বিষয়বস্তুতে চলুন

নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দশম পরিচ্ছেদ।

আশঙ্কা।

 “কমল. তুমি নিশ্চয়ই কোন রূপ অত্যাচার করিয়াছ।”

 শ্রাবণের মধ্যাহ্ন। ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। পল্বল ভেক কলরবমুখরিত।

 কমলের জ্বর হইয়াছে। সে কন্থায় অঙ্গ আবৃত করিয়া শয়ন করিয়া আছে। কন্থায় বিচিত্র সূচিকার্য্য—শিল্পনৈপুণ্যের পরিচায়ক। শিল্পসম্বন্ধে যে সুরুচি হারাইয়া আমরা বিদেশ হইতে আনীত বিজাতীয় শিল্পজাতের মোহে মুগ্ধ হইয়া জাতীয় শিল্পের সর্ব্বনাশ করিতে বসিয়াছি,— প্রাসাদ হইতে কুটীর পর্যন্ত সর্ব্বত্র আজ যে সুরুচির শোচনীয় অভাব তাহা এখনও রক্ষণশীলতার শেষ আশ্রয় রমণীমণ্ডলে বিদ্যমান। কন্থার সূচিকার্য্যে সেই সুরুচি স্বপ্রকাশ। কমল শয়ন করিয়া আছে। সতীশ তাহার শিয়রে বসিয়া। সে বলিল, “কমল, তুমি নিশ্চয় কোনও অত্যাচার করিয়াছ।”

 কমল বলিল, “না।”

 সতীশ তাপমান যন্ত্র আনিয়া পত্নীর দেহে তাপ পরীক্ষা করিতে বসিল; সস্নেহে তাহার ললাট হইতে চূর্ণকুন্তলজাল সরাইয়া সেই তপ্ত ললাটে হাত বুলাইতে লাগিল। কমলের নয়ন মুদিয়া আসিতে লাগিল। সে কয়বার বলিল, “তুমি কেন কষ্ট করিতেছ?” সতীশ শুনিল না।

তাপ লইয়া সতীশ দেখিল, জ্বর খুব প্রবল হইয়াছে। ধীরে ধীরে কমলের নয়নপল্লব নিদ্রায় মুদিত হইয়া গেল। সতীশ কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর উঠিল: অতি ধীরপদে বাহির হইয়া গেল— পাছে কমলের নিদ্রাভঙ্গ হয়। মা দালানে ছিলেন; অমল তাঁহার কাছে গল্প শুনিতেছিল। সতীশ বলিল, “মা, জ্বর খুব প্রবল।”

 মা বলিলেন, “আমি যাইয়া বসিতেছি। তুই একটু বিশ্রাম করিতে যা।”

 সতীশ পুত্ত্রকে বলিল, “অমল বাবু, চল, আমরা বাহিরে যাই।”

 অমল বাবু সে বিষয়ে বিশেষ ব্যগ্রতা জানাইলেন না। সতীশচন্দ্র বলিল, “ছবি দেখাইব।” তখন অমলবাবুর আপত্তি দূর হইল। পুত্ত্রকে লইয়া সতীশ বাহির-বাটীতে গেল! মা যাইয়া জ্বরকাতরা বধূর শিয়রে বসিলেন।

 কলিকাতা হইতে ফিরিয়া ঔষধ, পথ্য ও নিয়মের বাঁধাবাঁধিতে কমল কয় মাস ভাল ছিল। ক্রমে শাশুড়ীর ও সতীশের সহস্র চেষ্টা সত্বেও নিয়মের বাঁধাবাঁধির হ্রাস হইতে লাগিল। প্রথমে যেরূপ বাঁধাবাঁধি থাকে,ক্রমে তাহার হ্রাস হইয়াই থাকে। এ দিকে হেমন্তঅন্তে শীত আসিল। কমল শরীরে দুর্ব্বলতা অনুভব করিতে লাগিল। কিন্তু তাহার সামান্য অসুখে সকলে অত্যন্ত ব্যস্ত হইতেন বলিয়া সে সে কথা প্রকাশ করিল না। বৈশাখের প্রথমে সেই দুর্ব্বলতা আর সতীশচন্দ্রের শঙ্কাতীক্ষ্ণ দৃষ্টি অতিক্রম করিতে পারিল না। সতীশ বলিল, “কমল, নিশ্চয় তোমার অসুখ করিয়াছে।” কমল কিছুতেই সে কথা স্বীকার করিল না।

 কমল স্বীকার না করিলেও সতীশচন্দ্র আবার ঔষধ, পথ্য ও নিয়ম সম্বন্ধে বাঁধাবাঁধি করিতে লাগিল। গ্রীষ্মের দুই মাস কাটিল। তাহার পর অবর্ষণদীর্ণ ধরাবক্ষে বর্ষার জলধারা বর্ষিত হইল। দেখিতে দেখিতে ধরণীর ধূসর অঙ্গ নবোদ্গগত তৃণাঙ্কুরে হরিৎশোভা ধারণ করিল; বৃক্ষলতা প্রচুর পল্লবপুষ্ট হইয়া উঠিল, জলধরশীকরসঙ্গশীতল সমীরণে কেতকীকদম্বরেণু ভাসিতে লাগিল। কমলের শরীর আবার অসুস্থ হইল। বর্ষার আর্দ্রতায় তাহার দুর্ব্বল স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল। সতীশ লক্ষ্য করিল; মাও লক্ষ্য করিলেন। উভয়েরই উৎকণ্ঠার অন্ত রহিল না।

