দেওয়ানা/বিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

বিংশ পরিচ্ছেদ।

 এমন সময়ে একজন দ্রুত পদে সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়া আনারের শয্যাপার্শ্বে বসিয়া বলিল— “ভয় কি আনার উন্নিসা? এই এই যে আমি আসিয়াছি।”

 আনার তাড়াতাড়ি শয্যা হইতে উঠিয়া বসিয়াই, সবিস্ময়ে দেখিল নবাব তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া বলিতেছেন—“ভয় কি আনার?”

 এত রাত্রে নবাবকে তাহায় শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হইতে দেখিয়া আনারউন্নিসা একটু বিস্মিত হইয়া বলিল—“তুমি! প্রাণাধিক আমার! আঃ! আমার সকল ভয় গেল।”

 আনার শয্যা হইতে উঠিয়া বসিয়া আনন্দভরে স্বামীয় গলা জড়াইয়া ধরিল। বলিল—“আসিয়াছ ভালই করিয়াছ। মেঘ-বৃষ্টি-বিদ্যুৎ বজ্রনাদ, আর তার সঙ্গে কত দুশ্চিন্তা, আমায় বড়ই ভয় দেখাইতে ছিল। আমি যে খোদাকে ভুলিয়া তোমাকেই স্মরণ করিতেছিলাম।”

 আনার উন্নিসা দেখিল, বৃষ্টির জলে নবাবের পরিধেয় বস্ত্র স্থানে স্থানে ভিজিয়া গিয়াছে। সে গুলি ত্বরিতে খুলিয়া লইয়া, সে তখনই শুষ্ক বস্ত্র আনিল। নবাব বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া একটু সুস্থ হইলে, আনার বলিল,—“আমার খাবার চাপা আছে কিছু খাইবে কি? সরবৎ বা কফি তৈয়ারী করিব?”

 নবাব সুজা খাঁ বলিলেন,—“না কিছুরই প্রয়োজন নাই। তুমি এখন নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা যাও। কাল প্রভাতে তোমাকে সকল কথা বলিব। আজ আমি বড়ই শ্রান্ত।”

 আনার স্বামীর এ ব্যবস্থার উপর কোন কথা কহিতে পারিল না। তাহার দুশ্চিন্তাময়ী রজনী, সুখ নিদ্রায় কাটিয়া গেল।

 দিনের ঘটনার পর বিচার করিয়া লোকে বলে, আজ আমার সু বা কু-প্রভাত। কথাটা খুব সত্য। কিন্তু আমরা বলিতে পারি পর দিন আনারউন্নিসা ও নবাব সুজাবেগ উভয়ের পক্ষেরই কুপ্রভাত। কেন তাহাদের প্রকাশ পাইবে।

 সুজা খাঁ বেলা এক প্রহরের পর, নিজের কক্ষ মধ্যে বসিয়া কতকগুলি কাগজ পত্র দেখিতেছিলেন। এমন সময়ে এক বান্দা আসিয়া, তাঁহার হাতে একখানি পত্র দিল।

 পত্রের লেখা দেখিয়াই সুজাবেগ বুঝিলেন, পত্রখানি বাহাররানুর নিকট হইতে আসিয়াছে। বান্দাকে নেত্র ইঙ্গিতে বিদায় করিয়া দিয়া, নবাব সুজাবেগ সেই পত্রখানি সমনোযোগে পাঠ করিলেন। পাঠান্তে, তাঁহার মুখখানি খুবই মলিন হইয়া পড়িল।

 সহসা দ্বার সন্নিকটে তিনি যেন কাহারও সাবধান বিন্যস্ত পাদবিক্ষেপ-শব্দ শুনিতে পাইলেন। বুঝিলেন, তাঁহার পত্নী আনারউন্নিসা তাঁহার কক্ষের দিকে আসিতেছে। নবাব সাহেব, তাঁহার বিশ্রাম কক্ষেই বসিয়াছিলেন। সুতরাং তখনই ব্যস্তভাবে সেই পত্রখানি লুকাইয়া ফেলিলেন।

 আনার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া ধীরে ধীরে স্বামীর পার্শ্বে বসিয়া স্মিতমুখে বলিল,— “আজ কেমন আছ তুমি নবাব?”

