দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
দিগ্‌গজ-হরণ

 এমন সময় বিমলা আসিয়া বাহির হইতে দ্বার নাড়িল। বিমলা দ্বারপার্শ্ব হইতে অলক্ষ্যে সকল দেখিতেছিল। দ্বারের শব্দ শুনিয়া দিগ্‌গজের মুখ শুকাইল।

 আশ্‌মানি বলিল, “কি সর্বনাশ! বিমলা আসিয়াছে—লুকাও, লুকাও।”

 দিগ্‌গজ-ঠাকুর কাঁদিয়া কহিল, “কোথায় লুকাইব?”

 আশ্‌মানি বলিল, “ঐ অন্ধকার কোণে একটা কেলে-হাঁড়ি মাথায় দিয়ে বসো গিয়া, অন্ধকারে ঠাওর পাইবে না! দিগ্‌গজ তাহাই করিতে গেল—আশ্‌মানির বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় বিস্মিত হইল। দুর্ভাগ্যবশতঃ তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণ একটা অড়হর ডালের হাঁড়ি পাড়িয়া মাথায় দিল—তাহাতে আধ হাঁড়ি বাঁধা অড়হর ডাল ছিল—দিগ্‌গজ যেমন হাঁড়ি উল্টাইয়া মাথায় দিবেন, অমনি মস্তক হইতে অড়হর ডালের শতধারা বহি—টিকি দিয়া অড়হড় ডালের স্রোত নামিল—স্কন্ধ, বক্ষ, পৃষ্ঠ ও বাহু হইতে অড়হর ডালের ধারা পর্ব্বত হইতে ভূতলগামিনী নদী সকলের ন্যায় তরঙ্গে তরঙ্গে নামিতে লাগিল; উচ্চ নাসিকা অড়হরের প্রস্রবণবিশিষ্ট গিরিশৃঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। এই সময়ে বিমলা গৃহপ্রবেশ করিয়া দিগ্‌গজের শোভারাশি সন্দর্শন করিতে লাগিলেন; দিগ্‌গজ বিমলাকে দেখিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দেখিয়া বিমলার দয়া হইল। বিমলা বলিলেন, “কাঁদিও না। তুমি যদি এই অবশিষ্ট ভাতগুলি খাও, তবে আমরা কাহারও সাক্ষাতে এ সকল কথা বলিব না।”

 ব্রাহ্মণ তখন প্রফুল্ল হইল; প্রফুল্লবদনে পুনশ্চ আহারে বসিল—ইচ্ছা অঙ্গের অড়হর ডালটুকুও মুছিয়া লয়, কিন্তু তাহা পারিল না, কিংবা সাহস করিল না। আশ্‌মানির জন্য যে ভাত মাখিয়াছিল, তাহা খাইল। বিনষ্ট অড়হরের জন্য অনেক পরিতাপ করিল। আহার সমাপনান্তে আশ্‌মানি তাহাকে স্নান করাইল। পরে ব্রাহ্মণ স্থির হইলে, বিমলা, কহিলেন, “রসিক। একটা বড় ভারি কথা আছে।”

 রসিক কহিলেন, “কি?”

বি। তুমি আমাদের ভালবাস?
দি। বাসি নে?
বি। দুই জনকেই?
দি। দুই জনকেই।
বি। যা বলি তা পারিবে?
দি। পারিব না?
বি। এখনই?
দি। এখনই।
বি। এই দণ্ডে?
দি। এই দণ্ডে।
বি। আমরা দুজনে কেন এসেছি জান?

|-

বি। না।

 আশ্‌মানি কহিল, “আমরা তােমার সঙ্গে পলাইয়া যাব।”

 ব্রাহ্মণ অবাক্ হইয়া হাঁ করিয়া রহিলেন। বিমলা কষ্টে উচ্চ হাসি সংবরণ করিলেন। কহিলেন,“কথা কও না যে?”

 “অ্যাঁ অ্যাঁ, তা তা তা তা”—বাঙ্নিষ্পত্তি হইয়া উঠিল না।

 আশ্‌মানি কহিল, “তবে কি পারিবে না?”

 “অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, তা তা—স্বামী-ঠাকুরকে বলিয়া আসি।”

 বিমলা কহিলেন, “স্বামী-ঠাকুরকে আবার বলবে কি? এ কি তােমার মাতৃশ্রাদ্ধ উপস্থিত যে, স্বামী-ঠাকুরের কাছে ব্যবস্থা নিতে যাবে?”

দি। না না, তা যাব না; ত কবে যেতে হবে?
বি। কবে? এখনই চল, দেখিতেছ না, আমি গহনাপত্র লইয়া বাহির হইয়াছি।
দি। এখনই?
বি। এখনই না ত কি? নহিলে বল আমরা অন্য লােকের তল্লাস করি।

 গজপতি আর থাকিতে পারিলেন না, বলিলেন, “চল, যাইতেছি।”

 বিমলা বলিলেন, “দোছোট লও।”

 দিগ্‌গজ নামাবলী গায়ে দিলেন। বিমলা অগ্রে, ব্রাহ্মণ পশ্চাতে যাত্রা করেন, এমত সময়ে দিগ্‌গজ বলিলেন, “সুন্দরি?”

বি। কি?
দি। আবার আসিবে কবে?
বি। আসিব কি আবার? একেবারে চলিলাম।

|-

হাসিতে দিগ্‌গজের মুখ পরিপূর্ণ হইল, বলিলেন,—“তৈজসপত্র রহিল যে।”
বি। ও সব তােমায় কিনে দিব।

 ব্রাহ্মণ কিছু ক্ষুণ্ণ হইলেন; কি করেন, স্ত্রীলােকেরা মনে করিবে আমাদের ভালবাসে না, অভাবপক্ষে বলিলেন,—“খুঙ্গীপুতি?”

 বিমলা বলিলেন, “শীঘ্র লও।”

 বিদ্যাদিগ্‌গজের সবে দুখানি পুতি—ব্যাকরণ আর একখানি স্মৃতি। ব্যাকরণখানি হস্তে লইয়া বলিলেন, “এখানিতে কাজই বা কি, এ ত আমার কণ্ঠে আছে।” এই বলিয়া কেবল স্মৃতিখানি খুঙ্গীর মধ্যে লইলেন! ‘দুর্গা শ্রীহরি’ বলিয়া বিমলা ও আশ্‌মানির সহিত যাত্রা করিলেন।

 আশ্‌মানি কহিল, “তােমরা আগু হও, আমি পশ্চাৎ যাইতেছি।”

 এই বলিয়া আশ্‌মানি গৃহে গেল; বিমলা ও গজপতি একত্রে চলিলেন। অন্ধকারে উভয়ে অলক্ষ্য থাকিয়া দুর্গদ্বারের বাহির হইলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া দিগ্‌গজ কহিলেন,—“কই, আশ্‌মানি আসিল না?”

 বিমলা কহিলেন, “সে বুঝি আসিতে পারিল না। আবার তাকে কেন?”

 রসিকরাজ নীরব হইয়া রহিলেন। ক্ষণেক পরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন,—“তৈজসপত্র!”