দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

দাসীচরণে

 সেই রজনীতে কতলু খাঁর বিলাস-গৃহমধ্যে নৃত্য হইতেছিল। তথায় অপরা নর্তকী কেহ ছিল না— বা অপর শ্রোতা কেহ ছিল না। জন্মদিনোপলক্ষে মোগল সম্রাটের সেরূপ পারিষদমণ্ডলী মধ্যে আমোদপরায়ণ থাকিতেন, কতলু খাঁর সেরূপ ছিল না। কতলু খাঁর চিত্ত একান্ত আত্মসুখরত, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির অভিলাষী। অদ্য রাত্রে তিনি একাকী নিজ বিলাস-গৃহ-নিবাসিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাহাদিগের নৃত্যগীত কৌতুকে মত্ত ছিলেন। খোজাগণ ব্যতীত অন্য পুরুষ তথায় আসিবার অনুমতি ছিল না। রমণীগণ কেহ নাচিতেছে, কেহ গায়িতেছে, কেহ বাদ্য করিতেছে; অপর সকলে কতলু খাঁকে বেষ্টন করিয়া বসিয়া শুনিতেছে।

 ইন্দ্রিয়মুগ্ধকর সামগ্রী সকলই তথায় প্রচুর পরিমাণে বর্ত্তমান। কক্ষমধ্যে প্রবেশ কর; প্রবেশ করিবামাত্র অবিরত-সিঞ্চিত গন্ধবারির স্নিগ্ধ ঘ্রাণে আপাদমস্তক শীতল হয়। অগণিত রজত-দ্বিরদরদ্-স্ফটিক শামাদানের তীব্রোজ্জল জ্বালা নয়ন ঝলসিতেছিল; অপরিমিত পুষ্পরাশি কোথাওমালাকারে, কোথাও স্তুপাকারে, কোথাও স্তবকাকারে, কোথাও রমণী-কেশপাশে, কোথাও রমণীকণ্ঠে স্নিগ্ধতর প্রভা প্রকাশিত করিতেছে। কাহার পুষ্পব্যঞ্জন; কাহারও পুষ্প আভরণ; কেহ বা অন্যের প্রতি পুষ্পক্ষেপণ প্রেরণ করিতেছে; পুষ্পের সৌরভ, সুরভি বারির সৌরভ, সুগন্ধ দীপের সৌরভ, গন্ধদ্রব্যমজ্জিত বিলাসিনীগণের অঙ্গের সৌরভ, পুরীমধ্যে সর্ব্বত্র সৌরভে ব্যপ্ত। প্রদীপের দীপ্তি, পুষ্পের দীপ্তি, রমণীগণের রত্নালঙ্কারের দীপ্তি, সর্ব্বোপরি ঘন ঘন কটাক্ষবর্ষিণী কামিনমণ্ডলীর উজ্জ্বল নয়ন-দীপ্তি। সপ্তস্বরসম্মিলিত মধুর বীণাদি বাদ্যের ধ্বনি আকাশ ব্যাপিয়া উঠিতেছে, তদধিক পরিস্কার মধুরনিনাদিনী রমণকণ্ঠগাতি তাহার সহিত মিশিয়া উঠিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে তাললয়মিলিত পাদবিক্ষেপে নর্ত্তকীর অলঙ্কার-শিঞ্জিত মন মুগ্ধ করিতেছে।

 ঐ দেখ পাঠক! যেন পদ্মবনে হংসী সমীরণোথিত তরঙ্গহিল্লোলে নাচিতেছে; প্রফুল্ল পদ্মমুখী সবে ঘেরিয়া রহিয়াছে। দেখ, দেখ, ঐ যে সুন্দরী নীলাম্বর-পরিধানা, ঐ বার নীলবাস স্বর্ণতারাবলীতে খচিত, দেখ! ঐ যে দেখিতেছ সুন্দরী সীমন্তপার্শ্বে হীরকতারা ধারণ করিয়াছে, দেখিয়াছ উহার কি সুন্দর ললাট! প্রশান্তি, প্রশস্ত, পরিষ্কার; এ ললাটে কি বিধাতা বিলাসগৃহ লিখিয়াছিলেন? ঐ রে শ্যামা পুষ্পাভরণা, দেখিয়াছ উহার কেমন পুষ্পাভরণ সাজিয়াছে? নারীদেহ শোভার জন্যই পুষ্প-সৃষ্টি হইয়াছিল! ঐ যে দেখিতেছ সম্পূর্ণ, মৃদুরক্ত, ওষ্ঠধর যার; বে ওষ্ঠাধর ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া রহিয়াছে, দেখ উহার সুচিক্কণ নীলবাস ফুটিয়া কেমন বর্ণপ্রভা বাহির হইতেছে; যেন নির্ম্মল নীলাম্বুমধ্যে পূর্ণচন্দ্রালোক দেখা যাইতেছে। এই যে সুন্দরী মরালনিন্দিত-গ্রীবাভঙ্গী করিয়া হাসিয়া হাসিয়া কথা কহিতেছে, দেখিয়াছ উহার কেমন কর্ণেরকুণ্ডল দুলিতেছে? কে তুমি সুকেশি সুন্দরি? কেন উরঃপর্য্যন্ত কুঞ্চিতালকরাশিলম্বিত করিয়া দিয়াছ? পদ্মবঙ্গে কেমন করিয়া কাল-কণিনী জড়ায় তাহাই কি দেখাইতেছ?

