দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয়

চরিতাষ্টক

বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার।

 এই সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন পণ্ডিতের জীবনবৃত্ত সংগ্রহের কোন উপায় নাই। উঁহার চরিত সম্বন্ধে কোন পুস্তকাদি নাই এবং অধিক পরিমাণে গল্প করিতে পারেন এরূপ প্রাচীন লোকও, প্রায় নাই। অনেক যত্নে যাহা কিছু সংগৃহীত হইয়াছে তাহা সম্পূর্ণ চরিতবৃত্তান্ত না হইলেও উহাদ্বারা উক্ত আচার্য্যের বিষয় অনেকাংশে অবগত হওয়া যাইবে।

 ইনি, নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্র এবং বর্দ্ধমান রাজ চিত্র সেনের সময় বর্ত্তমান ছিলেন। কলিকাতার যোড় বাঙ্গালাস্থিত কোন দেবমন্দিরে সংযোজিত প্রস্তর ফলকে একটী সংস্কৃত কবিতা খোদিত ছিল। ঐ কবিতাটী বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের রচিত। উহা ১১৫৩ সালে প্রস্তুত হইয়াছিল। ১২৭০ সালের মহাঝড়ে প্রস্তর-ফলক বহুধা ভগ্নহওয়ায় কবিতার মর্ম্মগ্রহণ করিতে পারা যায় নাই। আপাততঃ ইহা অপেক্ষা অধিকতর সূক্ষ্মরূপে তাঁহার জীবিত কালের সময় নিরূপণ করা গেল না। সুবিখ্যাত গুপ্তপল্লী গ্রামে অতি সম্ভ্রান্ত শোভাকর বংশে বাণেশ্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম রামদেব তর্কবাগীশ। রাম দেবের দুই স্ত্রী, দুই স্ত্রীতে তাঁহার তিন সন্তান হয়। প্রথমার গর্ভে রামনারায়ণ ন্যায়লঙ্কার এবং দ্বিতীয়ার গর্ভে বাণেশ্বর ও রামকান্ত। রামকান্ত জ্ঞানোপার্জ্জন বিষয়ে যোগ্যতা প্রদর্শন করিতে পারেন নাই বটে; কিন্তু শুনাযায় বিষয় বুদ্ধি, বাক্‌পটুতা এবং রসিকতা বিষয়ে তিনি একজন প্রধানের মধ্যে গণ্য ছিলেন। তাঁহার বাক‍্পটুতা বিষয়ক দুই একটা কথা যথা স্থানে বলা যাইবে।

 বাণেশ্বর কত বয়সে বিদ্যারম্ভ করেন, কতদিন বিদ্যালোচনায় প্রবৃত্ত ছিলেন এবং কোন্ কোন্ শাস্ত্রের কত দূর কিরূপে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, এ সকলের যথাযথ বিবরণ দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যাহা জানা গিয়াছে তদ্দ্বরাই নিঃসংশয়িত রূপে সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে যে, তিনি পিতার নিকট শিক্ষারম্ভ করিয়া অতি অল্পদিনের মধ্যে অসাধারণ বিদ্যা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। শিক্ষাবিষয়িণী ক্ষমতানুসারেই শিক্ষা সাধনের তারতম্য হইয়া থাকে। বুদ্ধি, মেধা, শ্রমশক্তি প্রভৃতি গুণগ্রাম, যাহার যত অধিক, সে তত অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণে কৃতকার্য্য হয়। এই কারণে বিদ্যালয়ের বালকগণের মধ্যে, কোন নির্দিষ্ট বিষয়, কাহাকে বা শীঘ্র, কাহাকে বা বিলম্বে শিখিতে দেখা যায়। যে বিষয় শিখিতে সচরাচর যত শ্রম ও সময়ের প্রয়োজন; কাহাকে অপেক্ষাকৃত অল্প শ্রম ও সময়ে সেই বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে দেখিলে সামান্য লোকে সেইরূপ কৃতকার্য্যতাকে দৈব বিদ্য বলিয়া প্রতিপন্ন করে। বিশেষতঃ বঙ্গবাসিগণের প্রকৃতিই এইরূপ যে, কোন ব্যক্তিতে একটু কিছু অসাধারণ দেখিলেই তাহাতে বস্তু[১] আছে বলিয়া সিদ্ধান্ত করেন। বোধ হয়, এই কারণেই কালিদাস, শ্রীধর, বাণেশ্বর প্রভৃতি অসাধারণ শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণের বিদ্যা, দৈবলব্ধ বলিয়া লোকে খ্যাত হইয়াছে। এইরূপে দৈবশক্তির উপর নির্ভর করিয়া প্রকৃত কারণের অনুসরণ না করতেই পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তিগণের শিক্ষা বিবরণ দুষ্প্রাপ্য হইয়াছে। বাণেশ্বরের দৈব বিদ্যার নিম্নলিখিত রূপ জনশ্রুতি পাওয়া যায়।