 নবাব সুজ খাঁ, মলিন হাস্যের সহিত আনারের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন,—“তুমি ভাল থাকিলে, তোমার হাসিমুখ দেখিলেই আমার যে অপার আনন্দ আনারউন্নিসা!”

 আনার। হইতে পারে! কিন্তু তবুও বুঝিতেছি, আজ তোমার তরিয়ৎ বা মন কিছুই যেন ভাল নয়?

 সুজা। কেমন করিয়া জানিলে?

 আনার। কাল সারারাত তুমি ভাল করিয়া নিদ্রা যাও নাই। তোমার নিদ্রা না আসা পর্য্যন্ত, আমি দীর্ঘক্ষণ জাগিয়া থাকিয়া তোমাকে ব্যজন করিয়াছি। আর এই পবিত্র স্নিগ্ধ প্রভাতে, তোমার হাস্য বিহীন বিরস মলিন মুখ আমার স্পষ্টই বুঝাইয়া দিতেছে। যেন কি একটা দারুণ দুশ্চিন্তা—”

 সুজাবেগ একটী মর্ম্মভেদী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “আনার! আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে।”

 আনার। সে কি? কি বলিতেছ তুমি?

 সুজাবেগ। আমার পাঁচলক্ষ টাকার জহরত এক মহাজনের গদীতে গচ্ছিত ছিল। তাহাই আনিতে আজমীরে গিয়াছিলাম। শুনিলাম, যে দুই মাস পূর্ব্বে তাহা চোরে লইয়া গিয়াছে। যার কাছে জমা ছিল, সে লোকটা ভয়ে নিরাশায় আত্মহত্যা করিয়াছে। জহরত গুলির কোন পাত্তাই নাই। গদী ও উঠিয়া গিয়াছে। আমার বর্ত্তমান বড়ই অন্ধকারময়।

 আনার। গেলই বা পাঁচলক্ষ টাকা। তুমি বাঁচিয়া থাকিলে টাকার অভাব কি?

 সুজাবেগ। যে কথা তোমায় সেদিন বলি নাই, তাহা আজ বলিব। আমি বড়ই বিপন্ন। শাহজাদা দারাকে আমি ছয় লক্ষ টাকা দিতে প্রতিশ্রুত আছি। দিতে না পারিলে আমার জীবন পর্য্যন্ত বিপন্ন!

 আনার। ব্যাপার কি?

 “সবই বলিতেছি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিস্থলে থাকিয়া এখন আর গোপন করিলে চলিবে না।” এই কথা গুলি বলিয়া নবাব সুজাবেগ কক্ষের বাহিরে গিয়া একবার চারিদিকে দেখিয়া আসিলেন। দেখিলেন, কোন বান্দা বাঁদিই সেখানে নাই। তখন ধীরে ধীরে কক্ষের দরজাটী বন্ধ করিয়া দিয়া, সেই গুপ্ত কক্ষের মন্ত্রণা ব্যাপার সম্বন্ধে সকল কথাই আনারকে প্রকাশ করিয়া বলিলেন।

 নবাবের কথা শুনিয়া আনার ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। তাহার সর্ব্ব শরীর কাঁপিতে লাগিল। সেই ভয় চকিত ভাবটা সামলাইয়া লইয়া আনার মনে মনে ভাবিল, — “এ সংকট সময়ে সাহস হারাইলে চলিবে না। পত্নীর গভীর কর্ত্তব্য পালনের যদি কোন উপযুক্ত অবসর আমার ঘটিয়া থাকে—তাহা এই।”

 এইরূপ ভাবিয়া আনার অপেক্ষাকৃত প্রসন্নমুখে স্বামীকে বলিল, “তুমিই আমার রত্মালঙ্কার, তুমি আমার সর্ব্বস্ব। তুমি বজায় থাকিলে আমার কিসের ভাবনা। সুখে দিন কাটিতেছিল, না হয় একটু কষ্টে কাটিবে। কিন্তু সে কষ্টেও আমার জীবনে—সুখ। কেন না তুমি শাহজাদার নিকট প্রতিশ্রুতিমুক্ত হইবে। তুমি একটু অপেক্ষা কর। আমি একটা কাজ সারিয়া আসিতেছি।”

