ধম্মপদ/যমক বর্গ

উইকিসংকলন থেকে

ধম্মপদ


প্রথম সর্গ―যমক বর্গ।

ধর্ম্মের পূরবগামী মন আমাদের,[১]
প্রধান পদার্থ মন ধর্ম্ম-সমূহের;
মন হ’তে ধর্ম্ম হয়, জানিবে সকলে।
দুষ্টমনে যদি কেহ এই ধরা তলে
কোন কার্য্য করে কিম্বা কোন কথা বলে,
নিরন্তর দুঃখ তা’র পিছে পিছে চলে;―

শকটের চক্র যথা যায় গড়াইয়া
ভারবাহী বলদের পদাঙ্ক ধরিয়া॥ ১॥
ধর্ম্মের পূরবগামী মন আমাদের,
প্রধান পদার্থ মন ধর্ম্ম-সমূহের;
মন হ’তে ধর্ম্ম হয়, জানিবে সকলে।
নির্ম্মল অন্তরে কেহ যদি এ ভূতলে
কোন কার্য্য করে কিম্বা কোন কথা বলে,
ছায়া প্রায় সুখ তা’র পিছে পিছে চলে॥ ২॥

তিরস্কার করে লোকে, করয়ে প্রহার,
পরাজয় করে কিম্বা হরে দ্রব্য-ভার,—
সতত ব্যাকুল যা’রা এই ভাবনায়
বৈরভাব তাহাদের শান্ত নাহি হয়॥ ৩॥
তিরস্কার করে লোকে, করে বা প্রহার,
পরস্ত করয়ে কিম্বা হরে দ্রব্য-ভার,—
ব্যস্ত যা’রা নহে কভু এই ভাবনায়
বৈরভাব তাহাদের দূরীভূত হয়॥ ৪॥
যদি কেহ করে ভবে শত্রুতা সাধন
শত্রুতায় নাহি হয় তাহার দমন;
মিত্রতাই শত্রুতার দমন-উপায়,
সনাতন ধর্ম্ম এই জানিবে নিশ্চয়॥ ৫॥
‘চিরদিন ধরাধামে রহিব না মোরা’—
এই তত্ত্ব নাহি জানে জ্ঞানহারা যা’রা;
যাঁহারা জানেন ইহা, তাঁহাদের আর
থাকেনা কলই মাত্র কোনও প্রকার॥ ৬॥

দেহের সৌন্দর্য্য-মাত্র যে মানব চায়,
সুখের সন্ধানে যা’র দিবা-নিশি যায়,
ইন্দ্রিয় সকল নহে সংযত যাহার;
পরিমিত নহে যা’র আহার বিহার,
যে দুর্ব্বল মানবের আলস্য সহায়
এ সংসারে পরাজয় তাহার নিশ্চয়।
বায়ু যথা ক্ষীণ বৃক্ষ করে উৎপাটন,
তেমতি মোহের[২] হাতে তাহার পতন॥ ৭॥

দেহের সৌন্দর্য্যমাত্র যেজন না চায়,
ইন্দ্রিয়সকল যা’র সুসংযত রয়,
মিতাহারী, শ্রদ্ধাযুক্ত, কর্ম্মঠ যেজন,
এসংসারে নাহি হয় তাহার পতন।
শৈলরাজ বায়ুবেগে না টলে যেমন,
তেমতি মোহের কাছে অটল সেজন॥ ৮॥
কাম-ক্রোধ-পরবশ হইয়া সেজন,
পবিত্র কষায় বস্ত্র[৩] করে পরিধান
সত্যহীন দমহীন সেজন নিশ্চয়
পরিতে কাষায় বস্ত্র উপযুক্ত নয়॥ ৯॥

কামাদিতে যেইজন নহে বশীভূত
শীল সমুহেতে[৪] চিত্ত যা’র প্রতিষ্ঠিত
সত্যব্রত সুসংযমী সেজন নিশ্চয়
পরিতে কাষায় বস্ত্র উপযুক্ত হয়॥ ১০॥
অসার পদার্থে যেই সার মনে করে,[৫]
যেজন অসার বলি সার বস্তু ধরে,

