বিষয়বস্তুতে চলুন

দেবী রাবিয়া

উইকিসংকলন থেকে
দেবী রাবিয়া

দেবী রাবিয়া।


মােসাম্মৎ রাহাতুন্নেছা খাতুন

প্রণীত

প্রথম সংস্করণ।

শ্রাবণ, ১৩২১।

All Rights Reserved.

মূল্য —॥০ আনা।
বাঁধাই —৸৹ আনা।

প্রকাশক—
এম, মােবারক আলী।
৩নং কলেজষ্ট্রীট্‌, মকদুমী লাইব্রেরী;
কলিকাতা।


Printed by S. A. Gunny
At the Alexandra Steam Machine Press, DACCA.


এজেন্ট—

এস, এণ্ড কোং
গফরগাঁও; ময়মনসিংহ।

আলবার্ট লাইব্রেরী,
নওয়াবপুর; ঢাকা।

দেবী রাবিয়া।

→☆←

 ফুল হীন, ফল হীন―জল হীন, ছায়া হীন আরব দেশ। সে দেশে নাই বসন্ত, ডাকেনা পাখী, নাচেনা ময়ূর ময়ুরী, তাই ফুটেনা ফুল;―কেবলি রোদ, কেবলি গ্রীষ্ম। সেখানে সহজে জল মিলে না, শস্যাদিও জন্মে না।

 আরব দেশের অধিবাসিগণের কাহারও কোন বিশেষ ধন সম্পত্তি নাই। থাকিবার মধ্যে আছে কেবল তাহাদের মরুভূমি পারাপারের একমাত্র সম্বল উট, আর দু’একটা খাজুর খোর্ম্মার বাগান। সে দেশের লোক ঘরের বাহির হইলেই রোদে পুরে, কিন্তু বৃষ্টির মুখ ক্বচিতই দেখিতে পায়।

 তথায় পাইবার মধ্যে পাওয়া যায় কূপের জল, আর খর্জ্জুর ও খোর্ম্মা ফল। সে দেশবাসীরা বাণিজ্য ব্যবসায় চালাইয়া মাংস রুটী সংগ্রহ করিয়া জীবন ধারণ করে। তাহারা শক্তি সাহসে মহাবীর, এবং কষ্ট সহিষ্ণুতার অবতার। তাহাদের হৃদয়ে ধর্ম ও কটিতে থাকে খর্জ্জুর খোর্ম্মা। এই খোর্ম্মার বলে ও ধর্ম্মের বলে বলীয়ান হইয়া তাহারা মরুতরী উষ্ট্র লইয়া নানা দিগ্‌দেশে চলিয়া যায়। উট তাহাদের পিপাসার সময় জল অন্বেষণ করিয়া দেয়, এবং প্রচণ্ড বাতাস যখন মরুভূমির বালুকারাশি উড়াইয়া উড়াইয়া স্তূপ করিয়া তাহাদের জীবনের খেলা শেষ করিয়া দিতে ভীষণ উন্মত্ত হয়, এই বিপদে তখন উষ্ট্রই তাহাদিগকে রক্ষা করে।

 আমাদের দেশের ন্যায় নদী তড়াগস্রোতস্বিনী বিধৌতা, কুঞ্জবন পরিশোভিত বঙ্গসুন্দরীর হাস্যময়ী মূর্ত্তি আরব দেশে নাই। সেখানে আছে গিরিকন্দর পরিশোভমানা, খর্জ্জুরখোর্ম্মা আভরণা বিশুষ্ক প্রকৃতি। বঙ্গের স্বভাব শোভা যেমন সকলকেই আত্মহারা করিয়া দেয়; আরব দেশের জড় প্রকৃতিও কিন্তু আপনার উচ্ছ্বাস বহুল, শান্তি-ছায়াবিরল বক্ষে পৃথিবীর সর্ব্বস্ব আঁকরিয়া ধরিয়া থাকিতে চায়।

 বাহ্য প্রকৃতির মধ্যে যাহা দেখিতে পাওয়া যায়, মানব প্রকৃতির মধ্যেও যেন তাহারই ছবি অবিকল বর্ত্তমান। বঙ্গরমণী যেমন উদাস নয়না, শ্লথ-বেশা বিরহিণী, কিন্তু আরব রমণী প্রফুল্ল নয়না, উৎসব-বেশা আনন্দময়ী।

 এই শস্য শ্যামলা বঞ্চিত নদ নদী হীনা আরবে―বিধাতার অভিশপ্ত দেশের বসরা নগরীর এক ক্ষুদ্র পল্লীতে দরিদ্র ইস্‌মাইলের গৃহে রাবিয়া জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি জননী হারা হইয়া ছিলেন বলিয়া তাঁহার বৃদ্ধ পিতা ইস্‌মাইলই তাঁহাকে লালন পালন করিয়া মানুষ করিয়াছিলেন।

 ইস্‌মাইলের ভাই বোন কেহ ছিল না, সুতরাং স্ত্রী মারা গেলে তাঁহার ক্ষুদ্র সংসার দেখিবার আর কেহ রহিল না। তিনি কন্যা লইয়া মহাবিপদে পড়িলেন। বসিয়া খাইবার মত ঘরে কিছু সংস্থানও ছিল না, আবার রাবিয়াকে ঘরে একাকিনী ফেলিয়া যাইবারও উপায় ছিল না। কিন্তু এরূপে কয়দিন কাটিবে, উদরতো অত বুঝে না। সুতরাং উপায় না দেখিয়া ইস্‌মাইল জীবিকা উপার্জ্জনের জন্য বাহির হইবার সঙ্কল্প করিলেন।

 গরীব ইস্‌মাইল শুষ্ক রুটী প্রস্তুত করিয়া কন্যা পিতায় আহার করিতেন, আর কয় খণ্ড দিনের জন্য রাখিয়া দিতেন। রাত্রিকালে কন্যাকে বুকে লইয়া ইস্‌মাইল তাহার মায়ের কথা ভুলাইয়া রাখিতেন। রজনী প্রভাত হইলে হতভাগ্য ইস্‌মাইল রাত্রির তৈয়ারী রুটীসহ রাবিয়াকে এক প্রতিবেশিনীর গৃহে রাখিয়া কার্য্যস্থলে গমন করিতেন। রাবিয়া সেই কয় টুক্‌রা রুটী আহার করিয়া পিতার আগমন আশায় পথ পানে চাহিয়া থাকিতেন।

 এইরূপ অবস্থায় সাত বৎসর কাটিয়া গেল। অতঃপর রাবিয়া প্রতিবেশিনীর আশ্রয় ত্যাগ করিয়া পিতার কুটীরেই একাকিনী বসিয়া থাকিতেন; আর শ্রমকাতর পিতার পিপাসা দূরীভূত করিবার ইচ্ছায় দুর্লভ পানীয় জল সংগ্রহ করিয়া রাখিতেন। শ্রান্ত ইস্‌মাইল গৃহে ফিরিয়া রাবিয়ার সংগৃহীত জল পান করিয়া প্রাণ শীতল করিতেন।

 রাবিয়ার বাল্য জীবন এইরূপ কষ্টে অতিবাহিত হইয়াছিল বলিয়া তিনি অল্প বয়সেই আত্ম-নির্ভর, সেবা-পরায়ণ, কর্ম্মঠ ও শান্ত গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। দশ বৎসর বয়সে রাবিয়া মিতভাষিনী ও মিতব্যয়ী এবং পরিশ্রমী হইয়া উঠায় তাঁহার পিতার জীর্ণকুটীর খানিকে নিপুণ গৃহিনীর ন্যায় সাজাইয়া গুছাইয়া তুলিলেন।

 সকল দেশেই ভাল মন্দ লোক আছে―সাধু সন্যাসী ও চোর ডাকাত আছে। আরব দেশে এক জাতি ভ্রমণশীল লোক বেদুইন নামে অভিহিত। ইহারা ছাগ, মেষ, উট-পাখী, বন্য-গর্দ্দভ প্রভৃতি পশু পালন করে, আর পর্ব্বতে পর্ব্বতে―মরু প্রান্তরে প্রান্তরে ঘুরিয়া বেড়ায়। ইহারা সুবিধা পাইলে পথিক, বণিকদিগের সর্ব্বস্ব লুটিয়া লয়, এবং কখন কখন দরিদ্র পল্লীতে পতিত হইয়া পল্লীবাসীদের সর্বনাশ করিয়া চলিয়া যায়। এই জন্য আরব দেশে, পথিক এবং বণিক যাত্রিগণও দলবদ্ধ হইয়া চলে।

 এই সব বেদুইন জাতি সময় সময় রাবিয়ার বাসপল্লী আক্রমণ করিত, আর সুবিধা মত স্ত্রী পুরুষ যাহাকে পাইত, তাহাকেই ধরিয়া লইয়া দাস দাসীরূপে দূরদেশে বিক্রয় করিত; কিম্বা নিজেদের কাজ কর্ম্ম করাইত। রাবিয়া যখন দশ বৎসরের, তখন একদিন হঠাৎ এই দস্যুদল তাহাদের পল্লী আক্রমণ করিয়া অনেক লোকের সঙ্গে ইস্‌মাইলকেও লইয়া প্রস্থান করিল।

 মাতৃহীন রাবিয়া পিতৃহীন হইয়া অকূল সাগরে ভাসিলেন। আপন বলিবার লোক তাঁহার পৃথিবীতে রহিল না, অতবড় সংসারে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবার কেহ রহিল না। রাবিয়ার পিতা ইস্‌মাইল ছিলেন একা, আজ রাবিয়াও হইলেন একাকিনী।

 অনাথিনী শোকাকুলা রাবিয়া আকাশ পাতাল ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। শরীর খাটাইয়া পরিশ্রম করিয়া এক টুক্‌রা রুটীর সংস্থান করিবার মত তাঁহার বয়স হয় নাই। আশ্রয় হীন রাবিয়া চিন্তা করিয়া কোনই উপায় দেখিতে না পাইয়া পৃথিবীময় অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। বিশ্বদাহী আরব প্রকৃতির তপ্ত বায়ু শন্ শন্ শব্দে বহিয়া বহিয়া বালিকার দুঃখবিধুরা আত্মা দগ্ধ করিয়া যাইতে লাগিল। রাবিয়া অকূল সাগরে ভাসিয়া মাথা স্থির রাখিতে পারিলেন না,―তাঁহার পদতল হইতে যেন মৃত্তিকা সরিয়া যাইতে লাগিল, আকাশ যেন ভীষণ গর্জ্জন করিয়া তাঁহার মস্তকে পড়িতে লাগিল। বালিকা তখন কাষ্ঠ পুত্তলিকার ন্যায় বিকল।

 আরব দেশের আতিথেয়তা বিশ্ববিখ্যাত। আরবগণ সহজেই যেমন উত্তেজিত হয়, আবার তেমনই দুঃখীর দুঃখে, বিপদ গ্রস্তের বিপদে অতি সহজেই তাহাদের হৃদয় ফুলের মত কোমল হইয়া দয়া পরবশ হয়। সেই পল্লীর সকল গৃহস্থই দরিদ্র। কিন্তু দরিদ্র হইলেও তাহাদের দয়া প্রবণ হৃদয় অনাথিনীর একটা উপায় না করিয়া স্থির থাকিতে পারে না। তখন পল্লীবাসিগণ মিলিত হইয়া ব্যবস্থা করিলেন,―“আমাদের কাহারও অবস্থা যখন স্বচ্ছল নয়, তখন রাবিয়া এক এক দিন আমাদের এক এক বাড়ী অতিথি হইবে।” এই ভাবে রাবিয়ার দিন চলিতে লাগিল।

 পল্লীবাসী গৃহস্থদের কৃপায় রাবিয়ার অন্ন চিন্তা দূর হইল বটে, কিন্তু তাঁহার মনের চিন্তা কিছুতেই কমিল না। সকলেই তাঁহাকে প্রতিপালন করিতে প্রতিশ্রুত হইলেও তিনি বিনা পরিশ্রমে কাহারও অন্ন স্পর্শ করিতেন না। সমস্ত দিন কোন গৃহস্থের কাজ কর্ম্ম করিয়া আহার করিতেন, আর সন্ধ্যাকালে স্নেহপূর্ণ পিতা মাতার শীতল কোলের মত শান্ত কুটীর খানিতে প্রবেশ করিয়া শৈশবস্মৃতি স্মরণ করিয়া অশ্রুপাত করিতেন। পল্লীর কোন কোন বৃদ্ধা কৃপা বশতঃ রজনীতে রাবিয়ার সঙ্গে শয়ন করিতেন; আর চির দুঃখিনী বালিকা বিছানায় পড়িয়া পিতার জন্য রোদন করিয়া করিয়া তপ্তশ্বাস ত্যাগ করিতেন। কিন্তু সে সুদীর্ঘ তপ্তশ্বাস হতভাগিনী রাবিয়ার বুকের বিষাদময় বেদনার লাঘব করিতে পারিত না।

 এইরূপ দুঃখ বেদনায় দিন কাটিতে লাগিল। দিন যায় রাত্রি আসে, আবার রাত্রি যায় দিন আসে। কত পিতৃবৎসলার পিতা বিদেশ হইতে গৃহে আসিতেছে, কত ব্যবসায়ী ব্যক্তি বাণিজ্যে লাভ করিয়া আসিয়া স্নেহের পুত্তলি কন্যাকে যত্নে কোলে লইয়া আদর করিতেছে। কিন্তু দিনের পর কত দিন, মাসের পর কত মাস চলিয়া যাইতেছে, তবুও তো আশ্রয়হীনা রাবিয়ার পিতা ফিরিয়া আসিল না; একটি ছোট্ট স্নেহের কথা বলিয়াও তাহার নয়নের অশ্রু মুছাইয়া দিল না! হায়! কন্যাগত জীবন, স্নেহ পরায়ণ ইস্‌মাইল কি এখন এতই নিষ্ঠুর?

