বিষয়বস্তুতে চলুন

নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব/আমার ছাত্র

উইকিসংকলন থেকে

আমার ছাত্র

 মানুষের প্রতি মানুষের এই যে হিংসা, এই যে উলঙ্গ বর্বরতা আচরিত হচ্চে সভ্যতার নামে, শত বৎসরের শিক্ষা সংযম এক মুহূর্তে যাতে করে তৃণের মত উড়ে গেল, উদগ্র লোভ, হিংসা ও লালসার এই যে নগ্ন মূর্তি দেখা গেল চোখে,—তাতে দমে গেলে চলবে না। মানুষ আছে এখনও, মানবতা আছে, মনুষ্য সমাজ থেকে লজ্জায় মুখ ঢেকে বিদায় নেবার সময় ভগবান এদেরই দিকে ফিরে ক্ষীণ আশ্বাসের বাণী শুনতে পান, শুনতে পেয়ে থম্‌কে দাঁড়ান।

 আমাদের গণেশদাদার কথা বলবার যোগ্য বলে এতদিন ভাবতামই না, কিন্তু আজ দেখচি গণেশদাদার ছবি আমার মনের পটে মস্ত বড় হয়ে ফুটে উঠেছে। এর আর একটা কারণ যে গণেশদাদা আমার ছাত্র।

 গণেশদাদার নাম গণশা মুচি। আমাদের গ্রামের মুচিপাড়ার ছোট্ট খড়ের চারচালা ঘরে দুটি গরু ও চার-পাঁচটি বাছুর এবং স্ত্রীপুত্র নিয়ে, উঠানে লাউমাচা পুঁইমাচা বানিয়ে, পুন্‌কে নটে শাক বুনে, মেটে আলু ও বুনো ওল তুলে হাটে বিক্রি করে সংসার চালাতো।

 যখন পাঠশালায় পড়ি, তখন হরিশ জ্যাঠামশায়ের বাড়ি গণেশ মুচি কৃষাণের কাজ করে। আমরা গণেশদাদা বলে ডাকতাম, অন্যলোকে বলতো গণশা মুচি। মিশ্‌কালো, দোহারা গড়ন, মুখে একপ্রকার শান্ত, দীন ভাব, লাজুক-নম্র চোখ দুটি, সর্বদাই যেন অপ্রতিভ, যেন কি একটা মহা অপরাধ করে ফেলেচে সে।

 হরিশ জ্যাঠামশায় কড়া প্রকৃতির গ্রাম্য গাঁতিদার। গণেশদাদাকে ডেকে বলছেন—এই গণশা—বাব্‌লাতলার জমিতে দোয়ার দেওয়া হয়েচে?

 গণেশ অমনি হাত কচলাতে কচলাতে বলতো—আজ্ঞে না, বাবাঠাকুর। কাল তো মোটে লাঙল দেলাম—

 —হারামজাদা, এতদিন ঘুমুচ্ছিলে নাকে তেল দিয়ে? কবে বলিচি চষ্‌তে ও ভুঁই!

 —জমিতি লাঙল না লাগলি কি ক-অ-রবো বাবাঠাকুর। আজ সাঁজবাতির মদ্যি দোয়ার দিয়ে দেবানি—

 —না দিলে জুতিয়ে তোমার আজ হাড় খুলে নোব মনে থাকে যেন।

 গণেশদাদা আমরা যেখানে খেলা করচি সেখানে এসে হেসে বলতো—বাবাঠাকুর চটে গিয়েচেন।

 আমি বলতাম—ও গণেশদাদা, ইংরিজি জানো?

 —ইন্‌জিরি? কনে থেকে জানবো? মুই কি লেখাপড়া জানি?

 —শিখবে?

 —শিখিয়ে দাও দাদাঠাকুর তো শিখি—

 —শেখো—ওভার মানে ওপর।

 —কি?

 —ওভার মানে ওপর, উড্ মানে কাঠ, কাউ মানে গরু—

 গণেশদাদা মুখস্থ করতে লাগলো। ইউ. পি. পাঠশালায় কুঞ্জ মাস্টারের শেখানো যত বিদ্যা আমার মাথায় ভিড় করে তাদের উগ্রতায় আমাকে ব্যতিব্যস্ত করছিল, তা সবগুলো গণেশদাদার ঘাড়ে না চাপাতে পারলে যেন আমার নিস্তার নেই। সেই থেকে গণেশদাদার ইংরিজি শিক্ষার ভার আমি স্বহস্তে গ্রহণ করলাম। গোটা ওয়ার্ডবুকখানা গণেশদাদাকে কণ্ঠস্থ করাবার সে কী দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা আমার। মুখে মুখে শেখানো ছাড়া অবিশ্যি অন্য উপায় ছিল না, গণেশদাদার ভাষাতেই বলি, ‘মা সরস্বতীর ঘরের ঝন্‌কাট কখনো মাড়াইনি যে।’

