ধম্মপদ/ভিক্ষু বর্গ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চবিংশ সর্গ―ভিক্ষুবর্গ।

নয়ন সংযত করা অতি শুভকর,
কর্ণের সংযম হয় মঙ্গল আকর;
হিতকর ঘ্রাণেন্দ্রিয় সংযম সাধন
হিতকর রসনার হয়় নিয়ন্ত্রণ॥১॥৩৬০॥
কায়ঃ, মনঃ, বাক্য―এই তিনের সংযম
মানবের পক্ষে হয় শুভদ পরম;
নয়নাদি অষ্টদ্বারে[১] যে ভিক্ষু সংযত,
সর্ব্ববিধ দুঃখ তার হয় তিরোহিত॥২॥

হস্ত, পদ, বাক্য যা’র হয় সুসংযত
সংযমীর শ্রেষ্ঠ বলি সে জন বিদিত;
আধ্যাত্মিক ভাবে রত হ’য়ে অনুক্ষণ
সমাধি-সম্পন্ন যদি হ’ন সেই জন,
সঙ্গশূন্য হৃষ্টচিত্ত সেই নরবর
ভিক্ষু নামে সুবিদিত হন ধরা’পর॥৩॥
যে ভিক্ষুর হইয়াছে মুখ সুসংযত
প্রজ্ঞাযুক্ত কথা যিনি বলেন সতত,
ঔদ্ধত্য নাহিক যা’র, সমর্থ যেজন—
অর্থ ও ধর্ম্মের তত্ত্ব করিতে বর্ণন,
মধুর তাহার বাক্য জানিবে নিশ্চিত
ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ বলি তিনি হন অভিহিত॥৪॥
যিনি ধর্ম্মরত, যা’র ধর্ম্মে অবস্থান
ধর্ম্মই যাহার চিন্তা, ধর্ম্ম যা’র ধ্যান,
সদ্ধর্ম্ম হইতে সেই ভিক্ষু সুপণ্ডিত
বিন্দুমাত্র নাহি হন কভু বিচলিত॥৫॥

অবজ্ঞা স্বকীয় দ্রব্যে অতীব অন্যায়,
পরলব্ধ দ্রব্যে যেন স্পৃহা নাহি হয়;
পরলব্ধ দ্রব্যে হয় লালসা যাহার
চরমে সমাধি লাভ অসম্ভব তা’র॥৬॥
অবজ্ঞা নাহিক যা’র অন্ন মাত্র লাভে,
কাল গত হয় যার অতি শুদ্ধ ভাবে,
ধন্য সেই নিরালস্য ভিক্ষুর জীবন,
প্রশংসা করেন তা’য় সদা দেবগণ॥৭॥
বাহু কিম্বা আন্তরিক কোনও বিষয়ে
আসক্তি নাহিক যা’র কোনও সময়ে,
বিষয়ের ক্ষয়ে যা’র শোক নাহি হয়
তিনিই প্রকৃত ভিক্ষু জানিবে নিশ্চয়॥৮॥
মৈত্রীবশে সর্ব্বকার্য্য করেন সাধন,
আনন্দে পালেন যিনি বুদ্ধের শাসন,
সংসার-সংস্কার হয় যে ভিক্ষুর নাশ,
চরমে শাশ্বত স্থানে তাহার নিবাস॥৯॥

হে ভিক্ষু! এ দেহতরী করহ সেচন,—
পাপ-বারি-ভারাক্রান্ত যাহা অনুক্ষণ
সেচন করিলে সেই সলিলের রাশি
লঘু হ’য়ে দেহ-তরী উঠিবেক ভাসি;
রাগ-দ্বেষাদির শেষে করিয়া ছেদন
চরমে লভিবে তুমি নির্ব্বাণ পরম॥১০॥
নির্ম্মূল করহ পঞ্চ ইন্দ্রিয়-বাসনা;
ইন্দ্রিয়ের বিষয়েতে আসক্ত হ’য়োনা;
যোগবলে সমাধিতে হ’য়ে নিয়োজিত
বাহ্য দর্শনাদি ক্রিয়া করহ রহিত;
ইন্দ্রিয়গণের হয় যাহা অগোচর
ভাবনা করহ সেই নির্ব্বাণ সত্বর;
যেই ভিক্ষু পঞ্চেন্দ্রিয় পার হ’য়ে যায়,
ওঘোত্তীর্ণ[২] বলি তাকে সর্ব্বলোকে কয়॥১১॥৩৭০॥

হে ভিক্ষু! করহ ধ্যান, হ’য়োনা প্রমত্ত,
ইন্দ্রিয় বিষয়ে যেন নাহি যায় চিত্ত,
প্রমত্ত হইলে শেষে লভিয়া নরক
গিলিতে না হয় যেন লৌহের গোলক,
ভীষণ অনলে তথা হয়ে দহ্যমান
না হয় করিতে যেন কাতর ক্রন্দন॥১২॥
প্রজ্ঞাহীন মানবের ধ্যান নাহি হয়,
ধ্যান ভিন্ন নাহি হয় প্রজ্ঞার উদয়,
প্রজ্ঞা ধ্যান দুই যা’র আছয়ে সম্বল,
তিনিই নির্ব্বাণ লাভে সক্ষম কেবল॥১৩॥
যা’র দেহে রাগ দ্বেষ লেশ মাত্র নাই,
যা'র চিত্ত শান্তি পূর্ণ রয়েছে সদাই
ধর্ম্মের সম্যক্ তত্ত্ব সুবিদিত যার
সে ভিক্ষুর অলৌকিক আনন্দ অপার॥১৪॥
রূপ বেদনাদি পঞ্চ স্কন্ধের[৩] যখন

