নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/সপ্তদশ অধ্যায়
সপ্তদশ অধ্যায়
উপসংহার
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, “ওয়াশিংটন মহাশয়, আপনার জীবনের কোন্ ঘটনায় আপনি সর্ব্বাপেক্ষা বেশী আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছেন?” এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব। কারণ আমার জীবনের সমস্ত ঘটনাই বিস্ময়কর। তবে সকল কথা মনে মনে গভীর ভাবে আলোচনা করিলে মনে হয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি শ্রীযুক্ত চার্লস্ উইলিয়ম এলিয়ট আমাকে যে পত্র লিখেন তাহাতেই বোধ হয় আমি সর্ব্বাপেক্ষা বেশী বিস্মিত হইয়াছিলাম।
আমার ইউরোপ ভ্রমণের দুই তিন বৎসর পূর্ব্বে এলিয়ট আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন। ১৮৯৬ সালের মে মাসে অর্থাৎ আমার ৩৬।৩৭ বৎসর বয়সে এই পত্র পাই। তাহার কিছুকাল পূর্ব্বে আমি আটলাণ্টা-সম্মিলনে বক্তৃতা দিয়া সমগ্র আমেরিকায় প্রসিদ্ধ হইয়াছি।
এলিয়ট আমাকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে একটি অনারারি উপাধি দিতে চাহিয়াছেন। সেই উপাধি গ্রহণ করিবার জন্য আমাকে জুন মাসে তাঁহাদের উৎসবে যোগদান করিতে হইবে। ইহাই তাঁহার পত্রের মর্ম্ম।
আমেরিকার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়! তাহার কর্ত্তার নিকট হইতে সম্মানের দান লাভ! যে সম্মানের দান আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানবীর ও সাহিত্য বীরগণ মাত্র পাইবার যোগ্য! আমি সত্য বলিতেছি এলিয়টের এই পত্র পাইয়া আমি যতদূর বিস্মিত হইয়াছিলাম এরূপ আর কখনও হই নাই।
হার্ভার্ডের এম, এ উপাধি গ্রহণ করিতে যথাসময়ে ম্যাসাচুষ্টেট্স্ প্রদেশের কেম্ব্রিজ-নগরে উপস্থিত হইয়াছিলাম। সমারোহের সহিত আমার হস্তে এম্, এ উপাধিসূচক প্রশংসাপত্র প্রদত্ত হইল। পরে এলিয়ট-মহোদয় আমাকে এবং অন্যান্য যাঁহারা আমার মত ‘সম্মানের দান’ পাইয়াছেন তাঁহাদিগকে একটা ভোজ দিলেন। সেই ভোজে অন্যান্য সকলের বক্তৃতার পর আমি বলিলাম,—
“আজ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্মানিত করিয়া নিগ্রোজাতিকে সম্মানিত করিলেন। আপনারা আমাকে এই সম্মানের উপলক্ষ্য কেন করিয়াছেন তাহার জন্য আপনারাই দায়ী। আমিই ইহার উপযুক্ত হইলে যারপর নাই সুখী হইতাম সন্দেহ নাই।
যাহা হউক, আপনারা এই উপায়ে আমেরিকায় একটি প্রধান সমস্যার মীমাংসায় হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। কারণ যুক্তরাজ্যের শিক্ষিত ও ধনবান্ ব্যক্তিগণ কিরূপে অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনসাধারণের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইতে পারিবে তাহাই এক্ষণে সকল আমেরিক-সন্তানের একমাত্র ভাবিবার বিষয়। ঐ যে অনতিদূরে বীকনস্ট্রীটের সুরম্য প্রাসাদ সমূহ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, উহাদের অধিবাসিগণ কি আলাবামা প্রদেশের তুলার জমির চাষাদিগের এবং লুসিয়ানা প্রদেশের ইক্ষুর আবাদের কুলীগণের তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করিতে পারিতেছেন? যুক্তরাষ্ট্রের স্বদেশ-সেবকগণের এক্ষণে আর কোন কর্ত্তব্য নাই। তাঁহারা আলোচনা করুন—কি উপায়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র, অবনত ও পদদলিত নরনারীর ক্রন্দন উন্নত, শিক্ষিত ও ধনবান্ ব্যক্তিগণের কর্ণে পৌঁছিবে?
