নকল রাণী/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 চৈত্রমাস—রৌদ্রের দিকে চায় কার সাধ্য, তায় পশ্চিমাঞ্চল পাথুরে গর‍্মি, বেলা দ্বিপ্রহর। মাঝে মাঝে লু বহিতেছে। পথে লোকের চলাচল প্রায় বন্ধ, তবে যাদের না গেলে নয়, তারাই প্রচণ্ড মার্তণ্ডদেবকে উপেক্ষা করিয়া চলিয়া যাইতেছে। আমি ও সেই সন্ন্যাসী আমাদের কার্য্যোপলক্ষে বাহির হইয়াছি। এখন সন্ন্যাসী তাঁহার সন্ন্যাস-বেশ পরিত্যাগ করিয়াছেন। সেই দিবসই আমি জানিতে পারিলাম, সন্ন্যাসী প্রকৃত সন্ন্যাসী নহেন, সময় সময় সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করেন, কখন কখন অপর বেশও ধারণ করিয়া থাকেন। ডিটেক‍্টিভ কর্ম্মচারীর ন্যায় ইনিও বেশ-পরিবর্ত্তনে একজন সিদ্ধহস্ত। এমন সময় একটী লোক কাশীর শিকরোলের দিক হইতে ঘর্ম্মাক্ত-কলে বরে পূতসলিলা জাহ্নবীর তীযর দিয়া কি যেন প্রণষ্ট বস্তু খুঁজিতে খুঁজিতে এদিক-ওদিক চারিদিক চাহিতে চাহিতে ক্রমশঃ মণিকর্ণিকার ঘাট সমীপে উপরিীত হইল। পথিকবর, যেখানে পরমহংস বাবাজী থাকে, তাহার অনতিদূরে একটা ঘরের বারাণ্ডায় উপবেশন করিয়া আপনা আপনি বলিতে লাগিল, “ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কাশীর সর্ব্বস্থান অন্বেষণ করিলাম, বেটাকে কোথায় দেখলাম না; কিন্তু আর ত পারি না, রোদ্দুরে রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে মাথার ঘাম পায়ে পড়‍্ছে। চলা তার, কাল আবার তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখ‍্বো, দেখি, দেখ‍্তে পাই কি না?” পথিক দেবমন্দিরের সুশীতল ছায়ায় বিশ্রাম করিতে লাগিল। পাঠককে পথিকের বিষয় বোধ হয় বিশেষ পরিচয় দিতে হইবে না, ইনিই আমাদের শঙ্করদাস, অমরচাঁদকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে।

 পথিক অন্যমনস্কভাবে বসিয়া আছে, আমরাও খুরিতে ঘূরিতে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার সঙ্গী তাহার পশ্চাদ্ভাগ হইতে কহিলেন,—“কেও! শঙ্করদাস নাকি? এত রোদ্দুরে কোথায়?

 শঙ্কর চমকিয়া উঠিয়া পশ্চাৎভাগে চাহিয়া দেখে, একটি সুন্দর যুবাপুরুষ তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। যুবককে দেখিলে বিশেষ ভদ্রলোক বলিয়া প্রতীতি হয়। বয়স শঙ্কর অপেক্ষা এক আধ বৎসরের কমই হউক, আর সামান্য বেশীই হউক, যুবককে দেখিতে অতি সুন্দর, বলিষ্ঠ ও দৃঢ়কায়। অপরিচিত যুবক শঙ্করের নিকট আসিয়া বলিলেন, “শঙ্কর দাস, মেয়ে-মানুষের কথায় রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে মর কেন? যাহার জন্য না খেয়ে দেয়ে, সকাল হতে বেলা দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত এই প্রচণ্ড রৌদ্রে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ, তাহার সন্ধান আমি বলিয়া দিতে পারি।”