 ঘরে ঘরে মন্ত্রগ্রহণ করা গুপ্তপল্লীর শোভাকরবংশের চিরাচরিত রীতি। কিন্তু বাণেশ্বর স্বপ্নে এইরূপ আদিষ্ট হন যে, “তুমি খানাকুল কৃষ্ণনগর নিবাসী ** বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট দক্ষিণ প্রয়াগের[২] গঙ্গাতীরে * * দেবতার মন্ত্র গ্রহণ করিবে”। কৃষ্ণনগর নিবাসী উক্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই দিন রজনীতে উহার বিপরীত প্রকার স্বপ্ন সন্দর্শন করেন। এই স্বপ্নানুসারে নির্দ্দিষ্ট স্থানে বাণেশ্বর মন্ত্র গ্রহণ করিয়া যপ আরম্ভ করেন। কয়েক বৎসর যপের পর তিনি সিদ্ধি লাভ করিলেন। এই সিদ্ধি নিবন্ধনই তিনি অসাধারণ বিদ্যালাভ করিয়াছিলেন।

 গুপ্তপাড়ার যে ঘাট কোটাবাড়ীর ঘাট বলিয়া খ্যাত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের নিবাস তাহারই নিকট ছিল। বোধ হয়, গুপ্তপাড়ার ঐ পল্লীতে বিদ্যালঙ্কারই সর্ব্ব প্রথমে কোটা করেন। যে হেতু তাঁহার কোটার নামানু সারেই, উক্ত ঘাট কোটাবাড়ীযর ঘাট বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছে।

 বাণেশ্বরের বাল্যকালের এক কৌতুকাবহ গল্প প্রসিদ্ধ আছে। এই শোভাকর বংশে বাণেশ্বরের কিছু পূর্ব্বে মথুরেশ নামক একটী বালক ছিল। এই বালকটী পাঠে অনাবিষ্ট হইয়া সর্ব্বদা দৌরাত্ম করিয়া বেড়াইত। তাহার পিতা সর্ব্বদাই তাহাকে তাড়না করিতেন। একদিন নিতান্ত বিরক্ত হইয়া ব্রাহ্মণীকে বলিলেন, “তুমি আজ মথুরেশকে ছাই খেতেদিও।” সাধ্বী পত্নী, পতির আজ্ঞালঙ্ঘন পাপ মনে করিয়া সেই দিন মথুরেশের ভোজন পাত্রের এক পার্শ্বে এক খানি অঙ্গার দিয়াছিলেন। মথুরেশ ভোজন কালে তাহা জানিতে পারিয়া জননীকে জিজ্ঞাসা করিলেন। জননী প্রথমতঃ অনেক ছল করিয়া পরে প্রকৃত বিষয় প্রকাশ করিলেন। মথুরেশ তখনি ভোজনে বিরত হইয়া গৃহ-বহির্গত হইলেন। বিদেশে গিয়া যে রূপেই হউক, নানা বিদ্যায় পণ্ডিত হইয়া বহু বৎসর ভ্রমণের পর একদিন শ্যামাপূজার রজনীতে সন্ন্যাসীর বেশে নিজ গৃহে উপস্থিত হয়েন। প্রতিমার সম্মুখ প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান হইয়া যদৃচ্ছাক্রমে শ্যমাশক্তির স্তবাত্মক অষ্টাধিক শত সংস্কৃত শ্লোক[৩] আবৃত্তি করিলেন। ক্ষণকাল পরে, “যদি কেহ শ্লোক কয়টী লিখিয়া রাখিত” এইরূপ রলিয়া অল্প আক্ষেপ প্রকাশ করিলেন। সন্ন্যাসীর স্তবপাঠে সকলেই মোহিত ও আর্দ্র হইয়াছিলেন; সুতরাং তাঁহার আক্ষেপে সকলেই আক্ষিপ্ত হইলেন। ঐ সময়ে একটা বালক নিজ পিতার সহিত সন্ন্যাসীর নিকট দণ্ডায়মান ছিল। সে; “আমি সব শিখিয়াছি।” বলিয়া সমুদয় অবিকল পাঠ করিল। বালকের পিতা তাহা শুনিয়া বলিলেন; “কালে বাণুও পণ্ডিত হবে।” যিনি এতাদৃশ শ্রুতিধর পুত্রের প্রতিও তাদৃশ ব্যঙ্গোক্তি করেন, সেই রামদেব তর্কবাগীশ কত বড় লোক, ইহা দ্বারা তাহারও কতক আভাস পাওয়া যাইতেছে। শুনা যায়, রামদেব সমস্ত মহাভারত স্বহস্তে লিখিরা কণ্ঠস্থ করিয়াছিলেন।

