নেতাজীর জীবনী ও বাণী/উত্তর-কলিকাতা অধিবাসীগণের নিকট আবেদন

উইকিসংকলন থেকে

উত্তর কলিকাতা আধিবাসীগণের নিকট নিবেদন

[ মান্দালয় জেল হইতে ১৯২৭ সালের নির্বাচনের পূর্বে লিখিত ]

 আমার অপরাধ সম্বন্ধে আমি বলিতে পারি যে, অপরাধ যদি কিছু করিয়া থাকি তাহা এই যে, পরাধীন জাতির সনাতন গতানুগতিক জীবনপন্থা ছাড়িয়া কংগ্রেসের একজন দীন সেবক হিসাবে স্বদেশ-সেবায় মন-প্রাণ-শরীর সমর্পণ করিবার প্রয়াস পাইয়াছি। তারপর আমি যে শুধু কারারুদ্ধ হইয়াছি তাহা নয়। বিশ মাস হইল আমি দেশান্তরিত। বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার জলের পবিত্র স্পর্শ হইতে কতকাল যাবৎ আমি বঞ্চিত! তবে আমার সান্ত্বনা ও সৌভাগ্য এই যে আমার কারাবাস ব্যর্থ হয় নাই। আজ “আমার সকল ব্যথা রঙ্গিন হয়ে গোলাপ হয়ে” ফুটিয়াছে। এইখানে আসিবার পূর্ব্বে আমি বাংলাকে ভারতভূমিকে ভালবাসিতাম। কিন্তু এই বিচ্ছেদের দরুণ সোনার বাংলাকে পুণ্য ভারতভূমিকে শতগুণে ভালবাসিতে শিখিয়াছি। বাঙ্গলার আকাশ, বাংলার বাতাস—“স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।” বাঙ্গলার মোহিনী রূপ আজ আমার নিকট কত পবিত্র কত সুন্দর হইয়াছে। যে আত্যন্তিক আত্মোৎসর্গের আদর্শ লইয়া আমি কর্ম্মভূমিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম। নির্ব্বাসনের পরশমণি আমায় দিন দিন সে মহাদানের যোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। যে চিরন্তন সত্য বাংলার ভাগীরথী ও বাংলার ঢেউখেলানো শ্যামল শস্যক্ষেত্রে মূর্ত্ত হইয়া উঠিয়াছে, বাঙ্গলার যে প্রাণধর্ম্মকে বঙ্কিম হইতে আরম্ভ করিয়া দেশবন্ধু পর্য্যন্ত প্রতিভাবান্ মনীষিগণ সাধনার দ্বারা উপলব্ধি করিয়া সাহিত্যের মধ্যে প্রকট করিয়াছিলেন, বাঙ্গলার যে বিচিত্র রূপ কত শিল্পী, কবি সাহিত্যিকের লেখনী ও তুলিকার বিষয় হইয়াছে, আজ তাহার আভাস পাইয়া ধন্য হইয়াছি। এই অনুভূতির পুণ্য প্রভাবে আমার দুই বৎসর কারাবাস সার্থক হইয়াছে। আমি বুঝিতে পারিয়াছি যে এ হেন মায়ের জন্য দুঃখ ও বিপদ বরণ করা কত গৌরবের কত সৌভাগ্যের কথা।

 নিজের জীবন পূর্ণরূপে বিকশিত করিয়া ভারতমাতার পদাম্বুজে অঞ্জলি স্বরূপ নিবেদন করিব এবং এই আন্তরিক উৎসর্গের ভিতর দিয়া পূর্ণতর জীবন লাভ করিব—এই আদর্শের দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হইয়াছিলাম। স্বদেশ সেবা বা রাজনীতির পয্যালোচনা আমি সাময়িক বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করি নাই। এজন্য পরাধীন দেশে স্বদেশ সেবকের জীবনে যে বিপদ ও পরীক্ষা, দুঃখ ও বেদনা অবশ্যম্ভাবী, তার জন্য কায়মনে প্রস্তুত হইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমার এই ক্ষুদ্র অথচ ঘটনাবহুল জীবনে যে সব ঝড় আমার উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে বিঘ্ন বিপদের নেই কষ্টিপাথর দ্বারা আমি নিজেকে সূক্ষ্মভাবে চিনিবার ও বুঝিবার সুযোগ পাইয়াছি। অজানা ভবিষ্যৎকে সম্মুখে রাখিয়া যে ব্রত একদিন গ্রহণ করিয়াছিলাম তাহা উদ‍্যাপন না করিয়া বিরত হইব না। আমার সমস্ত প্রাণ ও সারা জীবনের শিক্ষা নিঙাড়িয়া আমি এই সত্য পাইয়াছি—পরাধীন জাতের সব ব্যর্থ,—শিক্ষা দীক্ষা কর্ম্ম—সব ব্যর্থ—যদি তাহা স্বাধীনতালাভের সহায় ও অনুকূল না হয়। তাই আজ আমার হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশ হইতে এই বাণী নিরন্তর আমার কাণে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে, “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়রে কে বাঁচিতে চায়?”

 আত্মোৎসর্গের পবিত্র ও জীবন্ত বিগ্রহ প্রাতঃস্মরণীয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের চরণে দেশ সেবায় আমার প্রথম শিক্ষা দীক্ষা। তাঁহার জীবদ্দশায় সকল বিপদ তুচ্ছ করিয়া তাঁহার পতাকা অনুসরণ করিছি। তাহার অবর্ত্তমানে তাঁহার লোকোত্তর চরিত্রের শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করিয়া ও তাঁহার মহিমাময় জীবনের আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া একনিষ্ঠভাবে জীবনের পথে চলিব, এই সঙ্কল্প মনের মধ্যে পোষণ করি। সর্ব্ব মঙ্গলময় ভগবান আমার সহায় হউন।