 শঙ্করের এত বেলা পর্যন্ত খাওয়া হয় নাই, তার উপর পথশ্রম, পথশ্রম ব’লে পথশ্রম! বারাণসীর এমন গলি খুঁজি নাই—গুপ্তস্থান নাই বা প্রকাশ্য রাজপথ নাই, যেখানে তন্ন তন্ন না করিয়া শঙ্করদাস অমরচাঁদের জন্য খুঁজিয়াছে। সুতরাং এ সময় ভাল কথাটাও মন্দ লাগে, তার এই অপরিচিতের মেয়েমানুষ-সংযুক্ত ঠাট্টা বিদ্রুপের কথা শুনিয়া শঙ্করের মান্ধাতার আমলের পিত্ত পর্য্যন্ত চটিয়া উঠিল। শঙ্কর রোষভরে বলিয়া উঠিল,—“বেটা কি নিরেট, কেমন ক’রে ভদ্রলোকের সহিত কথা কহিতে হয়, জানে না। বিশ্বেশ্বরের এই সব বেওয়ারিস মালগুলোকে যদি দুই এক ঘা আক্কেল সেলামি দেওয়া যায়, তবে বেটারা ভদ্রলোকের সঙ্গে কেমন করিয়া কথা কহিতে হয়, শিখিতে পারে।”

 আমার সঙ্গী কহিলেন,—“আমি অভদ্র —না তুমি অভদ্র। তুমি টাকা খেয়ে একটি লোকের বহুমূল্য জীবন নাশ করিতে উদ্যত হইয়াছ, ইহাতে মূর্খ তুমি হইলে, না—হইলাম আমি। বাহাদুরি আছে তোমার বুদ্ধির! তোমার কাছ থেকে এ রকম বুদ্ধির দৌড় একটু ধার করে নিলে হয়?

 বীরবর শঙ্করের এ ব্যঙ্গোক্তি স্য হইল না। সে উঠিয়া “পাজি। যা মুখে আসে তাই বলিস্, জানিসনে আমি কে?” এই বলিয়া যুবকের মাথায় সজোরে এক চপেটাঘাত করিল। যুবক কিছুমাত্র অসন্তোষ বা বিরক্তির ভাব প্রকাশ করিলেন না, কিছুমাত্র ক্রোধিত বা উত্তেজিত না হইয়া বরং হাস্য সহকারে কহিলেন,—“বেশ! বেশ! এবার সন্তষ্ট হইয়াছ ত—কাহাকে মারিয়াছ এখন বুঝিতে পারিবে? যার মস্তকের জন্য ৫০০৲ টাকা খেয়েছ, আমি সেই বদমায়েস অমরচাঁদ।”

 “তুমি—ভূ—মি—আ—পনি্ অমরচাঁদ—যাহাকে ডিটেক‍্টিভ পুলিসের কর্ম্মচারী বলিয়া সকলে সন্দেহ করে—আপনি সেই অমরচাঁদ!!” অমরচাঁদকে দেখিয়া শঙ্করের তেজ লোপ পাইল, শরীরের উষ্ণ শোণিত শীতল হইয়া গেল;—শঙ্কর স্থাণুবৎ।

 যুবক কহিলেন, “কি হে বীরবর! চুপ কর‍্লে যে, মুখে কথা নাই কেন? অমরচাঁদের মাথা কাট‍্তে বেরিয়েছ—এস, আর দেরী কেন, টপ্ করে কেটে ফেল? তোমার কাছে মারধোর ত খেলুম, অপমানটাও খুব কল্লে, জীবনে আমার আর সাধ নাই, তোমার হাতে মরণই মঙ্গল!!”

 অমরচাঁদের কথা শুনিয়া শঙ্কর অতিশয় লজ্জিত হইল। তখন অমরচাঁদ কহিলেন, “তোমার সহিত আমার অনেক কথা আছে, কোন নির্জ্জন স্থানে তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইলে সকল কথা হইবে, সেই সময় ইচ্ছা করিলে আমাকে হত্যা করিয়া তোমার মনিবের মনস্কামনাও পূর্ণ করিতে পারিবে।”

 শঙ্কর এই প্রস্তাবে সম্মত হইল। পরদিবস রাত্রি ১১ টার সময় বরুণার ধারে—একটী ভগ্ন অট্টালিকায় উভয়ের নির্জ্জন সাক্ষাতের স্থান নির্দ্দিষ্ট হইল।