দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
আশ্‌মানির অভিসার

 দিগ্‌গজ গজপতির মনোমোহিনী আশ্‌মানি কিরূপ রূপবতী, জানিতে পাঠকমহাশয়ের কৌতূহল জন্মিয়াছে সন্দেহ নাই। অতএব তাঁহার সাধ পূরাইব। কিন্তু স্ত্রীলোকের রূপবর্ণন-বিষয়ে গ্রন্থকারগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া থাকেন, আমার সদৃশ অকিঞ্চন জনের তৎপদ্ধতিবহির্ভূত হওয়া অতি ধৃষ্টতার বিষয়। অতএব প্রথমে মঙ্গলাচরণ করা কর্তব্য।

 হে বাগ্দেবি! হে কমলাসনে। শরদিন্দুনিভাননে! অমল-কমল-দল-নিন্দিত-চরণ-ভক্তজন-বৎসলে! আমাকে সেই চরণকমলের ছায়া দান কর; আমি আশানির রূপবর্ণন করিব। হে অরবিন্দানন-সুন্দরীকুল-গর্ব্বখর্ব্বকারিণি! হে বিশাল-শাল-দীর্ঘ-সমাস-পটল-সৃষ্টি-কারিণি! একবার পদনখের এক পার্শ্বে স্থান দাও, আমি রূপবর্ণন করিব। সমাস-পটল, সন্ধি-বেগুন, উপমা-কাঁচকলার চড়চড়ি রাঁধিয়া এই খিচুড়ি তোমায় ভোগ দিব। হে পণ্ডিতকুলেপ্সিত-পয়ঃপ্রস্রবিণি! হে মুর্খজন-প্রতি ক্বচিৎ কৃপকারিনি! হে অঙ্গুলি-কণ্ডূয়ন-বিষম-বিকার-সমুৎপাদিনি! হে বটতলা-বিদ্যাপ্রদীপ-তৈল-প্রদায়িনি! আমার বুদ্ধির প্রদীপ একবার উজ্জ্বল করিয়া দিয়া যাও! মা! তোমার দুই রূপ; যেরূপে তুমি কালিদাসকে বরপ্রদা হইয়াছিলে, যে প্রকৃতির প্রভাবে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা জন্মিয়াছিল, যে প্রকৃতির ধ্যান করিয়া বাল্মীকি রামায়ণ, ভবভূতি উত্তরচরিত, ভারবি কিরাতার্জ্জুনীয় রচনা করিয়াছিলেন, সেরূপে আমার স্কন্ধে আরোহণ করিয়া পীড়া জন্মাইও না; যে মূর্ত্তি ভাবিয়া শ্রীহর্ষ নৈষধ লিখিয়াছিলেন, যে প্রকৃতিপ্রসাদে ভারতচন্দ্র বিদ্যার অপূর্ব্ব রূপবর্ণন করিয়া, বঙ্গদেশের মনোমোহন করিয়াছেন, যাহার প্রসাদে দাশরথি রায়ের জন্ম, যে মূর্ত্তিতে আজও বটতলা আলো করিতেছে, সে মূর্তিতে একবার আমার স্কন্ধে আবির্ভূত হও, আমি আশ্‌মানির রূপবর্ণন করি।

 আশ্‌মানির বেণীর শোভা ফণিনীর ন্যায়; ফণিনী সেই তাপে মনে ভাবিল, যদি বেণীর কাছে পরাস্ত হইলাম, তবে আর এ দেহ লোকের কাছে লইয়া বেড়াইবার প্রয়োজনটা কি! আমি গর্ত্তে যাই। এই ভাবিয়া সাপ গর্ত্তের ভিতর গেলেন। ব্রহ্মা দেখিলেন প্রমাদ; সাপ গর্ত্তে গেলেন, মানুষদংশন করে কে? এই ভাবিয়া তিনি সাপকে ল্যাজ ধরিয়া টানিয়া বাহির করিলেন, সাপ বাহিরে আসিয়া, আবার মুখ দেখাইতে হইল, এই ক্ষোভে মাথা কুটিতে লাগিল; মাথা কুটিতে কুটিতে মাথা চেপ্টা হইয়া গেল, সেই অবধি সাপের ফণা হইয়াছে। আশ্‌মানির মুখচন্দ্র অধিক সুন্দর, সুতরাং চন্দ্রদেব উদিত হইতে না পারিয়া, ব্রহ্মার নিকট নালিশ করিলেন। ব্রহ্মা কহিলেন, ভয় নাই, তুমি গিয়া উদিত হও, আজি হইতে স্ত্রীলোকদিগের মুখ আবৃত হইবে; সেই অবধি ঘোমটার সৃষ্টি। নয়ন দুটী যেন খঞ্জন, পাছে পাখী ডানা বাহির করিয়া উড়িয়া পলায়, এইজন্য বিধাতা পল্পবরূপ পিঁজরায় কবাট করিয়া দিয়াছেন। নাসিকা গরুড়ের নাসার ন্যায় মহাবিশাল; দেখিয়া গরুড় আশঙ্কায় বৃক্ষরোহণ করিল, সেই অবধি পক্ষিকুল বৃক্ষের উপরেই থাকে। কারণান্তরে দাড়িম্ব বঙ্গদেশ ছাড়িয়া পাটনা অঞ্চলে পলাইয়া রহিলেন; আর হস্তী কুম্ভ লইয়া ব্রহ্মদেশে পাইলেন; বাকি ছিলেন, ধবলগিরি, তিনি দেখিলেন যে, আমার চুড়া কতই বা উচ্চ, আড়াই ক্রোশ বই তো নয়, এ চূড়া অন্যূন তিন ক্রোশ হইবেক; এই ভাবিতে ভাবিতে ধবলগিরির মাথা গরম হইয়া উঠিল, বরফ ঢালিতে লাগিলেন, তিনি সেই অবধি মাথায় বরফ দিয়া বসিয়া আছেন।

