুমি কে?”

 রমণী কহিল, “আয়েষা”

 রাজপুত্র নিস্তদ্ধ হইয়া আয়েষার মুপ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আর কোথাও কি ইঁহাকে দেখিয়াছেন? না; আর কখন দেখেন নাই; সে বিষয় নিশ্চিত প্রতীতি হইল।

 আয়েষার বয়ঃক্রম দ্বাবিংশতি বৎসর হইবেক। আয়েষা দেখিতে পরমসুন্দর, কিন্তু সে রীতির সৌন্দর্য্য দুই চারি শব্দে সেরূপ প্রকটিত করা দুঃসাধ্য! তিলোত্তমাও পরম-রূপবতী, কিন্তু আয়েষার সৌন্দর্য্য রীতির নহে; স্থির-যৌবনা বিমলারও একাল পর্য্যন্ত রূপের ছটা লােক-মনোমােহিনী ছিল; আয়েষার রূপরাশি তদনুরূপও নহে। কোন কোন তরুণীর সৌন্দর্য্য বাসন্তী-মল্লিকার ন্যায়; নবস্ফূট, ব্রীড়াসঙ্কুচিত, কোমল, নির্ম্মল, পরিমলময়। তিলােমার সৌন্দর্য্য সেইরূপ। কোন রমণীর রূপ অপরাহ্নের স্থলপদ্মের ন্যায়; নির্ব্বাস, মুদ্রিতোন্মুখ, শুষ্কপল্লব, অথচ সুশােভিত, অধিক বিকসিত, অধিক প্রভাবিশিষ্ট, মধুপরিপূর্ণ। বিমলা সেইরূপ সুন্দরী। আয়েষার সৌন্দর্য্য নব-রবি-কর-ফুল্ল জল-নলিনীর ন্যায়; সুবিকাশিত, সুবাসিত, রসপূর্ণ, রৌদ্র-প্রদীপ্ত, না সঙ্কুচিত, না বিশুদ্ধ; কোমল, অথচ প্রোজ্জ্বল; পূর্ণ দলরজি হইতে রৌদ্র প্রতিফলিত হইতেছে, অথচ মুখে হাসি ধরে না। পাঠক মহাশয়, “রূপের আলো” কখন দেখিয়াছেন? না দেখিয়া থাকেন, শুনিয়া থাকিবেন। অনেক সুন্দরী রূপে “দশ দিক্ আলে৷” করে। শুনা যায়, অনেকের পুত্ত্রবধূ “ঘর আলাে” করিয়া থাকেন। ব্রজধামে আর নিশুম্ভের যুদ্ধে কালরূপেও আলাে হইয়াছিল। বস্তুতঃ পাঠক মহাশয় বুঝিয়াছেন “রূপের আলো” কাহাকে বলে? বিমলা রূপে আলো করিতেন, কিন্তু সে প্রদীপের আলাের মত; একটু একটু মিট্মিটে, তেল চাই, নহিলে জ্বলে না; গৃহকার্য্যে চলে; নিয়ে ঘর কর, ভাত রান্ধ, বিছানা পাড়, সব চলিবে; কিন্তু স্পর্শ করিলে পুড়িয়া মরিতে হয়। তিলোত্তমাও রূপে আলাে করিতেন—সে বালেন্দু-জ্যোতির ন্যায়; সুবিমল, সুমধুর, সুশীতল; কিন্তু তাহাতে গৃহকার্য্য হয় না; তত প্রখর নয়, এবং দুরনিঃসৃত। আয়েষাও রূপে আলো করিতেন, কিন্তু সে পূর্ব্বাহ্নিক সুর্য্য-রশ্মির ন্যায়; প্রদীপ্ত, প্রভাময়, অথচ যাহাতে পড়ে, তাহাই হাসিতে থাকে।

