বিষয়বস্তুতে চলুন

নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব/প্রভাতী

উইকিসংকলন থেকে

প্রভাতী

 সেদিন কি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হোল নদীর তীরের কাননভূমিতে।

 জানি, এসব কথা লেখা এত কঠিন! একটা ছত্র যদি লিখতে ভুল হয়, মনের ক্রমের সঙ্গে না মেলে, তবে সবটাই ভুল হয়ে যাবে, অস্পষ্ট হবে, অবাস্তব ঠেকবে।

 তবু আমায় চেষ্টা করতে হবে। সে অভিজ্ঞতার আনন্দ পরকে দিতে হবে। নিজে ভোগ করে চুপ করে বসে থাকা আমার ভালো লাগে না।


 বর্ষার দিনের মেঘমেদুর আকাশ। ঠাণ্ডা দুপুরটি, অথচ বৃষ্টি হয়নি আজ তিন চারদিন। রাস্তা ঘাট শুক্‌নো খট্‌ খট্ করচে। ঘন মেঘ জমে রয়েচে আকাশে, কালো মেঘে অন্ধকার জল-স্থল, বৃষ্টি এল এল, অথচ বৃষ্টি আসচে না। স্নান করতে গেলাম নদীতে, ঘরের বাইরে পা দিয়েই কি যে আনন্দ হোল মনে!

 সবুজ তাজা প্রাণের প্রাচুর্যে ধরিত্রীর অঙ্ক ভরপুর। শ্যামল আভা, সবুজ মটরলতা, মটরলতায় মটরফল, মাকাল-লতার অগ্রভাগে মাকাল ফল, বুনো যজ্ঞিডুমুর গাছের আর্দ্র গুঁড়িতে থোলো থোলো কচি ডুমুর, ঝোপে ঝোপে নাকজোয়ালের সুদৃশ্য তিন রঙা ফুল (gladiosa superba) দুলচে সজল বাতাসে। সঙ্গে সঙ্গে দুলচে বাঁশের কোঁড়, নদীর গৈরিক জল, ওপারের কাল নলখাগড়ার গুচ্ছ। আমি নদীজলে অবগাহন করলাম বাঁশতলার ঘাটে। স্নান করে উঠলাম সিক্ত বস্ত্রে। উঁচু পাড়, চখা বালির ঘাট, পায়ে এতটুকু কাদা লাগে না কোথাও, আবক্ষ অবগাহন করো, যতদূর যাও ততদূর চখা বালি। নম্র, নতশীর্ষ বেণুবন ঘাটের জলে ছায়া করে থাকে খর রোদের সময়, খড়খড় শব্দ করচে তালগাছে দোদুল্যমান বাবুই পাখীর বাসা। উঁচু পাড় বেয়ে উঠতে ডানধারে এক বিরাট ঝোপ, তার মাথায় মাথায় মটরলতার ঝোপ, আঙুরলতার ঝোপ। কাবুলী আঙুর নয় অবিশ্যি, আমাদের বনে এক রকম অতি সুদৃশ্য লতা বর্ষায় গাছের মাথা বেয়ে গজিয়ে উঠে নিবিড় ঝোপের সৃষ্টি করে, আঙুরের মত খাঁজকাটা পাতা, আঙুরের মত থোকো থোকো ফল ধরে লতার গাঁটে গাঁটে। মটর লতাও যাকে বলচি, মটরের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই—ওকে বলে বড় গোয়ালে লতা, মটরের মত ছোট ছোট চমৎকার ফল গুচ্ছ গুচ্ছ দুলচে লতাগ্রভাগে, সবুজ কচি পত্রসম্ভার বুনো যজ্ঞিডুমুর গাছের তলায় নিবিড়তার সৃষ্টি করেচে।

 আমি ভালবাসি এ ধরনের সম্পূর্ণ বন্য গাছঝোপ দেখতে, নইলে বিহারে চাকুলিয়া মিলিটারী ক্যাম্পের লোহার বেড়ায় দেখেচি পটপটি-লতার ফুল—সে আমার ভাল লাগেনি, কেননা তার পাশেই রয়েচে ট্যাঙ্ক, মোটর, ট্র্যাক্টর প্রভৃতি জিনিস—যার পাশেই অদূরে রয়েছে বম্বার প্লেনের সারি। এখানে সে সবের বালাই নেই। নিভৃত লতাবিতান ও কাননভূমি ও পল্লীনদীর শান্ত তীর, মানুষের উগ্রলোভ ও অর্থোপার্জনের জন্য নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এর জন্যে পটভূমিকা রচনা করেনি।

