দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
দ্বার খুলিলে আশ্মানি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র দিগ্গজের হৃদ্বোধ হইল যে, প্রণয়িনী আসিয়াছেন, ইহার সরস অভ্যর্থনা করা চাই, অতএব হস্ত উত্তোলন করিয়া কহিলেন,—“ওঁ আয়াহি বরদে দেবি!”
আশ্মানি কহিল, “এটা যে বড় সরস কবিতা, কোথা পাইলে?”
দি। তোমার জন্য এটী আজ রচনা করিয়া রাখিয়াছি।
আ। সাধ করিয়া তোমায় রসিকরাজ বলেছি?
দি। সুন্দরি! তুমি বইস; আমি হস্ত প্রক্ষালন করি।
আশানি মনে মনে কহিল, “আলোপ্পেয়ে! তুমি হাত ধোবে? আমি, তোমাকে ঐ এঁটো আবার খাওয়াব।”
প্রকাশ্যে কহিল, “সে কি, হাত ধোও যে, ভাত খাও না।”
গজপতি কহিলেন, “কি কথা, ভোজন করিয়া উঠিয়াছি, আবার ভাত খাব কিরূপে?”
আ। কেন, তোমার ভাত রহিয়াছে যে? উপবাস করিবে?
দিগ্গজ কিছু ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “কি করি, তুমি তাড়াতাড়ি করিলে।” এই বলিয়া সতৃষ্ণনয়নে অন্নপানে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।
আমনি কহিল, “তবে আবার খাইতে হইবেক।”
দি। রাধে মাধব; গণ্ডূষ করিয়াছি, গাত্রোত্থান করিয়াছি, আবার খাইব?
আ। হাঁ, খাইবে বই কি। আমারই উচ্ছিষ্ট খাইবে। এই বলিয়া আশ্মানি ভোজনপাত্র হইতে এক গ্রাস অন্ন লইয়া আপনি খাইল।
ব্রাহ্মণ অবাক্ হইয়া রহিলেন।
আশমানি উৎসৃষ্ট অন্ন ভোজনপাত্রে রাখিয়া কহিল, “খাও।”
ব্রাহ্মণের বাঙ্নিষ্পত্তি নাই।
আ। খাও, শােন, কাহাকেও বলিব না যে, তুমি আমার উচ্ছিষ্ট খাইয়াছ। কেহ না জানিতে পারিলে দোষ কি?
দি। তাও কি হয়?
কিন্তু দিগ্গজের উদরমধ্যে অগ্নিদেব প্রচণ্ড জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন। দিগ্গজ মনে মনে করিতেছিল যে, আশ্মনি যেমন সুন্দরী হউক না কেন, পৃথিবী ইহাকে গ্রাস করুন, আমি গােপনে ইহার উৎসৃষ্টাবশেষ ভোজন করিয়া সহ্যমান উদর শীতল করি।
আমানি ভাব বুঝিয়া বলিল, “খাও,—না খাও, একবার পাতের কাছে বসো।”
দি। কেন? তাতে কি হইবে?
আ। আমার সাধ। তুমি কি আর একটা সাধ পূরাইতে পার না?
দিগ্গজ বলিলেন, “শুধু পাতের কাছে বসিতে কি? তাহাতে কোন দোষ নাই। তােমার কথা রাখিলাম।”
এই বলিয়া দিগ্গজ পণ্ডিত, আশ্মানির কথায় পাতের কাছে গিয়া বসিলেন। উদরে ক্ষুধা, কোলে অন্ন, অথচ খাইতে পারিতেছেন না—দিগ্গজের চক্ষে জল আসিল!
আশ্মানি বলিল, “শূদ্রের উচ্ছিষ্ট ব্রাহ্মণে ছুঁলে কি হয়?”
পণ্ডিত বলিলেন, “নাইতে হয়।”
আ। তুমি আমার কেমন ভালবাস, আজ বুঝিয়া পড়িয়া তবে আমি যাব। তুমি আমার কথায় এই রাত্রে নাইতে পার?
দিগ্গজ মহাশয় ক্ষুদ্র চক্ষু রসে অর্দ্ধ-মুদ্রিত করি, দীর্ঘ নাসিকা বাঁকাইয়া, মধুর হাসি আকর্ণ হাসি পলিলেন, “তার কথা কি? এখনই নাইতে পারি।”
অশনি বলিল, “আমার ইচ্ছা হইয়াছে তোমার পাতে প্রসাদ পাইব! তুমি আপন হাতে আমাকে দুইটী ভাত মাখিয়া দাও।”
দিগ্গজ বণিল, “তার আশ্চর্য্য কি? স্নানেই শুচি।” এই বলিয়া উৎসৃষ্টাবশেষ একত্রিত করিয়া মাখিতে লাগিল।
আশ্মানি বলিল, “আমি একটা উপকথা বলি শুন। যতক্ষণ আমি উপকথা বলিব ততক্ষণ তুমি ভাত মাখিবে, নইলে আমি খাইব না।”
দি। আচ্ছা।
অশিমানি এক রাজা আর তাহার দুয়ো শুয়ো দুই রাণীর গল্প আরম্ভ করিল। দিগ্গজ হা করিয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া শুনিতে লাগিল—আর ভাত মাখিতে লাগিল।
শুনিতে শুনিতে দিগ্গজের মন আশ্মানির গল্পে ডুবিয়া গেল—আশ্মানির হাসি, চাহনি ও নথের মাঝখানে আটকাইয়া রহিল। ভাতমাখা বন্ধ হইল—পাতে হাত লাগিয়া রহিল—কিন্তু ক্ষুধার যাতনাটা আছে। যখন আশ্মানির গল্প বড় জমিয়া আসিল—দিগ্গজের মন তাহাতে বড়ই নিবিষ্ট হইল—তখন দিগ্গজের হাত, বিশ্বাসঘাতকতা করিল। পাত্রস্থ হাত, নিকটস্থ মাখা-ভাতের গ্রাস তুলিয়া, চুপি চুপি দিগ্গজের মুখে লইয়া গেল। মুখ হা ঁকরিয়া তাহা গ্রহণ করিল। দন্ত, বিনা আপত্তিতে তাহ। চর্ব্বণ করিতে আরম্ভ করিল। রসনা, তাহা গলাধঃকরণ করাইল। নিরীহ দিগ্গজের কোন সাড়া ছিল না। দেখিয়া আশ্মানি খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, “তবে রে বিট্লে—আমার এঁটো না কি খাবি নে?”
তখন দিগ্গজের চেতনা হইল। তাড়াতাড়ি আর এক গ্রাস মুখে দিয়া গিলিতে গলিতে এঁটোহাতে আশ্মানির পায়ে জড়াইয়া পড়িল। চর্ব্বণ করিতে করিতে কাঁদিয়া বলিল, “আমায় রাখ; আশ্মান! কাহাকেও বলিও না।”