নীল তারা ইত্যাদি গল্প/মাঙ্গলিক

উইকিসংকলন থেকে

মাঙ্গলিক

ভাপতি বললেন, ওঃ আমাদের কি অচিন্তনীয় সৌভাগ্য! যে মহাপুরুষ আজ এই মহতী সভায় পদার্পণ করেছেন তাঁর সমুচিত সংবর্ধনা করি এমন সামর্থ্য আমাদের নেই। এঁর মুখের ভাষা আমাদের অবোধ্য। আমাদের বাগ যন্ত্র এঁর নাম উচ্চারণ করতে পারে না, আমাদের লেখনীও তা ব্যক্ত করতে পারে না। তবে এই মহান অতিথির কি পরিচয় দেব? শুধু বলতে পারি, ইনি মাঙ্গলিক। এদেশে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে অমানুষী প্রতিভার বলে ইতি আমাদের বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং তাতেই নিজের বাণী দেবেন। এঁর সময় অতি অল্প, আধ ঘণ্টা পরেই স্বলোকে প্রত্যাবর্তন করবেন। আপনারা প্রশ্ন করে বাধা দেবেন না, এঁর শ্রীমুখ থেকে যে সুসমাচার নিঃসৃত হবে তাই ভক্তিভরে শ্রবণ মনন ও হৃদয়ে ধারণ করুন।

 সামনের মাইক্রোফোনটা ঠেলে ফেলে দিয়ে সর্বজনীন পুজোর লাউড স্পীকারের মতন কান ফাটা নিনাদে মাঙ্গলিক বলতে লাগলেন।—

 ওহে সভাপতি আর উপস্থিত মানুষেরা—গোড়াতেই জানিয়ে রাখছি, বাজে কথা আমি বলি না। তোমাদের এই সভাপতি মাননীয় কিনা, মহাশয় কিনা, তার প্রমাণ নেই, সেজন্য ও সব না বলে শুধু সভাপতি বলেছি। যারা আমার বাণী শুনতে এখানে এসেছে তাদের ভদ্র মহোদয় ও ভদ্র মহিলাগণ বলতেও আমি রাজী নই। তোমাদের মধ্যে কত জন ভদ্র আর কত জন অভদ্র আছে তা আমি জানব কি করে? কোনও প্রাণিজাতির উল্লেখ করতে হলে কেউ ভেড়া-ভেড়ী বা ছাগল-ছাগলী বলে না, শুধু ভেড়া বা ছাগল বললে তৎ তৎ প্রাণীর স্ত্রীপুরুষ দুইই বোঝায়। অতএব ভদ্র মহোদয় ও ভদ্র মহিলা না বলে আমি তোমাদের যে শুধু মানুষ বলে সম্বোধন করেছি তাই যথেষ্ট। যাক, এখন আমার বক্তব্য শোন। তোমাদের অসংখ্য জিজ্ঞাস্য আছে, নানা বিষয় জানবার জন্যে ছটফট করছ, তা আমি বুঝি। কিন্তু আমার সময় অতি অল্প আর তোমাদের বোধশক্তিও অতি ক্ষীণ, সেজন্যে অতি সংক্ষেপে ভাষণ দিচ্ছি।

 তোমাদের কৌতূহল কিয়ৎ পরিমাণে নিবৃত্তির জন্যে জানাচ্ছি—আমরা বিশ জন মঙ্গল গ্রহ থেকে এই ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবতরণ করেছি। পরে অন্যান্য দেশেও আমরা যাব। আমাদের উদ্দেশ্য—মানবজাতির কিঞ্চিৎ মঙ্গল সাধন। কি করে এসেছি জানতে চাও? উড়ন চাকতিতে চড়ে আসি নি, থালা বা রেকাবিতে চড়েও আসিনি। অতি সোজা উপায়ে ঝুপ করে নেমেছি, উল্কাপাত যেমন করে হয়। পতনের দারুণ বেগ কি করে সয়েছি, তোমাদের স্থূল বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যাই নি কেন—এ সব জানতে চেয়ো না, জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তোমরা বুঝতে পারবে না। আমাকে যেমন দেখছ আমার আসল মূর্তি তেমন নয়, উপস্থিত প্রয়োজনে এই পৃথিবীর উপযুক্ত দেহ ও বেশ ধারণ করেছি। আর একটা কথা তোমাদের হৃদয়ংগম করা দরকার। তোমাদের অর্থাৎ মানবজাতির এখন শৈশবদশা চলছে, কিন্তু মঙ্গলগ্রহবাসী আমরা অত্যন্ত প্রবীণ ও পরিপক্ক। আমাদের তুলনায় তোমরা নিরতিশয় অপোগণ্ড, বিদ্যাবুধিতে দশ কোটি বৎসর পিছিয়ে আছ। অতএব আমি যে সদুপদেশ দিচ্ছি তা নিয়ে তর্ক করো না, নির্বিচারে মেনে নাও, তাতেই তোমাদের মঙ্গল হবে।