সেই সমস্যার মীমাংসা করিবার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ব্রতী হইয়াছেন বুঝিতে পারিতেছি। আমেরিকার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় আমার ন্যায় কৃষ্ণাঙ্গ, উচ্চ শিক্ষাহীন নিগ্রোকে সম্মান করিয়া এদেশের নিম্নজাতিদিগকে উর্দ্ধে ভুলিবার পথ প্রদর্শন করিলেন। ইহাতে হার্ভার্ড অবনত হইলেন না, অথচ আমাদের দরিদ্রের হৃদয়ে আশার সঞ্চার হইল।
আমি এই ক্ষুদ্র জীবনে আমার অবনত স্বজাতিকে নানা উপায়ে উন্নত করিতে চেষ্টিত হইয়াছি! আমার নগণ্য শক্তির দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গসমাজে ভ্রাতৃভাব বর্দ্ধনেরও যথাসাধ্য চেষ্টা করা গিয়াছে। এত দিন আমার নিকট আমেরিকাজননী যাহা লাভ করিয়াছেন, আজকার এই গৌরবে ভূষিত হইবার পরও আমার সেইরূপ কর্ম্ম ও চিন্তাই আপনারা আশা করিতে পারিবেন।
আমি আমেরিকার জাতীয় আদর্শকে নিজ জীবনের আদর্শ স্বরূপ গ্রহণ করিয়াছি। আমি আমেরিকার সকল জাতিকে সেই জাতীয় আদর্শেই গঠিত দেখিতে চাহি। আমি শ্বেতাঙ্গের লক্ষ্য ও কৃষ্ণাঙ্গের লক্ষ্য দুইটা স্বতন্ত্র ভাবে দেখি না। আমার বিবেচনায় দুইএর লক্ষ্যই এক—দুই জাতিকেই আমেরিকার এক আদর্শে গড়িয়া তুলিতে হইবে। দুইএর উন্নতি—অবনতি এক মাপকাঠিতেই বিচার করিতে হইবে।
আগামী ৫০ বৎসরের ভিতর আমার স্বজাতি সেই আমেরিকার ছাঁচে ঢালা হইয়া উন্নত হইতে থাকিবে—সকল বিষয়ে শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে ঐক্য রক্ষা করিয়া বিকাশ লাভ করিবে। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সাধনার ভিতর দিয়া নিগ্রো সমাজ শিল্পে, সাহিত্যে, সেবায়, ব্যবসায়ে, চরিত্রে ও ধর্ম্মে পরীক্ষিত হইতে হইতে কালে আমেরিকা-জননীর অন্যতম সুদক্ষ অঙ্গে পরিণতি লাভ করিবে।”
আমি টাস্কেজীতে বিদ্যালয় স্থাপনকালে দৃঢ় বিশ্বাস করিয়াছিলাম যে, ভবিষ্যতে আমার বিদ্যালয় চূড়ান্ত উন্নত হইয়া উঠিবে। যুক্ত-দরবারের সভাপতিকে এই বিদ্যালয় দেখাইবার অযোগ্য হইবে না। আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হইয়াছিল। ১৮৯৮ সালে সভাপতি ম্যাক্ফিন্লি আটলাণ্টায় আসিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে তিনি এবং তাঁহার কর্ম্মচারিগণ টাস্কেজীতে পদার্পণ করিয়া যান। ১৬ই ডিসেম্বর ক্ষুদ্র টাস্কেজী নগর মহা আনন্দে পূর্ণ হইয়া গেল! শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ উভয় সমাজই সভাপতি মহাশয়ের অভ্যর্থনায় যোগদান করিল। আমার বিদ্যালয়ও যথেষ্ট সজ্জিত করা হইয়াছিল। সভাপতি মহোদয় বক্তৃতাকালে বলিলেন, “টাস্কেজীর প্রতিষ্ঠাতা বুকার ওয়াশিংটন নিগ্রোজাতির অন্যতম জননায়ক। ইনি স্বদেশে ও বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। ইহাঁর শিক্ষাপ্রচার, বাগ্মিতা এবং মানব-সেবা সর্ব্বত্র সুবিদিত।”
প্রায় ১৯ বৎসর ব্যাপী কার্য্যের পর টাস্কেজী বিদ্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি প্রথম পদার্পণ করিলেন। বিশ বৎসর পূর্ব্বে একটা পোড়ো বাড়ীতে আমাদের কার্য্য আরম্ভ হইয়াছিল। তখন টাস্কেজীর ছাত্র সংখ্যা ৩০ এবং শিক্ষক মাত্র একজন। আজ আমাদের ৬৯০০ বিঘা জমি। তাহার ৩০০০ বিঘা ছেলেরা চাষ করে। আমাদের এক্ষণে ৬৬টা বড় বড় ইমারত—ইহাদের ৬২টা ছাত্রদের নিজ হাতে গড়া। আজ এই বিদ্যালয়ে ৩০ প্রকার কৃষি ও শিল্পবিষয়ক কাজ কর্ম্ম শিখান হইতেছে। আমাদের পাশ করা গ্রাজুয়েট আমেরিকার প্রদেশে প্রদেশে শিক্ষকতা ও ব্যবসায় বা শিল্পের কর্ম্মে নিযুক্ত। প্রতিদিন আমার নিকট এইরূপ পাশকরা লোকের জন্য এত তাগিদ আসে যে, অনেককেই আমি নিরাশ করিতে বাধ্য হই।
