বিষয়বস্তুতে চলুন

নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/প্রথম খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দশম পরিচ্ছেদ।

অদৃষ্টের উপহাস।

এ দিকে চার পাঁচ দিন প্রভাতের পত্র না পাইয়া ধূলগ্রামে সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। পিসীমা’র ও নবীনচন্দ্রের ব্যস্ততা আশঙ্কায় পরিণত হইয়া আত্মপ্রকাশ করিল। নবীনচন্দ্র প্রত্যহ অগ্রজকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “দাদা, আজও পত্র আসিল না?” উত্তরে শিবচন্দ্র একদিন বলিলেন, “সে দেশ বেড়াইতে গিয়াছে; আমোদে আছে। আমাদিগকে পত্র লিখিবার সময় নাই।” তিনি নবীনচন্দ্রকে কৃষ্ণনাথের ও প্রভাতের পত্র দুইখানি দিলেন।

নবীনচন্দ্র পত্র দুইখানি পাঠ করিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, “উত্তর দিয়াছেন?”

শিবচন্দ্র বলিলেন, “হাঁ। লিখিয়াছি, তুমি ত আর আমার কথা শুনিবে না; যাহা ইচ্ছা করিতে পার। আমি আর কিছু বলিব না।”

নবীনচন্দ্র বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে জ্যেষ্ঠের মুখের দিকে চাহিলেন;—সে মুখ অন্ধকার। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৈবাহিকের পত্রের উত্তর দিয়াছেন?”

শিবচন্দ্র বলিলেন, “না।”

নবীনচন্দ্র যাইবার সময় পত্র দুইখানি লইয়া যাইলেন।

 নবীনচন্দ্র সেই দিনই পত্র দুইখানির উত্তর লিখিলেন। তিনি কৃষ্ণনাথকে লিখিলেন;— “আপনার পত্রে শ্রীমান নলিনবিহারীর পীড়ার সংবাদে দুঃখিত হইলাম। শ্রীমান ওখানে যাইয়া কেমন আছেন, এবং সুস্থ হইয়াছেন কি না, জানিতে ব্যগ্র আছি। আপনাদের সকলের কুশল সংবাদ দিয়া বাধিত করিবেন। বৈবাহিকা ঠাকুরাণীকে আমার নমস্কার জানাইবেন। আপনি আমার নমস্কার গ্রহণ করিবেন। আর সকলকে আমার যথাযোগ্য আশীর্ব্বাদ জানাইবেন। আমার মা’কে তাহার এই বুড়া ছেলের কথা স্মরণ করাইয়া দিবেন।”

 প্রভাতকে তিনি লিখিলেন:—

“প্রাণাধিকেষু,

 বাবা, প্রায় এক সপ্তাহ তোমার পত্র পাই নাই। তোমার পত্র পাইতে বিলম্ব ঘটিলে আমরা কিরূপ ব্যস্ত হই, তাহা কি তুমি জান না? তোমার পত্র পাইতে কখনও এমন বিলম্ব হয় না, তাই আমরা আশঙ্কিত হইয়াছি। পত্রপাঠ পত্রের উত্তর দিবে। কোনও কারণে বিলম্ব করিবে না। তোমার পত্র পাইতে বিলম্ব হইলে আমাকে দার্জ্জিলিং যাইতে হইবে। তুমি কবে ফিরিবে? তোমার ও মা’র মঙ্গল সংবাদ দিবে। ইতি

নিত্যাশীর্ব্বাদক 
শ্রীনবীনচন্দ্র দত্ত।” 

 পত্র যথাকালে প্রভাতের হস্তগত হইল। কৃষ্ণনাথও তাহাকে নবীনচন্দ্রের পত্র দেখাইলেন।

 প্রভাত উভয় পত্রই পাঠ করিল। তাহার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইল। যে ভালবাসে, সে দুঃখের অংশভাগী হইয়া দুঃখের আতিশয্য প্রশমিত করে; যাহাকে ভালবাসা যায়, তাহাকে আনন্দের অংশ না দিলে তৃপ্তি হয় না। প্রভাত শোভাকে এ আনন্দের অংশ না দিয়া পারিল না। কৃষ্ণনাথ পূর্ব্বেই বিদ্রূপ করিয়া শোভাকে বলিয়াছিলেন, “শোভা, তোর বুড়া ছেলে পত্র লিখিয়াছে।”

 প্রভাত পত্নীকে বলিল, “শোভা, কাকা পত্র লিখিয়াছেন। তোমার কথা লিখিয়াছেন। শুনিয়াছ?”

