দেওয়ানা/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

 এইরূপ সুখ স্বপ্নঘেরা অবস্থায়, তিন চারি মাস কাটিয়া গেল। এই দীর্ঘকাল মধ্যে, বাহারবানুর কোন সংবাদই নাই। আর সে জন্য নবাব সুজাখাঁ একটুও দুঃখিত নহেন। কেন না, তখন তাঁহার গৃহকক্ষে এক সুরভিমাথা নন্দনের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। আর, সমুজ্জ্বল বেশধারিণী, সদাহাস্যমুখী, রূপসীশ্রেষ্ঠা আনার উন্নিসা, মূর্তিময়ী আনন্দরূপে সুজাখাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত এই নবীন নন্দনে বিরাজ করিতেছে।

 বোধ হয় বিধাতার সৃষ্টিতে অবিচ্ছিন্ন নির্ম্মল প্রেমের উপর যেন একটা অভিশাপ চিরদিনই লাগিয়া আছে। সুজাখাঁ ও আনার উন্নিসা তাঁহাদের পবিত্র দাম্পত্য জীবনটী, বড়ই সুখের সহিত অতিবাহিত করিতেছিলেন। কিন্তু এই দৈব অভিশাপের অলঙ্ঘনীয় ব্যবস্থায়, সেই অনাবিল সুখস্রোতে এবার ভাঁটা পড়িতে আরম্ভ হইল। একটী দিনের সামান্য একটী ঘটনাতেই ভবিষ্যতের একটা মহা বিপদের বীজ রোপিত হইল। শান্তিময় সংসারে অশান্তি ফুটিয়া পড়িল।

 ব্যাপারটী এই। নবাব সুজাখাঁ সে দিন শাহাজাদা দারার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছেন। ইহার কারণ এই, সুলতান দার। শেকো লাহোর হইতে ফিরিয়াই তাঁহাকে কোন জরুরি কাজের জন্য তলব করিয়াছিলেন।

 উজ্জ্বল মধ্যাহ্ণ। আনারউন্নিসা,একথণ্ড চতুষ্কোণ লাল মখ্ মলের উপর, সূচের সূক্ষ্ম কাজ করিতেছিল। এসব সাঁচ্চার শিল্প অতীত যুগের গৌরবের জিনিস। আর এইরূপ সূক্ষ্ম শিল্পে আনারের খুবই একটা নিপুণতা ছিল। সুতরাং মধ্যাহ্নের অবসর কালে সে অনেক সময় সূচীর সাহায্যে তার সংসারের প্রয়োজনীয়, রেশমী বস্ত্রের উপর অনেক রকমের চিকণের কাজ করিত। আবার কখনও বা ওমারখায়েম, সাদী, গুলেস্তাঁ পড়িয়া তাহার দীর্ঘ অবসর কালের বিরক্তির ভাবটা লঘু করিয়া ফেলিত।

 একটী কথা আমরা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। আনার উন্নিসা, তাহার বাল্য সঙ্গিনী জুমেলিকে সঙ্গে লইয়াই, স্বামী গৃহে অসিয়াছিল। জুমেলিও এই নির্জ্জন বাড়ীতে, তাহার প্রিয় সঙ্গিনী রূপেই ছিল।

 সে দিন কে জানে কি কারণে, আনার তাহার অত্যন্ত শিল্প কার্য্যেও তেমন মনোযোগ দিতে পারিতেছিল না। তাহার মন যেন পদ্মপত্রের উপর জলের মত চঞ্চল। কিন্তু সহসা কেন যে এরূপ হইল, তাহা সে ঠিক করিতে পারিল না।

 ওমারখায়েমের কবিতাগুলি সব চেয়ে তার ভাল লাগিত। সে তাহার একটী কবিতা ধীরে ধীরে আবৃত্তি করিল।

 ঠিক এই সময়ে জুমেলি সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল—“এক অবগুণ্ঠিতা ওমরাহ-পত্নী, তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন!”

 আনার সবিস্ময়ে বলিল— “ওমরাহ পত্নী! কই এমন কোন ওমরাহ পত্নীর সঙ্গে ত আমার আলাপ পরিচয় হয় নাই! কে তিনি? কেমন করিয়া জানিলি যে তিনি ওমরাহ পত্নী?”

 জুমেলি। তিনি নিজেই বলিলেন।

 আনার। তাঁহার মুখের চেহারা কিরূপ?