 কপালের লিখন দোষে আশ্‌মানি বিধবা! আশ্‌মানি দিগ্‌গজের কুটীরে আসিয়া দেখিল যে, কুটীরের দ্বার রুদ্ধ, ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। ডাকিল,—

 “ও ঠাকুর!”

 কেউ উত্তর দিল না।

 বলিল,—“ও গোঁসাই।”

 উত্তর নাই।

 “মর বিট্লে কি করিতেছে? ও রসিকরাজ রসোপাধ্যায় প্রভু!”

 উত্তর নাই।

 আশ্‌মানি কুটীরের দ্বারে ছিদ্র দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল, ব্রাহ্মণ আহারে বসিয়াছে, এই জন্য কথা নাই; কথা কহিলে, ব্রাহ্মণের আহার হয় না। আশ্‌মানি ভাবিল, “ইহার আবার নিষ্ঠা; দেখি দেখি, কথা কহিয়া আবার খায় কি না।”

 “বলি ও রসিকরাজ!”.

 উত্তর নাই।

 “ও রসরাজ!”

 উত্তর। “হুম্।”

 বামুন ভাত গালে করিয়া উত্তর দিতেছে, ও ত কথা হ’ল না—এই ভাবিয়া আশ্‌মানি কহিল,—“ও রসমাণিক!”

 উত্তর। “হুম্।”

 আ। বলি কথাই কও না, খেও এর পরে।

 উত্তর। “হু—উ—উম্!”

 আ। বটে, বামুন হইয়া এই কাজ—আজি স্বামীঠাকুরকে বলে দেব, ঘরের ভিতরে কে ও?

 ব্রাহ্মণ সশঙ্কচিত্তে শূন্য ঘরের চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। কেহ নাই দেখিয়া পুনর্ব্বার আহার করিতে লাগিল।

 আশ্‌মানি বলিল, “ও মাগী যে জেতে চাঁড়াল! আমি যে চিনি।”

 দিগজের মুখ শুকাইল। বলিল, “কে চাঁড়াল? ছুঁয়া পড়ে নি ত?”

 আশ্‌মানি আবার কহিল, “ও, আবার খাও যে? কথা কহিয়া আবার খাও?”

 দি। কই কখন কহিলাম?

 আশ্‌মানি খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, “এই তো কহিলে।”

 দি। বটে, বটে, বটে, তবে আর খাওয়া হইল না।

 আ। হাঁ ত; উঠে আমায় দ্বার খুলে দাও।

 আশ্‌মানি ছিদ্র হইতে দেখিতেছিল, ব্রাহ্মণ যথার্থই অন্নত্যাগ করিয়া উঠে। কহিল, “না, না, ও কয়টী ভাত খাইয়া উঠিও।”

 দি। না, আর খাওয়া হইবে না, কথা কহিয়াছি।

 আ। সে কি? না খাও ত আমার মাথা খাও।

 দি। রাধে মাধব। কথা কহিলে কি আর আহার করিতে আছে?

 আ। বটে, তবে আমি চলিলাম; তােমার সঙ্গে আমার অনেক মনের কথা ছিল, কিছুই বলা হইল না। আমি চলিলাম।

 দি। না, না, আশ্‌মান! তুমি রাগ করিও না; আমি এই খাইতেছি।

 ব্রাহ্মণ আবার খাইতে লাগিল; দুই তিন গ্রাস আহার করিবামাত্র আশ্‌মানি কহিল, “উঠ, হইয়াছে; দ্বার খোল,”

 দি। এই কটা ভাত খাই।

 অ। এ যে পেট আর ভরে না; উঠ, নহিলে কথা কহিয়া ভাত খাইয়াছ, বলিয়া দিব।

 দি। আঃ নাও; এই উঠিলাম।

 ব্রাহ্মণ অতি ক্ষুণ্ণমনে অন্নত্যাগ করিয়া, গণ্ডূষ করিয়া উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দিল।