 গণেশদাদা কিন্তু শিখলো অনেক কথা। শ্রুতিস্মৃতির প্রাচীন উপায়ে প্রায় ডজনখানেক ইংরিজি শব্দের ঐশ্বর্যে সে ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠলো। আমিও শিষ্যগর্বে গর্বিত হয়ে উঠলাম রীতিমত।

 আমার সে-গর্ব মাঝে মাঝে বড় অশোভনভাবে আত্মপ্রকাশ করতো, গণেশদাদার লাজুকতা ও অপ্রতিভ ভাবকে আরও বাড়িয়ে। যেমন একটা উদাহরণ দিই। হরিশ জ্যাঠামশায়ের বাড়ি তাঁর বড় ছেলে ফুটুদা’কে বিয়ের জন্যে কন্যাপক্ষ দেখতে এসেচে—দু’তিনটি ভদ্রলোক, শ্যামনগরের কাছে কোথায় বাড়ি। আমরা ছেলেরা বলাবলি করলাম শ্যামনগর অর্থাৎ শহরের দিকে যতই বাড়ি হোক বাছাধনদের, আমাদের অজপাড়াগাঁ বলে যে নাক সিঁটকোবেন তা হোতে দিচ্চিনে—দেখিয়ে দেবো এ গ্রামের একজন মুচি কৃষাণও ইংরিজি কেমন জানে। সেই ভদ্রলোকের দল যখন হরিশ জ্যাঠামশায়ের চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছে, তখন আমি গণেশদাদাকে ডেকে বললাম—এই দেখুন, এদের মাইন্দার কেমন ইংরিজি জানে—

 তাদের মধ্যে একজন কৌতূহলের সুরে বললে—তাই নাকি। দেখি—দেখি—

 আমি অমনি বলি—গণেশদাদা, ওভার মানে কি?

 গণেশ হাত ওপরে তুলে বললে—ওপোর।

 —ওয়াটার?

 —জল।

 —স্কাই?

 —আকাশ।

 ইত্যাদি।

 এক ডজন শব্দের ক্ষীণ পুঁজি শেষ হোতেই আমি থেমে গেলাম। গণেশদাদার দিকে শহরের চালবাজ লোকদের সপ্রশংস দৃষ্টি পড়ুক— এই আমার ইচ্ছা। আমার উদ্দেশ্য সফল হোল; শহরে বাবুরা ওর দিকে চেয়ে চেয়ে বললে—বাঃ, বাঃ, এ লোকটি তো বেশ। কি নাম তোমার? বেশ। এদিকে এসো—

 ওরা চার আনা বকশিস করলে তখুনি। অর্থকরী বিদ্যা বটে ইংরিজি।...

 সেই থেকে গণেশদাদার কি উৎসাহ ইংরিজি শেখাবার। সাতদিনের মধ্যে আর এক ডজন শব্দ কণ্ঠস্থ করে ফেললে।

 আর একদিনের কথা মনে পড়ে। শীতকাল। বাড়িতে রুটি হচ্চে, দুধ আর গুড় দিয়ে খাবো বলে মনে খুব ফুর্তি। এমন সময় পীতাম্বর রায় জ্যাঠামশায়দের বাড়ি হৈ চৈ শুনে সেদিকে গেলাম। গিয়ে দেখি তার চণ্ডীমণ্ডপের সামনে লোকে লোকারণ্য। পীতাম্বর রায়, হরিশ জ্যাঠামশায়, নবীন চক্রবর্তী প্রভৃতি বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা চণ্ডীমণ্ডপে বসে। পীতাম্বর রায় খুব চীৎকার করচেন ও হাত-পা নাড়চেন। উঠানের মাঝখানে গণেশদাদা মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ব্যাপার শুনে বুঝলাম, পীতাম্বর রায়ের একটি গরু আজ দুদিন হারিয়ে গিয়েছিল, আজ সেটা গণেশদাদার বাড়ির পিছনে মুচিপাড়ার বড় আমবাগানে (যার নাম এ গ্রামে গলায় দড়ির বাগান) লতা দিয়ে বাঁধা ছিল এবং তার লেজ কে দা দিয়ে অনেকখানি কেটে দিয়েছে, ঝরঝর করে রক্ত পড়চে লেজ দিয়ে। এই অপরাধের সন্দেহ গিয়ে পড়েছে গণেশদাদার ওপর, কারণ প্রথমতঃ মুচিরা গরুর চামড়া বিক্রি করে, দ্বিতীয়তঃ গরু গণেশদাদার বাড়ির পিছনে বাঁধা ছিল, তৃতীয়তঃ গণেশদাদা গরীব। সুতরাং গণেশদাদাই রাত্রে গরুটি কেটে চামড়া খুলে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সেটাকে লুকিয়ে রেখেছিল তার বাড়ির পিছনের আমবাগানে। দায়ের কোপও সেই মেরেচে।