 দণ্ড দণ্ড পল পল করিয়া জন্ম দুঃখিনী রাবিয়ার নয়নের জলের উপর দিয়া দীর্ঘ একটি বৎসর চলিয়া গেল, তবুও তো রাবিয়ার দীর্ঘ নিশ্বাস ফুরায় না, নয়নের অশ্রু কমে না। যখন রাবিয়া কোন গৃহস্থের কর্ম্মে নিযুক্ত থাকেন, ততক্ষণ ভালই থাকেন; কিন্তু যেই নিরবিলি পড়িল অমনি হু হু করিয়া নয়নে বাণ ডাকিল, দাউ দাউ করিয়া হৃদয়ে আগুণ জ্বলিয়া উঠিল। তাঁহার সমস্ত দিনের সঞ্চিত তপ্ত নিশ্বাসে কুটীর খানি বেদনাযুক্ত হইয়া অশান্তিময় হইয়া উঠে, আর চোখের জলে বুক গাল বাহিয়া বাহিয়া বালিশ ভিজিতে থাকে।

 দিন রাত এত ভাবনা, এত দুঃখ, এত ভক্তি, এত আগ্রহসহ ডাকিয়াও রাবিয়া পিতাকে পাইতেছেন না। ভাবিতেছেন, স্নেহ ভুলিয়া উপায়হীনা কন্যার পিতা নিষ্ঠুর হইতে পারেন না। তবে একেত তিনি বৃদ্ধ, আবার দস্যুর কবলে আবদ্ধ; তাই আসিতে পারিতেছেন না। মুক্তি পাইলেই, সুযোগ ঘটিলেই পিতা দৌড়িয়া আসিবেন।

 বৃদ্ধ ইস্‌মাইল দস্যুর নিষ্ঠুর অত্যাচারে মৃত প্রায় হইয়াছেন। দস্যুর কঠিন হাতের নির্য্যাতনে বৃদ্ধের শরীর জর্জ্জরিত, এবং আশ্রয়হীন কন্যার ভাবনার শাসনে তাঁহার মন অবসন্ন। এই উভয় বিপদে বৃদ্ধের হৃদয় দগ্ধীভূত, শরীর অশক্ত। কিন্তু বৃদ্ধ ইস্‌মাইল ডাকাতদলের নির্ম্মম অত্যাচার হইতে কন্যার চিন্তায়ই অধিক অভিভূত।

 একদিন গভীর রজনীতে সুযোগ পাইয়া বৃদ্ধ কন্যার উদ্দেশে ছুটিয়া চলিলেন। বহু দিনের পরিশ্রান্ত শরীর মন লইয়া তিনি দুহিতার মায়ার টানে পলায়ন করিলেন বটে, কিন্তু বিস্তীর্ণ ভীষণ মরুভূমি।―শক্তিহীন সম্বল হীন বৃদ্ধ ইস্‌মাইল অপত্যস্নেহে সাহস সঞ্চয় করিয়া বিপুল মনোবলে বলীয়ান হইয়া পদব্রজেই এই বিশাল মরুদেশ পার হইতে চলিয়াছেন।

 নীরব যামিনী। অনন্ত বিস্তার মরুভূমে ভীষণ নীরবতা। পশু পাখীরও এই নীরবতায় ভয় হয়। মূর্ত্তিমান ভীতি ও নৈরাশ্য যেন গ্রাস করিতে দণ্ডায়মান। এইরূপ গম্ভীর নির্জ্জন উন্মুক্ত প্রান্তরের পথে স্নেহ-পরবশ-প্রাণ বৃদ্ধ চলিতেছেন।

 ক্রমে রজনী শেষ হইয়া প্রভাত দেখা দিল। মরুভূমির নীরবতা কমিতে লাগিল। উষার আলোক মুখে লইয়া ধীরে ধীরে সূর্য্য তাহার প্রাথমিক রক্তরঞ্জিত লোহিত আলোকে বিশাল বালির সমুদ্র হাসাইয়া তুলিল।

 সূর্য্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত মরুভূমি ভীষণ আকার ধারণ করিল। সমস্ত মরুভূমি দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। বরিকর-তেজে বালুকারাশি ঝক্‌ ঝক্ করিয়া ঝল্‌সিতে লাগিল। বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই বৃদ্ধ আপন মনে পথ চলিতেছেন। ক্রমে ক্রমে বেলাও বাড়িতে লাগিল বৃদ্ধও দুর্ব্বল হইতে লাগিলেন। পিপাসায় তাঁহার কণ্ঠ বিশুষ্ক হইয়া উঠিল।

 কিন্তু হায়! বেলা প্রায় দুই প্রহর হইলে বৃদ্ধ আর চলিতে পারেন না। প্রত্যেক বালুকণা তাঁহার দু’পায় যেন তীক্ষ্ণধার কাঁটার মত বিঁধিতে লাগিল। বৃদ্ধ মৃত্যু যাতনা ভোগ করিতে লাগিলেন। প্রতি পদক্ষেপে পদক্ষেপে, প্রতি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তাঁহার আয়ু ক্ষয় হইতে লাগিল। তবুও বৃদ্ধ নীরবে পথ চলিতেছেন।

 এইরূপে চলিতে চলিতে বৃদ্ধ অনাহার ও পথশ্রমে অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। পিপাসায় পিপাসায় তাঁহার অন্তরাত্মা শুকাইয়া দম বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। দারুণ অবসাদে ও দুশ্চিন্তায় বৃদ্ধের হৃদয় ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। উৎকট পথশ্রমে একটু ছায়া, বুক ফাটা পিপাসায় এক বিন্দু জল, প্রাণ রক্ষার পরিমাণ একমুষ্টি ক্ষুৎ—কিছুই তো এই বিজন মরুদেশে পাইবার উপায় নাই। বৃদ্ধের বুক শুকাইয়া গিয়াছে, হৃদয় দুরু দুরু করিতেছে। তাঁহার এত যত্নে রক্ষিত পুত্রীস্নেহ মুহূর্ত্তের মধ্যেই বুঝি তিরোহিত হইয়া যায়। তাঁহার হৃদয়-সমুদ্র মথিত হইয়া ভীষণ তরঙ্গ উঠিল, তথাপি তিনি নিজের জন্য চিন্তাহীন।―তিনি সহিষ্ণুতার অবতার।

 এতক্ষণে উত্তপ্ত মরুভূমি বহু দুঃখ দিয়া হতভাগ্য বৃদ্ধের উপর কিঞ্চিৎ সদয় হইল। অতি কষ্টে তিনি কিছু দূর অগ্রসর হইলেই দেখিতে পাইলেন, দয়াময় বিধাতার আশীর্ব্বাদ স্বরূপ সম্মুখেই এক মনোরম বৃহৎ জলাশয়; আর মাইল পরিমাণ পথ চলিতে পারিলেই সেই হাস্যময়ী হ্রদের তীরবর্ত্তী হওয়া যায়। শ্রমক্লিষ্ট পিপাসাদগ্ধ বৃদ্ধ মনোহর জলাশয় দর্শনে অভূতপূর্ব্ব আনন্দে বলদীপ্ত হইয়া উঠিলেন। বৃদ্ধ তৃষ্ণা ভারাক্রান্ত নয়নে দেখিলেন, স্ফটিকের মত জলরাশি বুকে করিয়া স্বভাব সুন্দর নয়নাভিরাম জলাশয় সোহাগে ঢল ঢল করিয়া মৃদু মৃদু দুলিতেছে। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সোহাগ-তরঙ্গের উপর সূর্য্যের কিরণ পড়িয়া বিচিত্র শোভা ধারণ করিয়াছে। সেই জলাশয়ের তীর ভরিয়া নানাবিধ ছোট বড় গাছ ফুলে ফলে পরিশোভিত হইয়া স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়া বিস্তার করিয়া রহিয়াছে। নানারঙ্গের পাখী সমূহ কি যেন এক বিপুল আনন্দে গাছে গাছে নাচিয়া নাচিয়া বেড়াইতেছে; এবং গাছের নীচে শীতল ছায়ায় বিচিত্র বর্ণের হরিণ হর্ষ পুলকিত হৃদয়ে তাহাদের শিশুশাবক লইয়া মনের সুখে কচি কচি ঘাশ খাইতে খাইতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। চারুদর্শন কত লতা পাতা ঈষৎ বায়ু হিল্লোলে দুলিয়া দুলিয়া মরুভূমির মধ্যে নন্দন-কাননের শোভা বিস্তার করিয়া রহিয়াছে। সে জলাশয়ের পারে যেন প্রীতি, আনন্দ ও শান্তি গলাগলি করিয়া মিলিয়া রহিয়াছে।

 এই নন্দন-কানন স্থিত জলাশয়ের স্নিগ্ধ জল, গাছের শীতল ছায়া, সুগন্ধি ফুল, সুপক্ব ফল, সুন্দর পাখী,―মনোহর হরিণ, নয়ন রঞ্জক লতা পাতা―সমস্ত মিলিয়া যেন প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে শ্রমাতুর বৃদ্ধকে ডাকিয়া বলিতেছে,―“এস তৃষিত পথিক সুজন! এস শ্রান্ত পথিক, এস! স্বর্গরাজ্যে এস! তুমি পথিক বড় কষ্ট পাইয়াছ, পিপাসায় তোমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে, রোদে তোমার মস্তক পুড়িয়া যাইতেছে, শরীর জ্বলিয়া যাইতেছে! এস শ্রান্ত, এখানে আসিয়া ক্ষণিক বিশ্রাম কর! এসহে পথিক, এই নির্ম্মল জল পান করিয়া তৃপ্ত হও, শ্যামল তরুর ছায়ায় বসিয়া প্রাণ জুড়াও, পাখীর গান শুনিতে শুনিতে, হরিণের নাচ দেখিতে দেখিতে তোমার ক্লান্তি দূর কর! এস, তুমি বড় কষ্ট পাইয়াছ পথিক, এস!”

 এই মনোহর দৃশ্য দর্শনে বৃদ্ধের মুগ্ধনয়ন মধুর ভাবে পূর্ণ হইয়া উঠিল। বৃদ্ধ ইস্‌মাইল ভাবিলেন, সত্যই বুঝি আমার কষ্ট দূরীভূত হইবে। প্রাণ ওষ্ঠাগত, সম্মুখে আশাতীত স্বর্গ রাজ্য―এত দুঃখের পর যে এমন সুন্দর সুখের বন্দোবস্ত ঘটিয়াছে, ইহা মনে করিয়া বৃদ্ধ রুদ্ধ-কণ্ঠে অশ্রু বিসর্জ্জন করিলেন।

 বৃদ্ধ চলিতে চলিতে আবেগ-উৎসাহ মিশ্রিত হর্ষ পুলকিত স্বরে বলিতে লাগিলেন,―“এত দয়া তোমার পরমেশ্বর! না শীঘ্র চলি। ঐ যে বিধাতার করুণাময় হাত খানি মোহন লতাররূপ ধারণ করিয়া স্নেহভরে শ্রান্ত আমাকে ডাকিতেছে। যাই, ঐ তরু তলে গিয়া তাহার শীতল ছায়ায় বসিয়া মঙ্গলময় জগদীশ্বরের মহিমা দর্শন করি।”

 উৎসাহভরে উৎফুল্ল অন্তরে নূতন আশায় প্রলুব্ধ বৃদ্ধ কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়াই আবার এক আনন্দময় দৃশ্যে আশ্চার্য্যান্বিত হইলেন। দেখিলেন, সেই মনোহর হ্রদের পার ভরিয়া আনন্দ কোলাহলপূর্ণ কি সুন্দর এক বিরাট নগর। সেই বিপুলায়তন নগরের সিংহদ্বার দিয়া কত শত লোক উৎসাহ ব্যস্ততার সহিত স্বস্ব বিষয় কার্য্যে গমনাগমন করিতেছে। সকলেরই চোখে মুখে জাজ্জ্বল্যমান আনন্দ ও প্রীতি এবং আশা ও উৎসাহ দীপ্তিমান্। আর সকলেরই বুক ভরা প্রেম, চোখ ভরা ভালবাসা লইয়া পরিশ্রান্ত পান্থদিগকে আদরে আহ্বান করিতেছে। তিনি এই মনোরম দৃশ্যে আরও মুগ্ধ হইয়া, আরও বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “―চলি, শীঘ্র চলি। শরীরের সবটা শক্তি একত্র করিয়া ঐ বাঞ্ছিত তীর্থে উপস্থিত হইয়া জীবনের অভিসম্পাৎ দূর করি।”

 আশার উত্তেজনায় বৃদ্ধ কোনোরূপে পথ অতিক্রম করিতে লাগিলেন। নতুবা এমন ক্ষীণপ্রাণ, এমন দুর্ব্বল ব্যক্তি বাহন ব্যতীত এক পা চলিতেও পারে না। কিন্তু এ কি? মাইল খানিক চলিয়াও তো সে হ্রদের তীরে উপনীত হইতে পারিলেন না। তিনি বিস্মিত নয়নে চাহিয়া দেখিলেন, সেই শান্ত স্নিগ্ধ মনোরম বিরাম-কুঞ্জ ঠিক্‌ সেই ভাবেই তত দূর পথেই সম্মুখে বিরাজিত; অথচ সেই মহাতীর্থ আরও অধিকতর মোহিনীমূর্ত্তি ধারণ করিয়া তাঁহার হৃদয় নয়ন আকর্ষণ করিতেছে।

 বৃদ্ধ সকলই প্রত্যক্ষীভূত, সকলই সত্য দেখিতেছেন, অথচ কি আশ্চর্য্য ব্যাপার। ঠিক্‌ পূর্ব্ববৎ―উহার দূরতা এখনও কিছু কমে নাই। যেন এক পদও তিনি অগ্রসর হন নাই। বৃদ্ধ চমকিত হইয়া অস্ফুট কাতরতার সহিত বলিয়া উঠিলেন,―“একি মায়া! কেন। এমন হইল জগদীশ্বর! পুণ্যতীর্থ কতদূর বিশ্বনাথ!!

