নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/কর্ম্ম-জীবন/ভারতীয় জাতীয় মহা-সমিতির সভাপতি

উইকিসংকলন থেকে

ভারতীয় জাতীয় মহা-সমিতির সভাপতি

‘হরিপুরা’-কংগ্রেস ১৯৩৮—‘ত্রিপুরী’-কংগ্রেস ১৯৩৯—প্রতিযোগিতা—জয়লাভ—মহাত্মার ক্ষোভ—হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণ—সুদীর্ঘ হাজত-বাস—মুক্তি—নিরুদ্দেশ।

ইংলণ্ডে অবস্থিতি-কালে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির এক-পঞ্চাশত্তম ‘হরিপুরা’-অধিবেশনের সভাপতি নির্ব্বাচিত হইলেন।

 ভারতীয় জাতীয় মহা-সমিতির সভাপতিরূপে তিনি যে অভিভাষণ প্রদান করেন, তাহাতে তাঁহার দৃূরদৃষ্টি, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ-শক্তি ও পাণ্ডিত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকটিত। এই অভিভাষণে তিনি প্রথমেই সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। তিনি বলিতেছেন—

 “মানবের ইতিহাসের প্রতি প্রাথমিক দৃষ্টিপাতেই সাম্রা্জের উত্থানপতন আমাদিগকে আকর্ষণ করে। কি প্রাচ্যে, কি পাশ্চাত্যে, সর্ব্বত্রই সাম্রাজ্য প্রথমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতে থাকে; পরে উন্নতির সর্ব্বোচ্চ শিখর অধিগত করিয়া ধীরে ধীরে হীনাবস্থায় নিপতিত হয় এবং কখনো কখনো মৃত্যুর আলিঙ্গনে লুপ্ত হইয়া যায়। পাশ্চাত্ত্যে প্রাচীন রোম-সাম্রাজ্য এবং বর্ত্তমান কালের তুর্কী-সাম্রাজ্য ও অষ্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য এই নিয়মের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত; ভারতবর্ষেও মৌর্য্য, গুপ্ত এবং মোগলসাম্রাজ্য ইহার ব্যতিক্রম নহে। ইতিহাসের এই সমস্ত বাস্তব ঘটনার প্রতি লক্ষা করিয়া কেহ কি সাহসের সহিত বলিতে পারেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাগ্যে অন্য়রূপ বিধান রহিয়াছে?[১]

 *  *  *  *

 একথা সত্য যে প্রত্যেক সাম্রাজ্যই ভেদনীতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া শাসন-কার্য্য চালাইয়া থাকে; কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে গ্রেট ব্রিটেনের মত এই নীতি এমন কৌশলপুর্ণ, ধারাবাহিক এবং নিষ্ঠুরভাবে অন্য় কোন সাম্রাজ্য অনুসরণ করিয়াছে কি না সন্দেহ।[২]

 *  *  *  *

 বর্ত্তমানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমে আয়ার্ল্যাণ্ড এবং পুর্ব্বে ভারতবর্ষ রহিয়াছে; মধ্যভাগে প্যালেষ্টাইন, মিশর ও ইরাক-সহ বিরাজমান; দূর প্রাচ্যে জাপান ও ভূমধ্যসাগরে ইতালী চাপ দিতেছে; পটভূমিকায় সোভিয়েট রুশিয়া প্রত্যেক সাম্রাজ্যবাদী জাতির হৃদয়ে ভীতির উদ্রেক করিতেছে। এই সমস্ত বিষয়ের চাপ ও কঠোর শ্রমস্বীকারের সম্মিলিত ফল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কতদিন সহ্য করিতে সমর্থ হইবে? * * * পরিশেষে বলা চলে যে, আকাশ-সৈন্য আধুনিক যুদ্ধে যুগান্তর সংসাধিত করিয়াছে; ইহাতে শক্তি-সাম্য পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি হইতে তিরোহিত হইয়াছে, এবং বিশাল সাম্রাজ্যের মৃত্তিকা-নির্ম্মিত চরণ যুগল বর্ত্তমানে যেরূপ উন্মুক্ত হইয়া পড়িয়াছে, পূর্ব্বে কখনও সেরূপ হয় নাই।[৩]

