নেপালে বঙ্গনারী/নেপালের অধিবাসিগণ

উইকিসংকলন থেকে
বীর হাঁসপাতাল।

নেপালের অধিবাসীগণ।

 নেপালের আয়তনের তুলনায় ইহার অধিবাসী বিভিন্ন জাতি সমুদায়ের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক বলিয়া মনে হয়। একটী দেশে এরূপ বিভিন্ন জাতির সমাবেশ অতি অল্প স্থলেই দেখিতে পাওয়া যায়। বিজয়ী গুর্খাগণ বর্ত্তমান নেপালের প্রধান অধিবাসী হইলেও জনসংখ্যায় পূর্ব্বতন অধিবাসী নেওয়ারগণই অধিক। গুর্খা এবং নেওয়ার ভিন্ন মগর, গুরুম, লিম্বু (Limbu) কিরাটী, ভুটিয়া, এবং লেপচা গণও (Lepcha), এই প্রদেশের অধিবাসী।

 ১৭৬৮ খৃষ্টাব্দে যখন পৃথ্বীনারায়ণ নেপাল রাজ্য জয় করেন তখন হইতেই গুর্খাগণ এদেশে সর্ব্বতোভাবে আধিপত্য স্থাপন গুর্খাগণ হিন্দু এবং রাজপুতবংশোদ্ভব; মুসলমানদিগের অত্যাচারে ইহারা জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া ক্রমশঃ কটিমণ্ডুর বিশ ক্রোশ পশ্চিমে গোরখালি নামক পার্ব্বত্য প্রদেশে আসিয়া বাস করিতে থাকে। গোরখালি হইতে ইহাদের গুর্খা নামের উদ্ভব। বর্তমান রাজবংশ, প্রধান রাজ-পুরুষগণ, এদেশের সমুদয় প্রধান ব্যক্তি গুর্খাবংশসম্ভূত। সৈনিক বিভাগের অধিকাংশ সৈনিক এবং প্রধান সৈনিক কর্ম্মচারিগণ সকলেই গুর্খা। বিজয়ী গুর্খাগণের চরণে, ধন, মান, সম্পদ, সকলই উৎসর্গীকৃত হইয়াছে। তাহাতে আর বিচিত্র কি? অধিকাংশ গুর্খা দেখিতে সুশ্রী। নেপালের উচ্চবংশের মহিলাগণ দেখিতে অত্যন্ত সুন্দরী।

 ব্রাহ্মণদিগের আকৃতির পার্থক্য সহজেই বুঝিতে পারা যায়। ব্রাহ্মণগণ অপেক্ষাকৃত কৃশ, ক্ষিপ্র, এবং আর্যলক্ষণ যুক্ত। নেপালে যেমন বিচিত্র জাতির অধিবাস, কাটমণ্ডু ও সহরেও সেইরূপ বিচিত্রমূর্ত্তি মানবের সমাগম দেখিতে পাওয়া যায়। কেহ বা গৌরকান্তি দীর্ঘাকৃতি আর্য্য সন্তানের ন্যায়, কেহ বা বলিষ্ঠ দৃঢ় নাতিস্তুল নাতিদীর্ঘ পীতবর্ণ মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভব অনুমান হয়। আকৃতি এবং বর্ণের বৈচিত্র দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়। কেহ বা উজ্জ্বল গৌরকান্তি, কেহ বা শ্যাম, কেহ বা কৃষ্ণবর্ণ। তবে এ কথা বলিতে হয়, হিন্দুস্থানের কৃষ্ণকান্তি এখানে বিরল। অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল বর্ণের।