 জুমেলি। মুখ দেখিতে পাই নাই। বলিলাম ত তিনি অবগুণ্ঠিতা।

 আনারউন্নিসা ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না—কে—এ? সুতরাং বলিল—“তাঁহাকে সমাদরে এখানে সঙ্গে করিয়া লইয়া আয়।”

 পরক্ষণেই জুমেলি সত্য সত্যই এক অবগুণ্ঠিতা রমণীকে আনারের কক্ষে প্রবেশ করাইয়া দিয়া, তাহার নিজের কাজে চলিয়া গেল।

 আনারউন্নিসা, সৌজন্যতার খাতিরে, তাহাকে সমাদর করিয়া, এক সোফার উপর বসাইয়া বলিল—“বড়ই সুখী হইলাম, যে আপনি দয়া করিয়া আমার এ গরীব-খানায় পদার্পণ করিয়াছেন। আপনার পরিচয় পাইলে খুবই সুখী হইব।”

 সেই অবগুণ্ঠিতা রমণী অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া, সহসা উঠিয়া দাঁড়াইয়া, সহাস্য মুখে বলিল—“আমায় চিনিতে পারিতেছ কি আনার বেগম?”

 বিস্ময়স্তিমিত নেত্রে আনারউন্নিসা দেখিল, বাহারবানু তাহাকে বলিতেছে—“আমায় চিনিতে পারিতেছ কি, আনার বেগম?”

 আনারউন্নিসা, ত্বরিত গতিতে আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—“কি প্রয়োজনে এখানে আসিয়াছ তুমি?”

 বাহারবানু বিদ্রুপপূর্ণ স্বরে বলিল— “অত ব্যস্ত হইও না নবাব সুজাবেগের আদরিণী পত্নী! যাহা বলিতে আসিয়াছি, তাহাতে কেবল যে আমার স্বার্থ ই জড়িত—তাহা নয় আমার কথাগুলি না শুনিলে, হয়ত তোমার নিজের স্বার্থে আঘাত লাগিতে পারে। আর এ টুকুও আমি তোমায় বলিতে পারি, যে সে আঘাতের শক্তিটা সরাসর মুখ বুজিয়া সহিয়া যাওয়া তোমার পক্ষে খুবই কষ্টকর হইবে।”

 এ যে অদ্ভূত রকমের ভয় প্রদর্শন! বাহারবানু যেভাবে কথা কহিতেছিল—সেটা যে সম্পূর্ণ উপেক্ষার ভাব! সেই গৃহের সর্ব্বক্ষমতাময়ী গৃহস্বামিনা সে। একাধিশ্বরী সে! সামান্য এক কলঙ্কিতা রমণী যে এতটা স্বাধীনতা লইয়া তাহার সঙ্গে কথা কহে—এত স্পর্দ্ধা তার?

 আনারউন্নিসার আত্মমর্য্যাদা জ্ঞানের প্রচ্ছন্ন শক্তি তাহার হৃদয়ে সাহস সঞ্চার করিল। সে বিরক্তির সহিত বলিল—“আমি তোমার কোন কথাই শুনিতে চাই না। তোমার মত স্ত্রীলোকের সঙ্গে, কোন কথাই আমার থাকিতে পারে না। তোমার প্রকৃত পরিচয় তুমি সে দিন না দিলেও, তার পরক্ষণেই আমি তোমার পরিচয় পাইয়াছি। এখন আমাদের যতটুকু কথাবার্তা হইল, তাহাই যথেষ্ট। তুমি অতি অশিষ্ট ভাবে আমার সঙ্গে ব্যবহার করিয়াছ। কিন্তু তাহাও আমি উপেক্ষার চক্ষে দেখিতে প্রস্তুত। তুমি এখনি এখান হইতে চলিয়া যাও। আমার এ কক্ষ তোমার অপবিত্র নিশ্বাসে কলুসিত করিও না।”

 বাহারবানু, বিদ্রুপপূর্ণ স্বরে বলিল— “চলিয়া যাইব? কেন? নবাব সুজাবেগের উপর কি আমার কোন অধিকারই নাই? দুই তিন মাসের জন্য আমি আমার ন্যায্য অধিকার ছাড়িয়া একটু দূরে ছিলাম, তাহাতেই তুমি এতটা আধিপত্য সঞ্চয় করিয়াছ? না—আনারউন্নিসা! বাহারবানু তাহার জীবন থাকিতে তোমাকে নবাব সুজাখাঁর উপর একাধিপত্য করিতে দিবে না—তোমার এ স্পর্দ্ধা, এ দর্প সহ করিবে না।

 আনারউন্নিসা, বাহারবানুর এইরূপ অশিষ্টতাপূর্ণ ভয় প্রদর্শনে বড়ই ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। সে রুষ্ট স্বরে বলিল “তুমি এখনই এস্থান হইতে চলিয়া যাও। না গেলে আমার ভৃত্যেরা তোমাকে অপমান করিয়া এখান হইতে তাড়াইয়া দিবে।

 বাহার। সাধ্য কি তোমার ভৃত্যদের—যে তাহারা আমার সম্মুখে অগ্রসর হয়! এক দিন যখন আমি নবাব সুজাখাঁর হৃদয়ের পূর্ণ অধিশ্বরী ছিলাম—তখন তোমার এই সব ভৃত্য আমার অনেক নিমক খাইয়াছে। ভৃত্যের প্রয়োজন কি? তোমার স্বামী নবাব সুজাখাঁকে না হয় একবার সংবাদ দাও। দেখি, তিনি নিজেই আমাকে তাড়াইয়া দিতে সক্ষম হন কি না?