 শোভা হাসিমুখে বলিল, “শুনিয়াছি।”

 প্রভাতের মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। প্রভাত বলিল, “এবার কলিকাতায় ফিরিয়া ধূলগ্রামে যাইবে?”

 শোভা বলিল, “যাইব।” কিন্তু স্বরে আগ্রহের অভাব।

 প্রভাত পত্নীর মুখ চুম্বন করিল।

 প্রভাত পরদিনই পিতৃব্যকে পত্র লিখিল। সে লিখিল “আমি কলিকাতায় আসার পর আমার সর্ব্বকনিষ্ঠ শ্যালকের শিরঃপীড়া বাড়িয়া উঠে। চিকিৎসকদিগের পরামর্শে দুই দিনের মধ্যে দার্জ্জিলিংএ আসা স্থির হয়। আমার শ্বশুর মহাশয় আমাকে লইয়া আসিবার প্রস্তাব করিলে আমি অসম্মত হই; আপনাদের অনুমতি ব্যতীত যাইতে পারিব না।আমি শেষ পর্য্যন্ত মনে করিয়াছিলাম, কাটাইতে পারিব। কিন্তু তাহা হয় নাই। শ্বশুর মহাশয় আমার কোনও আপত্তি শুনেন নাই। তিনি বাবাকে পত্রও লিখিয়াছেন। আমিও এ বিষয়ে বাবাকে পত্র লিথিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি আমার উপর রাগ করিয়া লিখিয়াছেন,—‘তুমি আমার অনুমতির অপেক্ষা রাখ নাই। সুতরাং তোমাকে কোনও কথা লিখাই নিষ্ফল। তুমি বড় হইয়াছ। তোমার হিতাহিত তুমি বুঝিতে পার। এখন আর তোমার কর্তব্যাকর্তব্য সম্বন্ধে আমার অনুমতি বা উপদেশ অনাবশ্যক। তাহা আর দিব না।’ আমি অনন্যোপায় হইয়া আসিয়াছি। সে জন্য বড় লজ্জিত হইয়াছি। বাবার পত্র পাইয়া আমি কিরূপ কষ্ট পাইয়াছি —কত কাঁদিয়াছি, বলিতে পারি না। আপনারা রাগ করিয়াছেন বলিয়া সাহস করিয়া পত্র লিখিতে পারি নাই। সে অপরাধ ক্ষমা করিবেন। আমি যত সত্বর হয় যাইবার চেষ্টা করিতেছি। যাইয়া শ্রীচরণ দর্শন করিব।”

 পত্র পাইয়া নবীনচন্দ্রের স্নেহার্দ্র হৃদয় প্রভাতের বেদনায় চঞ্চল হুইয়া উঠিল। তিনি শিবচন্দ্রকে সংবাদ দিলেন, প্রভাতের পত্র পাইয়াছেন।

 শিবচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাল আছে?”

 নবীনচন্দ্র বলিলেন, “হাঁ। বৈবাহিক মহাশয় অত্যন্ত জিদ করিয়া তাহাকে লইয়া গিয়াছেন। আপনি তিরস্কার করিয়াছেন, সে জন্য কত দুঃখ করিয়াছে।”

 নবীনচন্দ্র উত্তরে প্রভাতকে লিখিলেন:—

“প্রাণাধিকেষু,

 তোমার পত্রে তোমাদের কুশলসংবাদ অবগত হইয়া নিঃশঙ্ক হইলাম। আমরা রাগ করিয়াছি ভাবিয়া পত্র লিখ নাই। অমন করিতে আছে? তুমি কি বুঝিতে পার নাই, দাদার কথা রাগের নহে—অভিমানের? আমাদের রাগ বল, অভিমান বল, তুমি ভিন্ন আর কে সহ্য করিবে? তুমি দাদাকে পত্র লিখ নাই; পত্রপাঠ লিখিও। বাবা, এ সবই তোমার; আমরা আর কয় দিন?

