নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/পরিশিষ্ট (খ)

উইকিসংকলন থেকে

পরিশিষ্ট

(খ)

 সম্প্রতি ‘জয়-হিন্দ’ নামে একখানি রোজনামচা প্রকাশিত হয়েছে। এটি কার লেখা আমাদের জানা নেই তবে লেখিকা শ্রীমতি ‘ম’ নামে নিজের পরিচয় দিয়েছেন এবং এই রোজনামচাখানি ‘জনৈক বিদ্রোহিনী ভারত কন্যার রোজনামচা’ বলে প্রসিদ্ধিলাভ করেছে। তার থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল:—

জুলাই ২, ১৯৪৩

 সুভাষবাবু আজ এলেন। স্ত্রী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সকলেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটলো। ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সে এক শ্বাসরোধী দৃশ্য—মানুষের সমুদ্র— ভারতীয় মালয়বাসী চীনা ও জাপানী— সকলেই এই বিরাট বিপ্লবীকে একবার দর্শন করবার জন্যে হুড়োহুড়ি করতে করতে পিষে গেল।

 উন্নত, দৃঢ় ভঙ্গী, গৌরবে সমুন্নত ও অনমনীয় শির এবং তাঁর প্রাণভোলানো হাসি নিয়ে সুভাষ বাবু সকলের অন্তর জয় করে নিলেন। আমাদের বিশ্বাস হল যে সেই নেতা এলেন যাঁর ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি এবং যিনি আমাদের গন্তব্যস্থলে নিয়ে যাবেন। ছবিতে তাঁর সুন্দর দেহগঠন ও পুরুষোচিত দীর্ঘাকৃতির সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না। আমাদের চান্সারীগলির কার্যালয়ে স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সময়ে আমি তাঁকে ভাল করে দেখলাম। তাঁর হাসির এমন এক যাদু আছে যার বিরুদ্ধে কোন রকম বিরোধিতা টিঁকতে পারে না।···

জুলাই ৯, ১৯৪৩

 আজ এক বিরাট জনসমাগম। লক্ষ লক্ষ লোক নেতাজীর বক্তৃতা শুনতে জড় হয়েছে—প্রকৃতই শুধু মাথার সমুদ্র। দুরন্ত উত্তেজনা! সত্যিই নেতাজী যেভাবে জনসাধারণের সঙ্গে ব্যবহার করেন তার মধ্যে এক অপূর্ব স্নেহের স্বাদ আছে। বিশেষ করে স্ত্রীলোকও শিশুদের প্রতি তিনি বিশেষ যত্নশীল। এমন কি তাঁকে দেখবার জন্যে কিংবা স্পর্শ করবার জন্যে যখন জনতা হুড়োহুডি করতে লেগে যায় তখনও তিনি একটুও রূঢ় ব্যবহার করেন না। গতকাল তিনি আমাদের কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। একটি বৃদ্ধা মহিলা দরজার কাছে তাঁর পদস্পর্শ করতে চেষ্টা করেন। তিনি তাঁকে হাতে ধরে তুলে মাথা পেতে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। বল্লেন—‘মা’! পরবর্তীকালে তিনি যখন কোলকাতায় ফেলে আসা স্নেহশীলা মায়ের কথা বর্ণনা করেছিলেন তখন আমাদের চোখে জল এসে গিয়েছিল।

 মাইকের সামনে যখন তিনি বক্তৃতা করেন তখন নেতাজী ঋজু দৃঢ় ভঙ্গীতে দাঁড়ান। তাঁর কোনরকম অস্বাভাবিক বক্তাসুলভ বাচলতা নেই। খুব কমই অঙ্গভঙ্গী করেন। গম্ভীর, ধীর অথচ দৃঢ় ভাষায় তিনি শুধু যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে চলেন। শ্রোতাদের মধ্যে প্রত্যেক স্ত্রী ও পুরুষ মনে করে যেন বিশেষ করে তাকেই কথাগুলো বলছেন। কোনওরকম নাটুকে ভঙ্গী তাঁর মধ্যে নেই। এক চুমুকও জল খেতে হয়না কাউকে হাওয়া করতে হয় না···কোন লেখা থেকে স্মৃতি সঞ্চয় করতে হয় না— কোনও রকম কাগজপত্রের বালাই নেই। মনে হবে তোমার বাবা বুঝি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার মঙ্গলের জন্যে আবেদন করছেন জোরের সঙ্গে যুক্তি দিয়ে তোমাকে আচ্ছন্ন করছেন···।