 পীতাম্বর রায়ের ও হরিশ জ্যাঠামশায়ের যুক্তির মধ্যে যে ফাঁক ছিল, তা কারো চোখে পড়লো না। গণেশদাদার বক্তব্য প্রথমতঃ সুসম্বদ্ধ নয়, দ্বিতীয়তঃ ভয়ে তার বুদ্ধিশুদ্ধি (যার আতিশয্য তার কোনোদিনই নেই) লোপ পেয়েছিল, সুতরাং আত্মপক্ষ সমর্থনে সে পটুত্বের বিশেষ পরিচয় দিল না!

 উঃ, সে কি মারটাই মারলেন পীতাম্বর জ্যাঠামশাই ওকে, পা থেকে চটি জুতো খুলে! কত কাল কেটে গিয়েচে, দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর, কিন্তু আজও আমি চোখের সামনে গণেশদাদার যন্ত্রণা ও লজ্জাকাতর মুখ দেখতে পাই। মার বটে একখানা। শুধু শোনা যায় পীতাম্বর রায়ের তর্জন-গর্জন এবং চটাং চটাং চটি জুতার শব্দ গণেশদাদার পিঠে। পিঠ ফেটে রক্ত পড়তে লাগলো, দরদর করে। তখনও পীতাম্বর জ্যাঠার থামবার চেহারা ছিল না, নীলু বাঁড়ুয্যের ছেলে মণিদাদা, জোয়ান ছোকরা, দৌড়ে গিয়ে পীতাম্বর রায়ের হাত ধরে টেনে এনে নিরস্ত করলে।

 আহা, গণেশদাদা বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো। আমি জানতাম গণেশদাদা নির্দোষী। আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো গণেশদাদার কান্না দেখে। ইচ্ছে হোল পীতাম্বর জ্যাঠার কান ধরে কেউ এখুনি ঘুরপাক দেয় তো আমার মনের রাগ মেটে।

 এ সব বাল্যকালের কথা।

 সারা বাল্যকাল ধরে দেখেছি গণেশদাদা লোকের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে দিনান্তে একথালা রাঙা আশচালের ভাত কায়ক্লেশে যোগাড় করচে। তাতেই তার কী খুসি!

 —ও গণেশদাদা, আজ কি খেলে?

 আমি হয়তো প্রশ্ন করি।

 তখন গণেশদাদা আস্তে আস্তে বলবে, যেন কল্পনায় খাদ্যগুলো সে আবার পরম তৃপ্তির সঙ্গে আস্বাদ করছে।

 —খ্যালাম? তা খ্যালাম মন্দ নয়। তোমার বড় বউদিদি রেঁধেলো অনেকগুলি। খ্যালাম ধরো (আঙুলের পর্বে হিসেব রেখে) ভাত, শুল্‌কোর (গ্রামের নাম) নাঙা ডাঁটা দিয়ে, কুমড়ো দিয়ে, পেঁজ দিয়ে ঝিঞের ঝাল (তরকারি হিসেবে অদ্ভূত শুধু নয়, বিকট), বাগুন দিয়ে পেঁজ দিয়ে, কাঁচানংকা আর তেঁতুল। তা বেশ খ্যালাম—কি বলো?

 —বেশ খেয়েচ, আবার কি খাবে?

 কোনোদিন জিজ্ঞাসিত না হয়েও একগাল হেসে বলতো—দাদাঠাকুর, আজ খুব খ্যালাম—

 —কি ও গণেশদাদা?

 —কি বল দিনি?

 গণেশদাদা সকৌতুকে আমার দিকে তাকায়।

 —তা কি জানি? তুমি বলো!