 বাণেশ্বর বয়ঃ প্রাপ্ত ও পণ্ডিত হইয়া মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার একজন সুযোগ্য ও আদরণীয় সভাসদ হইয়াছিলেন। রাজা তাঁহাকে অত্যন্ত ভক্তি ও সম্মান করিতেন। এই স্থানে দীর্ঘ কাল ছিলেন।

 রাজা নবকৃষ্ণ ও তাহার যথেষ্ট আদর ও সম্মান করিতেন। তিনি কলিকাতার শোভাবাজারে বিদ্যালঙ্কারের একটা বাড়ী করিয়া দেন। ঐ বাড়ী বর্তমান আছে এবং উহাতে তাঁহার বংশীয়েরা অদ্যাপি কলিকাতার মধ্যে মহা সমাদরে বাস করিতেছেন। এই বাড়ীর বাস সম্বন্ধেই কলিকাতার বিখ্যাত বসাক দিগের বাটাতে কোন শ্রাদ্ধীয় সভায় বিদ্যালঙ্কারের গমন হয়। এই শূদ্র সংসর্গ প্রযুক্ত-রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁহার প্রতি কিঞ্চিৎ অভক্তি প্রকাশ করেন। রাজার এই অভক্তি ভাব, বাণেশ্বর যে মুহূর্ত্তে জানতে পারেন, সেই মুহূর্ত্তেই কৃষ্ণনগর ত্যাগ করিয়া বর্দ্ধমানে প্রস্থান করিলেন। বর্দ্ধমান রাজ চিত্রসেন তাঁহাকে পরম সমাদরে গ্রহণ করিয়া নিজ সভার প্রধান অসন প্রদান করিলেন।

 আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা এইরূপ নির্দ্দেশ করিয়াছেন যে, ইহলোকে নরত্বই সর্ব্বাপেক্ষা দুর্লভ, নরত্ব অপেক্ষা বিদ্যা, এবং বিদ্যা অপেক্ষা কবিত্ব দুর্লভ। কিন্ত‌ু শক্তিই সর্ব্বাপেক্ষা সুদুর্লভ। চিন্তার উপযুক্ত রূপে অবকাশ পাইলে অনেকেই উৎকৃষ্ট ভাবশুদ্ধ কবিতাদি রচনা করিতে পারেন। কিন্তু বিষয় দর্শন মুহূর্ত্তেই অক্লেশে অনুপম শ্লোকাদি রচনা করা, সাধারণ ক্ষমতার কর্ম্ম নহে। ঐ ক্ষমতাকেই শক্তি বলে। বাণেশ্বর বিদ্য}লঙ্কারে এই চুক্তি প্রচুর পরিমাণে দৃষ্ট হইত। ঈশ্বরের এই অসামান্য দান, তাঁহাতেই দত্ত হইয়াছিল। যে সময়ে যে কথা বলা উচিত, যিনি তদ্দণ্ডেই ঠিক সেইরূপ কথা বলিতে পারেন লোকে তাঁহাকে উপস্থিত বক্তা বলে। তদনুসারে বাণেশ্বরকে উপস্থিত কবি বলা যাইতে পারে। কারণ তিনি উৎকৃষ্ট কবিতা দ্বারা ঐরূপ উপস্থিত বক্ত‌ৃতা করিতে পারিতেন। বোধ হয়, উপস্থিত কবিত্ব বিষয়ে এ দেশে বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারই অদ্বিতীয় ছিলেন।