 বৃদ্ধ আবার চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিলেন, যেন কোন যাদুকর তাহার অদ্ভুত যাদু প্রভাবে সেই নয়নানন্দকর হ্রদ, উহার তটভূমির প্রীতিপ্রফুল্লতাময় শ্যাম বৃক্ষরাশি, কচি তৃণাঙ্কুরে ভ্রমণশীল হরিণ সমূহ, বিরাট দর্শন নগর দ্বার, কর্ম্মকোলাহলময় জন সমাগম মুহূর্ত্তের মধ্যে সমস্তই কোথায় উড়াইয়া দিয়াছে।

 হঠাৎ মায়াপুরী অন্তর্হিত হইল। মুহূর্ত্তের অভিনয় মুহূর্ত্তেই শেষ হইল। কেবল বালুকারাশি সূর্য্যের প্রচণ্ড তাপে ধক্‌ ধক্‌ করিয়া জ্বলিতেছে।

 বৃদ্ধ কপালে আঘাত করিয়া একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিলেন,―“হায় ভাগ্য! আমি অভাগা কন্যার মুখ দর্শন আশায় ভুলিয়া গিয়াছিলাম যে, মরুভূমিতে মায়ামরীচিকা, মৃগতৃষিকা রহস্য এমনই হয়। বুকভরা দুঃখ লইয়া স্নেহের পুত্তলী দুহিতাকে দেখিতে চাহিয়া কোন্ পাপে দয়াময় খোদা এমন প্রবঞ্চিত ও এমন বিড়ম্বিত হইলাম! কেন তুমি আমাকে বঞ্চিত ও মর্ম্মাহত করিতেছ নিখিলনাথ!”  দুর্ভাগ্য বৃদ্ধ ইস্‌মাইল পুনরায় কন্যার মায়ায় উন্মত্ত হইয়া শক্তিহীন পা দুখানি ধীরে ধীরে চালনা করিতে লাগিলেন। বড় কষ্টে ধীর পদে বৃদ্ধ কাতরতার সহিত ভীষণ প্রান্তর পার হইতে লাগিলেন।

 নির্জ্জন কুটীরে বসিয়া, রজনীতে শয়ন করিয়া রাবিয়া কেবলই পিতার কথা ভাবেন। বৎসরেক কাটিয়া গেলে পর একদা সারা দিনের পরিশ্রমের শেষে বিকাল বেলায় রাবিয়া দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কুটীরের দ্বারে বসিয়া বালুকা-ভূমির দিগন্তহীন বিস্তার দেখিয়া, বৃদ্ধ পিতার বিপদ-কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার মন আকুল হইয়া আর্ত্তনাদ করিতে ছিল। আর আগুনের মত মরুদগ্ধ বাতাস আসিয়া তাঁহার শোণিতশোষী তপ্তশ্বাস লুটিয়া লইয়া ছুটিতেছিল। রাবিয়ার হৃদয় ভেদ করিয়া গরম জল নয়ন বাহিয়া পড়িতেছে, এমন সময় এক কৃশকায় বৃদ্ধ ধনুকের তীরের মত বেগে আসিয়া তাঁহার সম্মুখে পড়িয়া গেলেন।

 রাবিয়া দেখিয়াই চিনিলেন তাঁহার পিতা। চীৎকার করিয়া গিয়া তাহার বুকে পড়িয়া— “হায় পিতা, এতদিন কোথায় ছিলেন?” বলিয়া উচ্চৈস্বরে রোদন আরম্ভ করিলেন। ইস‍্মাইল শুষ্ককণ্ঠে, ক্ষীণস্বরে বলিলেন,—“মা, দস্যুদের নিকট হইতে পলাইয়া আসিয়াছি। একটু জল, বড় পিপাসা?”

 কুটীরে জল ছিল না। রাবিয়া কুটীরে অল্প সময় থাকিতেন বলিয়া, বিশেষতঃ পিতার অভাবে উদাসীনতা বশতঃ দুর্লভ পানীয় সঞ্চিত রাখিবার আবশ্যকতা মনে করেন নাই। পরিশ্রান্ত পিতা জল চাহিবা মাত্রই রাবিয়া প্রস্রবণ উদ্দেশে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলেন। দৌড়িয়া যাইতে আসিতেও কম সময় লাগিল না। রাবিয়া জল আনিয়া দেখেন ইস‍্মাইলের ক্লিষ্টপ্রাণ আর শীর্ণ দেহে নাই। বহুকাল পরে অসম্ভব-দর্শন পিতাকে পাইয়াও তৃষ্ণায় তাঁহাকে এক বিন্দু জল দিতে না পারিয়া রাবিয়ার অন্তর দারুণ ব্যথায় ফাটিয়া যাইতে লাগিল। যে পিতা তাঁহাকে পরম স্নেহে অতি আদরে লালন পালন করিয়াছিলেন, সেই স্নেহপরায়ণ পিতাকে এক দণ্ডও প্রাণ ভরিয়া শুশ্রূষা করিতে পারিলেন না বলিয়া রাবিয়া দারুণ মর্ম্মদাহে বাণাহত পাখীর ন্যায় মাটিতে পড়িয়া ছট্ ফট্ করিতে লাগিলেন। তাঁহার করুণ রোদনে আকাশ পর্যন্ত আলোড়িত হইতে লাগিল। বজ্রাহতের ন্যায় রাবিয়া পিতার ধূল্যাবলুণ্ঠিত মস্তক কোলে তুলিয়া লইয়া তাঁহার নিস্পন্দ ওষ্ঠে, পলকহীন চক্ষে, স্পন্দহীন বক্ষে, চেতনাহীন দেহে শীতল জল সেচন করিতে লাগিলেন।

 স্বল্পমূল্য বৃদ্ধ ইস‍্মাইলকে ডাকাতগণ বিক্রয় না করিয়া নিজদেরই দাসত্বে রাখিয়া ছিল। দুর্ব্বল ইস‍্মাইল আশ্রয়হীনা কন্যার কথা ভাবিয়া ভাবিয়া কত বিনয় করিত, কত লুটাইয়া লুটাইয়া কাঁদিত, কিন্তু কিছুতেই নিষ্ঠুর প্রাণ দস্যুদিগের হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইত না। আজ বৃদ্ধ কোন সুযোগে মুক্তি পাইয়াই পিতৃগত প্রাণা বালিকাকে দেখিবার জন্য ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া এই মুক্তির দিনে তাঁহার চিরমুক্তি রাবিয়ার ব্যথিত প্রাণকে মথিত করিয়া দিতে ছিল। হায়! হতভাগিনী কেন এক গণ্ডুষ জল সঞ্চিত রাখেন নাই? আজ তাহারই দোষে তাঁহার দয়াময় পিতা জীবন হারাইলেন। রাবিয়া নিজকে পিতার মৃত্যুর কারণ মনে করিয়া বিষম অনুতপ্ত হইতে লাগিলেন। সে অনুতাপে তাঁহার হৃদয়গ্রন্থি ছিঁড়িয়া পড়িতে লাগিল।

 হায়! যে স্নেহপ্রাণ পিতা দিনান্ত পরিশ্রম করিয়া করিয়া রাবিয়াকে প্রতিপালন করিয়াছেন, সেই পিতা আজ মৃত্যুকালে একটি স্নেহের কথা, একটি দুঃখের কথাও বলিতে পারিলেন না, কিন্তু রাবিয়া তাঁহার মৃতদেহে সকল কাহিনী পাঠ করিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন। বৃদ্ধের বিশুষ্ক মুখে কত উপবাস ক্লেশ, কত তৃষ্ণার যন্ত্রণা রেখাপাত করিয়া রহিয়াছে, কত বিনিদ্র রজনী চোখের নীচে কালিমাপাত করিয়াছে, কত কঠিন কশাঘাত জীর্ণ পৃষ্ঠে চিহ্ণ আঁকিয়া দিয়াছে। ঐ সব দেখিয়া রাবিয়ার হৃদয় বিচূর্ণ হইতে লাগিল।

 পল্লীবাসিগণ পরস্পর সংবাদ পাইয়া বৃদ্ধের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার জন্য যখন উপস্থিত হইল, তখনও তাহারা দেখিল রাবিয়া পিতার শবের উপর তপ্ত অশ্রু ও শীতল জল সেচন করিয়া রোদন করিতেছেন।

 আরও কিছু দিন গেল। প্রতিবাসীগণের অনুগ্রহেই রাবিয়ার জীবন বাঁচিতে লাগিল; এবং তিনিও কায়িক পরিশ্রম না করিয়া কাহারও অন্ন গ্রহণ করিতেন না। আপদ বিপদ, শোকে দুঃখে রাবিয়ার জীবন গঠিত হইতে লাগিল। ক্রমে রাবিয়া যৌবন-সীমায় উপনীত হইলেন। হতভাগিনী রাবিয়া আবার রমণীর সুঠাম সৌন্দর্য্য শোভায় চির বঞ্চিতা ছিলেন। তাঁহার শরীরের বর্ণ যেমন কাল ছিল, গঠনও তেমনই কুৎসিত ছিল। বাহ্যিক সৌন্দর্য্য সম্ভারে রাবিয়া বড়ই দীনা ছিলেন। এই জন্য বিবাহ করিয়া গার্হস্থ স্থিতি লাভের লোভ তাঁহার মনে কখনও উদয় হইত না। রাবিয়া তাঁহার দুরাদৃষ্ট ভাবিয়া ও বিশ্রী বদন দেখিয়া স্থির করিয়া লইলেন যে, শ্রমার্জ্জিত অন্নে প্রাণ বাঁচাইয়া পিতারচিত স্নেহ-কুটীরেই তাঁহার উদ্দেশ্য বিহীন পরিশ্রান্ত জীবন কাটাইয়া যাইবেন। যাহার সহায় নাই, সম্বল নাই, রূপ নাই, লোভ নাই, তাহার আবার ভয় কি? চিন্তা কি? এই মনে করিয়া রাবিয়া নিশ্চিন্ত মনে দিবা রাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন।

 এইরূপে আরও কয়েক বৎসর কাটিয়া গেল। রাবিয়া এখন ভাবনা হীন, উদ্দেশ্য হীন। কিন্তু তিনি চিন্তা হীন, লক্ষ্য হীন হইলে কি হইবে,— বিপদ তাঁহার পাছে পাছে লাগিয়াই আছে। রাবিয়াকে সঙ্কটে ফেলায়াই বিপদের সুখ, রাবিয়ার চোখে মুখে জল দেখিলেই বিপদের আমােদ। আবার এক দিন বেদুইন দস্যুগণের দ্বারা পল্লী আক্রান্ত হইল; আর সকলের সঙ্গে সঙ্গে রাবিয়াও অপহৃত হইলেন।

 একেশ্বরবাদের প্রবর্ত্তক মহাপুরুষ হজরত মােহাম্মদের (দঃ) অনুশাসনে দাসত্ব প্রথা দূষণীয় বলিয়া নিষিদ্ধ হইলেও তখনো ধনাঢ্য সমাজে ইহা প্রচলিত ছিল। রূপগুণ সম্পন্ন দাস দাসী বহু মূল্যে বিক্রীত হইত। রাবিয়া এক সম্ভ্রান্ত বিলাসী ধনবান্ ব্যক্তির জন্য ক্রীত হইলেন। রাবিয়া কৃষ্ণকায়া এবং কুৎসিতা ছিলেন বলিয়া তাঁহার ভাগ্যে সেই, ধনীভবনে শ্রমসাধ্য কর্ম্মের ভার পড়িল।

 তৎকালীন মুসলমানদিগের অবস্থা বর্ত্তমান সময়ের ন্যায় শোচনীয় ছিল না। তখনকার মুসলমানগণ মধ্যান্য ভাস্করের মত উজ্জ্বল জ্ঞান গরীমা ও প্রতিভা বলে পৃথিবী আলোকিত করিয়া যশঃ সম্মানে প্রভুত্ব করিতেন। শিল্প স্থাপত্য, কৃষি বাণিজ্য, সাহিত্য ইতিহাস, দর্শন বিজ্ঞান, শাসন শৃঙ্খলা, ন্যায় বিচার, মহত্ব ও উদারতায় সকলের বরেণ্য ছিলেন মুসলমান।

 তখনকার মুসলমান বর্ত্তমান সময়ের মুসলমানের ন্যায় শ্রমবিমুখ আলস্যাতুর ছিল না। তাঁহাদের বুদ্ধি কৌশলে, বল বিক্রমে, সাধনা ও ঈশ্বর নিষ্ঠার ফলে দেশের পর দেশ মোস্লেম- সাম্রাজ্যভুক্ত হইতেছিল। আর তাঁহাদের বিতরিত জ্ঞান লাভ করিয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তিমিরাবৃত মানব মণ্ডলী আলোক প্রাপ্ত হইয়াছিল। সে কালের মুসলমানগণ রাজ্য গ্রহণ করিয়া তৎবিনিময়ে ধর্ম্ম ও জ্ঞান বিতরণ করিতেন। সেই জ্ঞান লাভ করিয়া জগতের কত দুর্ব্বল জাতি আজ মহাবলীয়ান; মূর্খ জাতি মহাপণ্ডিত; এবং অধম জাতি কত সম্রাট্; আলস্যপরায়ণ জাতি কত বণিক্, ধনী; হতমান জাতি কত মানী!—আর আজ সেই পূর্ণিমার আলোদীপ্ত মুসলমান সমাজ অমাবস্যার গভীর অন্ধকারে পতিত! হায়! আজ মুসলমান সমাজ এমনই অধম! এমনই হতভাগ্য!!