 —আজ তোমার বউদিদি বড্ড করেল। উস্তের (উচ্ছে) শাক আর দয়াকলা দিয়ে একটা তরকারি আর পান্ত ভাত।

 খাবারটা লোভনীয় বলে মনে না হোলেও মৌখিক তারিফ না করে উপায় নেই গণেশদাদার কাছে।

 খাওয়ার তো এই দশা—পরণে ময়লা ছেঁড়া কাপড় কিংবা গামছা ছাড়া আমি তো গণেশদাদার ছবি মনেই করতে পারিনে। অথচ... ব্রাহ্মণপাড়ার অর্ধেক কাজে গণেশকে না হোলে চলেই না। বেশির ভাগই ব্যাগার।

 —ওরে গণশা, আজ উঠোনের কাঠগুলো ঘরে তুলে দিয়ে আসিস তো?

 —গণশা, গাছের নারকোলগুলো পেড়ে দিতে হবে ওবেলা।

 —গরুটো পণ্টে গিয়েচে রে, তুই দুপুরবেলা একবার এসে গরুটো আজ এনে দিবি—বুঝলি?

 —গণশা, আমার গাছের দুকাঁদি কাঁচকলা হাট থেকে বিক্রি করে দিতে হবে বাবা—

 শুধু মিষ্টিকথা—ব্যাস্। ঐ পর্যন্ত! কখনো গণেশদাদা মুখ ফুটে একটা পয়সা মজুরি এ সব ফাইফরমাশ খাটার জন্যে চাইতো না। বরং বলতো—বেরাহ্মণ দেবতা, ওনাদের পা ধোয়া জল খেলি স্বগ্‌গো। ওনাদের একটু সেবা করবো তার আবার পয়সা!

 কিন্তু শুধু ব্রাহ্মণের নয়, আমি যে-কোনো জাতির সেবা করতে দেখেচি ওকে অম্লানবদনে। জেলে-পাড়ার অথর্ব বুড়ী বিন্দের মাকে তার সঞ্চিত তেঁতুলকাঠের গুঁড়ি কুড়ুল দিয়ে চ্যালা করে দিতে দেখেচি। কত ক্রিয়াহীন মধ্যাহ্নে ব্রাহ্মণপাড়ার চণ্ডীমণ্ডপগুলি যখন অলস যুবক ও প্রৌঢ়দের পাশা দাবা ক্রীড়ার বিবিধ ধ্বনিতে অথবা দিবানিদ্রাভিভূত ব্যক্তিদের নাসিকা গর্জনে মুখরিত, তখন গণেশদাদা কারো তেঁতুলগাছে তেঁতুল পেড়ে দিচ্চে, না হয় কারো কলাইয়ের গাছ-বোঝাই গাড়ি চালিয়ে খামারে আনচে। ঘামে এর সারা দেহ ভিজে, মাথার চুল ধুলিধূসর, পেটে পেট লেগেচে, কারণ—এখনও খাওয়া হয়নি।

 কখনো দেখিনি গণেশদাদা কারও সঙ্গে ঝগড়া করছে কিংবা চড়াসুরে কথা বলচে।

 আমার বাল্যকাল কেটে গেল। কলেজে পড়ে দুটো পাস করে গ্রামে ফিরে যেতে পথেই গণেশদাদার সঙ্গে দেখা বেলতলার মাঠে। গণেশদাদা গরু চরাচ্চে মাঠের মধ্যে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়েই আমার পথ। গণেশদাদাকে ডেকে বললাম—ও গণেশদাদা, চিনতে পারো?

 —তা চিনতে পারবো না, দ্যাখোদিনি দা’ঠাকুর। কোলে পিঠি করে মানুষ করলাম আর চিনতি পারবো না? কত বচ্ছর দেখিনি। কোথায় ছিলে এ্যাদ্দিন আমাদের ভুলে?

 —মামার বাড়ি। তুমি তো বুড়ো হয়ে গিয়েচ দেখচি। মাথার চুল পেকেচে হ্যাঁ গণেশদাদা?

 —ওমা, তোমাদের কোলে করে মানুষ করলাম, তোমরাই কত বড় হয়ে গেলে—মুই আর বুড়ো হবো না? বয়েস কি ক‍ম হোল?

 —ভাল আছ, হ্যাঁ গণেশদাদা?

 —হ্যাঁ ভালো। তোমরা সব ভালো?