 কিন্তু এই বিশ্বশক্তির মধা হইতে ভারতবর্ষ পুর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী হইয়া উঠিবে। আমাদের এই বিশাল দেশে ৩৫ কোটি লোকের বাস; এক সময়ে এই দেশের বিশালতা এবং জনশক্তির বিপুলতা আমাদের দুর্ব্বলতাই প্রকাশ করিত; কিন্ত বর্ত্তমানে উহা শক্তির আধার—যদি আমরা সম্মিলিত হইয়া আমাদের শাসনকর্ত্তার সম্মুখে সাহসের সহিত দাঁড়াইতে পারি।

 ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র পুনরায় নিখিল-ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির ত্রিপুরী-অধিবেশনের সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। কিন্তু নির্ব্বাচিত হইলেও, নির্ব্বাচন-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁহার বিজয়-গৌরব-লাভ জাতীয় ইতিহাসের এক ব্যথা-বিমণ্ডিত মসীলিপ্ত ইতিহাস।

 এবার নির্ব্বাচন-প্রার্থী ছিলেন তিনজন—মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ পট্টভি সীতারামিয়া ও সুভাষচন্দ্র। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁহার ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য ডাঃ সীতারামিয়ার অনুকূলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতে সরিয়া আসিলেন; সুতরাং শেষ পর্য্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী রহিলেন— দুইজন ডাঃ সীতারামিয়া ও সুভাষচন্দ্র।

 মহাত্মা গান্ধী ও তাঁহার অনুবর্ত্তিগণ ডাঃ সীতারামিয়ার অনুকূলে ছিলেন, তাঁহারা সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কে বিরুদ্ধ মত পোষণ করিতেন। ইহার কারণ,—ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের ইচ্ছা ছিল, তাঁহারা দেশীয় রাজ্য ও ব্রিটিশ-শাসিত অংশ লইয়া এক যুক্তরাষ্ট্র গড়িয়া তোলেন। মহাত্মা-প্রমুখ নরমপন্থী রাজনীতিকগণ ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের এই আকাঙ্ক্ষার স্বপক্ষে ছিলেন; কিন্তু সুভাষচন্দ্র ও তাঁহার অনুবর্ত্তিগণ মহাত্মার দলীয় এই দুর্ব্বলতাকে আপোষ-মীমাংসার প্রচেষ্টা বলিয়া মনে করিতেন। তাঁহাদের অভিমত ছিল, আপোষ-মনোবৃত্তিতে কোনদিনই স্বাধীনতা আসিবে না। স্বাধীনতা অর্জ্জন করিতে হইলে আপোষ-বিরোধী মনোভাব লইয়া, তাহা জোর করিয়া আদায় করিতে হইবে।

 দৃষ্টিপথের এই পার্থক্য-হেতু মহাত্মা গান্ধী ইত্যাদি ব্যক্তিগণ সুভাষচন্দ্রের নির্ব্বাচন পছন্দ করিলেন না, তাঁহারা নানাভাবে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধাচণে কুণ্ঠিত হন নাই। কিন্তু তাঁহাদের বিরুদ্ধাচরণ সত্ত্বেও গণভোটে সুভাষচন্দ্রই নির্ব্বাচিত হইলেন। তাঁহার এই নির্ব্বাচনে ইহাই প্রতীয়মান হইল যে, তিনি মহাত্মা গান্ধী অপেক্ষাও ব্যাপকভাবে দেশবাসীর হৃদয়-জয়ে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 নির্ব্বাচন এত তীব্র হইয়াছিল যে, সুভাষচন্দ্র জয়লাভ করিলে মহাত্মা গান্ধী বলিয়াছিলেন, “ডাঃ পট্টভির পরাজয়ে আমার পরাজয় হইয়াছে!”

 কেবল তাহাই নহে, তিনি এমন ইঙ্গিতও করিলেন যে, যাহাতে মনে হয়, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদিগের এখন পদত্যাগ করা সঙ্গত। ইহার ফলে ত্রিপুরীতে কংগ্রেস-অধিবেশনের পূর্ব্বেই প্রাক্তন ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যগণ সুভাষচন্দ্রের নিকট পদত্যাগ পত্র দাখিল করিয়া পরিপূর্ণ অসহযোগিতা প্রদর্শন করিলেন!