 বিশেষ বাঁধাবাঁধি সত্ত্বেও কমলের শরীর দুর্ব্বল হইতে লাগিল। শ্রাবণের প্রথমে জ্বর প্রকাশ পাইল।

 কমলের জ্বরের সংবাদ পাইয়া শিবচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। সকলেই চিন্তিত,—সকলেই উৎকণ্ঠিত। স্থির হইল, কমলকে পুনরায় কলিকাতায় লইয়া যাইতে হইবে। কিন্তু প্রবল জ্বর না ছাড়িলে, বর্ষা একটু না ধরিলে লইয়া যাওয়া যায় না। তখন জিলা হইতে বড় ডাক্তার আনান স্থির হইল; লোক গেল।

 জিলা হইতে যে ডাক্তার আসিলেন, তিনি রোগিণীর অবস্থা পরীক্ষা করিয়া শঙ্কিত হইলেন, বলিলেন, “আমি এ জ্বর সারিয়া দিতেছি। তাহার পর আপনারা রোগিণীকে কলিকাতায় লইয়া যাইবার যে সঙ্কল্প করিয়াছেন,—তদনুসারেই কার্য্য করুন।”

 ডাক্তারের এই কথায় সকলের আশঙ্কা কমিল না, বরং বাড়িল।

 আট দিন ভোগের পর জ্বর ছাড়িল। রোগিণীকে অন্নপথ্য দিয়া ডাক্তার বিদায় লইলেন। কিন্তু যাইবার সময় আবার বলিলেন, “বিলম্ব না করিয়া রোগিণীকে কলিকাতায় ল‍ইয়া যাউন।”

 সতীশ নিভৃতে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে, সত্য বলুন।”

 ডাক্তার দেখিলেন, তাহার নয়নে ভীতিভাব, তাহার কণ্ঠস্বর উৎকণ্ঠাকম্পিত। তিনি বলিলেন, “বিশেষ কিছু নহে। তবে শরীর বড় দুর্ব্বল; দীর্ঘকাল ভাল চিকিৎসার প্রয়োজন।”

 ডাক্তারের কথায় সতীশ নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না। কলিকাতায় যাইবার আয়োজন হইতে লাগিল।

 সতীশ বলিল, “বাসা ভাড়া করিবার জন্য প্রভাতকে পত্র লিখি!”

 শিবচন্দ্র বলিলেন, “আমি বা নবীন — কেহ যাইয়া ভাড়া করিয়া সব ব্যবস্থা করিয়া রাখিব।” পুত্ত্রের ব্যবহারে তিনি এমনই বিরক্ত হইয়াছিলেন।

 নবীনচন্দ্র বুঝাইয়া বলিলেন, “দাদা, সতীশ পত্র লিখিবে, লিখুক। আমাদের দুঃখের কথা আর বাহিরে জানাইয়া ফল কি?”

 শিবচন্দ্র বুঝিলেন; বলিলেন, “আচ্ছা। সতীশ লিখে লিখুক।”

 শেষে তাহাই হইল।

 চারি দিন পরে প্রভাতের পত্র আসিল। কমলের পীড়ার সংবাদে সে বিশেষ উৎকণ্ঠা জানাইয়াছে; সংবাদ দিয়াছে, বাড়ী ভাড়া করা হইয়াছে।

 এ দিকে বর্ষার প্রকোপও শান্ত হইল। কলিকাতায় যাইবার সকল আয়োজন স্থির ছিল; কেবল কালের দৌর্ব্বল্য ও বর্ষা— এই উভয় কারণে যাওয়া ঘটে নাই। সুতরাং পত্র পাইয়া আর যাইতে বিলম্ব হইল না!

 যাইবার কয় দিন পূর্ব্ব হইতে কমল আবার বড় অসুস্থ বোধ করিতে লাগিল। চক্ষু জ্বালা করে, মাথা ধরে, আহারে রুচি নাই, মুখ বিস্বাদ,— শরীরে সুখ নাই। কমলের ঘুসঘুসে জ্বর হইতেছিল। শরীরের শক্তি ক্রমে ক্ষয় হইয়া আসিতেছিল; অথচ সে ক্ষয় ধীরে ধীরে হইতেছিল,—সহজে অনুভূত হয় না। নিয়তির কঠোর কার্য্য প্রকৃতি যেন স্নেহবশে যথাসম্ভব যাতনাবিহীন করিতেছিল।

 প্রথমে স্থির হইয়াছিল, শিবচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, সতীশচন্দ্রের জননী ও সতীশচন্দ্র কমলকে লইয়া কলিকাতায় যাইবেন। শিবচন্দ্র স্বয়ং যাইবার জন্য বাস্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার উৎকণ্ঠার অবধি ছিল না। কিন্তু বৈষয়িক কার্য্যের অনুরোধে তাঁহার যাওয়া ঘটিয়া উঠিল না। তিনি বলিলেন, কার্য্য শেষ করিয়াই যাইবেন। চিকিৎসাদি সম্বন্ধে তিনি নবীনচন্দ্রকে অনেক উপদেশ দিলেন; কিন্তু পুত্ত্রের সম্বন্ধে কোনও কথাই বলিলেন না।

 নবীনচন্দ্র, সতীশচন্দ্র ও সতীশচন্দ্রের জননী কমলকে লইয়া কলিকাতায় গমন করিলেন। দত্ত-পরিবারে সকলেই উৎকণ্ঠিত হইলেন। শিবচন্দ্র সংবাদের আশায় পথ চাহিয়া রহিলেন। পিসীমা’র ও বড় বধূর আশঙ্কা যেন অসহনীয় হইয়া উঠিল।