 গণেশদাদাকে এই বয়সে গরু চরাতে দেখে আশ্চর্য হলাম। কারণ পল্লীগ্রামে গরু চরানো হোল বিষয়কর্মের প্রথম সোপান। সাধারণতঃ বালকেরা এ কাজ করে থাকে—তারপর ক্রমোন্নতির ধাপে ধাপে উঠতে শুরু করে। মোটামুটি সেটা এই রকম:—

 ১। গরু চরানো (১৭ বছর বয়েস পর্যন্ত)

 ২। জন খাটা (১৬/১৭ থেকে ত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত)

 ৩। অপরের কৃষাণগিরি করা (২৫।৩০ থেকে চল্লিশ পর্যন্ত)

 ৪। নিজের জমিতে চাষ আবাদ করা (এ সৌভাগ্য সকলের ঘটে না)

 ৫। বাড়িতে ধানের গোলা বাঁধা (যেমন অনেকেই ব্যবসা করে কিন্তু ধনী হতে পারে না, তেমনি চাষ অনেকেই করে কিন্তু গোলা বাঁধতে পারে না। এ সৌভাগ্য ক্বচিৎ ঘটে চাষীর ভাগ্যে)

 ৬। কিন্তু এ লিখচি কেন, এ ভাগ্য সকলের হয় না—ব্যবসাদার মাত্রেই কি টাটা-বিড়লা হয়? তবুও এটার উল্লেখ করতেই হবে—প্রত্যেক চাষীর স্বপ্ন, প্রত্যেক রাখালের অলস- মধ্যাহ্নের স্বপ্ন, প্রত্যেক দিন-মজুরের বর্ষা-দিনে এক হাঁটু জল-কাদায় ধান বপন করতে করতে ক্লান্তি অপনোদনের স্বপ্ন—এটি উল্লেখ না করলে চলবে না। সেটি হোল নিজে মহাজন হয়ে নিজের গোলা থেকে অপরকে ধান কর্জ দেওয়া।

 এই উচ্চতম ষষ্ঠ স্তর প্রাপ্তি বহু পুণ্যের ফলে ঘটে।

 যাক্, কিন্তু গণেশদাদা এই বয়েসে বিষয়কর্মের প্রথম সোপানটিতে কেন, এ প্রশ্ন আমার মনে না উঠে পারলো না। পাড়াগাঁয়ে এই বয়সেও যারা গরু চরায়, বুঝতে হবে তারা ভাগ্যলক্ষ্মী দ্বারা নিতান্তই অবহেলিত, তারা নিতান্তই অভাজন। এ প্রশ্ন গণেশদাদাকে করলাম না, যদি ও মনে কষ্ট পায়। আমার কিন্তু মনে বড় কষ্ট হোল পক্ককেশ গণেশদাদাকে পাঁচন হাতে তালপাতার ছাতি মাথায় গরু চরাতে দেখে।

 গণেশদাদা বললে—বোসো, বোসো দাদাঠাকুর। তামুক খাবা?

 —ও শিখিনি।

 —এতটুকু দেখিচি তোমারে। কত বড়্ডা হয়ে গিয়েছ। হ্যাদে, দিজ্ঞ্যেস করো দিনি সেই ইন্‌জিরি? মনে আছে কিনা দেখি।

 ওঃ, অনেক দিনের কথা—উচ্চ প্রাইমারি পাঠশালার সেই দিনগুলি কতকাল আগে অতীতে মিলিয়ে গিয়েছে। আজ পনেরো বছর আগের ব্যাপার সেই গণেশদাদাকে ইংরিজি শেখানো। কি কি শিখিয়েছিলাম তাই কি ছাই আমার মনে আছে?

 গণেশদাদা কিন্তু হাসি-হাসি মুখে জিজ্ঞাসুনেত্রে চেয়ে আছে আমার দিকে। বললাম—তুমি বলতে আরম্ভ করো?

 —ওভার মানে ওপর—

 —বেশ, বেশ—তারপর!

 —তুমি জিগোও দাদা,—আমি বলি—

 —জল?

 —ওয়াটার।

 —আকাশ?

 —স্কাই।

 —দুধ?

 —মিল্ক।

 গণেশদাদার মুখে বিজয়ীর গর্বিত হাসি। তুমি তো ঠকাতে পারলে না দাদাঠাকুর এতদিন পরেও, ভাবটা এই রকম। আমি ভাবচি, এ-ইংরিজি শিখে তালপাতার ছাতি মাথায় গোচারণরত গণেশদাদার কি উপকার হবে?

 গণেশদাদা বললে—বলো বলো—

 —পিঁপড়ে?

 —পিঁপড়ে? ওডা তো শিখোওনি দাদাঠাকুর। ও তুমি শিখোওনি। ঝা শিখিইলে, তা মুই এ্যাকটাও ভুলিনি। তা ওডা মোরে শিখিয়ে দাও, পিঁপড়ের ইন্‌জিরি কি?