 কোন সময়ে বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সহিত তরণীযোগে ভাগীরথী বহিয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন করিতেছিলেন। ত্রিবেণী অতিক্রম করিয়াই রাজা বিদ্যালঙ্কারকে জিজ্ঞাসা করিলেন। “মহাশয়, ভাগীরথীকে এই স্থানে এত মন্দ গামিনী দেখাইতেছে কেন?”, বিদ্যালঙ্কার। “তাহার কারণ আছে, শ্রবণ করুন” বলিয়া নিম্ন লিখিত কবিতাটী বলিলেন।

“সগরসন্ততিসন্তরণেচ্ছয়া প্রচলিতাতিযবেন হিমালয়াৎ।
ইহ মন্দমুপৈতি সরস্বতী যমুনয়োর্ব্বিরহাদিব জাহ্নবী।”

 ভাগীরথী সগর সন্তানগণের উদ্ধার বাসনায় সরস্বতী ও মমুনা নাম্নী সখীদ্বয় সমভিব্যাহারে হিমালয় হইতে অতিবেগে গমন করিতেছিলেন, এই স্থানে ঐ সখী দ্বয়ের সহিত বিরহ নিবন্ধন জাহ্নবীর এতাদৃশী অবস্থা হইয়াছে। ফলতঃ নদী যত সম ভূমিতে যায় ততই মন্দবেগ হইয়া থাকে। বিশেষতঃ ত্রিবেণী হইতে সরস্বতী ও যমুনা নাম্নী শাখা নদী দুই টি ভিন্ন ২ দিকে গমন করায় উক্ত স্থানে ভাগীরথীর ঐরূপ অবস্থাই সম্ভব। কি! আশ্চর্য্য শক্তি! কি অদ্ভুত কবিত্ব! এমন বিশুদ্ধ ভাব সমন্বিত ললিত কবিতা, দীর্ঘ কাল চিন্তার পর সুকবির মুখ হইতে নির্গত হয় কি না সন্দেহ।

 অপর কোন সময়ে কৃষ্ণ চন্দ্রের প্রতিষ্ঠিতা কালীর হৈম কিরীট অপহৃত হয়। তখন কর চালনা গণনায় লোকের বিশ্বাস ছিল। ঐ প্রক্রিয়ায়, “চৌরোহরঃ” এই পদ লিখিত হইল। তদনুসারে সেই কালী পুজকের ভ্রাতা হর নামক কোন ব্যক্তির প্রতি সন্দেহ করা হইল। সে চুরি কয়াছিল কিনা তাহার নিশ্চয় নাই; কিন্ত‌ু রাজ দণ্ড ভয়ে সে অত্যন্ত ভীত হইয়াছিল। কোন উপায় না দেখিয়া অন্যতম সভাসদ বাণেশ্বরের শরণ লইল। তিনি শরণাগত ব্রাহ্মণের রক্ষায় কৃত সঙ্কল্প হইয়া তাহাকে অভয় দিয়া বিদায় করলেন।

 প্রত্যহই রাজসভায় গিয়া থাকেন। এক দিন সৈনিক পুরুষেরা চৌর্য্যাপরাধী হরকে রাজ সম্মুখে উপস্থিত করিয়া বিচার প্রার্থনা করিল। বিদ্যালঙ্কার যেন কিছুই জানেননা এইরূপ ভাণ করিয়া উপস্থিত ঘটনার সবিশেষ বৃত্তান্তু সভ্য গণকে জিজ্ঞাসা করিলেন। সভ্যগণ উত্তর দিলেন। তিনি মুদিত নেত্রে রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমার বোধ হইতেছে এ নির্দ্দোষী, যে ব্যক্তি কিরীট চুরি করিয়াছে আমি যেন জানিতে পারিয়াছি, শ্রবণ করুন।” বলিয়া নিম্ন লিখিত কবিতাটী আবৃত্তি করলেন;—

“জলে লবণবল্লীনং মানসং তম্মনোহরম্।
মনোজিহীর্ষয়া দেব্যাঃ কিরীটং হুরতে হরঃ॥”

লবণ জলে যেরূপ লীন হয়, মনোহর কিরীটে দেবীর মন সেইরূপে লীন হইয়াছিল। দেবীর মনোহরণাভিলাষী শূলপাণি দেখিলেন, তাঁহার মন কিরীটেতে লগ্ন হইয়া আছে। অতএব তিনি কিরীট শুদ্ধই অপহরণ করিয়াছেন। পরম ভক্ত কৃষ্ণ চন্দ্র, কবিবরের মুখ হইতে এই কথা শুনিয়া অশ্রুপাত করিলেন এবং মানব হরকে নিষ্কৃতি দিলেন।