জুলাই ২৫, ১৯৪৩

 আজ শ্রীমতী ট—ও কুমরী স-কে চায়ের নেমন্তন্ন করেছি। কুমারী স পেনাং থেকে আসছেন—এবং সমস্ত এশিয়াবাসিদের আক্রমণকারী জাপানীদের হাতে ফেলে রেখে বৃটিশেরা কেমনভাবে পেনাং ছেড়ে পালিয়ে গেছে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।

 তিনি বললেন:

 বোমাবর্ষণের ফলে কি বিরাট গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয়েছিল তার বর্ণনা আমি দিতে পারবো না।

 তবে সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার এই যে এই জনসাধারণকে কোনও রকম সাহায্য করবার জন্য কোনও সরকারী কর্মচারী ছিল না। বৃটিশেরা সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নিয়ে বন্দুকের পাহারায় এক কোনে সরে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করছিল। তৃতীয় দিনে ইভাকুয়েশন করা স্থির হল। কিন্তু কোন এশিয়াবাসীকে পালানোর ক্ষমতা দেওয়া হল না। স্থানীয় সামরিক ও অসামরিক কর্মচারীরা বল্লেন কেবলমাত্র খাঁটি বৃটিশ রক্তের লোকেরাই পালাতে পারবে। এমন কি ইউরেশিয়ানরাও নয়। আমি কয়েকজন ইউরেশিয়ান মহিলাকে জানি তাঁরা বৃটিশ ব্যবসায়ীদের বিবাহ করেছিলেন। শ্রীমতী ‘ব’ আমার বন্ধু। তাঁর স্বামী তাঁকে ফেলেই পালালেন। তিনি ইউরেশিয়ান—তাঁর যাবার অধিকার নাই।

জানুয়ারী ২৬, ১৯৪৪

 আজ আমরা স্বাধীনতাদিবস পালন করলাম।

 বক্তৃতার আগে নেতাজীকে মাল্যভুষিত করা হল। বক্তৃতার সময় তিনি মালাটি হাতে জড়িয়ে রেখে ছিলেন। বক্তৃতা শেষে জিজ্ঞাসা করলেন— এই মালাটি কেহ কিনতে চায় কি না। বিক্রয় লব্ধ টাকা ফৌজের তহবিলে যাবে।

 প্রথম ডাক উঠলো এক লক্ষ টাকা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংখ্যা যখন সওয়া চারে উঠলো, প্রথম গ্রাহক চীৎকার করে উঠলেন—পাঁচ। যখন শেষ ডাক সাত লাখ ঘোষণা করা হচ্ছে তখন তাঁকে একটু চিন্তিত দেখা গেল, মনে হল, অন্তরে কিসের একটা ঝড় উঠেছে। মালাটি বিক্রী হল বলে— এমন সময় তিনি মঞ্চের ওপর লাফিয়ে উঠলেন— আমি আমার সব দিচ্ছি আমার যা কিছু—আমার পাই পয়সাটি পর্যন্ত— চীৎকার করে উঠলেন তিনি। সুভাষবাবু এই কম্পমান যুবকটিকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন—সাবাস্ —এ মালা তোমার!

মার্চ ২, ১৯৪৪

 হুররে! আমাদের ডাক পড়েছে! হুকুম পাওয়া গেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রাণী ঝাঁসি বাহিনী থেকে দুটি দলকে পাঠাবার অনুমতি পাওয়া গেছে। আমাদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে যে সম্মুখক্ষেত্রের অবস্থা বিপজ্জনক!

 আমি যাচ্ছি ‘প’— (শ্রীমতী ম’র স্বামী)। যদি ফিরে না আসি তাহলে আমার জন্য দুঃখ করো না। তুমি আবার বিবাহ করলে আমি খুশি হবো— কেবল একটি অনুরোধ: প্রকৃত কর্মী বা রাণী ঝাঁসী বাহিনীর মধ্য থেকে কাউকে পছন্দ করে নিও। তোমার বর্তমান জীবনের পর প্রসাধনরতা, ঠোঁটে রং লাগানো পুতুল তোমাকে আর মানাবে না।

 বিদায়—বিদায়—বিদায় তোমাকেও সুদূর পাঞ্জাববাসী পুত্র আমার!