 ঠিক এই সময়ে ঘটনাচক্র চালিত হইয়া, নবাব সুজাখাঁ সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ মাত্রেই যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল। নির্জ্জন পথ-বাহী পথিক, সহসা কোন উন্নতফণা বিষধর সম্মুখে দেখিলে যেমন আতঙ্কে চমকিয়া দূরে সরিয়া দাঁড়ায়, নবাব সুজাখাঁ তাঁহার পত্নীর নিভৃত কক্ষ মধ্যে, এই কলঙ্কিতা বাহারবানুকে দেখিয়া, ততোধিক সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িলেন।

 কিন্তু তাঁহার ক্রোধ সংবরণের একটা শক্তি ছিল। আভিজাত্য গৌরব ও মর্য্যাদার একটা দর্পও ছিল। তাঁহার শুদ্ধাত্তঃপুর কক্ষ মধ্যে, তাঁহার প্রিয়তমা পত্নীর বিশ্রামাগারে, বাহারবানুর মত কলঙ্কিতার উপস্থিতি ব্যাপারটা, তাঁহার হৃদয়ে বড়ই একটা আঘাত করিল। তিনি বিরক্তিসূচক স্বরে, বাহারের দিকে চাহিয়া বলিলেন—“কি প্রয়োজনে এখানে আসিলে বাহারবানু?”

 বাহারবানু, নবাবকে একটী সেলাম করিয়া শ্লেষপূর্ণ মৃদু হাস্যের সহিত বলিল—“জনাবের চরণ দর্শন করিব বলিয়া। এই তিন মাস দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই, এজন্য আমার দিল্‌টা বড়ই বেতমিজ হইয়া পড়িয়াছে। তাহা ছাড়া জনাবালির সঙ্গে গোপনে দুই চারিটী কথা কহিব বলিয়াই এখানে আসিয়াছি।

 নবাব সুজাবেগ, একবার মাত্র আনারউন্নিসার মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন—বাহারের এই ধৃষ্টতাসঞ্জাত অপমানে আনারউন্নিসা খুবই ক্রুদ্ধ হইয়াছে। তাঁহার আরক্তিম গণ্ড-দেশের ক্রোধজমিত লাল আভা তখনও সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত হয় নাই। নাসারন্ধ, স্ফীত, চক্ষে বিদ্যুৎ রেখা—মুখেও যেন একটা বিজাতীয় ঘৃণার ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে।

 নবাব সুজাবেগ, বাহারবানুর দিকে চাহিয়া, দৃঢ় স্বরে বলিলেন,—“তোমার যদি কোন বিশেষ গোপনীয় কথাই থাকে, তুমি আমার সঙ্গে এস। এ কক্ষে আসা তোমার খুব অন্যায় কাজ হইয়াছে।”

 বাহারবানু এ কথায় মর্ম্মে মর্ম্মে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল—“কেবল আপনাকে নয় আপনার নূতন বেগম এই আনারউন্নিসাকেও আমার দুই চারিটা কথা বলিবার ছিল। কিন্তু আপনি আসিয়া পড়ায় বলা হইল না। যাই হোক,—এই বেগমের কক্ষে প্রবেশ করিয়া আমাকে আজ যতটা অপমানিত হইতে হইয়াছে, তাহাই বোধ হয়, জনাবের এক সময়ের এই আদরিণী বাহারবানুর পক্ষে যথেষ্ট! তবে এই অপমানের প্রতিশোধের জমা খরচ, একদিন সুবিধা মত আপনার সঙ্গেই হইবে।”

 সুজাবেগ বাহারবানুকে আর বেশী কিছু বলিবার অবসর না দিয়া ও তাহাকে পশ্চাৎবর্ত্তী হইতে ইঙ্গিত পূর্ণ সংকেত করিয়া, সেই কক্ষ ত্যাগ করিলেন। বাহারও ক্ষিপ্রগতিতে তাঁহার অনুসরণ করিল। প্রকারান্তরে সে দিন বাহারবানুরই জিত হইল। সে যে কথাটা আনারউন্নিসাকে শুনাইবার উপযুক্ত অবসর অপেক্ষা করিতেছিল, সুজাখাঁ সহসা সেই কক্ষ মধ্যে উপস্থিত হইয়া, তাঁহার সেই বক্র অবসর পথকে সরল করিয়া দিলেন।

 আনার বুঝিল—যে স্বামীকে সে তাহার জীবনের যাহা কিছু প্রিয়, সব দিয়া ভাল বাসিয়াছে—তাহার সেই স্বামীর উপর এই শয়তানীর খুবই বেশী আধিপত্য। যে স্বামীর অতীত জীবনের, কলঙ্ককাহিনীর কথাগুলি সে চেষ্টা করিয়া ভুলিতেছিল এই সর্ব্বনাশিনী কলঙ্কিনী বাহারবানু এক তীব্র ফুৎকারে তাহা জ্বালাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।