 আগে তোমাদের বহিরঙ্গ অর্থাৎ দেহ বেশ চাল-চলন ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছু বলছি, তার পর অন্তরঙ্গ অর্থাৎ পলিটিক্‌সের আলোচনা করব। মানুষ জাতির দেহের গড়ন মন্দ নয়, তবে কদাচারের ফলে তোমরা তা কুৎসিত করে ফেলেছ। কেউ দেদার লুচি মণ্ডা মাছ মাংস ঘি দুধ খেয়ে মোটা থপথপে হয়েছ, কেউ হরদম চা সিগারেট পান দোক্তা প্রভৃতি বিষ খেয়ে চেহারাটি পাকাটে করে ফেলেছ। বোকামি আর অত্যাচারের ফলে কেউ কেউ ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছ। তোমাদের পরিচ্ছন্নতার অত্যন্ত অভাব দেখছি। জীবাণুতত্ত্ব তোমরা একটু আধটু জান, তবু গতানুগতিক ফ্যাশনের বশে নিজের শরীর আর গৃহকে ব্যাকটিরিয়ার ভাণ্ডার বানিয়েছ। এখানে অনেকের গোঁফ দেখছি, কয়েক জনের দাড়িও দেখছি। দশ-বারো জন টেকো মানুষ ছাড়া আর সকলের মাথার চুলও দেখছি। আর মেয়েদের মাথায় তো চুলের জঙ্গল। ছি ছি ছি। এও কি জান না যে গোঁফ দাড়ি আর চুল হচ্ছে জীবাণুর আড়ত? তোমাদের স্বাস্থ্যবিশারদগণ অতি অকর্মণ্য, তাই এই কদর্য প্রথা তুলে দেবার কোনও চেষ্টা করেন নি। কামিয়ে ফেল, স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই নেড়া হও আর গোঁফ দাড়ি উৎপাটন করে ফেল। আমার শিরস্ত্রাণ দেখছ তো, পাতলা টাইটেনিয়ম ধাতুর তৈরী। এতে চুলের কাজ হয় অথচ ময়লা জমে না। এরকম জিনিস যদি এদেশে দুর্লভ হয় তবে অ্যালুমিনিয়মের টুপি পর। মেয়েরা যদি তাদের সেকেলে ফ্যাশন বজায় রাখতে চায় তবে টুপির পিছলে খোঁপার মতন একটা ঘটি জুড়ে দিতে পারে। ইচ্ছা হলে তাতে বেল ফুলের মালা জড়ানো চলবে। কিন্তু স্ত্রী আর পুরুষের আলাদা সাজের দরকারই হবে না, সে কথা পরে বলছি। তোমাদের বাড়িতে যেসব কম্বল রগ কার্পেট শতরঞ্জি আর পরদা আছে, নির্মম হয়ে পুড়িয়ে ফেল। যাতে ধূলো আর ব্যাকটিরিয়া জমতে পারে এমন জিনিস রেখো না।

