নীতিকণা/কৃষক ও পণ্ডিতের কথোপকথন

উইকিসংকলন থেকে

কৃষক ও পণ্ডিতের কথোপকথন

নগর হইতে দূরে চাসী এক জন,
স্বচ্ছন্দে করিত বাস হ’য়ে হৃষ্টমন।
বার্দ্ধক্যে তাহার কেশ হ’য়েছে ধবল,
দেহের বলিত মাংস করে থল থল।
চিন্তিত সে নহে কভু ধনের আশায়,
হ’য়েছে পরম জ্ঞানী বহুদৰ্শিতায়।
গ্রীষ্মকালে রৌদ্রে কিম্বা শীতকালে শীতে,
কাতর না হয় কভু মেষ চরাইতে।
মনের আনন্দে শ্রম করে অনুক্ষণ,
হিংসা দ্বেষ দুরাকাঙ্ক্ষা জানে না কেমন।
করিতে পরের মন্দ করে না বাসনা,
দেশে তার হ’ল জ্ঞান-যশের ঘোষণা।
জানিতে সে কৃষকের জ্ঞানের কারণ,
আসিয়া পণ্ডিত এক দিল দরশন।

পরস্পর শিষ্টাচার শেষ হ’লে পরে,
বলিল পণ্ডিত তারে অতি মৃদুস্বরে।
“অনুগ্রহ প্রকাশিয়ে বল মহাশয়,
কিরূপে হইল তব জ্ঞানের উদয়।
জেগেছ কি রজনীতে বিদ্যার লাগিয়া,
লভেছ কি জ্ঞানধন বিদেশ ভ্রমিয়া?
জ্ঞানার্থে কি করে’ছিলে কর্ণাটে গমন,
উজ্জয়িনী গিয়া কি হে লভিলে এ ধন?
তোমার মানস-পটে মনু মহাকবি,
অঙ্কিত করিয়া গে’ছে জ্ঞানের কি ছবি”?
বিনয়ে কৃষক বলে “শুন মহাশয়,
আমার বিদ্যার সহ নাহি পরিচয়।
মানবের রীতি নীতি শিখিবার তরে,
কভু আমি ভ্রমি নাই দেশ দেশান্তরে।
নরের চরিত বল বুঝিব কেমনে,
বুঝিতে অক্ষম তাহা বুদ্ধিমান জনে।
আপনিই আপনারে না পারি বুঝিতে,
যতন করিব কেন অপরে জানিতে?
মানবের রীতি নীতি করি দরশন,
সাধ্য কি করিতে পারি জ্ঞান উপার্জ্জন?

আমার যে কিছু জ্ঞান পাই’ছ দেখিতে,
পাইয়াছি আমি তাহা প্রকৃতি হইতে।
কুৎসিত প্রবৃত্তি যদি হয় কভু মনে,
মানসের শান্তি দূর হয় সেই ক্ষণে।
তাহাতে মানসে হয় কতই অসুখ,
তাই তারে স্থান দিতে হ’য়েছি বিমুখ।
মধুমক্ষি পরিশ্রম করে নিরন্তর,
তাহা দেখি শ্রম শিক্ষা করে’ছি সুন্দর।
দেখিয়া সঞ্চয়পটু পিপীলিকাগণে,
সঞ্চয় করিতে শিক্ষা করে’ছি যতনে।
কুকুরের কৃতজ্ঞতা দেখিয়াছি যবে,
কৃতজ্ঞ হইতে আমি শিখিয়াছি তবে।
কুকুর বিশ্বাসী অতি করি দরশন,
বিশ্বাসী হইতে আমি হই সযতন।
পক্ষপুটে শাবকেরে করি আচ্ছাদন,
কুক্কুট যতনে শীতে করয়ে পালন।
তাহা দেখি শিখিয়াছি পালিতে সন্তান,
অন্য পাখি হ’তে হ’ল অন্যবিধ জ্ঞান।
প্রকৃতি হইতে আরো কত জ্ঞান পাই,
উপহাস ঘৃণা নিন্দা কভু করি নাই।

যখন কাহারো সনে করি আলাপন,
বাহির না হয় কভু গর্ব্বিত বচন।
অন্যের গর্ব্বিত বাক্য না পারি সহিতে,
তাই তাহা ত্যজিয়াছি যতন সহিতে।
অবিরল কতগুলা যেবা কথা কয়,
দেখি যে অনেক তার অনর্থক হয়।
অনেক কহিতে গেলে পাছে মিছা হয়,
হইয়াছি মিতভাষী তাই মহাশয়।
হরিলে আমার ধন ব্যথা মনে পাই,
তাই অপরের ধন চুরি করি নাই।
চারি দিকে প্রকৃতিরে করি দরশন,
এইরূপ কত জ্ঞান করে’ছি অর্জ্জন।
সামান্য কীটেও যদি করি দরশন,
তা’তেও কোন না কোন করি জ্ঞানার্জ্জন।”
কৃষকের কথা শুনি, পণ্ডিত বলিল,
কৃষক, তোমার বাক্যে জ্ঞান উপজিল।
তুমিই প্রকৃত গুণী ধন্য তব জ্ঞান,
পণ্ডিত নাহিক দেখি তোমার সমান।