 এই কথা বলিয়া আনার দ্রুতপদে নিজের কক্ষে চলিয়া গেল। রত্নালঙ্কারপূর্ণ ক্ষুদ্র পেটিকা একটী বাহির করিয়া, নিজের গায়ের সমস্ত অলঙ্কার গুলি খুলিয়া ক্ষিপ্রহস্তে তাহা সাজাইয়া ফেলিল। আর নবাব সুজাখাঁর জন্মতিথির দিনে সে যে বহুমূল্য হার রুখিনা বিবির নিকট উপহার পাইয়াছিল, ও যে লক্ষটাকা মূল্যের হীরক হার, বিবাহের পর নবাব সুজাখাঁ তাহাকে প্রেমোপহাররূপে দিয়াছিলেন তাহাও লইয়া নবাব সুজা বেগের সম্মুখে ধরিয়া দিল।

 নবাব সুজাবেগ কিরৎক্ষণ বিস্মিতনেত্রে আনারের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন—“এ সব রত্নালঙ্কার লইয়া আমি কি করিব আনারউন্নিসা?”

 আনার উন্নিসা। এগুলি বিক্রয় করিয়া তুমি শাহাজাদার নিকট ঋণমুক্ত হও, প্রতিশ্রুতি মুক্ত হও। আমার অলঙ্কার পরা ত তোমার চিত্ত তুষ্টির জন্য। আর এ সব অলঙ্কার তোমারই ত দেওয়া। সময় হয়, আবার করিয়া দিবে। নবাব! কখনও এ বাঁদী তোমার কাছে মুখ ফুটিয়া কোন কিছু প্রার্থনা করে নাই। আজ তোমার কাছে এই সামান্য প্রার্থনা করিতেছে। আমার এ ক্ষুদ্র আশা পূর্ণ কর।” জনাব! মেহের বান! এ বাঁদীর মুখের দিকে চাও।”

 এই কথা বলিয়া আনার উন্নিসা, সুজাখাঁর পদপ্রান্তে বসিয়া পড়িল। তাহার গণ্ডদেশে অশ্রুধারা। নবাব সুজাখাঁ সে করুণ দৃশ্য সহ্য করিতে পারিলেন না। আনারকে বক্ষে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন—“আনার উন্নিসা! সত্যই তুমি দেবীরূপিণী! নারীর হৃদয়ের নীচ ভাবের মধ্যেই আমার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়াছে। এই নারী জাতিকে বিধাতা যে কি মহত্ত্বময় উপদানে গড়িয়াছেন, তাহা আজ দেখিবার অবসর পাইলাম। আমি তোমার নরাধম স্বামী। তোমার মত এক বহুমূল্য রত্ন খোদা আমায় দিয়াছেন। সে রত্ন আমি স্বেচ্ছায় পদদলিত করিয়াছি। জীবনাধিকে! প্রিয়তমে! তোমার এ ঋণ কি কখনও শোধ করিতে পারিব? ছিঃ ছঃ! চোখের জল ফেলিও না। তোমার প্রার্থনাই আমি পূর্ণ করিলাম। এই দুনিয়ায় শয়তানের ছলনায় পড়িয়া, অনেক রকমে নাম কিনিয়াছি। আর তার সঙ্গে এ কীর্ত্তিটাও থাকিয়া যাউক, যে চরিত্রভ্রষ্ট, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন নবাব সুজাখাঁ, দত্তাপহারী রূপে, তাহার পত্নীর স্ত্রীধন অপহরণ করিয়া নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিয়াছে। নিজের জঘন্য জীবন বাঁচাইয়াছে।'

 প্রকাশ্যে একথা বলিলেও, তাঁহার মনের ইচ্ছা অন্যরূপ। তিনি মনে মনে সংকল্প করিলেন—“আমার বিষয় সম্পত্তি বন্ধক দিয়াও যদি কোন উপায়ে এই ছয়লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিতে পারি, তাহা হইলে এ অলঙ্কারের এক খানিও আমি স্পর্শ করিব না।”

 এইরূপ সংকল্প স্থির করিয়া নবাব সুজাখাঁ বলিলেন—“ভাল তাহাই হইবে। তুমি এখন তোমার সংসার ধর্ম্ম কর গে।”

 আনার উন্নিসা প্রসন্ন মুখে, ভয় ভাবনা রহিত হৃদয়ে, স্বামীর কক্ষ ত্যাগ করিল।