 তোমরা অনেকে গলদ্‌ঘর্ম হচ্ছ তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই গুমট গরমে কোন আক্কেলে জামা কাপড় পরে আছ? শিশু আর পরে মতন সরল হও, সব টান মেরে খুলে ফেলে দাও, সর্বাঙ্গে হাওয়া লাগুক। এই গরম দেশে বৎসরে ন মাস ধুতি পঞ্জাবি প্যাণ্ট শার্ট শাড়ি ব্লাউজ একবারেই অনাবশ্যক, স্বচ্ছন্দে দিগম্বর হয়ে থাকতে পার। শুধু মাথায় একটা পাতলা ধাতুর টুপি আর পারে এক জোড়া জুতো, এ ছাড়া কিছুই পরবে না। তবে হাঁ, কাঁধ থেকে ফিতে দিয়ে একটা ঝুলি ঝোলাতে পার, তাতে টাকাকড়ি নোটবুক পেনসিল কলম রুমাল ইত্যাদি থাকবে। আরশি পাউডার, মুখে আর গায়ে লাগাবার রংও তাতে রাখতে পার। অবশ্য শীতের সময় সবাই উপযুক্ত জামা কাপড় পরবে, রবার বা প্লাসটিকের। ইওরোপ আমেরিকার মেয়েদের তবু একটু বুদ্ধি আছে, তারা ক্রমশ দিগম্বরী হচ্ছে। কিন্তু ওখানকার পুরষরা বড় বোকা আর লাজুক, অনর্থক কাপড়ের বোঝা বয়ে বেড়ায়। তোমরা ভাবছ আমি নিজের শরীর আগাগোড়া ঢেকে রেখেছি কেন। ভুল বুঝেছ, আমার অঙ্গে যা দেখছ তা বস্তু নয়, এই পৃথিবীর ভীষণ অভিকর্ষের চাপে পাছে আমার হালকা শরীরটি চেপটে যায় এবং এখানকার অত্যধিক অক্সিজেন পাছে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাই বর্ম ধারণ করেছি। এই বর্মের অভ্যন্তরে আমি সদ্যোজাত শিশুর মতন নেংটা।

 তোমাদের এই পৃথিবীতে পুরুষের তুলনায় নারীর অবস্থা বড় মন্দ দেখছি। ভোট আর জীবিকার ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার পেলেও স্ত্রীজাতির সুবিধা হবে না। গহনা আর শৌখিন বস্ত্রে ওদের ভুলিয়ে রাখলেও ন্যায়বিচার হবে না। ওদের দুর্দশার কারণ প্রাকৃতিক। মানব জাতির স্ত্রীরা গর্ভধারণ করে কিন্তু পুরুষরা করে না। প্রকৃতির এই পক্ষপাতের ফলে স্ত্রীজাতি পূর্ণভাবে আত্মনির্ভর হতে পারে না, পুরুষ কিংবা রাষ্ট্রের অনুগ্রহ না পেলে তাদের চলে না। কুমারী থাকলে অথবা গর্ভরোধ করলে অবস্থার উন্নতি হবে না। প্রাণী মাত্রেই সন্তান চায়, এই স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা দমন করা অন্যায়। একমাত্র উপায়— স্ত্রী আর পুরুষের ভেদ লোপ করা, অর্থাৎ স্ত্রী যেমন মাঝে মাঝে গর্ভবতী হয় পুরুষও তেমনি মাঝে মাঝে গর্ভবান হবে। স্ত্রী আর পুরুষ দুরকম মানুষ থাকাই অন্যায়। যেমন শামুক প্রভৃতি কয়েক প্রকার প্রাণী তেমনি আমরা মাঙ্গলিকরা উভয়লিঙ্গ হার্মাফ্রোডাইট, প্রত্যেকেই অর্ধনারী অর্ধপুরুষ। আমাদের স্বামীস্ত্রী ভেদ নেই। কিন্তু সম্পত্তি আছে, সন্তানের প্রয়োজন হলে দম্পতির দুজনেই পালা করে গর্ভধারণ করে। মানুষেরও সেই ব্যবস্থা দরকার। তোমাদের কেন্দ্রীয় সংসদে পুংস্ত্রীসমীকরণের জন্যে একটা আইন পাস করিয়ে নাও, তার পর যা করবার আমরা করব। মাঙ্গলিক শরীরবিজ্ঞানীরা অনায়াসে তোমাদের দেহের অদলবদল করে দিতে পারবেন, এবং এক বার করে দিলে বংশানুক্রমে তা বজায় থাকবে।