 বর্ত্তমান অধোগত মুসলমানদিগের সেই সৌভাগ্যের সময় প্রত্যেক ধনী এবং শিক্ষিত ব্যক্তির গৃহেই বিদ্বৎ সমাগম হইত। মধ্য যুগে ফরাসী রাজ্যে বিদ্বৎ সম্মিলনী যেমন একটা প্রচলিত নিয়মের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিল; তাৎকালিক আরব সমাজেও শিক্ষিত ও বৃত্তশালীর ভবনে বিদ্বৎ সম্মিলন তেমনি একটি বিশেষ কর্ত্তব্য প্রথায় গণ্য হইয়াছিল। এমন কি, গুণগ্রাহী সম্ভ্রান্ত বলিয়া সম্মান লাভ করিবার লালসায় অনেকেই পণ্ডিত মণ্ডলীকে নৈশ ভোজে আমন্ত্রণ করিয়া শ্লাঘা লাভ করিতেন। রাবিয়ার প্রভুগৃহে প্রতি রজনীতে এই বিদ্বৎ সম্মিলনী হইত। এই জন্য রাবিয়ার বিশ্রামের সময় ছিল না। কঠিন পরিশ্রমে স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইয়া কত দাস দাসীই বৎসর বৎসর মৃত্যুর কোলে শয়ন করিয়া বিশ্রাম লাভ করিত। আবার নূতন নূতন কত হতভাগ্য তাহাদের শূন্য স্থান পূর্ণ করিতে আসিত; তাহাদিগকে অতি সামান্য ত্রুটিতেও কশাঘাত ও লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত। রাবিয়া বাল্যকাল হইতে কর্ম্ম নিপুণ ও পরিশ্রমী ছিলেন বলিয়া তাঁহার স্বাস্থ্য নষ্ট হয় নাই। এইজন্য লাঞ্ছনার ভাগ তাঁহার কপালে কমই পড়িত।

 নৈশভোজে অধিক মদ্যপানে প্রভু ও অতিথিগণ অবসন্ন হইয়া পড়িলে দাস দাসীগণের বিশ্রামের সুযোগ ঘটিত। আর প্রভুর প্রাসাদাবশিষ্টে তাহারা সারাদিনের শ্রম ভর্ৎসনার লাঘব করিত। কিন্তু রাবিয়া সে দলে মিশিতেন না, নিজের স্বতন্ত্র কক্ষে যাইয়া বিশ্রাম করিতেন। এই জন্য তিনি সঙ্গীয় অপরাপর ভৃত্যদিগের সহানুভূতি হইতেও সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলেন। পরন্তু রাবিয়ার সংযত মৌনগম্ভীর চরিত্র দর্শনে কেহ তাঁহাকে বিরক্ত করিতে সাহসী হইত না। প্রত্যহ রাবিয়া বেদনাহত প্রাণে নীরবে নির্জ্জন কক্ষ আশ্রয় করিয়া পড়িয়া থাকিতেন।

 এইরূপে রাবিয়ার দিন কাটিয়া যাইতেছে। এক রজনীতে কবি, চিকিৎসক, জ্যোতিষী, দার্শনিক প্রভৃতি বহু পণ্ডিত রাবিয়ার প্রভুগৃহে আসর জমকাইয়া বসিয়াছেন। কবিয়ে কবিয়ে কবিতা, চিকিৎসকে চিকিৎসকে ব্যবস্থা, জ্যোতিষে জ্যোতিষে গণনা, দার্শনিকে দার্শনিকে আলোচনা চলিতেছে। পণ্ডিতে পণ্ডিতে তর্ক ও মীমাংসা হইতেছে, সকলেই নিজ নিজ বিদ্যা বুদ্ধির দ্বার খুলিয়া দিয়া কল্পতরু হইয়া বসিয়াছেন; রাবিয়ার প্রভু মহাপুরুষের ন্যায় অনাশক্ত নিষ্কাম ভাবে মদের নেশায় বিভোর হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। রাবিয়া প্রতি রজনীর মত আজিও যথারীতি খাদ্য পেয় আনিয়া স্তরে স্তরে সাজাইয়া রাখিয়াছেন।

 ভোজন আরম্ভ হইল। রাবিয়া আনিয়া রাখিতেছেন, আর নিঃশেষ হইতেছে। এমন সময় একজন আগন্তুক একটা অস্থিগ্রন্থি হইতে মাংস গ্রহণ করিবার কালে সেই গ্রন্থি সংস্থান দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন,―“বাঃ! এই গ্রন্থিগুলি কি আশ্চর্য্য কৌশলে গঠিত। মানুষের শরীরেও কি এই মত গ্রন্থি আছে?” তচ্ছ্রবণে একজন চিকিৎসক বলিলেন,―“মনুষ্য দেহেও এমনই দেখিতে পাওয়া যায়; কেবল চতুষ্পদের ও দ্বিপদের গমন রীতির পার্থক্য আছে বলিয়া যেটুকু বিভিন্নতা।”

 প্রথম ব্যক্তি আরও কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া বলিলেন,―“বিধাতার কি অপূর্ব্ব সৃষ্টি! মানুষের সহিত চতুষ্পদ জন্তুর এই গ্রন্থি সংস্থান মিলাইয়া দেখিতে পাইলে আজ কি আনন্দই না হইত!” এই কথাটা নেশাবিভোর গৃহকর্ত্তার কানে প্রবেশ করিল। পরন্তু এই কৌতূহলপ্রদ প্রসঙ্গ আলোচনায় অতিথিগণের আগ্রহ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। সকলের কৌতূহল মত্ততার সময় রাবিয়া আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। আর অমনি মদিরামত্ত গৃহস্বামী গম্ভীর স্বরে বলিয়া উঠিল,—“ইহার জন্য চিন্তার কথা কি? এই দাসীটার পা কাটিয়া দেখিলেই হয়।”

 আদেশ প্রাপ্তি মাত্রই কয়েকজন রাবিয়াকে চাপিয়া ধরিল, এবং একজন চিকিৎসক একখানা ছুরী লইয়া তাঁহার পায়ের জঙ্ঘার পেশী সমূহ একটার পর একটা খুলিয়া অস্থি বাহির করিয়া ফেলিল। রাবিয়া অকস্মাৎ এই নিদারুণ বিপদে পড়িয়া হতবুদ্ধি হইলেও তখন তিনি অচল অটল।

 রাবিয়ার পদের গ্রন্থি সংস্থান দর্শনে সকলেই বলিয়া উঠিল,—“খোদার কি অপার কুদ্‌রত। ঈশ্বরের কি বিচিত্র মহিমা।” অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে অনাথের নাথ জগদীশ্বরের সর্ব্বদুখঃহর নাম রাবিয়ার কানে গিয়া মধুর ঝঙ্কার দিতে লাগিল। চিকিৎসক পেশীগুলিকে যথা স্থানে বসাইয়া কিঞ্চিৎ ঔষধ দিয়া বাঁধিয়া দিলে, ভৃত্যগণ ধরাধরি করিয়া রাবিয়াকে তাঁহার কক্ষে রাখিয়া আসিল।

 ভাগ্য-বিমুখ রাবিয়ার সমগ্র জীবন দুঃখময় হইলেও বর্ত্তমান বেদনা তাঁহার চরম বোধ হইল। তিনি নিষ্ঠুরপ্রাণ প্রভুর এই কঠোর অত্যাচারের দারুণ যন্ত্রণায় মৃতকল্প হইয়া পড়িলেন। সমগ্র জীবনের দুঃখ বিপদ তাঁহাকে সহিষ্ণুতার অবতার এবং সংযত চরিত্রবতী করিয়াছিল বটে, কিন্তু তাঁহার জীবনে মধুর ঈশ-প্রেমের স্নিগ্ধ আলোকের রেখাপাত হইবার সুবিধা ঘটিয়া উঠে নাই। আজিকার রজনীর এই চরম যন্ত্রণার সময় যে মধুময় খোদার নাম রাবিয়ার কানে অমৃত বর্ষণ করিয়া গেল, তাহা তাঁহার জীবনে আর কখনও ব্যর্থ হয় নাই। রাবিয়া যন্ত্রণাপ্লুত প্রাণে পরম যত্নে সেই দীনবন্ধুর নাম স্বীয় মনোমন্দিরের নির্ম্মল সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। মহীয়ান্ ঈশ্বরের রচিত পূতস্নিগ্ধ সিংহাসনে ঈশ্বরকে বসাইয়া পূজা করাই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। অতএবই রাবিয়া দেবী! ―রাবিয়া রমণী সমাজের বরণীয়া! রাবিয়া স্ত্রীজাতির শিরোমণি!!

 সনাতন জগদীশ্বরের সেই মধুময় নামের উৎস স্বরূপ রাবিয়ার বেদনাক্লিষ্ট মুখ হইতে প্রথম প্রার্থনা বাহির হইল,―শুক্‌রে খোদা―জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ।

 রাবিয়া একাকিনী মৃত্যুশয্যায় পড়িয়া আবার ভক্তি-গদ্গদ কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিলেন,― “ওগো দয়াল প্রভো! আজিকার যন্ত্রণায় হৃদয়ঙ্গম করিলাম, এতদিন আমি কি সুখ আরামে ছিলাম। বিকলাঙ্গ হইয়া জানিলাম, এতদিন শত দিকে তুমি কত যত্নে আমাকে রক্ষা করিতেছ;―দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে আমার সুখ স্বচ্ছন্দতার জন্য তুমি কত যত্ন করিতেছ। ইহা মনে হইলে আমি অকৃতজ্ঞতায় ও লজ্জায় মরিয়া যাই। আমি তোমার গ্লানি করিব কোন্ সাহসে প্রভো!”

 এই নিষ্কাম প্রেম-পিপাসা শতমুখে ফুটিয়া উঠিয়া দিন দিন পরিপুষ্ট হইতে লাগিল। ভৃত্যগণ দুই বেলা সামান্য খাদ্য পেয় দিয়া চলিয়া যাইত, আর রাবিয়া দিবা রাত্রি একাকিনী পড়িয়া থাকিতেন। এই সঙ্কট সময় তিনি নিরন্তর ঈশ্বর-অনুগ্রহ লাভ করিয়া বাঁচিয়া উঠিলেন।

 রাবিয়া মাসাধিক কাল শয্যা শায়িনী ছিলেন। অতঃপর ক্রমে সুস্থ হইয়া তিনি পুনরায় স্বীয় প্রভুর কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। এই হইতে রাবিয়া প্রকাশ্যে প্রভুর শ্রম-সাধ্য কার্য্য করিলেও সর্ব্বদা পরমেশ্বরকে অহেতুক প্রেম দান করিয়া পরিতৃপ্ত থাকিতেন।

 রাবিয়ার জীবন যেমনই পর-সেবায় নিযুক্ত ছিল, তাহার প্রার্থনাও তেমনি বিশ্ববাসীর কল্যাণ কামনায় উত্থিত হইত। সংসারে যদিও তাঁহার আপন বলিবার কিছুই ছিল না, তথাপি সর্ব্ববিধ সুখ ঐশ্বর্য্যের একমাত্র মূলাধার জগদীশ্বরকে লাভ করিয়াও তিনি কখনও নিজের সুখস্বচ্ছন্দতার জন্য,―নিজের আশ্রয় সুবিধার জন্য কিছুই আকাঙ্ক্ষা করেন নাই। যদিও পরের আশ্রয় ভিন্ন এই বিশাল পৃথিবীতে তাঁহার মাথা রাখিবার তিল পরিমাণ স্থান ছিল না, তথাপি তিনি অহর্নিশ নির্লোভ প্রাণে জগতবাসীর জন্য মঙ্গল কামনা করিয়াই প্রার্থনা করিয়াছেন। রাবিয়া পরের হিতাকাঙ্ক্ষায়ই তপস্যামগ্ন থাকিতেন।

 অতঃপর কেহ কখন রাবিয়ার বদন বিষণ্ণ দেখেন নাই। সকল দুঃখ যন্ত্রণা, বিপদ আপদ তিনি জগদীশ্বরের অনুগ্রহ প্রসাদ ভাবিয়া অম্লানচিত্তে গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি প্রসন্ন বদনে বলিয়াছেন,―“দয়াময় প্রভো! যখনই তুমি এই অধম দাসীর পানে কৃপা করিয়া চাহিয়াছ, তখনই আমি কত শত উৎসবে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছি। প্রভু আমার, সূর্য্য কি কখন পদ্মের মুখ মলিন দেখিয়াছে? প্রেমাস্পদের মুখ দর্শনে দুঃখ যাতনা থাকে কি প্রভো!