 কমল কিছু দিন তোমার পত্র পায় নাই। সতীশ আজ সংবাদ জানিতে পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে সংবাদ দিও। আমার আশীর্ব্বাদ তুমি জানিও; মা’কে জানাইও। মা কি এ বুড়া ছেলেকে একেবারেই ভুলিয়া বসিয়া আছেন? ইতি

নিত্যাশীর্ব্বাদক 
শ্রীনবীনচন্দ্র দত্ত।” 

এই পত্র পাইয়াও প্রভাতের নয়নে অশ্রু দেখা দিল। কিন্তু এ অশ্রু বেদনার নহে,— আনন্দের। সে আনন্দ পিতৃব্যের হৃদয়ে আপনার স্নেহাসন অবিচলিত জানিয়া।

 প্রভাত পত্রখানি জামার পকেটে রাখিল। রাত্রিকালে জামা খুলিয়া শয়ন করিল। প্রভাতে উঠিয়া সে জামা পরিয়া বাহিরে আসিল; পকেটে হাত দিয়া দেখিল, পত্র নাই। নিশ্চয়ই জামা পরিবার সময় পড়িয়া গিয়াছে। প্রভাত শয়নকক্ষে ফিরিয়া আসিল; দেখিল, শোভা তাহার পত্র পড়িতেছে।

 শোভা তাহার পত্র পড়িতেছে দেখিয়া প্রভাত একটু বিরক্ত হইল; বলিল, “পত্র দাও।”

 শোভা মুখ তুলিল; প্রভাতের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “রাগা-রাগি কিসের?”

 প্রভাতের মুখ যেন রক্তহীন, পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। তাহার প্রথম ইচ্ছা হইল, বলে, সে কথায় শোভার আবশ্যক নাই। কিন্তু পাছে শোভা দুঃখিতা হয় বলিয়া সে কথা বলিল না; বলিল, “আমার শীঘ্র বাড়ী ফিরিবার কথা ছিল, বাড়ী না যাইয়া এখানে আসিয়াছি, তাই বাবা বোধ হয় রাগ করিয়াছেন।”

 শোভার ওষ্ঠ কুঞ্চিত হইল। সে বলিল, “কি অন্যায় হইয়াছে?”

 “বাড়ীতে আবশ্যক ছিল।” কথাটা যে সম্পূর্ণ সত্য—এমন নহে। বলিতে বাধ-বাধ ঠেকিল।

 শোভা পত্রখানা ফেলিয়া চলিয়া গেল।

 প্রভাত পত্র লইয়া বাহিরে আসিল। সমস্ত দিন মনটা কেমন চঞ্চল হইয়া রহিল।

 শোভা ভাবিল, “কি অন্যায়টা হইয়াছে? ইহাতেই রাগ? ছোট বৌদি কি সাধে বলিয়াছে,—সেই সূর্য্যমামার দেশে কেমন করিয়া ঘর করিতে যাইব?”

 প্রভাত নবীনচন্দ্রের নির্দ্দেশমত পিতাকে পত্র লিখিল। নবীনচন্দ্র সে পত্রের উত্তর দিলেন। পূর্ব্বে বহুবার এমন হইয়াছে। কিন্তু পূর্ব্বে ও এবারে কিছু প্রভেদ ছিল। তাই প্রভাত লিখিল, “বাবা আমাকে পত্র লিখেন না কেন? নিশ্চয়ই তাঁহার রাগ পড়ে নাই।”

 উত্তরে নবীনচন্দ্র লিখিলেন, “দাদা পত্র লিখেন নাই বলিয়া দুঃখ করিয়াছ কেন? আমার পত্র পাইলে কি হয় না? দাদা নানা কার্য্যে ব্যস্ত; সর্ব্বদা তাঁহার সময় হয় না। তাহা তুমি জান। সেই জন্যই আমি তোমার পত্রের উত্তর দিয়া থাকি। তুমি ত কখনও তাহাতে কিছু মনে করিতে না। তুমি পূর্ব্বের মত তাঁহাকে পত্র লিখিবে।”

 প্রভাত বুঝিল, নবীনচন্দ্র যাহা লিখিয়াছেন, তাহা সত্য। কিন্তু সন্দেহ মিটিল না; হৃদয়ে যে ছায়া পড়িয়াছিল, তাহা অপসৃত হইল না।

 ইহার পর হইতে প্রভাত প্রত্যাবর্ত্তনের জন্য ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতে লাগিল। কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “আর এক পক্ষ পরেই সকলে ফিরিব। বাস্ত হইয়া অগ্রে যাইবার প্রয়োজন কি?” শেষে প্রভাত বলিল, “কলেজের ছুটী ফুরাইয়া আসিল। তাড়াতাড়ি বাড়ী হইতে আসিয়াছিলাম। বাড়ীতে আবশ্যক আছে, বাড়ীর পত্র পাইয়াছি। একবার বাড়ী যাইব।” তাহার আগ্রহাতিশয়ে কৃষ্ণনাথ সম্মতি দিতে বাধ্য হইলেন। তাহার প্রধান কারণ, তাঁহার গৃহিণী তাঁহাকে বুঝাইয়াছিলেন,—জামাই যখন সত্য সত্যই যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে, তখন আর পুনঃপুনঃ বাধা দিয়া কায নাই।