অলীক চিন্তার দেয় যেজন আশ্রয়।
সংসারে সে সারবস্তু কভু নাহি পায়॥১১॥
সারবস্তু সারবলি যে মানব মানে,
অসারে অসার বলি যেইজন জানে,
যে দেয় আশ্রয় মনে সদা সুচিন্তায়,
এ সংসারে সারবস্তু সেইজন পায়॥১২॥
যে গৃহে স্বচ্ছন্দরূপ নাহি আচ্ছাদন,
বৃষ্টি যথা তার মধ্যে পশে অনুক্ষণ,
চিন্তা ধ্যান-পরায়ণ যে মানব নয়।
ভেগাসক্তি তারে তথা করয়ে আশ্রয়॥১৩॥
যে গৃহে স্বচ্ছন্দ রূপে আছে আচ্ছাদন
বৃষ্টি যথা তার মধ্যে না পশে কথন,
সেই রূপ চিন্তা-ধ্যান-হত যেই জন,
ভোগাসক্তি তা’রে নাহি করে আক্রমণ॥১৪॥
পাপকর্ম্ম অনুষ্ঠান যেইজন করে
ইহলোকে পরলোকে সেই শোক করে;

স্বকৃত মলিন কর্ম্ম করি দরশন
শোেক করে কষ্ট পায় সেই সর্ব্বক্ষণ॥১৫॥
পুণ্যকর্ম্ম অনুষ্ঠান যেইজন করে,
ইহ পরকালে সেই আনন্দে বিহরে।
স্বকৃত পবিত্র কর্ম্ম করি দরশন
ভূমানন্দে আত্মহারা হয় সেইজন॥১৬॥
পাপকর্ম্ম অনুষ্ঠান যে করে সতত
ইহপরলোকে সেই তাপ পায় কত!
“পাপ করিয়াছি”—এই চিন্তায় সেজন
তাপিত-হৃদয়ে করে জীবন যাপন।
অনন্ত দুর্গতি লভি পরলোকে গিয়া,
তাপানলে হয় তার জর জর হিয়া।॥১৭॥
পুণ্য-কর্ম্ম অনুষ্ঠান যেইজন করে,
ইহপরলোকে সেই আনন্দে বিহরে;
“পুণ্য করিয়াছি”—এই পবিত্র চিন্তায়,
ধরায় পরমানন্দে জীবন কাটায়

দেহ ত্যজি পরলােকে যায় সে যখন।
সুগতি লভিয়া হয় আনন্দে মগন॥১৮॥
পরের সহস্র গাভী করলে গণন
গোপ তা’র অধিকারী না হয় যেমন,
তেমতি প্রমাদ-রত তুষ্ট যেইজন
আবৃত্তি করিয়া মাত্র শাস্ত্রের বচন,
অনুযায়ী কার্য্য নাহি করে আচরণ
অধিকার নাহি তা’র হইতে শ্রমণ[৬]॥১৯॥
অল্পমাত্র শাস্ত্রাবৃত্তি করিয়া যেজন,
জ্ঞানোদ্দেশ্যে ধর্ম্মনীতি করেন পলিন,
রাগ মােহ দ্বেষ যত করেন বর্জ্জন
ইহ পরলােকে সেই যথার্থ শ্রমণ॥২০॥