 কংগ্রেসের এই জঘন্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ও মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে—শ্রদ্ধাভাজন সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত বিজয়রত্ন মজুমদার মহাশয় যাহা লিখিয়াছেন, তাহার কিছু-কিছু নিম্নে উদ্ধৃত হইল।—

 “১৯১৯ এবং তৎপরবর্ত্তী কালে—আজ পর্য্যন্ত, কংগ্রেস বলিতে গান্ধীজী এবং গান্ধীজী বলিতে কংগ্রেসকেই বুঝাইত এবং বুঝায়; সুতরাং এই পরাজয়ে উভয়েরই পরাজয় ইহা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। তথাপি গান্ধীজী কেন যে ‘ব্যক্তিগত পরাভব’ শব্দ-সমষ্টির উপর জোর দিয়াছিলেন, তাহাও সহজেই অনুধাবন করিতে পারা যায়।

 গান্ধীজীর অভ্রভেদী প্রভাব যে খর্ব্ব হইতে চলিয়াছে, এই সত্য সুস্পষ্টরূপেই অনুভূত হইয়াছিল।···একমাত্র সর্ব্বশক্তিমান্ ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট ব্যতিরেকে এই ভারতবর্ষে গান্ধীজীর ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবকে, কোনও দিন কোনও লোকই দ্বন্দে আহত করিতে সাহস পায় নাই।···সুদীর্ঘকাল পরে একজন শক্তিমান্ ভারতীয় সেই গান্ধীকেই চ্যালেঞ্জ করিয়া বসিল।

 চ্যালেঞ্জ করাই ত অপরাধ—যুদ্ধে জয়লাভ করা মহা অপরাধ—অমার্জ্জনীয় অপরাধ। গান্ধী-ভারতবর্ষ যেন বিহারের ভূমিকম্পে আলোড়িত হইয়া উঠিল!···ইদানীং কালের কংগ্রেসে এমন কাদা ছোঁড়াছুড়ির দৃষ্টান্ত আদৌ বিরল, একথা আমি অসঙ্কোচে লিখিয়া রাখিতে পারি।”

 বিজয়বাবুর এই মন্তব্যের পর আমাদের আর কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। যা হোক্, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যগণ যখন পদত্যাগ করিয়া সুভাষচন্দ্রকে একেবারে অসহায় করিয়া তুলিতেছিলেন, সুভাষচন্দ্র তখন কঠিন রোগে শয্যাশায়ী—তাঁহার ব্রঙ্কো-নিমোনিয়া। কিন্তু এই অবস্থায়ই তিনি ৬ই মার্চ্চ তারিখে ‘এম্বুলেন্স্’ গাড়ী করিয়া ত্রিপুরীতে প্রবেশ করিলেন।

 অধিবেশনের সময় তাঁহার দেহের উত্তাপ এত বেশী হইল যে, ডাঃ হেনেসী তাঁহাকে পরীক্ষা করিয়া জব্বলপুর হাসপাতালে যাইবার পরামর্শ দিলেন। পণ্ডিত জওহরলালও সুভাষচন্দ্রকে সেই অনুরোধই করিলেন; কিন্তু সুভাষচন্দ্র তখন জাতীয় চিন্তায় উন্মাদ! ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা তাঁহার কাছে তখন তুচ্ছ। দৃপ্ত সিংহের ন্যায় তিনি গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন, “আমি জব্বলপুর হাসপাতালে যাইবার জন্য এখানে আসি নাই। অধিবেশন শেষ হইবার পূর্ব্বে অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার অপেক্ষা আমি মৃত্যু বরণ করিতে চাই।”

 কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, সুভাষচন্দ্রের শারীরিক অবস্থা যখন এইরূপ এবং যে অবস্থার সাক্ষীদের মধ্যে ডাঃ হেনেসি এবং পণ্ডিত জওহরলালের নামোল্লেখ করা যাইতে পারে, সেই অবস্থাও গান্ধীজীর অনুবর্ত্তিগণ বিশ্বাস করিতে পারেন নাই—তাঁহারা ইহাকে পীড়ার ভান মনে করিয়াছিলেন! এ বিষয়ে বিজয় বাবু বলিয়াছেন:—