 শোভার কিন্তু নিশ্চয় বিশ্বাস জন্মিল, প্রভাত দার্জ্জিলিংএ আসাতে তাহার পিতা রাগ করিয়াছেন; এবং তাহাই জানিয়া সে ব্যস্ত হইয়া গৃহে ফিরিল। পত্নী—বিশেষতঃ নবপরিণীতা, অল্পবয়স্কা পত্নী আবার কবে মনে করিয়া থাকে যে, সে ব্যতীত অপরের সম্বন্ধেও তাহার স্বামীর কর্তব্য আছে; স্বামীর উপর সে ব্যতীত আর কাহারও অধিকার আছে?

 প্রভাত গৃহে গেল। যাইবার সময় পত্নীর আঁধার মুখ দেখিয়া গেল। তাই ভাবিতে ভাবিতে গেল। বিচ্ছেদ কি কখনও সুখের হয়? এক দিকে পিতার বিরক্তি, অপর দিকে পত্নীর আঁধার মুখ—উভয় চিন্তাই কষ্টের।

 প্রভাত গৃহে আসিল। নবীনচন্দ্র তেমনই আগ্রহে তাহার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। গৃহে তাহার আদর যত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটী ছিল না। সতীশচন্দ্র তাহার আগমনসংবাদ পাইয়া একদিন স্বয়ং আসিয়া তাহাকে লইয়া গেল।হাস্যপরিহাসে, বিদ্রূপে, রহস্যালাপে সে দিন কাটিয়া গেল।

 কিন্তু প্রভাতের সন্দেহ ঘুচিল না। তাহার মনে হইল, যেন পিতার ব্যবহার বিরক্তিমুক্ত নহে। যখন সন্দেহের কোনও কারণ না থাকে, তখন যে ব্যবহার দৃষ্টিপথে পতিত হয় না, সন্দেহ-শঙ্কিত হৃদয়ে তাহা সহজেই অনুভূত হয়। বরং সন্দেহকলুষিত হৃদয়-দর্পণে অনেক সময় অবিকৃত দ্রব্যের প্রতিবিম্বও বিকৃত দেখায়।

 প্রভাত বুঝিল না, তাহার উপর বিরক্তি তাহার স্নেহশীল পিতার পক্ষে বিষম বেদনার কারণ। শিবচন্দ্র বুঝিলেন না,

তাঁহার সামান্য বিরক্তিও দীপ্ত অঙ্গারের মত পুত্ত্রের হৃদয় দগ্ধ করে। একমাত্র পুত্ত্রের ব্যবহারে দারুণ অভিমান স্নেহময় পিতৃহৃদয় পীড়িত করিতেছিল—স্নেহের প্রবাহপ্রকাশপথ রুদ্ধ করিয়া দারুণ বেদনা দিতেছিল। আবার পিতার অপরিম্লান স্নেহলাভে অভ্যস্ত পুত্ত্রের হৃদয়েও পিতার সামান্য বিরক্তি হেতু দারুণ মর্মবেদনা ও তাঁহার ব্যবহারে অভিমান জন্মিল। উভয়েরই হৃদয়ে বেদনা,— অথচ কেহই তাহা প্রকাশ করিলেন না। যদি প্রভাত একবার পূর্ব্বের মত পিতার কাছে সরলভাবে কোনও প্রয়োজনের কথা বলিত, তবে শিবচন্দ্রের উচ্ছ্বসিত স্নেহস্রোতে সকল অভিমান ভাসিয়া যাইত। যদি শিবচন্দ্র একবার পূর্ব্বের মত বলিতেন, “প্রভাত, তুই এই কার্য্য কর” বা “তুই এই কার্য্য করিতে পাইবি ন।,” তবে পুত্ত্রের হৃদয়ের সকল ব্যথা অপনীত হইত। কিন্তু তাহা হইল না।

 ছুটী ফুরাইল। প্রভাত কলিকাতায় গেল। সে পিতার আঁধার মুখ দেখিয়া ভাবিতে ভাবিতে গেল,—আমার দোষ কি?