 কি গুর্খা কি নেওয়ার স্ত্রী পুরুষের পরিচ্ছদ সুদৃশ্য এবং সুসঙ্গত। বাহ্যিক বেশ বিন্যাসে নেওয়ার এবং গুর্খার পার্থক্য কিছুই নাই। পাজামা, এবং চাপকানের ন্যায় এক প্রকার জামা, তার উপর সাদা কাপড়ের কোমরবন্ধ, মস্তকে একটা কাপড়ের টুপী, সাধারণ পুরুষদিগের বেশ এই প্রকার। তবে বর্ত্তমান বিলাতী সভ্যতার সংস্পর্শে অনেকের দেহে বিলাতী ছাঁটের কোট দেখিতে পাওয়া যায়। অত্যন্ত দীন দরিদ্র পথের ভিখারীর পর্যন্ত সমুদয় দেহ বস্ত্রাবৃত। তাহা শত ছিন্ন ধূলিধূসরিত হউক, কিন্তু অর্ধনগ্ন দেহ এ দেশের রাজপথে কখনও দেখা যায় না। নারীগণ সচরাচর বিশ ত্রিশ হস্ত দীর্ঘ বিচিত্র বর্ণের শাড়ী পরিধান করে। হিন্দুস্থানী মেয়েদের ন্যায় সম্মুখে কোঁচা, তাহা প্রায় ভূমিতে লুটাইয়া পড়ে, উর্দ্ধাঙ্গে জামা। প্রায় দশ হাত লম্বা নাতিপরিসর কাপড় কোমরে জড়াইয়া রাখে। শাড়ী খানা কোঁচা করিতেই যায়। দেহের উপরার্দ্ধ আবরণের জন্য চাদর বা ওড়না ব্যবহৃত হয়। কুমারী, সধবা, কি বিধবা কাহারও মস্তকে আবরণ নাই। নেপালী রমণীদিগের কেশ বিন্যাসের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমরা সম্মুখে সিঁতি কাটিয়া পশ্চাতে বেনী রচনা করি; তাহারা পশ্চাতে সিঁতী কাটিয়া কাপালের উপরে এক দীর্ঘ বেনী রচনা করে এবং তাহার শেষ ভাগে রক্তিম বর্ণের সুতার গুচ্ছ বাঁধিয়া আপনাদের সৌভাগ্য প্রকাশ করে। বিধবাগ লাল সুতা বাঁধে না। বেনীতে লাল সুতা বাঁধা ভিন্ন সধবাদের আর দুইটা লক্ষণ আছে। হাতে কাঁচের চুড়ি, গলায় পুঁথির মালা। এই দুইটাই কিন্তু বিলাতি জিনিষ। সধবাদিগের প্রধান লক্ষণ এই দুইটী বিলাতি জিনিষ কিরূপে হইল তাহা বুঝিতে পারা যায় না। রাজরাণী হইতে পথের ভিখারিণী পর্যন্ত হাতে কাঁচের চুড়ি গলায় পুঁথির মালা; নেপালে এবম্বিধ লক্ষণযুক্তা রমণী দেখিলেই তাঁহাকে ভাগ্যবতী পতিযুক্তা স্থির করিতে হইবে। হিন্দুস্থানী কিংবা বাঙ্গালী রমণীর ন্যায় নেপালি নারীকূলের অঙ্গে অলঙ্কারের প্রাচুর্য্য নাই।

 মস্তকে সোনার গহনা, কাণে বড় বড় পাশার ন্যায় সোনার ফুল, গলায় পদকের ন্যায় গহনা। চরণে পাঁয়জর ভিন্ন অন্য কোন অলঙ্কার দেখা যায় না। উপর হাতে কোন প্রকার অলঙ্কার কিম্বা নাসিকায় নথ এদেশে কখনও দেখি নাই।