 আর, তুমি কে সুন্দরি, যে কতলু খাঁর পার্শ্বে বসিয়া হেমপাত্রে সুরা ঢালিতেছ? কে তুমি, যে সকল রাখিয়া তোমার পূর্ণলাবণ্য দেহ প্রতি কতল খাঁ ঘন ঘন সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছে? কে তুমি অব্যর্থ কটাক্ষে কতল খাঁর হৃদয় ভেদ করিতেছ? ও মধুর কটাক্ষ চিনি! তুমি বিমল। অত সুরা ঢালিতেছ কেন? ঢাল, ঢাল, আরও ঢাল, বসন-মধ্যে ছুরিক: আছে ত? আছে বই কি। তবে অত হাসিতেছ কিরূপে? কতল খাঁ। তোমার মুখপানে চাহিতেছে। ও কি? কটাক্ষ! ও কি, আবার কি? ঐ দেখ, সুরাস্বাদ-প্রমত্ত সবনকে ক্ষিপ্ত করিলে। এই কৌশলেই বুঝি সকলকে বঞ্ছিত করিয়া কতল খাঁ প্রেয়সী হইয়া বসিয়াছ? না হলে কন, হাসি, যে অঙ্গভঙ্গী, সে সরস-কথারহস্য, যে কটাক্ষ! আবার সরাব! কতল খাঁ, সাবধান! কতল খাঁ কি করিবে! বে চাহনি। চাহিয়া বিমলা: সুরাপাত্র দিতেছে! ও কি ধ্বনি? এ কে গায়? এ কি মানুষের গান, ন, সুররমণী গায়? বিমলা গায়িকাদিগের সহিত গায়িতেছে। কি সুর: কি ধবনি? কি লয়! কতল খাঁ এ কি? মন কোথায় তোমার, কি দেখিতেছ? সমে সমে হাসিয়া কটাক্ষ করিতেছে; ছুরির অধিক তোমার হৃদয়ে বসাইতেছে, তাহাই দেখিতেছ? অমনি কটাক্ষে প্রাণ হরণ করে, আবার সঙ্গীতের সন্ধি-সমৃদ্ধ কটাক্ষ! আরও দেখিয়াছ, কটাক্ষের সঙ্গে আবার অল্প মস্তক-দোলন? দেখিয়াছ, সঙ্গে সঙ্গে কেমন কণাভরণ দুলিতেছে? হাঁ। আবার সুরা ঢাল, দে মদ দে, এ কি! এ কি: বিমলা উঠিয়া নাচিতেছে। কি সুন্দর। কিবা ভঙ্গী? দে মদ! কি অঙ্গ! কি গঠন! কতলু খাঁ! জাহাপনা! স্থির হও! স্থির! উঃ: কতলুর শরীরে অগ্নি জ্বলিতে লাগিল। পিয়ালা! আহা! দে পিয়াল! মেরি পিয়ারি। আবার কি? এর উপর হাবি, এর উপর কটাক্ষ? সরাব! দে সরাব।  কতলু খাঁ উন্মত্ত হইল। বিমলাকে ডাকিয়া কহিল, “তুমি কোথা, প্রিয়তমে।”

 বিমল কতলু খাঁর স্কন্ধে এক বাহু দিয়া কহিলেন, “দাসী শ্রীচরণে।”—অপর করে ছুরিকা—

 তৎক্ষণাৎ ভয়ঙ্কর চীৎকার-ধ্বনি করিয়া বিমলাকে কতলু খাঁ দূরে নিক্ষেপ করিল; এবং যেই নিক্ষেপ করিল, অমনি আপনিও ধরাতলশাষী হইল। বিমলা তাহার বক্ষঃস্থলে আমূল তীক্ষ ছুরিকা বসাইয়া দিয়াছিলেন।

 “পিশাচী-শয়তানী!” কতলু খাঁ এই কথা বলিয়া চীৎকার করিল। “পিশাচী নহি—শয়তানী নহি—বীরেন্দ্রসিংহের বিধবা স্ত্রী।” এই বলিয়া বিমলা কক্ষ হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিলেন।