 ―“যখন যাতনা পাই, তখন দুঃখ হয়, তাই কাঁদি―নিজের জন্য নয় প্রভু, ভাবি―এখনও তো এইরূপ বেদনায় কত শত শত মানব ভোগিতেছে। হায়! কবে সবটুকু যাতনা, সবটুকু দুঃখ আমায় দিয়া মানব জাতি প্রফুল্ল কণ্ঠে তোমার মধুময় নাম গান করিবে?

 ―“তোমার এই তুচ্ছ দাসীর হৃদয়ের সমস্ত শোণিত প্রদান করিলেও যদি তাপদগ্ধ সংসার-মরুভূমিতে এক ব্যক্তিরও দাঁড়াইবার স্থানটুকু শীতল হয়, তবে আমার শোণিতে এই ধরণীতল রঞ্জিত হউক না কেন প্রভো!

 ―“দয়াময় প্রভো! আমি যেন আপন হৃদয়ের তীব্র বেদনা আপন চিত্তে গোপন রাখিয়া এই বিশ্ববাসীকে পরিতৃপ্ত করিয়া আনন্দ লাভ করিতে পারি। যে পর্ব্বতের মধ্যস্থলে অগ্নিকুণ্ড স্থাপিত, সেও কি লতা পাতা দূর্ব্বাদলে স্নিগ্ধ শ্যামল শোভায় শোভিত হয় না নাথ? আমাকেও তেমনি শ্যামল শোভায় আবৃত রাখ।

 এইরূপে দিন যাইতে লাগিল। রাবিয়া সমস্ত দিবস গৃহস্বামীর কার্য্যে লিপ্ত থাকিলেও মনে মনে সদা সর্ব্বদা জগদীশ্বরের নাম জপ করিতেন। আর রাত্রিকালে কার্য্য হইতে অবসর হইয়াই বিশ্বপালক প্রভুর নিকট নতজানু হইয়া উপাসনারত হইতেন।

 আরব দেশের অতিথি-পরায়ণতা চির প্রসিদ্ধ। তথায় শত্রুর ভবনে অতিথি হইলেও প্রভুর ন্যায় সেবা পাওয়া যায়। পৃথিবীস্থ সভ্য-সমাজে আরবের অতিথি-সেবার কোথায়ও তুলনা হইতে পারে না। এক দিবস রাবিয়ার প্রভুগৃহে অতি থর সমাগম হইল না। সন্ধ্যা ঘনতর হইয়া রাত্রি হইল; ধীরে ধীরে রাত্রি গভীর হইল। বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া শেষে দাস দাসীদিগকে বিদায় দিয়া গৃহস্বামী একাকী অতিথির অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। অতিথি না পাইলে খাদ্য সামগ্রী স্পর্শও করিবেন না;― প্রাতঃকাল পর্যন্ত তাঁহাকে অতিথির জন্য অপেক্ষা করিতেই হইবে। গৃহকর্ত্তা অধীর হইয়া রমণীয় প্রাসাদ হইতে বাহির হইয়া দেখিলেন, পূর্ণিমার চন্দ্র তাহার স্নিগ্ধ আলোকে বসুন্ধরা মাতাইয়া আপন ভাবে হাসিয়া চলিতেছে; তাহার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোৎস্নাময়ী মধুর যামিনীও আত্মহারা হইয়া হাসিতেছে। আর সে হাস্যময়ী রজনীতে সীমাহীন বালুকা-প্রান্তর বিরাট সমুদ্রের রজত তরঙ্গের মত দেখা যাইতেছে। আরব্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের একমাত্র দর্শনীয় খর্জ্জুর-কুঞ্জ চাঁদের জ্যোছনা মাথায় পড়িয়া, শ্যামল শোভায় উজ্জ্বল হইয়া ঝির ঝির শব্দে নাচিতেছে।―আজ আরবের বিশুষ্ক প্রকৃতি যৌবন উচ্ছ্বাসে উথলিয়া উঠিয়াছে। চির-নীরস আরব প্রকৃতির এই অপূর্ব্ব কমণীয় নয়ন-রঞ্জিনী শোভায় ঐশ্বর্য্যমত্ত গৃহস্বামী বিমুগ্ধ হইলেন।

 এমন সময় অকস্মাৎ একটি মধুস্রাবী স্বর শুনিয়া তাহার প্রাণ উধাও হইল। তিনি সেই স্বর লক্ষ্য করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন; ধীরে ধীরে ভৃত্যাবাসে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সকলেই গাঢ় নিদ্রায় অচেতন―কেবল দুঃখিনী রাবিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া তন্ময়চিত্তে বলিতেছেন,―“ওগো হৃদয়স্বামি! তোমাকে শত শত ধন্যবাদ। হে আমার অন্নদাতা প্রভো! তোমাকেও শত ধন্যবাদ। তোমার নিকট যে মাথা রাখিবার স্থান এবং জীবন ধারণের অন্ন জল ও লজ্জা নিবারণের বস্ত্র পাইতেছি, তাহার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ; আর তোমার আদেশে যে যন্ত্রণা পাইয়াছি, তাহার জন্য আরও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। আমি জ্ঞান হীনা তোমার দয়াতেই অনাথের নাথ জগদীশ্বরকে চিনিতে পারিয়াছি। হে জগতের পতি! তোমার কাছে আর কি চাহিব? দয়াময় প্রভো! তোমাকে ডাকিলেই যে অনন্ত অপার্থিব সুখ পাই, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে তো তাহার তুলনা নাই। ইচ্ছা হয়, সর্ব্বক্ষণ কেবল তোমাকে হৃদয়ে বসাইয়া সেই সুখ তোমাকেই দেখাই, আর আনন্দে তোমার নাম জপিতে জপিতে নাচিয়া বেড়াই!

 —“ওগাে অগতির গতি নিখিল পতি! কেন তুমি জগতে দুঃখ দিয়া সকলকে নিন্দার ভাগী করিয়া তামাসা দেখ? তােমার নিন্দা আমার যে অসহ্য! সাগরে যেমন খাল বিল, নালা নদী গিয়া পতিত হইয়াছে, তেমনি আমাতেই জগতের সমস্ত দুঃখের ধারা আসিয়া পতিত হউক! প্রভু আমার, আমি দুর্ব্বলা হইয়াও তােমার মধুময় নামে সমস্ত বহন করিব। প্রভাে! যখনই তুমি আমার দিকে সদয় হইয়া চাহিয়াছ,তখনই আমি আনন্দ সাগরে ভাসিয়া আপন হারা হইয়াছি।”

 অতঃপর রাবিয়া স্বীয় প্রতিপালক প্রভু, সম অবস্থাপন্ন দাস দাসী এবং অপরাপরের মঙ্গল কামনা করিয়া, তাহাদের অজ্ঞানকৃত পাপ ও অত্যাচার অনাচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া শয়ন করিলেন।  এই অভৃত পূর্ব্ব দৃশ্য দেখিয়া গৃহস্বামী উন্মত্তের ন্যায় প্রাসাদে ফিরিলেন। তিনি অবহেলা করিয়া যাঁহাকে অত কষ্ট দিয়াছেন,সামান্য কারণে তীব্র ভর্ৎসনা করিয়া যাতনা প্রদান করিয়াছেন, সে আজ অম্লান বদনে অন্তরের সহিত তাঁহার শুভ কামনা করিয়া, উদারতা ও ঈশ্বর প্রেমের পরিচয় দিয়া যে অভিনব ভাব ও নূতন জীবনের আভাস দেখাইল; তাহাতে যুগপৎ লজ্জা ভয় ও ভক্তি তাঁহার হৃদয় আলোড়িত করিয়া তুলিল।

 পর দিনও চিন্তায় চিন্তায় কাটিয়া গেল। সন্ধ্যা হইল। রজনী গভীর হইলে আবার সেই মধুর স্বরে আকুল হইয়া তিনি রাবিয়ার কক্ষের দ্বারে উপস্থিত হইলেন। রাবিয়া তখন বিশ্ব-স্বামীর চরণতলে ভূ-লুষ্ঠিত হইয়া উপাসনা রত— এক অপূৰ্ব স্বর্গীয় জ্যোতিরেখা দোলিয়া দোলিয়া সেই অন্ধকার কক্ষ খানি আলােকিত করিয়া রাখিয়াছে, আর রাবিয়ার কণ্ঠ তদগত-চিত্তে বলিতেছে,—“প্রভু জগদীশ্বর, তুমি জান আমার এই ক্ষুদ্র প্রাণ দিবানিশি সর্বক্ষণ তােমার আদেশ পালনে কত উৎসুক; এই দেহ মন প্রতিমুহূর্ত্ত তােমার আরাধনায় নিযুক্ত রাখিতে কতই অভিলাষ; কিন্তু আমি হতভাগিনী পরাধীনা সেবাদাসী বলিয়া প্রত্যহ বিলম্বে তােমার চরণতলে উপস্থিত হই। প্রভাে, তুমি এই জন্য তােমার এই তনয়াকে ক্ষমা করিও।

 —“ওগাে, কে তুমি অভাগা সারা রাতি সখার রুদ্ধদ্বারে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছ? ওগাে, তােমার হৃদয়ে কেন অগ্নিশিখা?— তােমার হৃদয় দগ্ধ হইতেছে তবুও তােমার নয়নে জল বহিল না? ওরে ভিখারী, ওরে তৃষিত, ওরে ধুলিলুণ্ঠিত, আয় আমার দুঃখী ভাই বোন, আয় আমার হৃদয়ে আয়! তোর হৃদয়ের তাপ আমাকে দিয়া তোর বিষাদ ভার দূর কর, আমার দুই নয়নের জল তোকে দিব। ওরে তাপিত, একবার প্রাণ ভরিয়া কাঁদিয়া দেখ্না, কত অনন্ত শান্তি। অধম্‌ হইতে অধম তুই, একদিন প্রাণ ভরিয়া কাঁদিয়া প্রভুর মন ভিজাইতে পারিলি না? আয় তোরে কাঁদা শিখাইব। ওরে ক্লান্ত, ওরে ভ্রান্ত, ওরে প্রাণ ভরিয়া যদি কাঁদিতে চাস, তবে আমার শীতল বুকে আয়, তোর নয়নে স্রোত বহিবে;—আর সখা সেই নয়ন জলে অভিসিক্ত হইয়া দেখা দিবে।

 —ওগো সখে, যত দিন তুমি পৃথিবীর সমস্ত পতিতকে হাত ধরিয়া না উঠাও, মিনতি করি সখা ততদিন এই দাসীর হাত ধরিও না। যতদিন তুমি সমস্ত দুঃখীর সমস্ত তাপীর নয়নের জল না মুছাও, প্রভো! ততদিন এ ক্ষুদ্র দাসীর চোখের জলের দিকে ফিরিয়া দেখিওনা। যত দিন সকল প্রাণীর দগ্বীভূত হৃদয় সিক্ত না কর, জ্বলুক এ দাসীর হৃদয়, থাকুক দাসীর হৃদয় মরুভূমি— তোমার করুণা চাই না। যে পতিত, সে কি উঠিবেনা প্রভো! নয়নজলে ভাসিয়াও কি দুঃখী সান্ত্বনা পাইবে না প্রভো! যে দুঃখী বিষাদে অবসন্ন, সে কি তোমার দয়া পাইবেনা প্রভো! দাসীর তো তুমি আছই হৃদয়শ্বের, তাহাদের কে আছে প্রভো?