 তারপর যে কথা বলছিলাম।

 স্নান করে ঝোপটির কাছে এসে দাঁড়ালাম।

 বেশ চমৎকার লাগছিল।

 হঠাৎ নিজের মন সংযত করে নানাদিক থেকে মনকে কুড়িয়ে এনে চুপ করে দাঁড়ালাম। ঠিক যেন দেবদর্শনে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা জগৎ যেন দেখতে পেলাম ঝোপের মধ্যে উঁকি দিয়ে। এতক্ষণ কোথায় কি পাখি ডাকছিল সেদিকে মন দিইনি। এই সময় ঝোপের গভীর অন্তঃপ্রদেশ থেকে একটা পাখী শুনলাম থেকে থেকে ডাকচে—অনেকক্ষণ থেকেই ডাকচে, বহুদূর থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসচে মেঘশীতল আকাশের তলা বেয়ে। মন সমস্তটা কুড়িয়ে এনে যেমন এই ঝোপের দিকে দিয়ে একমনে দাঁড়ালাম, অমনি এই সব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলাম। অমনি ঝোপের মধ্যে উঁকি মেরে সেই অদ্ভুত, অপূর্ব জগৎটাকে দেখতে পেলাম।

 যে জগৎ কি আমি বর্ণনা করতে পারি?

 এত সূক্ষ্ম, এত অদ্ভুত ধরনের জগৎ এ!

 যে জগতে শুধু বনকলসীর গায়ে বেগুনি ফুল ফোটে, টুকটুকে মাকাল-ফল দোলে, মটর ফলের লতায় টুনটুনি পাখী বসে গান করে, বর্ষার সজল প্রভাতে যজ্ঞিডুমুরের পাকা ফল টুপ টুপ করে মাটিতে পড়ে, বনকুসুমের গন্ধ ভেসে আসে—বহুদূরের জগৎ অথচ খুব নিকটের—কিন্তু সে নিভৃত, নিরালা জগৎ অতি নিকটে থাকলেও চেনা যায় না, দেখা যায় না, দৃষ্টির অতীত, স্পর্শের অতীত কোন অনুভূতির রাজ্যে তার অবস্থান ধরা দেয় না কিছুতেই। কি অবর্ণনীয়, গাঢ় শান্তি ও অপরূপ সৌন্দর্য বহন করে আনে দূর-থেকে দেখা তার মনোমোহিনী রূপ। তার বর্ণনা ভাষায় দেওয়া যায় না, কতকগুলি প্রতীক দিয়ে তাকে একটুকু বোঝানো যায় কি না যায়! অন্তর্মুখী মন সে জগৎকে একটু স্পর্শ করে যায় মাত্র—সে জগৎকে দেখতে পেলে মনের উদ্বোধনের নব দ্বারপথে উঁকি দিতে হয়, তবে যদি ধরা পড়ে! আরও কত কি রহস্যময় কথা শোনায় এ জগতের পত্রমর্মরে। মন কোথায় নিয়ে যায় সীমাহারা সৌন্দর্যের রাজ্যে, দৈনন্দিন ক্ষুদ্রত্ব ও বন্ধন থেকে মুক্তির সন্ধান যোগায়—যে-মুক্তি নিরাসক্তির অমরত্বে ঐশ্বর্যশালী, প্রতিদিনের পরিচিত জগতের বহু দূরে যে লোকাতীত লোকের বাণী মাঝে মাঝে দু’একজন মানুষের কানে এসে পৌঁছায়।

 কতক্ষণ অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম।

 তখনও সেই নিভৃত, গুপ্ত জগৎ আমার চোখের সামনে ঝলমল করচে মৌন আমন্ত্রণের মুখরতায়। কিন্তু স্কুলের বেলা হয়ে গেল, দাঁড়ানোর উপায় নেই আমার। মনটাকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হলাম সে জগতের দূরাগত বংশীধ্বনির মূর্ছনা থেকে।

 সেদিনই আবার বাঁশতলার ঘাটে অবগাহন করতে নামলুম সন্ধ্যার আগে। বর্ষার অপরূপ মেঘমেদুর অপরাহ্ণ, পাখী তেমনই ডাকচে, বনকলসীর ফুল তেমনি ফুটে আছে, মটর-লতা তেমনি দুলচে—কিন্তু লতাবিতানের নিরালা ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ও-বেলার দেখা সে রহস্যময় জগৎ অন্তর্হিত হয়েছে। কিছুতেই তাকে আর খুঁজে পেলাম না।