 রাজ পরিবারের এবং ধনী গৃহস্থদের মহিলাগণ সাধারণ স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় কোঁচা করিয়া বস্ত্র পরিধান করেন না। তাঁহার পাজামা, জ্যাকেট এবং ওড়না ব্যবহার করেন। প্রায় বিশ গজ কাপড়ে একটী পাজামা প্রস্তুত হয়। পরিধানকালে তাহাকে পাজামা বলিয়া বোধ হয় না—অনেকটা পেটিকোট কিম্বা বেলুনের ন্যায় দেখায়। বিধবা ভিন্ন কেহ শুভ্র বসন পরিধান করে না। উচ্চ পরিবারের রমণীগণ সর্ব্বদা জুতা মোজা পরিধান করিয়া থাকেন, তাহাতে হিন্দু আচারের কোন ব্যতিক্রম হয়না। পূজা কিম্বা আহারের সময় জুতা মোচন করিলেই চলে। নেপালী সুন্দরীগণ যখন বেশবিন্যাস করিয়া শকটারোহনে রাজপথে বাহির হন তখন তাঁহাদিগকে পরীর দল কিম্বা প্রজাপতির ঝাঁকের ন্যায় দেখায়। কজ্জল শোভিত আয়ত নয়ন, তদুপরি অঙ্কিত ভ্রূযুগল, রাজ পরিবারের মহিলাগণ স্বাভাবিক ভ্রূর পরিবর্ত্তে কজ্জ্বল দ্বারা ভ্রূ অঙ্কিত করেন। রক্তাভ অধরোষ্ঠগণ্ডস্থলবিশিষ্ট শুভ্রমূর্ত্তি রমণীকুল। যখন বিচিত্র বর্ণের পরিচ্ছদে সজ্জিত হইয়া রাজপথে দর্শন দেন এবং তাঁহাদের সূক্ষ্ম ওড়না বায়ুভরে উড়িতে থাকে তখন যে তাঁহাদিগকে পরীর দল বলিয়া ভ্রম হইবে, তাহাতে আর বিচিত্র কি? নেপালীরা গোঁড়া হিন্দু বটে কিন্তু আমাদের দেশের আচার ব্যবহারের সহিত ইহাদের পার্থক্য অনেক। শীতপ্রধান দেশ বলিয়াই বোধ হয় এখানে অবগাহন এবং বস্ত্র পরিবর্ত্তনের রীতি সেরূপ নাই। উচ্ছিষ্টের বিচার আমাদের দেশের ন্যায় নহে। এদিকে আবার রন্ধনশালায় বসিয়া না আহার করিলে চলে না। প্রস্তুত অন্ন রন্ধনগৃহের বাহিরে ভোজন করা বিধেয় নহে। এই জন্য ভিন্ন জাতীয়েরা এক রন্ধনশালায় আহার করিতে পারে না। পতি হয়ত ক্ষত্রিয়, পত্নী ভোট সুতা, এমন এমন স্থলে পতি পত্নীকে ভিন্ন ভিন্ন রন্ধনের ব্যবস্থা করিয়া ভিন্ন ভিন্ন রন্ধনশালায় আহার করিতে হয়। তাঁহাদের সন্তানেরা তৃতীয় রন্ধনশালায় আহার করে। একই গৃহে তিন সংসার। বলা বাহুল্য এখানে অনুলোষ অসবর্ণ বিবাহ চলিত আছে। অন্য জাতীয় ব্যক্তিকে স্পর্শ করিয়া পান, তামাক কিম্বা জল পর্যন্ত পান করা চলে না। নেপালে আমাদের দেশের ন্যায় অবরোধ প্রথা নাই (নেপালের বাহিরে ইহারা অবরোধ প্রথা মানিয়া চলেন)। শ্বশুর শ্বাশুড়ী কিম্বা অন্য গুরুজনের নিকট বধুগণ অবলীলাক্রমে উপনীত হন ও প্রয়োজনীয় বাক্যালাপ করেন। কি স্ত্রী কি পুরুষ পূজা অর্চ্চনায় এবং ধর্ম্মাচরণে দিবসের অনেক সময় ব্যয় করিয়া থাকেন। গুর্খাগণ সাহসী সৈনিক বটে, কিন্তু পরিশ্রমী, কার্য্যকুশল জাতি নহে। তাহারা কৃষি কিম্বা শিল্পকর্ম্মে অনুরক্ত নহে। দেশের যত প্রকার শ্রমসাধ্য কিম্বা সূক্ষ্ম কার্য্য আছে তাহার অধিকাংশই নেওয়ারদিগের দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে। কি স্বদেশে কি বিদেশে ব্যবসা বাণিজ্য অধিকাংশই তাহাদিগের হস্তে; সুতরাং তাহাদিগের মধ্যে অনেক সম্পন্ন ব্যক্তি আছে। লেখা পড়ার কার্য্যেও অধিকাংশ স্থলে নেওয়ারগণই নিযুক্ত। কাটমণ্ডু এবং তাহার নিকটস্থ স্থান সমূহে অধিকাংশ নেওয়ারের বাস। নেপালের অন্যান্য অংশে তাহাদিগের সংখ্যা তাদৃশ অধিক নহে। নেওয়ারগণই বস্তুতঃ নেপালের আদিম অধিবাসী। তাহারা অধিকাংশই বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ছিল। বর্ত্তমান সময়ে হিন্দুরাজার রাজ্যে নেপালে। বৌদ্ধধর্ম্মের চরম দুর্দ্দশা উপস্থিত হইয়াছে। আর কিছুদিন পরে। ইহার অস্তিত্ব থাকিবে কিনা সন্দেহ। নেওয়ারগণকে কিছুতেই অসভ্য জাতি বলা যায় না। অপেক্ষাকৃত শান্ত, কার্য্যকুশল, শ্রমনিপুণ হইলেও সামাজিক নীতিতে এ জাতি গুর্খাদিগের তুলনায় হীন। জনসাধারণের ভিতর বিবাহবন্ধন অত্যন্ত শিথিল। নেওয়ারণীদিগের ভিতর পাতিব্রত্য ধর্ম্মের বিশেষ আদর আছে বলিয়া মনে হয় না। অবশ্য উচ্চ পরিবারের নেওয়ারদিগের সম্বন্ধে একথা খাটে না! নেওয়ারদিগের কন্যা বিবাহযোগ্যা হইলে পিতামাতা সচারাচর বিবাহ দিয়া থাকে বটে, কিন্তু একই পতির গৃহে তাহাদের জীবনের অবসান হয় না। সুযোগ এবং সুবিধা হইলে যে কোন কারণে তাহারা পত্যন্তর গ্রহণ করে। বিধবা হইলে ত কথাই নাই। ধরিতে গেলে নেওয়ারনীগণ কখনই বিধবা হয় না। অনেকস্থলে সহোদর ভ্রাতাগণের ভিন্ন ভিন্ন পিতা। গুর্খাদিগের বিবাহবন্ধন কিম্বা সামাজিক নীতি এরূপ শিথিল নহে; অন্ততঃ নারীগণ সম্বন্ধে। যথায় বহুবিবাহ এবং দাসত্ব প্রথা বিদ্যমান, তথায় পারিবারিক জীবনে ধর্ম্মনীতির উচ্চ আদর্শ অন্বেষণ করা বাতুলতা মাত্র। নেপালীদিগের ভিতর গুরুভক্তি এবং ব্রাহ্মণভক্তি অতিশয় প্রবল। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতা মাতা কিম্বা অন্যান্য গুরুজনের চরণ মস্তকে ধারণ করিয়া অভিবাদন করিতে হয়। ব্রাহ্মণগণের পদরজঃ গ্রহণের ব্যবস্থা কিঞ্চিৎ হাস্যোদ্দীপক। ধুলিতে মস্তক রাখিয়া পদরজঃ গ্রহণের পূর্ব্বেই তাঁহারা অর্দ্ধপথে মস্তকে চরণ তুলিয়া দেন। সকল প্রকার ক্রিয়া কর্ম্মে বার ব্রতে ব্রাহ্মণদিগকে অগ্রে দান করিতে হয়। প্রত্যেক সম্পন্ন গৃহস্থ কুল পুরোহিতকে যথেষ্ট সম্মান এবং দক্ষিণা দিয়া থাকেন। অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ করিলেও ব্রাহ্মণের প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা নাই। মহারাজ জঙ্গ বাহাদুরের সময় হইতে এদেশে সহমরণের ব্যবস্থা স্থগিত হইয়াছে। তৎপূর্ব্বে দলে দলে গুর্খারমণীগণ পতির চিতানলে প্রাণ বিসর্জ্জন করিতেন। বর্ত্তমান সময়ে নেপালে সহমরণ প্রথা একেবারে নাই। পূর্বে নেওয়ারদিগের ভিতরও সহমরণ প্রথা ছিল। কাটমণ্ডু সহরবাসীগণ ভিন্ন, নেপালের জনসাধারণ কোন প্রকার বিলাসিতার ধার ধারে না। ভারতবর্ষের পুরাকালের অবস্থা যদি কিয়ৎ পরিমাণে হৃদয়ঙ্গম করিতে হয়, তাহা হইলে নেপালের অবস্থা দেখিলেই বুঝিতে পারা যাইবে। নেপালী মাত্রকেই কৃষক বলিলে অত্যুক্তি হয় না। প্রত্যেক গৃহস্থ বৎসরের চাউল তরকারী আপনার ক্ষেত্রে উৎপাদন করে। ভারতবর্ষের ন্যায় নিরন্ন ব্যক্তির বাহুল্য এখানে নাই। গৃহে গাভী কিম্বা মহিষ, ক্ষেত্রে মোটা চাউল, মক্কা গম, শাক তরকারী, অধিকাংশের গৃহেই আছে। প্রভাতে গাত্রোখান করিয়াই দরিদ্র এবং ধনীর গৃহে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়। তৎপরে সকলে দিবসের কার্য্যে নিযুক্ত হয়। কার্য্য করিতে করিতে ক্ষুধা পাইলেই শুষ্ক চিড়া বা অন্য কিছু জলযোগ করে। দিবাশেষে পুনরায় অন্নগ্রহণ করে। অনেক দরিদ্র লোকের দুইবেলা অন্ন জোটেনা। কিন্তু সহজলভ্য ফল মূল দ্বারা উদরজ্বালা নিবারণ করে।