 "—হে প্রভো! আমাকে উচ্চ পর্ব্বত করিও না; আমাকে সমতল শস্য-শ্যামলা করিয়া দাও, ক্ষুধিত যেন আমাতে আহার পায়। আমাকে লবণাক্ত সমুদ্র করিও না; আমাকে দুঃখ তাপপূর্ণ ধরিত্রীতলে প্রস্রবণ করিয়া দাও, তৃষিত যেন আমাতে জল পায়। আমাকে বীরের হাতের তীক্ষ্ণধার তরবারি করিও না, আমাকে সামান্য যষ্টি করিয়া দাও, যেন দুর্ব্বল আমাতে অবলম্বন এবং পতিত আমাতে আশ্রয় পায়।”

 সামান্য দাসীর একনিষ্ঠ প্রেমময় প্রাণের স্বার্থহীন ঈশ্বর-সাধনা দর্শনে গৃহস্বামীর ধনৈশ্বর্য্যের অহঙ্কার চূর্ণ হইয়া গেল, অন্তর হইতে যশোলিপ্সার বাসনা তিরোহিত হইল, প্রভুত্ব স্বামীত্ব ভাব দূরীভূত হইল। সেদিন আর তাঁহার আহার হইল না। আরও এক দিন কাটিল। পূর্ব্ব দুই রজনীর ন্যায় সপ্নাবিষ্টের প্রায় যাইয়া শুনিলেন, রাবিয়ার প্রার্থনা মর্ম্মান্তিক করুণ স্বরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে,—

 “—হে হৃদয়স্বামি! আমি যদি স্বর্গ পাইয়া সুখভোগ করিবার লোভে তোমায় ডাকি, তবে স্বর্গ এ দাসীর নিমিত্ত হারাম হউক। আর যদি নরকের যন্ত্রণাভয়ে ডাকিয়া থাকি, তবে সে নরকেই আমার গতি হউক।

 “ওগো, কে হতভাগ্য বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছ? পাপে লজ্জা হইতেছে? মনে ভয় উদয় হইতেছে? ওরে কিসের লজ্জা, কিসের ভয়? আমার প্রভু তো দয়াময় পিতা! স্নেহ পরায়ণ পিতা তাঁহার অবোধ সন্তানের অপরাধ গ্রহণ করেন? ভয় কি? তুমি তোমার সকল পাপ আমায় দাও।

 “—প্রভো! প্রলোভন আসিয়া যখন আমায় বিমুগ্ধ করিতে চায়, তখন আমি কাঁদিয়া ফেলি,—দুঃখ দুর্ব্বলতায় নয় প্রভু, অপমানে। সে কি ইহা জানেনা যে, আমার সখা তুমি রক্ষাকর্তা স্বয়ং প্রভু জগদীশ্বর?”

 গৃহস্বামী তিন রজনী পর্য্যন্ত সব দেখিয়া, সব শুনিয়া—মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আত্মহারা হইলেন। প্রভাতে সমস্ত দাস দাসীকে নানাবিধ পুরস্কারে পরিতোষ সহ মুক্তি দিয়া রাবিয়াকে বলিলেন, “দেবী! তুমি রমণীকুলের উজ্জ্বল গৌরব কিরিটিনী। তোমার নিষ্ক্রিয় ঈশ্বর প্রেম এবং তোমার আকাঙ্ক্ষা হীন শুভ কামনা দেখিয়া আমার কলুষ কঠিন চিত্তের ভ্রান্তি দূরীকৃত হইয়াছে। তোমারই প্রসাদে আমি মহীয়ান ঈশ্বর প্রেমের মাধুর্য্য, সংযত জীবনের মাহাত্ম্য অনুভব করিতে পারিয়াছি। সাধ্বি! আজ তোমাকে অম্লানচিত্তে ভক্তির সহিত মুক্তি দিলাম। অনেক দিন তোমাকে অযথা কটু বলিয়াছি, সামান্য ক্রটীতে শাসন করিয়াছি; মা,আমি তোমার অবোধ সন্তান, আমায় ক্ষমা কর দয়াবতী জননি!”

 রাবিয়া বিস্মিত নয়নে লজ্জাবনত মস্তকে বলিতে আরম্ভ করিলেন,—“আমি আশ্রয় হীনা অনাথা, আপনার আশ্রয়ে সুখে আছি। আপনি নির্দ্দয় হইয়া আমাকে তাড়াইয়া দিবেন না। আমার যে কেহ নাই, আমি কোথায় আশ্রয় পাইব প্রভো? আপনি দাসীর যে কল্যাণ সাধন করিয়াছেন, তাহার তুলনা নাই। আপনার দয়াতেই আমার হৃদয় আজ প্রশান্ত। আমি আপনার সেবা করিয়া কথঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতা জানাইবার সুযোগ পাইতেছি; প্রভু আমাকে দূর করিবেন না।”

 গৃহস্বামী করযোড়ে বলিলেন,—“মা, আপনি মানবী নহেন, স্বর্গভ্রষ্ঠা দেবী। আমি নরাধমের এই পাপগৃহ দেবীর উপযুক্ত স্থান নয়। মা, আপনার এই অবোধ সন্তানকে ক্ষমা করিয়া আপনি আজ হইতে স্বাধীন ভাবে বিচরণ করুন।”

 পিঞ্জিরাবদ্ধ বনের পাখী বিমুক্ত হইলে যেমন মনের সুখে সুমধুর কল-সঙ্গীতে বিশ্বমুগ্ধ করিয়া অনন্ত আকাশপথে কেবলি উড়িতে থাকে; সেই মত দেবী রাবিয়ারও দাসীত্ব শৃঙ্খল ছিন্ন হইলে তিনিও দিবারাত্রি পরমানন্দে জগদীশ্বরের প্রেম-মার্গে ধাবিত হইলেন। ফলে তাঁহার পুণ্য-চরিত্রে ইসলাম-জগত বিমোহিত হইল।

 সাধ্বী রাবিয়া তখন বসরাতেই স্বাধীনভাবে বাস করিয়া দিবানিশি কোরআন-শরীফ পাঠ করিয়া উপাসনা আরাধনাতেই নিমগ্ন থাকিতেন। অনেক দিন তিনি এক নির্জ্জন অরণ্যে অবস্থিতি করিয়া কঠোর যোগাভ্যাসে রত থাকেন। সেই আরণ্য-প্রদেশে সিদ্ধি লাভ করিয়া পরে এক মস্জেদে বাস করিতে থাকেন। তখন তাঁহার সহিত বহু সাধু পুণ্যাত্মার দর্শন লাভ ঘটিয়াছিল। তাঁহারা সকলেই দেবী রাবিয়ার প্রগাঢ় ধর্ম্মভাবে বিমুগ্ধ হইয়া তাঁহার প্রতি প্রচুর শ্রদ্ধাপ্রীতি প্রদর্শন করেন। দেবী রাবিয়ার তন্ময়চিত্তের উপাসনা দেখিয়া বোধ হইত, ঈশ্বরে তাঁহার অভিন্ন হৃদয়। এমন একাগ্র চিত্তের উপাসনা, এমন নির্লোভ সাধনা, এমন নির্ম্মল বৈরাগ্য বাস্তবিকই অদ্ভুত ব্যাপার।

 তৎকালীয় ঋষিকল্প মহানুভব হোসেন বসরী বলেন,—“সাধ্বী রাবিয়া কাহারও শিক্ষাধীন না হইয়া অন্তরে অলৌকিক ধর্ম্মজ্ঞান লাভ করিয়াছেন।” সাধু-হৃদয়ে জগদীশ্বরের যথার্থ দয়ার ছায়াপাত হইলে মানুষের শিক্ষা বা সাহায্যের আবশ্যক হয় না। অনন্ত জ্ঞান-সাগরের অতুল রূপ একবার অন্তরে প্রবেশ করিলে, পৃথিবীর ক্ষুদ্র জ্ঞান-অধ্যয়নের আর প্রয়োজনীয়তা থাকে না।

 বসরায় সাধনা-সিদ্ধ হইয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিলেন বলিয়া তাঁহার নাম হইল দেবী রাবিয়া—অর্থাৎ বসরা বাসিনী রাবিয়া। তিনি ধ্যান জ্ঞান ও পবিত্রতা, সেবা বিনয় ও নিষ্কামতা গুণে বিশ্ব বিখ্যাত হইয়া ছিলেন। লোক সেবাতেও দেবী রাবিয়া অদ্বিতীয় ছিলেন। তিনি তো বাল্যাবধিই শ্রমপটু ছিলেন। তিনি তাঁহার শ্রমলব্ধ অর্থ দিয়া বাগ্দাদ হইতে মদিনা পর্য্যন্ত এক খাল খনন করিয়া দিয়াছিলেন।

 কতক দিন পর দেবী বসরা হইতে মক্কা-শরীফ চলিয়া যান। মক্কা, মদিনাজেরুসালম-মুসলমানদিগের এই তিনটি তীর্থ-পীঠেই তাঁহার অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত হইয়া ছিল। দেবী রাবিয়া কঠোর সাধনা প্রভাবে এমনই সুউচ্চ ধর্ম্ম-জীবন লাভ করিয়াছিলেন যে, নানাদেশ হইতে শত শত নরনারী তদীয় দর্শন লাভে ছুটিয়া যাইয়া অমূল্য উপদেশ প্রাপ্ত হইয়া ধর্ম্মপথে বিচরণ করিত। তাঁহার পবিত্র নামে সকলেই মস্তক অবনত করিত।

 মহর্ষি হোসেন দেবী রাবিয়াকে অত্যধিক শ্রদ্ধা করিতেন। তিনি সপ্তাহে এক দিবস ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিতেন। রাবিয়াও প্রতি সপ্তাহেই সেই সভায় উপস্থিত থাকিতেন। একদিন সভাস্থলে দেবী রাবিয়াকে না দেখিয়া ঋষি উপদেশ প্রদানে বিরত রহিলেন। তখন সকলেই তাঁহাকে বলিতে লাগিল,—“কত কত জ্ঞানী বিদ্বান এখানে উপস্থিত, আপনি এক বৃদ্ধা রমণীর অপেক্ষায় মৌন রহিয়াছেন কেন?” ধর্ম্মাত্মা হােসেন তদুত্তরে বলিলেন,—“যে সরবত্ হাতীর জন্য প্রস্তুত, তাহা ক্ষুদ্র পিপীলিকাকে দিতে পারি না।”

 তাপস প্রবর হােসেন উপদেশ প্রদান কালে যখন বলিতে বলিতে উৎসাহে মাতিয়া উঠিতেন, যখন তাঁহার পবিত্র মুখ হইতে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের ন্যায় কথা বাহির হইয়া স্রোতৃগণকে মুগ্ধ করিয়া উত্তেজিত করিত, তখন তিনি গভীর শ্রদ্ধার সহিত সাধ্বী রাবিয়ার প্রতি দৃষ্টি করিয়া বলিয়া উঠিতেন,—“এই সমস্ত মহৎ বাক্যাবলী তােমারই হৃদয়ের তেজ হইতে উৎপন্ন হইতেছে।”

 ঈশ্বরগত প্রাণ দেবী রাবিয়ার গভীর ভাবপূর্ণ উপদেশাবলীর কয়েকটি মাত্র প্রদত্ত হইল।—“যখন বর্ষাকালে আকাশের মেঘ আর দিগন্তের বাতাসে খুব লড়াই হয়; তখন মেঘ চায় জল হইয়া মাটিতে নামিয়া পড়িতে, বাতাস চায় তাহাকে উপর দিকে উড়াইয়া দিতে। কাল কাল মেঘ গুলি চায় ক্ষেত ভাসাইয়া জল ঢালিতে, বাতাস চায় শস্যের ফুল কুঁড়ি গুলি ছিড়িয়া ফেলিতে।—এইরূপে খুব যুদ্ধ হইলেও শেষে মেঘেরই জিত হয়। বৃথা কতক্ষণ ঘর দুয়ার নাড়িয়া, বন লতা কাঁপাইয়া, গাছের পাতা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া শেষে বাতাসের শক্তি ফুরাইয়া যায়; আর আপন মনে মেঘ গলিয়া বৃষ্টি ধারায় ধরাতল ভাসাইয়া পৃথিবী শীতল করিয়া দেয়। হায়! মানুষ কি দুর্বল! একটুকুতেই কেমন বিচলিত হইয়া পড়ে। প্রভাে! কবে তাহারা এই বৃষ্টি ধারার মত একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ী, একনিষ্ঠ তন্ময় হইবে?  “মানুষ বড়ই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। তাহারা একবারেই ভাল মন্দ বিবেচনা করে না। বৃথা তােমাদের হিংসা, বৃথা তােমাদের লালসা। আমরা কয়েক দিন মাত্র তাে এই সংসারে আছি। হায়! আমরা কোথায় এই ক্ষণ ভঙ্গুর ক্ষুদ্র জীবনটিকে শান্তির বিমল আনন্দে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিব; তাহা না করিয়া অনর্থক কলহ বিবাদে, দুঃখে দুর্দ্দশায়,দুষ্কর্ম্মে দুশ্চিন্তায় তাহাকে তিক্ত করিয়া ফেলি। এতই কি কষ্ট?—দু’টা দিন কি সহিয়া মানিয়া যাইতে পারিনা? কেন হায়, মানুষের হৃদয় এত দুর্ব্বল? অপরের হাতে তুমি অন্যায়রূপে আঘাত পাইয়াছ, কিন্তু আঘাত পাইয়াই যদি ফিরিয়া তাহাকে আঘাত কর, তবে তােমাতে আর হিংস্র পশুতে কি প্রভেদ থাকিল? বহু লোকেই বিষয় খণ্ড লইয়া মারামারি কাটাকাটি করে; কিন্তু স্বার্থের উপর আঘাত পাইয়াও যিনি আকাশ মণ্ডলের মত নিষ্কম্প, পর্ব্বতের মত অচল, পূর্ণিমার আলােকের মত নির্বিকার, তিনিই তাে প্রকৃত বীর! না না প্রভাে! আমরা বড়ই দুর্ব্বল, বড়ই অশক্ত। কত দিনে এই দুর্ব্বলতা দূর হইবে? ওগাে, কতকালে হে প্রভাে! কতকালে তােমার নীতি, তােমার প্রীতি মানুষে বুঝিবে?—বুঝিয়া আনন্দে কোলাকুলি করিবে? দয়াল প্রভাে! দয়া করে হতবল মানুষকে দয়া কর।!  "তিল তিল করিয়া তােমার আয়ু ক্ষয় হইতেছে, পলে পলে তুমি মৃত্যুর মুখে অগ্রসর হইতেছ। হে নির্ব্বোধ মানব, তাহা কি তুমি চিন্তা করিয়া দেখিতেছ? যাঁহার করুণায় জগৎ আনন্দময়, চাঁদ জ্যোছনাময়, ফুল গন্ধময়,―যাঁহার নামে প্রাণ পরিতৃপ্ত হয়, হৃদয়ে আনন্দের উৎস বহে, সময় থাকিতে সেই দীনবন্ধু জগদীশ্বরের নাম লও! যে বিশ্বপিতার আশ্রয় লয়, ত্রিসংসারে তাহার কিসের ভয়? যাঁহার কৃপায় জীবের জীবন, সর্ব্বভূতে যাঁহার অধিষ্ঠান, হায় কবে ঘরে ঘরে তাঁহার নাম জপ হইবে?