 “ইহাকে রাজনৈতিক অসুস্থতা বোধে হাসি-ঠাট্টার বিষয়ীভূত করা হইয়াছিল।”

 ত্রিপুরী-কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হইয়া গেল। সুভাষচন্দ্র মহাত্মাজীর আশীর্ব্বাদ ভিক্ষা করিলেন, তাঁহার সহযোগিতা প্রার্থনা করিলেন, তাঁহাকে কলিকাতায় আসিয়া ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নিযুক্ত করিতে অনুরোধ করিলেন; মোট কথা, তিনি কংগ্রেসের ঐক্য রক্ষার নিমিত্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন; কিন্তু যখন কিছুতেই কিছু হইল না, ব্যক্তিগত মান-অভিমান ও ঈর্ষ্যা-বিদ্বেষই যখন জাতীয় ঐক্যবোধকে অভিভূত করিয়া রাখিল, সুভাষচন্দ্র তখন পদত্যাগ করাই সমীচীন মনে করিয়া পদত্যাগপত্র দাখিল করিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁহার স্থলে সভাপতি নির্ব্বাচিত হইলেন ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ!

 সুভাষচন্দ্র বুঝিলেন, জাতীয় জীবনের মূর্ত্ত বিকাশ কংগ্রেসকে বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানরূপে গড়িয়া তুলিবার যে কল্পনা এতদিন তিনি করিয়া আসিতেছিলেন, তাহা চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। মহাত্মাজী যতদিন অসহযোগ-আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন, সুভাষচন্দ্র কেবল ততদিনই তাঁহার সহিত মিশিয়া চলিতে পারিতেছিলেন। কিন্তু মহাত্মাজী ও তাঁহার অনুবর্ত্তী কংগ্রেস এখন আর কোন সংগ্রামের পক্ষপাতী নহেন; অথচ তিনি নিজে বিশ্বাস করেন, আপোষ-বিহীন সংগ্রাম ব্যতীত কখনও স্বাধীনতা লাভ হইবে না। সুতরাং তিনি নির্জ্জীব ও নিষ্কর্ম্মার ন্যায় বসিয়া না থাকিয়া ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ (Forward Block) নামে এক সংগ্রাম-পন্থী কর্ম্মিদল গঠন করিলেন।

 আজ মনে হয়, ত্রিপুরী-অধিবেশন উপলক্ষে কংগ্রেসের উর্দ্ধতন কর্ত্তৃপক্ষ সুভাষচন্দ্রকে ভূলুণ্ঠিত করিবার জন্য যে সঙ্ঘবদ্ধ জঘন্য আয়োজন করিয়াছিলেন, যাহার ফলে সুভাষচন্দ্রের ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সৃষ্টি এবং অব্যবহিত পরেই কংগ্রেস-কর্ত্তৃপক্ষ-কর্ত্তৃক কংগ্রেস হইতে তিন বৎসরের জন্য তাঁহাকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা,—এ সমস্তই বুঝি দেশের মঙ্গলের জন্যই হইয়াছিল!

 কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের স্থান হইল না—সহানুভূতি দূরে বাক, অপমান ও লাঞ্ছনা তাঁহার মস্তকে শ্রাবণের ধারার ন্যায় বর্ষিত হইল,—তাই না সুভাষচন্দ্রের বিদ্রোহী-হৃদয় তাঁহার চিরদিনের স্বপ্ন সার্থক করিবার জন্য দূর-দূরান্তে ছুটিয়া গিয়াছিল!

 যা হোক্, বিদ্রোহী সুভাষচন্দ্র অনন্তর ১৯৪০ সালের ২৪শে মার্চ্চ তারিখে রামগড়ে আপোষ-বিরোধী সম্মেলনে সভাপতির পদ গ্রহণ করেন।

 জুন মাসে সুভাষচন্দ্র ভালহৌসী স্কোয়ারের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করিলেন। কারণ, হলওয়েল মনুমেণ্ট বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা—নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দুরপণেয় কলঙ্ক-কালিমায় মণ্ডিত করিয়াছে; সুতরাং এই ঐতিহাসিক অসত্যের অপপ্রচারকে—একটা জাতীয় কলঙ্ককে—ধ্বংস করিবার নিমিত্ত তিনি হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণের দাবী করেন, এবং তাহাই ক্রমে এক সঙ্ঘবদ্ধ ব্যাপক আন্দোলনে পরিণত হয়। সুভাষচন্দ্রের পরম কৃতিত্ব যে, সরকারকে অবশেষে সেই প্রস্তরীভূত জমাট মিথ্যার স্তম্ভকে অপসারিত করিতে হইয়াছে।