 কতলু খাঁর বাঙ্নিষ্পত্তি-ক্ষমতা ঝটিতি রহিত হইয়া আসিতে লাগিল। তথাপি সাধ্যমত চীৎকার করিতে লাগিল। বিমলাও যথাসাধ্য চীৎকার করিতে লাগিল। বিমলা ও চীৎকার করিতে করিতে ছুটিলেন। কক্ষান্তরে গিয়া কথোপকথন-শব্দ পাইলেন। বিমলা উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলেন। এক কক্ষ পরে দেখেন তথায় প্রহরী ও খোজাগণ রহিয়াছে। চীৎকার শুনিয়া ও বিমলার ত্রস্ত ভাব দেখিয়া তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে?”

 প্রত্যুৎপন্নমতি বিমলা কহিলেন, “সর্ব্বনাশ হইয়াছে। শীঘ্র যাও, কক্ষমধ্যে মোগল প্রবেশ করিয়াছে, বুঝি নবাবকে খুন করিল।”

 প্রহরী ও খোজাগণ উর্দ্ধশ্বাসে কক্ষাভিমুখে ছুটিল। বিমলাও ঊর্দ্ধশ্বাসে অন্তঃপুর-দ্বারাভিমুখে পলায়ন করিলেন। দ্বারে প্রহরী প্রমোদক্লান্ত হইয়া নিদ্রা যাইতেছিল, বিমলা বিনা বিঘ্নে দ্বার অতিক্রম করিলেন;

“দাসী শ্রীচরণে ।”

দেখিলেন, সর্ব্বত্রই প্রায় ঐরূপ, অবাধে দৌড়িতে লাগিলেন। বাহিরে ফটকে দেখিলেন প্রহরিগণ জাগরিত। একজন বিমলাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে ও, কোথা যাও?”

 তখন অন্তঃপুরমধ্যে মহা কোলাহল উঠিয়াছে, সকল লোক জাগিয়া সেই দিকে ছুটিতেছিল। বিমলা কহিলেন, “বসিয়া কি করিতেছ, গোললোগ শুনিতেছ না?”

 প্রহরী জিজ্ঞাসা করিল, “কিসের গেলযোগ?”

 বিমলা কহিলেন, “অন্তঃপুরে সর্বনাশ হইতেছে, নবাবের প্রতি আক্রমণ হইয়াছে।”

 প্রহরিগণ ফটক ফেলিয়া দৌড়িল; বিমলা নির্ব্বিঘ্নে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

 বিমলা ফটক হইতে কিয়দ্দুর গমন করিয়া দেখিলেন যে, একজন পুরুষ এক বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া আছেন। দৃষ্টিমাত্র বিমল তাঁহাকে অভিরাম স্বামী বলিয়া চিনিতে পারিলেন। বিমলা তাঁহার নিকট যাইবামাত্র অভিরামস্বামী কহিলেন, “আমি বড়ই উদ্বিগ্ন হইতেছিলান; দুর্গমধ্যে কোলাহল কিসের?”

 বিমলা উত্তর করিলেন, “আমি বৈধব্য-যন্ত্রণার প্রতিশোধ করিয়া আসিয়াছি। এখানে আর অধিক কথার কাজ নাই, শীঘ্র আশ্রমে চলুন; পরে সবিশেষ নিবেদিব। তিলোত্তমা আশ্রমে গিয়াছে ত?”

 অভিরামস্বামী কহিলেন, “তিলোত্তমা অগ্রে অগ্রে আশ‍্মানির সহিত যাইতেছে, শীঘ্র সাক্ষাৎ হইবেক।”

 এই বলিয়া উভয়ে দ্রুতবেগে চলিলেন। অচিরাৎ কুটীৱমধ্যে উপনীত হইয়া দেখিলেন, ক্ণপূর্ব্বেহ আয়েষার অনুগ্রহে তিলোত্তমা আশ‍্মানির সঙ্গে তথায় আসিয়াছেন। তিলোত্তমা অভিরামস্বামীর পদযুগলে প্রণত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। অভিরামস্বামী তাহাকে স্থির করিয়া কহিতে লাগিলেন, “ঈশ্বরেচ্ছায় তোমারা দুরাত্মার হস্ত হইতে মুক্ত হইলে, এখন আর তিলার্দ্ধ এদেশে তিষ্ঠান নহে। যবনেরা সন্ধান পাইলে এবারে প্রাণে মারিয়া প্রভুর মৃত্যুশোক নিবারণ করিবে। অমরা অদ্য রাত্রিতে এ স্থান ত্যাগ করিয়া যাই চল।”

 সকলেই এ পরামর্শে সম্মত হইলেন।