 “হায় প্রভু, তোমার লীলা খেলার অন্ত নাই। এই সংসার টা সাজায়েছ এক আজব চিড়িয়াখানা। বুদ্ধিহীন মানুষ সখ করিয়া এই চিড়িয়াখানায় পশু হইতেছে। কি আশ্চর্য্য! কেহ মনে মনে দুই চারি শত লোকের সর্ব্বনাশ সাধন করিবার জন্য ঐ পদ্‌টা গ্রহণের ফন্দি করিতেছে, কেহ নিজকে ধার্ম্মিক বলিয়া পরিচয় দিবার জন্য শত শত প্রবঞ্চনার জাল বিস্তার করিয়া বসিয়াছে। আবার কেহ একটু দয়া বিতরণ করিয়াই ভাবিতেছে, যদি একটা সভায় আমার এই দয়ার কথা প্রচার হইত। কেহ লুকাইয়া একটু সৎ কাজ করিয়া চিন্তা করিতেছেন, পাঁচ জনের সম্মুখে হইলে খুব বাহবা লওয়া যাইত। আবার কেহ যদি কাহারও কোন উপকার করে, আর যদি সে জন্মের মত তাহার গোলাম না হয়, তবে তখনই রাগে ফুলিয়া তাহার সর্ব্বনাশ করিতে উদ্যত হইয়া বলে,―“তুই বেইমান। তুই অকৃতজ্ঞ।”

 “তুমি পণ্ডিত, তুমি জ্ঞানী। কিন্তু মন তোমার বশ নয়; মন অসুখের কাজে ঘুরিয়া ফিরে; সুতরাং এই কথা জানার নাম যদি জ্ঞান হয়, তবে পৃথিবীর সকলেই জ্ঞানী। দুষ্ট মন অবোধ মানবকে সর্ব্বদাই ফাঁকি দিতেছে; আর তোমরা জানিয়া শুনিয়াও সেই অসুখের কাজই করিতেছ। বাস্তবিকই মানব জাতি বড়ই নির্ব্বোধ।―অসুখের নামে ভয়ে শিহরিয়া উঠিতেছে, আবার সেই অসুখকেই টানিয়া বুকে লইতেছে। মনের ধান্দায় আর ফিরিও না। মনের যাহা ইচ্ছা করুক, তুমি একবার বসিয়া পড়। একবার যদি মন বুঝিতে পারে যে, এই আর আমার মতে চলিবেনা, অমনি দেখিবে যে মন তোমার গোলাম। তখন মনকে যাহা বলিবে, তাহাই করিবে।

 “ধূর্ত্ত মন মানুষকে কেবলই ফাঁকি দিয়া ঘুরায়। মানবও কলের পুতুলের মত মনের পাছে পাছে ঘুরিয়া মরে। যদি কাহারও সঙ্কটাপন্ন পীড়া হয়, তখন অনাথের নাথ বিশ্বপিতাকে ডাকে, আর যখনই আরাম হইল, অমনি হয় দ্রব্যের গুণ বা কবিরাজের প্রশংসা আরম্ভ হয়। বিপদ হইতে উদ্ধার হইলে পরমেশ্বরের নাম ভুলিয়া ফেলে, কে আর তাহার নাম লয়? হায়। আমাদের কি শােচনীয় বর্ব্বরতা! দয়াময়, কবে তােমার সৃষ্ট জীব তােমাকে চিনিয়া তােমার নামে বিভাের হইবে।

 “আমার দয়াময় প্রভুর নাম লইলে পাপ গ্লানি দূর হয়। পাপি, তুমি ভাবিয়া ভাবিয়া ভয় পাইতেছ কেন? তবে আর ভাববাদী পয়গাম্বর আসিয়াছিলেন কেন? কার জন্য যন্ত্রণা সহ্য করিয়া সত্য প্রচার করিয়াছিলেন? তিনি পাপী তাপীকে ডাকিয়া মধুর স্বরে অভয় ঘােষণা করিয়া বলিয়াছিলেন,—“আয়, আমার খােদাকে ডাক, তাের পাপ তাপ থাকিবে না। দুৰ্বল কি ভাবিতেছ? ঈশ্বরকে ডাকিতে সাহস হয় না? তােমার মন তােমাকে শিক্ষা দিবে। ঈশ্বরকে ডাকিবার সাধ হইলেই সে ডাকিতে শিখে। ঈশ্বর সকলকেই ভালবাসেন। যার যত সাধ হয়, সে তত পায়। ঈশ্বর যে সাধময়, তাহাকে সাধিলেই কিনিতে পাওয়া যায়। হায়! দিন দুনিয়ার মালিক, ডাকিলে পাওয়া। যায়, তাহাকে ভালবাসিলাম কৈ? তাহাকে ডাকিলাম কৈ? যাঁহার আকাশের নীচে বাস করিতেছি, যাহার মাটিতে আরামে বেড়াইতেছি, যাঁহার মুখে আহার করিতেছি, যাঁহার অম্নে উদর ভরিয়া প্রাণ বাঁচাইতেছি, আমরা তাহারে ভালবাসিনা, তাঁহার নাম মুখে লইনা, তাঁহার আদেশ শুনিনা, আমরা কি অকৃতজ্ঞ, কি পামর! আমাদের জন্যেই তাে নরক।  “অবােধ মানব, তুমি শত দিকে তােমার মন দৌড়াইয়া হয়রান হইয়া মরিতেছ, অথচ যাহার তুমি সৃষ্টজীব, তাঁহার প্রিয় হইতে পারিলে না। হইবে কেমন করিয়া, একবার তােমার মন দৌড়াইতেছ বিষয় ভাবনায়, একবার তােমার মন দৌড়াইতেছ প্রতিহিংসা সাধনায় আবার দৌড়াইতেছ বৈরাগ্যের অন্বেষণে, একটু ক্ষুদ্র মানুষ দ্বারাকি এতটা চলিতে পারে?—মন্‌টা ঠিক ভাটার মত, যে দিকে গড়াইয়া দিবে, সেই দিকেই গড়াইয়া যাইবে। যদি ভাব তােমার ধন সম্পত্তি তােমার বড়ই প্রিয়বস্তু, অমনি মটি দাস হইয়া ধনাগারে পড়িয়া থাকিবে। আর যদি ভাব যে, ধন তােমার দুষমন, বৃথা মায়ায় তােমাকে ভুলাইয়া রাখিয়াছে, তাহা হইলে দেখ দেখি তােমার মটা কি বলে? নানা কুচিন্তা করিয়া মনের গােলাম হইয়া বসিয়াছ; পাপ-সাগরে ডুবিয়া নির্ম্মল হৃদয়ে অশান্তির আসন পাতিয়াছ। আচ্ছা ভাই, তুমি তিন দিন বসিয়া এক ভাবে আল্লা আল্লা করিয়া, দেখ দেখি মন তােমার অনুগত হয় কিনা। জগত পিতার পবিত্র প্রেমের বেষ্টনীর মধ্যে একবার প্রবেশ করিতে পারিলেই মন আপন বশ হয়।  “আমি মানুষ হইয়া মানুষের যন্ত্রণা বুঝিয়াছি।বুঝিয়াছি, দিবারাত্রি মানুষ কি ভীষণতাপে তপ্ত খােলায় ভাজা হইতেছে। আমার কায়মনােবাক্যে কামনা, যদি কোটি কোটি যন্ত্রণা ভােগ করিয়াও একটি মানুষের তাপ দূর করিতে পারি, তবে আমি ধন্য হইব। এই আমার মন্ত্র, এই আমার সাধন। আমার কথা শুন, প্রকৃত শান্তি চিনিয়া তাহা ক্রয় করিয়া সুখী হও। মিছে কাজে ঘুরিও না; প্রাণ ভরিয়া প্রভুকে ডাক।

 “তােমার মনের উপর আবরণ পরিয়াছে বলিয়া তুমি কিছুই ভাল দেখিতে পাওনা। মন তত তােমার অধীন নয়, তাই সব কথা মনে রাখিতে পার না। ঐ পিশাচটা ছাড়াইয়া ফেল। প্রেম ভিন্ন এই পিশাচ তাড়াইতে পারিবে না। ওকি সহজে ছাড়িয়া যাইবে? দিবা রাত্রি প্রেমময় বিশ্বপিতাকে ডাক। অমনি এক আধ ডাকে হইবে না; দুই একবার চোখ বুজিয়া বসিলেও চলিবেনা, তন্ময় হইয়া ডাক, সিদ্ধি পিশাচ ছাড়িয়া পলাইবে।  “দেখ দুর্বল, সাধ করিলেই হাসি আসে; আর সাধ করিলেই কাদা আসে। ভােগ। লালসা, কলহ বিদ্বেষ, অনিষ্ট অহঙ্কার সাধ করিয়াছিলে, তাহা তােমার পূর্ণ হইয়াছে। আবার শােকের সাধ করিয়া ছিলে, শােক করিতেছ। অনেক সাধই করিয়াছ, অনেক সাধই মিটিয়াছে। কিন্তু সাধের মত সাধ একটিও ও কর নাই। প্রকৃত সাধের বস্তু সৃষ্টিকর্তা জগত পিতা, সাধ করিলেই তাহাকে পাওয়া যায়। হায় বােকা, তুমি সে সাধের সখ কর নাই, সে সাধের অপূর্ব মজাও পাও নাই।

 “তুমি বলিতে পার, অনেক খুজিয়াছি, সাধের জিনিষ পাই নাই। আমি বলি, তুমি খুঁজিবার মত খোঁজ নাই, সাধের মত সাধ কর নাই, তাই পাও নাই। তুমি সাধ করিয়াছিলে কিরূপে বড় হইবে; শুনিয়াছিলে তাহাকে পাইলে বড় হওয়া যায়, তাই তারে খুজিয়াছিলে। সাধ করে ছিলে বড় হইবে, বড় হইয়াছ। তিনি ইচ্ছা কল্পতরু, যে যাহা সাধ করিয়া চাহিয়াছে, সে তাহাই পাইয়াছে। আবার প্রাণ ভরিয়া সাধ করিয়া যদি তাহাকেই চাও, পাইবে। পাইবেনা কেন? তিনি তাপহর; তিনি যে তাপিতের জন্য ব্যাকুল, ডাকিলেই পাইবে। ভাবনা চিন্তা পাছে ফেলিয়া বিশ্বাসী হও। বড় সােজা পথে বড়ই গােল বাঁধাইয়াছ। বিশ্বাস বড়ই সােজাপথ, সােজাপথ ত্যাগ করিয়া কণ্টকাকীর্ণ বাঁকা পথে যাইও না; সরল বিশ্বাসে, সরল প্রাণে ডাক, পাইবে।

 “হে সন্তাপি, তুমি চুপ করিয়া বসিয়া চিন্তা করিতেছ কেন? তপন আকাশ, জল বাতাস, গাছ লতা, পশু পাখী সকলি বিশ্বকর্ত্তার নাম জপ করিতেছে। গাছের পাতা মর মরিয়া বলিতেছে, প্রভু কোথায়? পর্বত মাথা উচ্চ করিয়া দেখিতেছে, প্রভু কোথায়? সাগরের জল কুলু কুলু নিনাদে ছুটিয়া বেড়াইয়া খুজিতেছে, প্রভু কোথায়? দয়াময় প্রভুময় যে ত্রিভুবন। আর তুমি বসিয়া বসিয়া সন্তাপ করিতেছ? ভয় কি? তাহার এক নাম পতিত পাবন। যে আপনাকে পতিত বলে। করে; প্রভু আমার তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ফিরে। আল্লার নাম বলে বেড়াও, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিবেন।

 কেন তাপী বসিয়া আছ? আমার কথায় বিশ্বাস হয় না? বুঝিয়াছি, তুমি ভয় ও ভরসার মধ্যস্থলে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছ। ভয় ও ভরসা উভয়ই যে মানুষের শত্রু। তােমার ভরসারও কাজ নাই, ভয়েও কাজ নাই। কেবল খােদা খােদা কর। কেন, সন্দেহ কিসে? ভাববাদী মহাত্মা খলিল (আঃ) কি খােদার নাম লইয়া দুরন্ত রাজা নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড হইতে উদ্ধার পান নাই? পুণ্যাত্মা ইউনুস (আঃ) কি সমুদ্রস্থিত মৎসের উদর হইতে খােদার নামে রক্ষা পান নাই? ধৰ্মাত্মা নূহ (আঃ) কি খােদার নামে বিশ্বপ্লাবিত জল-তরঙ্গ হইতে বাঁচিয়া ছিলেন না? তােমার কাজ তুমি কর, তাঁর কাজ তিনি করিবেন।”

