ধম্মপদ/বুদ্ধ বর্গ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্দ্দশ সর্গ—বুদ্ধবর্গ।

পারে না যাহায় জয় কেহ পরাজিতে
মহত্ত্ব যাহার কেহ পারে না লভিতে,
অনন্তগোচর বুদ্ধ বিশ্বচরাচরে
কেবা পারে কোন্ পথে ল’য়ে যেতে তারে?॥১॥১৭৯॥
ইতস্ততঃ ল’য়ে যেতে ভ্রান্ত নরগণে
জাল পাতি থাকে তৃষ্ণা অতি সঙ্গোপনে;
বিষাত্মিকা সেই তৃষ্ণা নাহিক যাহার
জগতে নাহিক যা’র মোহের বিকার
অনন্ত গোচর সেই বুদ্ধ চরাচরে
কেবা পারে কোন্ পথে ল’য়ে যেতে তারে?॥২॥১৮০॥
ধ্যানরত, বিজ্ঞ, ধীর, যিনি স্মৃতিমান,
বৈরাগ্য শান্তিতে যা’র দিবা অবসান,
তত্ত্বজ্ঞান যে নরের হ’য়েছে উদিত
সৌভাগ্য তাহার হয় দেবের বাঞ্ছিত॥৩॥

দুর্ল্লভ এ বিশ্বমাঝে মানব জনম
দুর্ল্লভ নশ্বর দেহে জীবন ধারণ
সুদুর্ল্লভ মানবের সদ্ধর্ম্ম শ্রবণ
সুদুর্ল্লভ বুদ্ধদের[১] জনম গ্রহণ॥৪॥
সর্ব্ববিধ পাপ-কার্য্য করহ বর্জ্জন
কুশল কর্ম্মের সদা কর আয়়োজন
আপনার চিত্ত সদা নির্ম্মল করিবে
বুদ্ধদের এ শাসন নিশ্চিত জানিবে॥৫॥
বুদ্ধেরা বলেন―ক্ষমা তপস্যা পরম,
তিতিক্ষা নির্ব্বাণ শ্রেষ্ঠ প্রধান ধরম;
“ভিক্ষু” নাহি হ'তে পারে পরঘাতী জন
পরের পীড়নকারী না হয় শ্রমণ॥৬॥

ক’রোনা কাহারো নিন্দা, ক’রোনা প্রহার
সুদৃঢ় রাখিবে চিত্তে করি সদাচার,
ভোজনেতে মিতাচারী হইবে নিশ্চয়
শয়নে আসনে হবে সংযত ধরায়॥
থাকে যেন যোগযুক্ত আপনার মন―
এ সকল বুদ্ধদের প্রধান শাসন॥৭॥
অল্পস্বাদ, দুঃখকর বাসনা নিচয়
অর্থের বর্ষণে কভু তৃপ্ত নাহি হয়;
এই তত্ত্ব স্পষ্টভাবে যেই জন জানে,
তাহাকে পণ্ডিত বলি সকলে বাখানে॥৮॥
সুখদ হ’লেও কিন্তু দিব্য বাসনায়
বৌদ্ধ শ্রমণেরা কভু সুখ নাহি পায়;
সংসারের তৃষ্ণাক্ষয় করিবার তরে
বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সদা সুসাধনা করে॥৯॥
পর্ব্বতে, উদ্যান বৃক্ষে, চৈত্যে কিম্বা বনে,
আশ্রয় শঙ্কিত জন লয় বহু স্থানে,―

উত্তম বা নিরাপদ আশ্রয় সে নয়,
সে আশ্রয়ে সর্ব্ব দুঃখে মুক্তি নাহি পায়॥১০-১১॥
বুদ্ধ, ধর্ম্ম, সজ্ঘ―এই তিনটি বিষয়[২]
সংসারে আসিয়া যিনি করেন আশ্রয়;
(১) দুঃখ আছে, (২) আছে তার কারণ নিচয়
(৩) দুঃখ হতে মুক্তিলাভ অসম্ভব নয়,
(৪) প্রকৃষ্ট অষ্টাঙ্গমার্গ[৩] মুক্তির সাধন―
এই চারি আর্য্য সত্য জানেন যেজন,
উত্তম ও নিরাপদ আশ্রয় তাঁহার
সর্ব্ব দুঃখ হ'তে তিনি লভেন নিস্তার॥১২-১৪॥

দুর্ল্লভ বুদ্ধের মত পুরুষ প্রধান,[৪]
সর্ব্বত্র হয় না জন্ম তাঁহার সমান
যে কুলে মহাত্মা হেন হন আবির্ভূত
পরম সৌভাগ্য তা’র হয় সম্বর্দ্ধিত॥১৫॥
সুখকর বুদ্ধদের পবিত্র জনম,
উপদেশ তাহাদের সুখদ পরম,
সুখকর সঙ্ঘারাম-শান্তি মনোহর
শান্ত তাপসের তপঃ অতি সুখকর॥১৬॥
শোক মোহ প্রপঞ্চাদি করি অতিক্রম
সকল বাসনা হ’তে মুক্ত যা’র মন,
পূজার্হ অকুতোভয় হেন বুদ্ধগণে
যেজন করেন পূজা ভক্তিগত প্রাণে,
ধন্য ধন্য সেইজন এ ঘোর মহীতে
তাহার পুণ্যের সংখ্যা কে পারে করিতে?॥১৭॥


  1. এখানে বুদ্ধশব্দে শাক্যমুনি সিদ্ধার্থকে বুঝাইতেছে না; যাঁহার বোধি জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান জন্মিয়াছে তাঁহাকেই বুদ্ধ বলা যায়। বুদ্ধগণ বলিলে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তিদিগকে বুঝাইবে।
  2. বুদ্ধ, তাঁহার ধর্ম্ম ও বৗদ্ধশ্রমণ এই তিনটিকে বৌদ্ধশাস্ত্রে ত্রিরত্ন বলে। বৗদ্ধগণ এই তিনটিরই আশ্রয় লন। হিন্দুধর্ম্মেও ত্রিমূর্ত্তির উপাসনা আছে; খৃষ্টধর্ম্মেও এইরূপ Holy Trinity আছে।
  3. দৃষ্টি, সঙ্কল্প, বাক্য, ব্যবসায়, জীবিকা, ব্যায়াম, স্মৃতি ও সমাধি এই আটটি বিষয়ের সম্যক আচরণই অষ্টাঙ্গ মার্গ। এই অষ্টাঙ্গমার্গদ্বারাই ক্তিলাভ হয়।
  4. এস্থলেও বুদ্ধ বলিতে তত্ত্বজ্ঞানীদিগকে বুঝাইতেছে।