 —এ্যাণ্ট।

 —এ্যাণ্ট? এ্যাণ্ট-এ্যাণ্ট-এ্যাণ্ট-এ্যাণ্ট—

 জিউলি গাছটার তলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য গ্রাজুয়েট আমি আমার পক্ককেশ গোচারণরত ছাত্রকে ইংরাজি ভাষার পাঠ দিতে দিতে বড্ড দেরি করে ফেলি, বেলা যায় দেখে গণেশই বললে—তুমি এস দাদাঠাকুর। মুই গরু কডারে জল দেখিয়ে আনি পোড়ার খালে—আজ অনেক কথা শেখলনি—এ সব দেশ মুরুক্ষুর দেশ, ল্যাখাপড়ার কথা কেউ বলে না—মোর মত ইন্‌জিরি ক’জনে জানে, এই তো সব রাখাল ছোঁড়ারা গরু চরাচ্চে, কই ডেকে শুধোও না জলের ইন্‌জিরি, ধানের ইন্‌জিরি—সব মুরুক্ষু দাদাঠাকুর—সব মুরুক্ষু—

 —পোড়ার খালে মাছ পড়চে আজকাল গণেশদাদা?

 —ওই হচ্চে দুচারটো বান, ফলুই, তেচোকো—চলো না একদিন ধত্তি যাই—

 —যাবো। দু-একদিন পরে।

 —ঝে ক’ডা দিন গাঁয়ে থাকবা, মোরে শেখাবা কিন্তু—

 —নিশ্চয়ই। এবার তোমাকে চার ডজন ইংরিজি কথা না শিখিয়ে আর—

 —তোমাদের বাপ মায়ের আশিব্বাদে ঝা মুই শিখিচি, তাতেই মোর সামনে কেউ দাঁড়াতি পারে? ওই তো হিবু ঘরামির ছেলে ওস্‌মান গরু চরাচ্চে—ডেকে শুধোও না—

 গণেশদাদা দূরে গোচারণরত একটি তেরো-চোদ্দ বছরের বালকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে।


 গ্রামে এসে গণেশদাদার কথা লোককে জিজ্ঞেস করলাম। ওর অবস্থা এত খারাপ হোল কেন? কারণ শুনলাম ওর দুই ছেলেই মারা গিয়েচে। বুড়ো হয়েচে বলে লোকের বাড়িতে কৃষাণের কাজে কেউ রাখতে চায় না। জমিদারের দেনার দায়ে সামান্য একটু ভিটেসংলগ্ন জমি ছিল, তাও বিক্রি হয়ে গিয়েচে। নিজের লাঙল নেই বলে ভাগে চাষ করবার উপায় নেই—যার লাঙল নেই, তাকে বর্গা দেবে কে জমি? সুতরাং এ-বয়েসে বাধ্য হয়েই ওকে গরু চরাতে হচ্চে।

 গণেশদাদার বাড়ি গেলাম একদিন। ও বসে বসে কঞ্চি চাঁচচে—ঝুড়ি বুনবে। ঝুড়ি তৈরি করে হাটে বেচলে পয়সা হয়, কিন্তু ও ঝুড়ি বুন্‌চে পরের ব্যাগার। এ আমি জানি। এর একটা মস্ত কারণ, ওকে পরের বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে আনতে হয়—অপরে তার দামস্বরূপ নেয় একটা ঝুড়ি, না তো একটা গাছ-ঘেরা কঞ্চির ঠোঙা। গণেশদাদার ঘরে কঞ্চির ঝাঁপের বেড়া, চালে খড় নেই—একটা চালকুমড়ো লতা উঠিয়ে দিয়েচে চালে, চালকুমড়োর ফুল আর ফল যথেষ্ট হয়েছে, লতাগুলো চাল ছাড়িয়ে এদিক ওদিক ঝুলে পড়ে বাতাসে দুলচে, একটা ধাড়ি ছাগল ঘরের ছেঁচতলায় কাঁঠাল পাতা পরম তৃপ্তিতে চর্বণ করছে, ওর বৌ গৃহকর্ম করচে—বেশ লাগল আমার। ঘরে পেতল কাঁসার সংস্পর্শ নেই—মাটির কলসী, মাটির হাঁড়ি সরা, মাটির ডাবর, মাটির ভাঁড়ে জল রাখা আছে। ভাত খায় কলার পাতায় নয়তো চাম্‌টার বিলের পদ্মপাতায়। আমাকে বললে—চালকুমড়ো একটা নিয়ে যাও দাদাঠাকুর।

 —ও আমি কি করবো?