উৎপত্তি লয়ের চিন্তা করেন সেজন
তখন নির্ব্বাণ প্রাপ্ত মানবের মত
প্রীতি ও প্রমোদে তিনি হন বিমোহিত॥১৫॥
সংযত রাখিবে সদা ইন্দ্রিয় আপন,
চিত্তের সন্তুষ্টি যেন না যায় কখন,
পালন করিবে যত ধর্ম্মের শাসন,―
আদিম কর্ত্তব্য এই ওহে ভিক্ষুগণ!
বিশুদ্ধ ভাবেতে যায় জীবন যাহার
কুশল বর্দ্ধক যিনি অনলস আর,―

এ হেন মিত্রের[৪] সেবা কর নিরন্তর,
পবিত্র পুণ্যের পথে হও অগ্রসর॥১৬॥
বুদ্ধি বৃত্তি সমূহের করিয়া সংস্কার
অনুষ্ঠান করি সদা শীলাদি আচার,
তজ্জনিত দিব্য সুখ করি অনুভব,
দুঃখ ধ্বংস করা তব হইবে সম্ভব॥১৭॥
পুষ্পবৃক্ষ ম্লান পুষ্প করয়ে বর্জ্জন―
ভিক্ষু তথা রাগ দ্বেষ দিবে বিসর্জ্জন॥১৮॥
কায়মনোবাক্য যা’র শান্ত সুসংযত,
সমাধিসম্পন্ন হন যে ভিক্ষু সুব্রত,
সংসার বাসনা সব করি উদ্গীরণ
তিনিই নির্ব্বাণ প্রাপ্ত উপশান্ত জন॥১৯॥
স্ববলে আত্মাকে সদা চালনা করিবে,
আত্মাকে স্ববশে আনি আত্মারাম হ’বে;

হে ভিক্ষু সাত্বিক শ্রেষ্ঠ, যদি এই মতে
আত্মাকে সতত রক্ষা পারহ করিতে,
তা’ হলে আনন্দে তুমি করিবে বিহার,
সে আনন্দ মহীতলে অতুল অপার॥২০॥
আত্মাই আত্মার প্রভু জানিবে নিশ্চয়,
আপনি আত্মাই হয় আত্মার আশ্রয়,
আত্মাকে সতত তুমি করিবে সংযত,
সুজাত অশ্বকে করে বণিক্ যেমত॥২১॥৩৮০॥
সংযম সাধনে ভিক্ষু সদানন্দময়
বুদ্ধনীতি পালি’ মতি হৃষ্ট অতিশয়,―
বাসনার ক্ষয়কারী, অতি সুখকর
চরমে পরম পদ লভেন সত্বর॥২২॥
যতই হউক ক্ষুদ্র ভিক্ষুর জীবন
করেন সতত যদি বুদ্ধাজ্ঞা পালন,
মেঘমুক্ত শশীসম তিনি এ ভুবন
জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেন কেমন॥২৩॥

  1. মূলগ্রন্থে “সর্ব্বত্র” বা সর্ব্বদ্বারে কথা আছে। বুদ্ধঘোষ উহার অর্থ অষ্টদ্বার ধরিয়াছেন। পঞ্চেন্দ্রিয়, অশ্রদ্ধা, আলস্য ও অজ্ঞান―এই অষ্টদ্বার।
  2. ওঘোত্তীর্ণ = রাগদ্বেষমোহমানাদি শূন্য।
  3. ১৫শ সর্গের ষষ্ঠ শ্লোক দ্রষ্টব্য। বাহ্য ও আভ্যন্তর জগতের যাবতীয় জ্ঞান যে পঞ্চ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হইয়াছে তাহারই নাম পঞ্চস্কন্ধ। উহাদের নামঃ―রূপস্কন্ধ, বেদনাস্কন্ধ, সংজ্ঞাস্কন্ধ, সংস্কারস্কন্ধ ও বিজ্ঞানস্কন্ধ। প্রত্যেক সজ্ঞান জীবের যাবতীয় গুণ এই পঞ্চস্কন্ধের অন্তর্ভূত। যখন কেহ দেহত্যাগ করে তখন তাহার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চস্কন্ধ বিনাশ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু পুনরায় কর্ম্মবলে একদল নবস্কন্ধ সঞ্জাত হয় এবং এক নূতন জীবের আবির্ভাব হয়। পঞ্চভূত ও পঞ্চঙ্কন্ধ প্রায় একই অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে। স্কন্ধ শব্দ বৌদ্ধদর্শনের একটি বিশেষ কথা। See Childers' Dictionary.
  4. মূলে “কল্যাণ মিত্র” শব্দ আছে। কল্যাণ মিত্র শব্দের অর্থ―সদুপদেশ প্রদাতা গুরু। Religious precepter