 এই আন্দোলন সম্পর্কে ২রা জুলাই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং মহম্মদ আলী পার্কে বক্তৃতা প্রদান ও ফরওয়ার্ড-ব্লক পত্রিকায় ‘হিসাব-নিকাশের দিন’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ২৮শে আগষ্ট তারিখে কারা-প্রাচীরের অন্তরালে—হাজতে অবস্থিতি-কালে, তিনি অভিযুক্ত হন; কিন্তু জেলে তিনি অনশন-ব্রত আরম্ভ করায় ৫ই ডিসেম্বর তারিখে তাঁহাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

 কারাগারে অবস্থিতিকালে ১৯৪০ খৃষ্টাব্দের ২৮শে অক্টোবর তারিখে, তিনি কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নির্ব্বাচিত হন, এবং তিনি পুনরায় সগৌরবে কলিকাতা-কর্পোরেশনের অল্‌ডারম্যান্‌ও নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন।

 তৎপর তাঁহার মুক্তি উপলক্ষে তাঁহাকে অভিনন্দন জানাইয়া ‘কলিকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেট’ লিখিয়াছিলেন, “আমরা জানি না কতদিন তিনি কারা-প্রাচীরের বাহিরে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবেন। বর্ত্তমান বর্ষের বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা প্রদান করায়, ভারতরক্ষা-আইনের দুইটি অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত; এতদ্ভিন্ন তাঁহার ইংরেজী দৈনিক ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকায় ‘হিসাব-নিকাশের দিন’ (The Day of Reckoning’) শীর্ষক প্রবন্ধের জন্যও তাঁহাকে অভিযুক্ত করা হইয়াছে।”

 ৫ই ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিলাভ করিয়া সুভাষচন্দ্র কলিকাতা এল্‌গিন্ রোড নিজের গৃহে ফিরিয়া আসিলেন; কিন্তু গভর্ণমেণ্টের সদা-সতর্ক প্রহরীর দল দিন-রাত তাঁহার বাটীর সম্মুখে ও চতুর্দ্দিকে তাঁহাকে ঘিরিয়া রহিল! তথাপি ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী তারিখে সহসা সংবাদ রটিল, তিনি স্বীয় গৃহ হইতে অতি রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। কলিকাতা পুলিশ-কোর্টে তাঁহার বিরুদ্ধে যে মোকদ্দমা চলিতেছিল, দিনের পর দিন আজও তাহা কেবলই মূলতুবী রাখা হইতেছে; কারণ, তাঁহাকে আদালতে হাজির করানো সম্ভব হয় নাই।

 তিনি নিরুদ্দিষ্ট হওয়ায়, গভর্ণমেণ্ট তাঁহার এল্‌গিন্ রোডের বাড়ীর অংশ ক্রোক করেন; এবং ক্রোকের ছয় মাসের মধ্যে তিনি উপস্থিত না হওয়ায় ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট তাহা নিলামে বিক্রয় হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হয়; কিন্তু নির্দ্ধারিত দিবসে কোন খরিদ্দার উপস্থিত না হওয়ায়, পুনরায় নিলামের দিন ধার্য্য করা হয়। সেদিনও কোন ক্রেতা উপস্থিত হইল না; তখন চবিবশ-পরগণার কালেক্টর বাহাদুর, কর্ত্তব্য-নির্দ্ধারণের জন্য কমিশনার বাহাদুরের নিকট সমস্ত কাগজপত্র পাঠাইয়া দিয়াছেন।

  1. In the face of these objective facts of history, can any one be so bold as to maintain that there is in store a different fate for the British Empire?”
     The Calcutta Municipal Gazette, Vol. XLII, No. 16, P.
  2. “But I doubt if any Empire in the world has practised this policy so skilfully, systematically and ruthlessly as Great Britain.”
     Ibid. P. 445
  3. “The clay feet of a gigantic empire now stands exposed as never before”.Ibid, P. 446.