 এখন পলিটিক্‌স সম্বন্ধে দু-চারটে কথা বলছি। এই পৃথিবীতে রাষ্ট্রচালনার দু রকম রীতি আছে দেখছি। একটি হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র, অর্থাৎ এক জন বা এক দল ধূর্ত লোক সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করে রাখে, তাদের শাসন আর সবাই ভেড়ার পালের মতন মেনে নেয়। অন্য রীতি হচ্ছে লোকতন্ত্র, অর্থাৎ জনসাধারণ যাদের নির্বাচন করে তারাই রাষ্ট্র চালায়। কিন্তু নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে বিস্তর অকর্মণ্য আর দুশ্চরিত্র লোক থাকে। দেশের অধিকাংশ লোক যদি সাধু বুদ্ধিমান হত তবে লোকতন্ত্রে মোটামুটি কাজ চলত। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি এখনও অত্যন্ত কাঁচা আর চরিত্রেও বিস্তর গলদ আছে। এমন অবস্থায় স্বৈরতন্ত্র আর লোকতন্ত্র দুটোই তোমাদের পক্ষে অনিষ্টকর। তোমরা মনে কর, স্বাধীনতা পেয়েছ। ছাই পেয়েছ। স্বাধীনতা লাভের উপায় বলছি শোন।

 তোমাদের মধ্যে ক জন এয়ারোপ্লেন জাহাজ রেলগাড়ি বা গরুর গাড়ি চালাতে পার? রাষ্ট্রচালনা কি তার চাইতে সহজ মনে কর? সবাই মিলে দেশ শাসন করবে এ দুর্বুদ্ধি ত্যাগ কর। আনাড়ী লোকের তা সাধ্য নয়। হয়তো লক্ষ বৎসর পরে মানুষ জাতি লায়েক হবে, কিন্তু তত দিন তোমাদের হিতকামী গুরু বা অভিভাবক দরকার। আমরা মাঙ্গলিকরা সেই গুরু দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি। তোমাদের নানা রাজনীতিক দল আছে, ও সবে যোগ দিও না। নতুন দল তৈরি কর—ইণ্ডো-মার্স বা ভারত-মঙ্গল পার্টি। আগামী ইলেকশনে তোমরা প্রতিনিধি খাড়া করবে, আমরা সর্বতোভাবে তোমাদের সাহায্য করব। সমস্ত আসনই তোমরা দখল করতে পারবে তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। তার পর প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সভায় একমাত্র দল হয়ে ঢুকে পড়, আমাদের হাতে শাসনের ভার ছেড়ে দাও। তোমরা নিশ্চিত হয়ে ঘুমুবে, খাবে দাবে স্ফূর্তি করবে, কবিতা আর গল্প লিখবে, গান শুনবে, হরেক রকম নাচ দেখবে, আর রাষ্ট্রচালনার সমস্ত ঝক্কি আমরা নেব। শুধু ভারতে নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই এই ব্যবস্থা চালাতে হবে। মানুষ আর মাঙ্গলিকের এই নিবিড় সম্পর্ক ঘটলেই তোমরা বুঝতে পারবে—আমাদের যা মতামত তোমাদেরও তাই, আমরা যা ভাল মনে করি তাই তোমাদের পক্ষে ভাল। আসল স্বাধীনতা আর ডিমোক্রাসি একেই বলে। অ্যাটম আর হাইড্রোজেন বোমার ভয় খাচ্ছ? ও সব ছেলে-ভুলনো জুজু আমরা গ্রাহ্য করি না, সমস্ত ফুঁয়ে উড়িয়ে দেব, বদমাশ গুণ্ডাদের ঝাড়ে বংশে সাবাড় করব।

 আজ এই পর্যন্ত। আর একদিন এসে সব কথা তোমাদের ভাল করে বুঝিয়ে দেব। সভাভঙ্গের আগে সবাই সমস্বরে আওয়াজ তোল—স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, লোকতন্ত্র জাহান্নমে যাক, ইয়ে আজাদী ঝুটা হৈ, হমারা দাদা মাঙ্গলিক, ভারত-মঙ্গল জিন্দাবাদ!

১৩৬২