 যদিও বিদ্যালঙ্কার এস্থলে কিঞ্চিৎ সময় পাইয়াছিলেন এরূপ কল্পনা করিয়া এই উপস্থিত কবিত্বের তত প্রশংসা না করা যায়, তথাপি ঐ শ্লোকটী একজনের বিপদুদ্ধার মূলক হওয়াতেই হার শত গুণ গৌরব প্রকাশ পাইতেছে।

 একদা রটন্তী পূজার রজনীতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নিজ বাটীতে কোন ব্যক্তিকে দেখিয়া “কিমদ্ভুতং” এই বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন। সে ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ উক্ত পদান্ত একটী কবিতা বলিলেন। সে কবিতাটি এই;—

“শিবস্য নিন্দয়া যয়া তাজদ্বপুঃ স্বকীয়কম্।
তদং ঘ্রি পঙ্কজদ্বয়ং শবে শিবে কিমদ্ভতম্॥”

 যিনি শিবের নিন্দা শ্রবণে আপনার শরীর ত্যাগ করিয়া ছিলেন, সম্প্রতি তাঁহার পদদ্বয়, সেই শবাকার শিবে সংস্থাপিত হইয়াছে, ইহাই অদ্ভত। ঐ ব্যক্তি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। পূর্ব্বে উল্লেখ করা হইয়াছে তিনি কোন সময়ে কৃষ্ণনগরের রাজ সভাত্যাগ করিয়া বর্দ্ধমান গিয়াছিলেন। হঠাৎ বিনা আহ্বনে তাঁহাকে গৃহাগত দেখিয়া রাজা কিমদ্ভ‌ূতং” শব্দ প্রয়োগ করেন। তিনি যে কি নিমিত্ত বিনা আহ্বানে কৃষ্ণনগরে উপস্থিত ইইয়াছিলেন এবং তাহার পর ঐ স্থানে থাকিলেন কি বর্দ্ধমানে গমন করিলেন, তোমার কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে এই মাত্র বোধ হয় যে, তিনি কৃষ্ণনগর রাজ সভায় কেবল সন্মান লাভের প্রত্যাশায় থাকিতেন না। রাজার সমাদর ও প্রণয় প্রকাশে বাধিত হইয়াছিলেন। অপর কৃষ্ণনগরের ন্যায় বর্দ্ধমানে তাহার গুণের গৌরব হয় নাই। এই সকল কারণেই তিনি বর্দ্ধমান হইতে কৃষ্ণনগরে আসিয়া ছিলেন। যদি ইহাই সত্য হয়, তবে তিনি এই আগমনের পর কৃষ্ণনগরেই ছিলেন, এরূপ সিন্ধান্ত করাও অসঙ্গত হয় না। বাণেশ্বরবিদ্যালঙ্কারের কৃষ্ণনগরে পুনরাগমন সম্বন্ধে যাহা কিছু বলা হইল, নিম্নলিখিত গল্পটী তাহার পোযকতা করিতেছে।

 বানেশ্বর বিদ্যালঙ্কার সম্মুখে উপস্থিত হইলেই, রাজেন্দ্র বাহাদুর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গাত্রেত্থান করিতেন। তাহাতে নবদ্বীপের কতকগুলি বিখ্যাত অধ্যাপক, গুরু পুরোহিত ব্যাতীত আর কাহাকে দেখিয়াই রাজার গাত্রোত্থান করা উচিত নহে, বলিয়া অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহাতে কৃষ্ণচন্দ্ররায় উত্তর করেন, “বিদ্যালঙ্কার মহাশয়কে আমার গুরু বলিলেও হয়, পুরোহিত বলিলে ও হয়।”

 বাণেশ্বরবিদ্যালঙ্কার একবার পুরুষোত্তমে রথযাত্রাদর্শনে গিয়াছিলেন। সেই বার রথ হইতে বলরাম ঠাকুরের বিগ্রহ ভুপতিত হয়। তদ্দর্শনে তৎকালীন উড়িষ্যারাজ “ঔৎপতিকং” এই শব্দ উচ্চারণ করেন। বাণেশ্বর, রাজাকে সম্বোধন করিয়া ঐ শব্দ অবলম্বনে নিম্নলিখিত কবিতাটী বলিলেন;—