গৃহ সম্পত্তি ইত্যাদির মূল্য সম্প্রতি ২,১০০,০০০৲। এতদ্ব্যতীত নগদ টাকা আছে ৩,০০০,০০০৲। বার্ষিক ব্যয় আজকাল ১৫০,০০০৲। এই টাকার অধিকাংশই গৃহে গৃহে ভিক্ষা করিয়া হইয়া থাকে। এক্ষণে আমাদের ছাত্র সংখ্যা ১৪০০। আমেরিকার ২৭ প্রদেশ হইতে ছাত্র আসিয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত আফ্রিকা, কিউচা, পোর্টো রিকো, জামেকা ইত্যাদি দূর বিদেশ হইতেও আমরা ছাত্র পাই। আজকাল আমাদের কর্ম্মচারী ও শিক্ষকগণের সংখ্যা সর্ব্বসমেত ১১০। ইহাঁরা স্বপরিবারে বাস করেন। বিদ্যালয়ের চতুঃসীমার মধ্যে এইরূপে অন্ততঃ ৭০০ জন লোকের বসতি।
১৮৯০ সালে টাস্কেজীতে প্রথম “নিগ্রো-মহাসম্মিলনের” প্রবর্ত্তন করি। তাহার পর হইতে প্রতিবৎসর নিগ্রোসম্মিলনের অধিবেশন হইয়া আসিতেছে। প্রায় ৮০০।৯০০ পুরুষ ও স্ত্রী নিগ্রো যুক্তরাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে টাস্কেজীতে বৎসরে একদিন করিয়া কাটাইয়া যান। এই দিন নিগ্রোজাতির আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাসম্বন্ধীয়, নৈতিক ও অন্যান্য সকল প্রকার উন্নতির উপায় আলোচিত হয়। এই সম্মিলনকে নিগ্রোদিগের জাতীয় সম্মিলন বলা যাইতে পারে।
এই একদিবসব্যাপী নিগ্রো-মহা-সম্মিলনের দৃষ্টান্তে বিগত ১০ বৎসরের মধ্যে নিগ্রোসমাজের ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রে ছোট বড় নানা প্রাদেশিক বা পল্লী-সম্মিলনের অনুষ্ঠান আরব্ধ হইয়াছে এইরূপ সম্মিলনের সাহায্যে নিগ্রোজাতির কর্ম্মশক্তি এবং চিন্তাশক্তি অসীম প্রভাব লাভ করিতেছে।
টাস্কেজীতে প্রতিবৎসর ‘নিগ্রো-মহা-সম্মিলনের পর দিবস আর একটা সমিতির অধিবেশন হইয়া থাকে। ইহার নাম “কর্ম্মীসমিতি”। ইহাতে নিগ্রোসমাজের নানা কেন্দ্রে যাঁহারা শিক্ষাপ্রচার কর্ম্মে ব্রতী আছেন তাঁহারা পরামর্শ করিয়া পর বৎসরের জন্য কর্ত্তব্য স্থির করেন। সুতরাং ইহাকে নিগ্রোসমাজের শিক্ষাসম্মিলন বলা যাইতে পারে। নিগ্রো-মহা-সম্মিলন যে কার্য্য ব্যাপকভাবে ও বৃহৎভাবে করেন কর্ম্মীসমিতি তাহার ‘কার্য্যনির্ব্বাহক’ সভা স্বরূপ হইয়া সেই কার্য্যই কথঞ্চিৎ ক্ষুদ্রতর গণ্ডীর মধ্যে সমাধা করেন। ১৯০০ সালে আমি নিগ্রোজাতির “ব্যবসায়-সম্মিলনে”র প্রবর্ত্তন করিয়াছি। এই সম্মিলনের প্রথম অধিবেশন বোষ্টননগরে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যে সকল নিগ্রো ব্যবসায়ে ও বাণিজ্যে লিপ্ত আছেন তাঁহারা এই সম্মিলনে সমবেত হইয়া ভাব-বিনিময় করিবার সুযোগ পাইয়া থাকেন। এই বৃহৎ অনুষ্ঠান হইতেই ছোট ছোট “প্রাদেশিক ব্যবসায়-সম্মিলনে”র জন্ম হইয়াছে।
এই গ্রন্থ আমি আমার জন্মভূমি ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশের রিচ্মণ্ডে বসিয়া সমাপ্ত করিলাম। আজ ১৯০১ সাল। ৩৫ বৎসর পূর্ব্বে এই রিচ্মণ্ড-নগর গোলামী প্রথার প্রধান কেন্দ্র ছিল। ২৫ বৎসর পূর্ব্বে, আমাদের স্বাধীনতালাভের কয়েক বৎসর পর, এই রিচ্মণ্ড-নগরে আমি প্রথম রাত্রি অনাহারে থাকিয়া রাস্তার পার্শ্বে কাঠের তক্তার নীচে মাটিতে শুইয়া কাটাইয়াছি। আর সেই রিচ্মণ্ডে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সমাজদ্বয়ের সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট আমি গত রাত্রে আমার আশার বাণী প্রচার করিলাম। যে স্থানে ২৫ বৎসর পূর্ব্বে একব্যক্তিও আমাকে একটি আলু মাত্র দান করিয়া ক্ষুধা নিবৃত্তি করিতে দেয় নাই, আজ সেই স্থানের সহস্র সহস্র নরনারী, শিক্ষিত সম্প্রদায় এবং প্রদেশরাষ্ট্রের সকল কর্ম্মচারীই আমাকে আদর আপ্যায়ন ও সম্বর্দ্ধনা করিতে ব্যগ্র। কালের কি বিচিত্র গতি!
সম্পূর্ণ।