  1. এস্থলে অবিকল মূলানুগত অনুবাদই প্রদত্ত হইল। বর্ত্তমান শ্লোকের ধর্ম্মশব্দের অর্থ লইয়া পণ্ডিতবর্গের মধ্যে নানা মতভেদ হইয়াছে। কেহ ধর্ম্ম শব্দে ‘পদার্থ’ বুঝিয়াছেন; ধম্মপদের অন্য কয়েক স্থলেও ধর্ম্মশব্দ সেই অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে। ধর্ম্মকে পদার্থ ধরিলে এস্থলে অর্থ হয় যে—পদার্থ সকলের মধ্যে মনই প্রধান পদার্থ, মনই অন্যান্য পদার্থের মূল। মােক্ষমূলর বলেন, আমরা যাহা কিছু হই—সে সকল আমাদের চিন্তারই ফল অর্থাৎ আমরা যেমন চিন্তা করি, আমাদের অবস্থাও তদনুরূপ হয়। পালি অভিধান প্রণেতা চাইলডার্স সাহেব এই অনুবাদকেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া মনে করিয়াছেন। বীল সাহেবের মতে মনই সকল পদার্থের মূল। See Mex Müller's Dhammapadlam, Sacred Books of the East, Vol X, p 3; Childers’ Pali Dictionary p, 120, Beal's Chinese Dhanmapadam p-63. ধর্ম্ম শব্দের অন্যান্য অর্থ লইয়া যে বিচার হইয়াছে, এস্থলে তাহার অবতারণা করিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না। বর্ত্তমান স্থলে ধর্ম্ম শব্দের সাধারণ অর্থ গ্রহণ করিলেও অর্থের বিশেষ রূপান্তর হইবে না।
  2. মূলগ্রন্থে ‘মার’ শব্দ আছে; মার শব্দ সাধারণতঃ কাম বা কন্দর্প অর্থে ব্যবহৃত হয়। কামদেব যে সকল অণুচরগণ সমভিব্যাহারে বিশ্বজনকে বিমোহিত করেন, তাহাদিগকে মারগণ কহে; এই মারগণের উৎপত্তির কথা পুরাণে দৃষ্ট হয়, মারের দলবলের কথা ত্রয়োদশ সর্গের ৯ম শ্লোকে উল্লিখিত হইয়াছে। মারশব্দ বৌদ্ধমতানুসারে “প্রলোভনকারী” বা “কুপ্রবৃত্তি” অর্থে গ্রহণ করিতে হইবে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য দেশে যাহাকে Satan বা Devil বলে, বৌদ্ধ গ্রন্থে মার শব্দ ও সেই অর্থে প্রযুক্ত হয়। বাঙ্গালা ভাষায় মার শব্দের সাধারণ ব্যবহার নাই। এজন্য অনুবাদে মার শব্দের পরিবর্ত্তে কোন কোন স্থলে ‘মোহ’ শব্দ ব্যবহৃত হইল। Mâr, the tempter, the great antagonist of Buddha, as well as of his followers is a very important personage, in the Buddhist scriptures. He is in many places the representative of evil, the evil spirit or in Christian terminology the devil Conquered by Buddha but not destroyed by him” max Müller.
  3. পীতবস্ত্র; পীতবর্ণ বৌদ্ধ পরিচ্ছদ।
  4. যে সকল সন্নীতিমালা দ্বারা বৌদ্ধ গৃহস্থের বা বৌদ্ধ শ্রমণের জীবন নিয়মিত হয়, উহারই নাম শীল। ইহা দশবিধ যথা:—(১) জীবহিংসা করিবে না, (২) পরদ্রব্য অপহরণ করিবে না, (৩) অপবিত্র কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবে না, (৪) মিথ্যা কথা বলিবে না, (৫) সুরাপান করিবে না। গৃহস্থমাত্রকেই এই পাঁচটি নীতি মানিয়া চলিতে হয়। শ্রমণদিগকে আরও পাঁচটি নীতি মানিয়া চলিতে হয়। বিলাস বিভ্রাট পরিত্যাগ করাই সে গুলির তাৎপর্য্য। উপরোক্ত প্রথম পাঁচটি নীতির নাম “পঞ্চশীল।”
  5. সার= সত্য (truth) চৈনিক “চীন” শব্দ “সত্য” অর্থেই প্রযুক্ত হয়। See Beal's Dhammapadam p. 64. বৌদ্ধদিগের মতানুসারে ছয় প্রকার সার আছে। শীলসার, সমাধিসার প্রজ্ঞাসার, বিমুক্তিসার, বিযুক্তিজ্ঞানদর্শনসার ও পরমার্থসার। পরমার্থসারকেই নির্ব্বাণ কহে।
  6. বৌদ্ধসন্ন্যাসীদিগকে শ্রমণ কহে। যাহারা সংযমী, মুক্তিকামী ও ব্রতাবলম্বী তাহারাই শ্রমণ বা যতি।