 যেন উদ্যানমধ্যে পদ্মফুল, এ আখ্যায়িকা মধ্যে তেমনি আয়েষা; এজন্য তাঁহার অবয়ব পাঠক মহাশয়ের ধ্যান-প্রাপ্য করিতে চাহি। যদি চিত্রকর হইতাম, যদি এইখানে তুলি ধরিতে পারিতাম, যদি সে বর্ণ ফলাইতে পারিতাম; না চম্পক, না রক্ত, না শ্বেতপদ্মকোরক, অথচ তিনই মিশ্রিত, এমত বর্ণ ফলাইতে পারিতাম; যদি সে কপাল তেমনি নিটোল করিযা আঁকিতে পারিতাম, নিটোল অথচ বিস্তীর্ণ, মন্মথের রঙ্গভূমি স্বরূপ করিয়া লিখিতে পারিতাম; তাহার উপরে তেমনই সুবঙ্কিম কেশের সীমারেখা দিতে পারিতাম; সে রেখা তেমনই পরিস্কার, তেমনই কপালের গোলাকৃতির অনুগামিনী করিয়া আকর্ণ টানিতে পারিতাম; কর্ণের উপরে সে রেখা তেমনই করিয়া ঘুরাইয়া দিতে পারিতাম; যদি তেমনই কালো রেসমের মত কেশগুলি লিখিতে পারিতাম; কেশমধ্যে তেমনই করিয়া কপাল হইতে সিঁতি কাটিয়া দিতে পারিতাম—তেমনই পরিষ্কার, তেমনই সূক্ষ্ম, যদি তেমনই করিয়া কেশরঞ্জিত করিয়া দিতে পারিতাম; যদি তেমনই করিয়া লোল কবরী বাঁধিয়া দিতে পারিতাম; যদি সে অতি নিবিড় ভ্রুযুগ আঁকিয়া দেখাইতে পারিতাম; প্রথমে যথায় দুটি ভ্রু পরস্পর সংযোগাশয়ী হইয়াও মিলিত হয় নাই, তথা হইতে যেখানে যেমন বর্দ্ধিতায়তন হইয়া মধ্যস্থলে না আসিতে আসিতেই যেরূপ স্থূলরেখ হইয়াছিল, পরে আবার যেমন ক্রমে ক্রমে সূক্ষ্মাকার কেশবিন্যাস-রেখার নিকটে গিয়া সূচ্যগ্রবৎ সমাপ্ত হইয়াছিল, তাহা যদি দেখাইতে পারিতাম; যদি সেই বিদ্যুদগ্নিপূর্ণ মেঘবৎ, চঞ্চল, কোমল, চক্ষুঃপল্লব লিখিতে পারিতাম; যদি সে নয়ন-যুগলের বিস্তৃত আয়তন লিখিতে পারিতাম; তাহার উপরিপল্লব ও অধঃপল্লবের সুন্দরী বঙ্কভঙ্গী, সে চক্ষুর নীলালক্তক প্রভা, তাহার ভ্রমরকৃষ্ণ স্থূল তারা, লিখিতে পারিতাম; যদি সে গর্ব্ববিস্ফারিত রন্ধ্র-সমেত সুনাসা; সে রসময় ওষ্ঠাধর; সে কবরীস্পৃষ্ট প্রন্তরশ্বেত গ্রীবা; সে কর্ণাভরণস্পর্শপ্রার্থী পীবরাংস; সে স্থূল কোমল রত্নালঙ্কারখচিত বাহু; যে অঙ্গুলিতে রত্নাঙ্গুরীয় হীনভাস হইয়াছে, সে অঙ্গুলি; সে পদ্মারক্ত, কোমল করপল্লব; সে মুক্তাহার-প্রভানিন্দী পীবরোন্নত বক্ষঃ; সে ঈষদ্দীর্ঘ বপুর মনোমোহন ভঙ্গী;—যদি সকলই লিখিতে পারিতাম; তথাপি তুলি স্পর্শ করিতাম না। আয়েষার সৌন্দর্য্যসার, সে সমুদ্রের কৌস্তুভরত্ন, তাহার ধীর কটাক্ষ। সন্ধ্যাসমীরণকম্পিত নীলোৎপলতুল্য ধীর মধুর কটাক্ষ কি প্রকারে লিখিব?

 রাজপুত্ত্র আয়েষার প্রতি অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার তিলোত্তমাকে মনে পড়িল। স্মৃতিমাত্র হৃদয় যেন বিদীর্ণ হইয়া গেল, শিরাসমুহমধ্যে রক্তস্রোতঃ প্রবল বেগে প্রধাবিত হইল, গভীর ক্ষত হইতে পুনর্ব্বার রক্তপ্রবাহ ছুটিল; রাজপুত্ত্র পুনর্ব্বার বিচেতন হইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন।

 খট্টারূঢ়া সুন্দরী তৎক্ষণাৎ ত্রস্তে গাত্রোখান করিলেন। যে ব্যক্তি গালিচায় বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছিল, সে মধ্যে মধ্যে পুস্তক হইতে চক্ষু তুলিয়া সপ্রেম-দৃষ্টিতে আয়েষাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল; এমন কি, যুবতী পালঙ্ক হইতে উঠিলে, তাহার যে কর্ণাভরণ দুলিতে লাগিল, পাঠান তাহাই অনেকক্ষণ অপরিতৃপ্তলোচনে দেখিতে লাগিল। আয়েষা গাত্রোত্থান করিয়া ধীরে ধীরে পাঠানের নিকট গমনপূর্ব্বক তাহার কাণে কাণে কহিলেন, “ওস্মান, শীঘ্র হকিমের নিকট লোক পাঠাও।”

 দুর্গজেতা ওস্মান খাঁই গালিচায় বসিয়াছিলেন। আয়ের কথা শুনিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।

 আয়েষা, একটা রূপার সেপায়ার উপরে যে পাত্র ছিল, তাহা হইতে একটু জলবৎ দ্রব্য লইয়া পুনর্মূচ্ছাগত রাজপুত্ত্রের কপালে মুখে সিঞ্চন করিতে লাগিলেন।

 ওস্মান খাঁ অচিরাৎ হকিম লইয়া প্রত্যাগমন করিলেন। হকিম অনেক যত্নে রক্তস্রাব নিবারণ করিলেন, এবং নানাবিধ ঔষধ আয়েষার নিকট দিয়া মৃদু মৃদু স্বরে সেবনের ব্যবস্থা উপদেশ করিলেন।

 আয়েষা কাণে কাণে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন অবস্থা দেখিতেছেন?”

 হকিম কহিলেন, “জ্বর অতি ভয়ঙ্কর।”

 হকিম যখন বিদায় লইয়া প্রতিগমন করেন, তখন ওস্মান তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া দ্বারদেশে তাঁহাকে মৃদুস্বরে কহিলেন, “রক্ষা পাইবে?”

 হকিম কহিলেন, “আকার নহে; পুনর্ব্বার যাতনা হইলে আমাকে ডাকিবেন।”