 —নিয়ে যাও, বেশ সুক্তুনি করো তোমরা। মোরা সুক্তুনি রাঁধতে জানিনে। বামুন-বাড়িতে কত সুক্তুনি খেইচি আগে আগে! পস্কার লাগে—

 —কেন, বউদিদি সুক্তুনি করতে জানে না?

 —অত তেল মসলা কনে পাবো মোরা? দাদাঠাকুরের য্যামন কথা। ও সব তরকারি কি মোরা খেতি জানি, না পারি?

 ওদের ঘরের দাওয়ায় একজন খুনখুনে বুড়ি ছেঁড়া কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছিলাম। গণেশদাদাকে জিজ্ঞেস করাতে ও বললে—আরে ও সেই রতনের মা, ওরে চেনো না? রতন ঘর ছেড়ে পালিয়েছে এক বাগদি মাগীকে নিয়ে। ওর মা যায় কনে? কেউ দেখে না। দুদিন না খেয়ে ঘরের মধ্যে পড়েছিল। তাই ওরে এনে রেখে দেলাম মোর এখানে। চকির ওপর না খেয়ে মরবে পাড়া পিরতিবাসী—চকি কি দ্যাখা যায়? তাই ওরে এনে রেখে দেলাম। যদি মোদের জোটে, তোমারও একবেলা জোটবে। তাও নড়তে পারে না, জ্বর, ছর্দি, কাশি। একটু হুম্‌নেপাতি ওছুদ এনে দিয়েলাম যগানন্দপুরের ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে। দু আনা দাম নিয়েল—তা যদি কোনো উপগার হোলো দাদাঠাকুর—তুমি জানো হুম্‌নেপাতি?

 —না আমি জানিনে। আচ্ছা আমি দেখবো এখন ওবেলা ওষুধের ব্যবস্থা।

 কি দেবো তোমারে দাদাঠাকুর তাই ভাবচি—

 —কিছু দিতে হবে না। তুমি কথা বলো আমি শুনি—

 কিন্তু কথা কইতে গণেশদাদা জানে না। তার সংকীর্ণ জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা সে সঞ্চয় করেছে আজ পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে, সে যতই সামান্য হোক, বলতে জানলে তাই নিয়েই চমৎকার কথার জাল রচনা করা যেতো যা আকাশকে বাতাসকে রাঙিয়ে দিতে পারতো, শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে পারতো—চাম্‌টার বিলের পদ্মফুলের পদ্মগন্ধি রেণু আমার নাকে উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারতো। গণেশদাদা সে সব পারে না। তবুও ওর সঙ্গ আমার এত ভালো লাগে। কথার দরকার হয় না, ওর নিরুপকরণ ও অনাড়ম্বর সাহচর্যই আমার মনে একটি মৌন লিরিকের আবেদন বহন করে আনে। সেবার চলে আসার পর পাঁচ ছ’ বছর হবে গণেশদাদার সঙ্গে আবার দেখা।

 গণেশদাদার মাথার চুল পেকে একেবারে শনের নুড়ি হয়ে গিয়েচে, পিঠের দিকটা বেঁকে একটু কুঁজো হয়ে গিয়েচে—সামান্য।

 শরৎকাল। পুজোর ছুটিতে সেবার নদীতে একটু বন্যার আভাস দেখা গিয়েচে। কাশফুল ফুটে আলো করেচে নদীর দুই পাড়। নদীর ধারের মাঠে গণেশ গরু চরাচ্চে, খুঁজতে খুঁজতে বার করলাম। ওর মাথার চুল আর ওর চারিপাশে কাশফুল একই রকম দেখতে। বৃদ্ধ গণেশদাদা সেই পাঁচ-সাত বছর আগের মত তাল পাতার ছাতি মাথায় দিয়ে লাঠি হাতে গরু চরাচ্চে। কোঁচড় থেকে বের করে কি খাচ্ছিল, আমায় দেখে লজ্জিত সুরে বললে—সৈরভির মা দুটো চাল ভাজা দেলে, বললে, গরম-গরম একখোলা নামিয়ে ফেললাম, তুমি দুটো নিয়ে যাও—তাই নিয়ে এ্যালাম। বেশ লাগে।—তা এলে কবে দাদাঠাকুর? আর দ্যাখো বড্ড বুড়ো হয়ে পড়িচি, তুমি আসচো, কিন্তু মুই বুঝতে পারলাম না। বলি, কেড়া আসে বাবুপানা? চকি তেমন আর ঠাওর হয় না—

 —চালভাজা খাচ্চ, দাঁত আছে?