 [রণক্ষেত্রে তাঁর স্বামী প্রাণ বিসর্জ্জন দেন— মুক্তি যুদ্ধে একটি অঞ্জলিবদ্ধ আহুতির মত। তারপর শ্রীমতী ম তাঁর খাতায় এই ক’টি কথা লিখে রাখেন!]

 আমি হতভাগ্য নারী। যে আঘাত আমি পেয়েছি তার থেকে কোনদিন মুক্তি নেই। প-এর স্মৃতি আমায় দিন রাত্রি বিঁধছে। আমি সারা বাড়ীতে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে শুনছি—

 আমি কেঁদেছি—পুরো দুটি দিন দুটি রাত্রি কান্নার জলে আমার বিছানা ভিজে গেছে। কি অভিশাপ——হে ভগবান কি অভিশাপ আমার তরে তুমি রেখেছিলে। আমি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভালবাসি; আমরা দুজনে তার জন্যে একই সঙ্গে কাজ করেছি। তাও আজ শেষ হয়ে গেল!···

 ‘প’-এর শেষ দৃশ্য আমাকে পীড়া দেয়। ক—যখন সব বর্ণনা করছিলেন আমার চোখের সামনে ছবিটা যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল। সে আমি আর ভুলতে পারি নি। তাঁর কথাগুলো আমার কানে বাজছে—

 ‘ওরা শত্রুর একটা বিরাট অস্ত্রাগার উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিল। সে জানতো এর মধ্যে বিপদ ঘুমিয়ে আছে। সেইজন্যই এই চরম কাজটি তার অন্য কোন সহকারীকে সে করতে দেয় নি। ব্রহ্ম সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মাটিতে সে মৃত্যুকে বরণ করেছে। তুমি শোক করো না, কারণ সে শোক করে নি। কাজ সম্পূর্ণ করবার পর ওরা যখন একটা নালার থেকে ওকে খুঁজ়ে বার করলে, তখন দেখলে তার বাঁ হাতখানা উড়ে গেছে আর সর্বশরীরে ভীষণ আঘাতের চিহ্ন। সে বুঝতে পেরেছিল যে সে আর বাঁচবে না। সেইজন্যে সে তোমার ও অন্যান্য সহকর্মিদের জন্যে এই বাণীটি পাঠিয়েছিল: “বীরের মত এগিয়ে চল—তোমাদের এগিয়ে চলায় কোন বিচ্যুতি যেন না থাকে। ম’-কে—আমার প্রিয়া পত্নীকে বোলো যে আমি বীরের মত মরেছি। ভারতমাতা আজ আমায় ডাকছে। আমি জানি তার প্রতি আমার কর্তব্য আমি করে গেলাম। নেতাজী, আমি রক্ত দিয়েছি আমি জানি আমার এই রক্ত অন্য সৈনিকদের প্রেরণা দেবে। বন্ধুগণ এখানে আর দেরী করো না। তোমাদের কাজ করে যাও। আমি শীগগীরই মরে যাবো। শত্রুরা আমায় জীবন্ত পাবে না। যে পথে আমাদের ফৌজ জয় ও মুক্তির দিকে এগিয়ে যাবে সেই পথ আমি আমার রক্ত দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিলুম। নেতাজীর বাণী আমার মনে পড়েছে:—

 হামারে জওয়ানমার্দো কে খুন হামারী আজাদী কিম্মৎ হোগা। হামারে শহীদো কে খুন—উন্‌কি বাহাদুরী ঔর মর্দাঙ্গীসে হি হিন্দুস্থান কি মাঙ্গ পুরী হো সেকে গি। হিন্দুস্থানো পর জুলুম-ও-সিতাম তোড়নে ওয়ালে বর্তনভি জবরো সে আদলে কা বাধা স্রিফ খুন সে হি লিয়া বা সেকে গা— জয় হিন্দ।”

 এবং তার কথা যেই শেষ হল, সে তার রিভলভারটা বের করলে এবং অমানুষিক কষ্টের সঙ্গে নলটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে চাপ দিলে ঘোড়ার ওপর···

 জয় হিন্দ···জয় হিন্দ···জয়


 হাজার হাজার বীর রমণীর জীবন গাঁথার একটি ছিন্ন পত্র মাত্র। কিন্তু তবু আমাদের কানে বাজছে: ‘নেতাজী, আমি আমার রক্ত দিয়েছি—····।

 বাবণের চিতার মত জ্বলছে এ রক্তের লাল আগুন···মানসপটে!