“ঔৎপাতিকং তদিহ দেব বিচিন্তনীয়ং
নারায়ণো যদি পতেদথবা সুভদ্রা।
কাদম্বরী-মদ-বিঘূর্ণিত লোচনস্য।
যুক্তং হি লাঙ্গল-ভৃতঃ পতনং পৃথিব্যাম্॥”

রথ হইতে ঠাকুর পড়া অশুভজনক, রাজা “ঔৎপাতিকং” শব্দ দ্বারা এই অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাণেশ্বর বলিলেন, নারায়ণ কিম্বা সুভদ্রা ভূপতিত হইলে উৎপাত আশঙ্কা করা যাইত; যাঁহার লোচন কাদম্বরী-মদপানে নিয়ত বিঘূর্ণিত হইতেছে, সেই হলধরের ভূপতন কোন রূপেই অসম্ভব বা অশুভ জনক নহে। রাজা ইহাতে সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করেন।

 বাণেশ্বর অতি সোজা লোক ছিলেন। পূর্ব্বে উল্লেখ করা হইয়াছে, কনিষ্ঠ রাম কান্ত তাহার ন্যায় পণ্ডিত ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার বুদ্ধি ও ক্ষমতা ছিল। তিনি এক দিন কোন কারণে ক্রব্ধ হইয়া জ্যেষ্ঠকে বলিলেন, মহাশয়, বিষয় বিভাগ করিয়া দিন, আমি পৃথক্ হইব। বাণেশ্বর বলিলেন, ভাই কি বিভাগ করিব, এসমুদায় বিষয়ই আমার স্বোপার্জ্জিত, ইহার এক কপর্দ্দকেও তোমার অধিকার নাই। পৈতৃক বিষয়ের মধ্যে এক খানি তৃণাচ্ছাদিত ক্ষুদ্র কুটীর উহা ভাগ করিয়া লইতে পার।

 রামকান্ত বলিলেন, তা কেন হবে। যিনি ইচ্ছা, উপার্জ্জ্বন করুন, একান্নবর্ত্তী ভ্রাতৃ-গণের সকলেই সমান অংশী। অতএব এই সমস্ত বিষয়েরই অর্দ্ধাংশ আমার প্রাপ্য।

 বাণেশ্বর বলিলেন, সে কেমন কথা। আমি উপার্জ্জ্বন করিয়াছি, তুমি লইবে কেন? আমি কখন অংশ দিব। না। তবে আমাকে রাজ দ্বারে অভিযোগ করিতে হইল, বলিয়া রামকান্ত গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন।

 কয়েক মাস পরে বাণেশ্বর একদিন নিমন্ত্রণে যাইবার জন্য গঙ্গাপার হইতেছেন, এমন সময়ে এক জন শ্মশ্রু ও লোহিত পরিচ্ছদধারী পুরুষ আপনাকে নবাবের পেয়দা বলিয়া পরিচয় দিয়া খেয়ার নৌকা ডাকিতে লাগিল। মাজী ভয়ে কম্পমান। নবাবের পেয়দা ডাকিতেছে, কি করে আধাগাঙ গিয়াও নৌকা ফিরাইয়া আনিল। নবাবের পেয়াদা দেখিয়া বাণেশ্বরের বাক‍্শক্তি রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, কাঁপিতেছেন।

 নৌকা কুলে লাগিল। পেয়াদা নৌকায় উঠিয়া বাণেশ্বরের দিকে ঘন ঘন তাকাইতে লাগিল। বাণেশ্বর বক্র লোচনে এক এক বার দেখিতেছেন; আর হৃদয়ের খানিক খানিক রক্ত শুকাইয়া যাইতেছে। পেয়দা হঠাৎ তাঁহার পা ধরিয়া প্রণাম করিল। বাণেশ্বর কারণ জিজ্ঞাসা করবেন কি মুখে কথা নাই, ভয়ে অর্দ্ধেক প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। “তুমি কে? কি জন্য প্রণাম কর” সঙ্কেতে বলিলেন।