 —তা আছে তোমার বাপমায়ের আশিব্বাদে। বলি ও কথা যাক, বিয়ে-থাওয়া করেছ?

 —না। বিয়ের আর বয়েস নেই।

 —কি কথা বলে। দাদাঠাকুর? তোমারে কোলে করে মানুষ করলাম, কালকের কাঁচা ছেলে, বয়েস ফুইরে গেল তোমার? ও কথা বোলোনি। মা লক্ষ্মীকে দেখে মুই চক্ষু বুঁজোবো। বিয়ে করো—কি করচো আজকাল?

 —চাকরি করচি।

 —বেশ বেশ। মোদের শুনেও সুখ। তা বোসো। এই গাছটার ছিঁয়াতে বোসো—হ্যাদে, তোমরা টুপি পরো? বেনার ডাঁটার খাসা টুপি বুনি দিতি পারি। পস্কার সায়েবের টুপি। নেবা?

 —না, আমি সায়েবের টুপি পরিনে।

 —বোসো। জিরোও, বড্ড রদ্দুর।

 কি সুন্দর নীল আকাশ কাশফুলে ভরা বিস্তীর্ণ মাঠের ওপরে হুমড়ি খেয়ে আছে। সাধারণ ধরনের নীল নয়, সে এক অদ্ভুত ময়ূরকণ্ঠি রংয়ের নীল। ওপার থেকে হু হু হাওয়া বইচে, গণেশদাদার মাথার সাদা চুল বাতাসে কাশফুলের মত উড়চে। আমার কাছে ছবিটি বেশ লাগে।

 গণেশদাদা এইবার চালভাজা খাওয়া শেষ করে নদীর পাড় বেয়ে জলে নেমে দুহাতে আজ্‌লা করে জল খেয়ে নিয়ে সরস তৃপ্তির সঙ্গে ‘আ’ বলে একটি দীর্ঘস্বর উচ্চারণ করলে। আমার কাছে এসে বললে—তামুক খাবা?

 —খাইনে।

 —দাঁড়াও সাজি। মোর দা-কাটা খরসান তামাক বড্ড তলব। কিছু নেই, শুধু তামাক আর গুড়। বাজারের তামুকে চুন মেশায়। বলি হ্যাদে দাদাঠাকুর, একটু শুধোও দিকি?

 —কি?

 —সেই ইন্‌জিরি। মুই মুখস্ত বলবো? ওভার মানে ওপর, ওয়াটার মানে জল, বাড্ মানে পাখী, বালির ইন্‌জিরি স্যাণ্ড, মাছের ইন্‌জিরি ফ্লাই—

 —উঁহু—

 —কি, মাছের ইন্‌জিরি ফ্লাই নয়?

 —না। তবে কি এ্যাণ্ট?

 —না, এ্যাণ্ট মানে পিঁপড়ে। মাছের ইংরিজি ফিশ্, মাছির ইংরিজি ফ্লাই।

 —হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। বলি হ্যাদে বয়েস হয়েচে আজকাল অনেক, সব কথা ঝক্করে মনে পড়ে না, বেস্মরণ হয়ে যাই। আর তুমি না এলি তো চর্চা হয় না, সব মুরুক্ষু—কার সঙ্গে ইন্‌জিরি বলবো বলো দিকি?

 আর এক ডজন ইংরিজি শব্দ বসে বসে আমার জ্ঞানপিপাসু শুভ্রকেশ ছাত্রকে শিক্ষা দিলাম, সেই কাশফুল-ফোটা চরে বসে। শরতের অপরাহুে। আগের শেখা শব্দগুলোও একবার সে ঝালিয়ে নিলে মহা উৎসাহে। তারপর সেই বিদ্যার বোঝা বহন করে সেই বছরের মাঘ মাসে নিমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে গণেশদাদা পরলোক যাত্রা করলে। পর বৎসর পুনরায় দেশে ফিরে গিয়ে আর ওকে দেখতে পাইনি।

 কি বৈষয়িক উন্নতির দিক থেকে, কি ইংরিজি শিক্ষার দিক থেকে গণেশদাদা সাবাজীবন প্রথম সোপানেব দিকেই রয়ে গেল বটে, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওর মধ্যে এমন কিছু ছিল, যার সাহায্যে ও সব সোপান অতিক্রম করে, আমাদের অনেককে অতিক্রম করে, অনেক উচুতে গিয়ে পৌঁচেছিল। তাই আজকার দিনে বার বার তার কথা মনে পড়ে।