 দেবী রাবিয়ার ঈশ্বরের প্রতি অপার বিশ্বাস ছিল। একদা দুই সাধুপুরুষ দেবী রাবিয়ার দর্শনলাভার্থ উপনীত হন। তাহারা তখন ক্ষুধায় কাতর ছিলেন। সে সময় রাবিয়ার নিকট মাত্র দুই খণ্ড রুটি ছিল, তাহাই তিনি অতিথিদ্বয়ের সম্মুখে আনয়ন করিলেন। এমন সময় এক ক্ষুধার্থী ভিখারী আসিয়া সেই রুটি দুই খণ্ড প্রার্থনা করিল। দেবী রাবিয়া অম্লানচিত্তে রুটি দুই খানি ভিক্ষুককে দিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সাধু ব্যক্তিরা দুঃখিত হইলেন।

 আশ্চর্য্যের বিষয়, ইহার অত্যল্প কাল পরেই এক দাসী কতিপয় রুটি হাতে তপস্বিনী রাবিয়ার নিকট উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিল,― “আমার কর্ত্রী ঠাকুরাণী এই রুটিগুলি আপনার সেবার জন্য দিয়াছেন।” দেবী রাবিয়া সেগুলি হাতে লইয়া গণনা করিয়াই পরিচারিকার হাতে ফেরত দিয়া বলিলেন,―“ফিরিয়া যাও, তোমাদের ভুল হইয়াছে।” দাসী করযোড়ে বলিল,―“আজ্ঞে না, আমার গৃহস্বামিনী এ গুলি আপনাকেই দিয়াছেন।” তবুও দেবী রাবিয়া পুনরায় বলিলেন, ―“না, তোমাদের ভুল হইয়াছে, ফিরিয়া যাও।”

 পরিচারিকা তখন গৃহে ফিরিয়া তাঁহার কর্ত্রীকে সকল কথা বলিল। তখন কর্ত্রী ঠাকুরাণী আরও দুইখানি রুটি বৃদ্ধি করিয়া দাসীকে পুনশ্চ পাঠাইয়া দিলেন। দেবী রাবিয়া এইবার গণনায় বিশ খণ্ড রুটি পাইয়া গ্রহণ করিয়া অভ্যাগতদ্বয়কে আহার করাইলেন।

 সাধু পুরুষদ্বয় পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করিয়া পরে কৌতূহলাক্রান্ত বশতঃ দেবী রাবিয়ার নিকট এই রহস্যের নিগূঢ় তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলেন। দেবী প্রশান্ত ভাবে উত্তর করিলেন,—“আপনারা ক্ষুধার্থ জানিয়া আমার যথা সম্বল রুটি দুই খণ্ড আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলাম; কিন্তু ইত্যবসরে যখন ক্ষুধার্থ ভিক্ষুক আসিয়া তাহা প্রার্থনা করিল, তখনই আমার মনে পড়িল, জগতপতি বলিয়াছেন,—“যে প্রার্থীকে না ফিরাইয়া কিছু দান করিবে, সে তাহার দশগুণ পাইবে! অমনি আমি ভিখারীর প্রার্থনা পূর্ণ করিলাম। তৎপর যখন খোদার অনুগ্রহে আঠার খণ্ড রুটিসহ সেই দাসী আসিল, তখন তাহাদের ভুল হইয়াছে বলিয়া তাহা ফেরত দিলাম। অতঃপর ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞামত, আমার দুই খণ্ড রুটির পরিবর্ত্তে দশ খানি হিসাবে বিশ খণ্ড রুটি পাওয়া গেল।” যেমন অটল ধর্ম্ম বিশ্বাস, তেমনই অদ্ভুত ঘটনা।

 একদা কোনও ব্যক্তি দেবী রাবিয়ার দীনতা বিমোচন করিতে চাহিলে, তিনি বলিলেন,— “তোমাদের নিতান্ত ভ্রম। তোমরা জগতের কেহই আমার দারিদ্রতা মোচনকারী নহ। যিনি যথার্থ অভাব মোচনকারী তিনি কি কেবল ধনবানকে স্মরণ করেন, আর দরিদ্রকে ভুলিয়া থাকেন, মনে কর? এই সংসার যাহার রাজ্য, আকাশ যাহার চন্দ্রাতপ, কিছুর প্রয়োজন হইলে তাহারই নিকট প্রার্থনা করিয়া লইব।” আর এক বার এক ধনী ব্যক্তি এক থলি স্বর্ণ মুদ্রা দিতে আসিয়া দেবীর কঠোর আত্মসংযমের নিকট শঙ্কিত হইয়া ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয়।

 ঈশ্বর-প্রেমের আনন্দ-তরঙ্গে যখন। হৃদয় ভাসাইয়া দেয়, তখন মানবের আর আপন পর ভেদাভেদ জ্ঞান থাকেনা, পাপ, পুণ্যের আন্দোলনে হৃদয় অভিভূত হয় না। তখন সমগ্র পৃথিবীময় একমাত্র স্রষ্টার অনন্ত সত্ত্বা অনুভব করিয়া মানব অনন্ত প্রেম-সাগরে ভাসিয়া বেড়ায়। মানুষের এই ভাব অতিশয় উচ্চভাব,—মহাজন সাধ্য তীব্র সাধনারও অতীত ব্যাপার। দেবী রাবিয়া মানব-জীবনের এই সমুন্নত দুর্লভ অবস্থায় উপনীত হইতে পারিয়াছিলেন। তিনি প্রায়ই বলিতেন,—“এখন আর আমার পাপাসুরের সহিত কোন বিরোধ নাই। শত্রু মিত্র সকলই আমার নিকট সমান।”

 একদা এক ব্যক্তি শিরঃপীড়ায় কাতর হইয়া মস্তকে এক পটি বাঁধিয়া ছিল। ঈশ্বর প্রাণ দেবী রাবিয়া তদ্দর্শনে বলিয়াছিলেন,—“কি আশ্চর্য্য। তুমি একদিনের পীড়াতেই মস্তকে গ্লানির চিহ্ন ধারণ করিয়া বসিয়াছ, কিন্তু যখন সুস্থ থাক, তখন তো কৃতজ্ঞতার কোন চিহ্ন শিরে বাঁধনা?

 চিন্তার অতীত সচ্চিদানন্দের রূপ মানুষ চর্ম্মচক্ষে দেখিতে পায় না। তাঁহার অনন্ত ভাবমাধুর্য্য বাক্যে বিকাশ করিতে পারে না, কেবল অন্তর্য্যামীর অনন্ত সত্ত্বা হৃদয়ই উপলব্ধি করিতে পারে। তপস্বিনী রাবিয়া এইজন্য বলিতেন,—“ঈশ্বরের দিকে নয়নের স্থান নাই, রসনার পথ নাই; তাঁহার সম্বন্ধে হৃদয়েরই কার্য্য।”

 দেবী রাবিয়া সমস্ত রজনী উপাসনা করিয়া কাটাইতেন; প্রাতরুপাসনার পর বসিয়া বসিয়াই কিঞ্চিৎ নিদ্রা যাইতেন। উপাসনাজীবনে একদিনও তিনি মাটিতে পিঠ রাখিয়া সুখে শয়ন করেন নাই। তাঁহার পরিধেয় বস্ত্রও মলিন ও জীর্ণ ছিল। মাত্র একটি ভগ্ন জলপাত্র দিয়া তিনি জলপান ও আচমনক্রিয়াদি সম্পন্ন করিতেন।

 সাধ্বী রাবিয়া আজীবন কৌমার্য্যব্রত পালন করিয়া চরিত্রবলের অতুলনীয় জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়াছেন। কঠোর উপাসনা রত হইয়া দেবী ধীরে ধীরে পরমেশ্বরে আত্ম সমপর্ণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। রোগ শয্যার শায়িত থাকা। কালে কেহ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন,— “আপনার কিছু খাইতে ইচ্ছা হয় কি?” তিনি প্রশান্ত-চিত্তে উত্তর করিয়াছিলেন,—“সুমিষ্ট খোর্ম্মা ফল আমার অতি প্রিয়। তুমি জান, এ স্থানে তাহা কত প্রচুর; কিন্তু এ পর্য্যন্ত আমি তাহা খাইয়া দেখি নাই। আমি দাসী, আমার আবার ইচ্ছা অনিচ্ছা কি গো? ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।” এইরূপে হিজরী ১৮৫ সাল—৮০১ খৃষ্টাব্দে দেবী রাবিয়ার জীবন-প্রদীপ নিবিয়া গেল।

 ইব‍্নুল জওজী সাফাতুস্ সাফাত গ্রন্থে দেবী রাবিয়া সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন,—“আব্দা নামে দেবী রাবিয়ার এক শিষ্যা ছিলেন; তিনি সর্বদা তাহার কাছে থাকিতেন। আব্দা বলেন “দেবী রাবিয়া সমগ্র রাত্রি উপাসনা করিতেন; ঊষাকালে মাত্র সূর্য্যোদয় হইবার পূর্ব্ব পর্য্যন্ত উপাসনা-মন্দিরেই একটু নিদ্রা যাইতেন। কিন্তু দিবাকরের আলোক চোখে পতিত হইতেই শয্যা ছাড়িয়া ব্যস্ত হইয়া বলিতেন,—“ওরে মন, কত দিন তুই ঘুম ঘোরে অচেতন থাকিবি? কবে ঘুমের মোহ ত্যাগ করিবি? সম্মুখে তো অনন্তনিদ্রা শয্যা পাতিয়া রহিয়াছে। শীঘ্রই তো কবরে পড়িয়া সুখে ঘুমাইবি। কয়টা দিন চেতন থাকিয়া ঘুমের সম্বল লইয়া চল্।”

 দেবী রাবিয়ার মৃত্যুর এক বৎসর পর একদিন আব্দা তাঁহাকে সপ্নে দেখিয়া বলিয়াছেন —“দেখিলাম, দেবী রাবিয়া আকাশের চাঁদের মত দশদিক আলো করিয়া এক উচ্চ সিংহাসনে বসিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার পরিধানে অতি উজ্জ্বল সাটিন বস্ত্র। এত চাকচিক্য, এত কোমল সাটিন কাপড় আমি আর কোথাও কখন দেখি নাই। দেখিলাম, তিনি স্বর্গরাজ্যের দীপ্তিময়ী মহারাণী। আমি তাঁহার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি আমাকে বলিলেন,—“আব্দা, সর্ব্বদা নিষ্কাম ভাবে খোদার ধ্যান করিও, কবরে শান্তি পাইবে।”

 দেবী রাবিয়ার নিষ্কামত্ব বিষয়ে কথিত আছে,—তিনি জগদীশ্বরে চিত্তসমাধান করিয়া সর্ব্বদাই বলিতেন,—“হে খোদা, যাহার প্রাণ সুখের আশায় তোমায় ভালবাসে, তাহাকে তুমি জীবন্ত দগ্ধ করিয়া মার।”

 তিনি সকলকেই বলিতেন—“যেমন পাপ গোপন কর, তেমনি সৎকার্য্য করিয়াও তাহা গোপনে রাখিও”।  লোক সমাগম হইলে, তিনি প্রায়ই বলিতেন,—“ওগো প্রভো, দাসীর চিত্ত তোমারই পবিত্র সংসর্গের জন্য পৃথক রাখিয়াছি; এখানে যাহারা আমার মঙ্গল প্রয়াসী, তাহাদের লাগি এই তুচ্ছ দেহ রহিয়াছে। আগন্তুক অতিথির সঙ্গী আমার এই মাটির দেহ; তুমি প্রিয়তম দাসীর অন্তরের সাথী।”

 মঙ্গলময়ী মাতা (উম্মুল খায়ের) রাবিয়া দেবীর সমাধি জেরুসালমের পূর্বাংশে জবলুত্তুর (mount of olives) পর্ব্বতের উপর বিদ্যমান। সে স্থান এখন তীর্থে পরিণত হইয়াছে। বৎসর বৎসর তথায় বহু ভক্তের সমাগম হয়।

 প্রাতঃস্মরণীয়া কুমারী দেবী রাবিয়া যদিও ক্ষণ ভঙ্গুর পৃথিবী ত্যাগ করিয়া চির শান্তিময় স্বর্গ রাজ্যে প্রস্থান করিয়াছেন, কিন্তু তথাপি তাঁহার কঠোর সাধনার পুণ্য-প্রভা, নিষ্কাম প্রার্থনার নৈবেদ্য, পাপী তাপী উদ্ধারারাধনার অর্ঘ্য, মুক্তির আশীর্ব্বদ পুস্পাঞ্জলী—আজিও ইস‍্লাম জগত বিমোহিত করিতেছে।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত বলে অনুমান করা হচ্ছে কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।

বিঃদ্রঃ এই লেখা/রচনা/বইয়ের লেখকের মৃত্যুসাল কোনও তথ্যসূত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। ভবিষ্যতে কোনো তথ্যসূত্র দ্বারা লেখকের মৃত্যুসাল সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে এলে, এই লেখকের রচনার প্রকৃত কপিরাইট অবস্থা যাচাই করা সম্ভব হবে। নতুন তথ্য অনুসারে এই বইটির কপিরাইট অবস্থা ভবিষ্যতে বিচার করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।