 পেয়াদা কহিল, মহাশয়, আমাকে চিনিতে পারেন নাই? আমি আপনার কনিষ্ঠ রামকান্ত। আপনি বিষয়ের ভাগ না দেওয়াতে আমি মুরশিদাবাদে গিয়া নবাব সাহেবের নিকট সমুদায় জানাইয়াছিলাম। তিনি আপনাকে অনুমতি পত্র দিবার জন্য পেয়াদা পাঠাইবার মানস করিলেন; কিন্তু তখন তথায় পেয়াদা উপস্থিত না থাকায় আমাকে বলিলেন, রামকান্ত, এখানে ত পেয়াদা উপস্থিত নাই, অতএব তুমিই পেয়াদার পোসাক পরিয়া অনুমতি পত্র লইয়া যাও। আমাকে এই পোসাক এবং অনুমতি পত্র প্রদান করিয়াছেন। আমি সেই পোসাক পরিয়া অনুমতিপত্র আনিয়াছি; এই লউন বলিয়া তাঁহার হাতে একখানি পত্র দিলেন। বাণেশ্বর, বলিলেন, “খোল্,—আগে তোর গায়ের পেয়াদাটা খোল্, —তারপর পত্র দে।”

 পরে পত্রে দেখিলেন, নবাব, রামকান্তকে বিষয়ের অর্দ্ধাংশ দিতে অনুমতি করিয়াছেন। তৎক্ষণাৎ তল্পি হইতে, তুলট ও দোয়াৎ কলম বাহির করিয়া রামকান্তকে অর্দ্ধেক বিষয় লিখিয়াদিলেন। শুনা যায়, ঐ পত্র অথবা তাহার অনুলিপি অদ্যাপি তাঁহার বংশীয়দিগের গৃহে আছে।

 রামকান্তের দুই একটা কথা বলিতে আমরা প্রতিশ্রুত আছি। রামকান্ত প্রায়ই বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণনগরের রাজসভায় অবস্থিতি করিতেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায় তাঁহারও যথেষ্ট সমাদর করতেন। বিশেষতঃ তাঁহার কথা শুনিতে রাজার বিলক্ষণ আমোদ ছিল। যখন তখন তাঁহার সহিত কথোপকথন করিতেন। এক দিন রামকান্ত বলিলেন, “মহারাজ, পেয়ে যে সম্ভষ্ট হইয়াছি, না পেলে তারও তুষ্ট হই।” প্রথমে কেহই কিছু বুঝিতে পারিলেন না। পরে জানিলেন, রামকান্ত জ্যেষ্ঠের সহিত গৃহ গমনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া আবশ্যক যাবতীয় দ্রব্য পাইয়াছেন, এখন এক খানি নৌকা পাইবার প্রার্থনা করিতেছেন। অন্য এক দিন কহিলেন; “মহারাজ! বলিলে বলা যায়; না বলিলে মন ভাঙ্গা থাকে।” রাজভাণ্ডার হইতে বিদ্যালঙ্কার ও রামকান্ত প্রতিদিন এক মন তণ্ড‌ুলের সিধা পাইতেন। এক জন চাকর ঐ সিধা হইতে চাউল চুরি করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। রামকান্ত কিছু দিন এই ক্ষতি সহ্য করিয়া পরে ইহা উপরি উক্ত বাক্যে রাজাকে জানাইয়াছিলেন। রামকান্ত প্রতি নিয়তই এইরূপ হেঁয়ালির ভাষায় কথা কহিয়া আমোদ করিতেন।

 এদেশের মধ্যে নৃপশ্রেষ্ঠ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময় নবদ্বীপের অবস্থা অতি উৎকৃষ্ট ছিল। তৎকালে এখানে প্রধান প্রধান পণ্ডিত বর্ত্তমান ছিলেন। তাদৃশ সময়ে বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার সেই নবদ্বীপে, এবং কলিকাতা, উড়িষ্যা, বর্দ্ধমান প্রভৃতি প্রধান প্রধান স্থানে যথেষ্ট আদর ও গৌরবলাভ করিয়াছিলেন। “বিদ্বান্ সর্ব্বত্র পুজ্যতে” বানেশ্বর ইহার প্রমাণ দিয়া গিয়াছেন।


  1. দেবাবেশ।
  2. ত্রিবেণী।
  3. এই অষ্টোত্তর শত শ্লোক অতি উৎকষ্ট কবিত্ব শক্তিসম্পন্ন। শ্যামা ক পলতানামে খ্যাত হইয়া অদ্যাপি পুস্তকাকারে বর্ত্তমান আছে।