 প্রার্ব্বত্য প্রদেশ হইলে কি হয় এদেশের মৃত্তিকায় ফল শস্য প্রচুর জন্মে। ভারতবর্ষের কুত্রাপি এত প্রচুর এবং সুলভ ফল শস্য জন্মে কি না সন্দেহ। নেপালে শীত এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ফল ও শস্যের একত্র সমাবেশ দেখিতে পাওয়া যায়। এদেশের নরনারী উপবাস ক্লেশ সহ্য করিতে পারে না। বৎসরের মধ্যে এক দিন (তীজব্রতে নেপালী রমণীর নীরাম্বু উপবাস করিবার ব্যবস্থা আছে। সেই দিন তাহাদিগের নিকট এক বিষম দিন—সেই এক দিনের অনশন তাহাদিগের নিকট বিষম বলিয়া মনে হয়। বঙ্গদেশের বিধবাদিগকে দেখিলে না জানি তাহাদিগের কি বিস্ময়ের উদয় হয়। নেপালের জনসাধারণ অত্যন্ত মাংসাহার প্রিয়, তাহাদিগের নিকট ইহা অপেক্ষা ঈপ্সিত আহার্য্য আর কিছু নাই। ভারতবাসীর অলীক সভ্যতা, অভাব, দারিদ্র, উপবাস, ইহাদিগের নিকট অজ্ঞাত। নেপালের প্রজাবর্গ দরিদ্র বটে, কিন্তু ইহারা অর্থহীন দরিদ্র; নিরন্ন, অনাহারক্লিষ্ট, করভারে প্রপীড়িত, জীর্ণ দেহ, মনুষ্যকঙ্কাল নহে। ইহারা দৃঢ় বলিষ্ট, কর্ম্মঠ ও প্রসন্নমূর্ত্তি। তবে অত্যন্ত অপরিষ্কার থাকে বলিয়া ইহাদিগকে দেখিলে প্রীতির উদয় হয় না। গন্ধগোকুলের ন্যায় তাহারা যেখানে যায় দুর্গন্ধ বিস্তার করে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি নেপালী মাত্রেই কৃষক। ব্রাহ্মণ শূদ্র সকলেই আপন আপন ক্ষেত্রের কর্ম্মে নিযুক্ত। জন সংখ্যার এক অংশ মাত্র সৈনিক বিভাগে নিযুক্ত। নেপালের পশ্চিমাংশে অধিকাংশ মগর এবং গুরুমের বাস। তাহারা অপেক্ষাকৃত খর্ব্ব ও অত্যন্ত বলিষ্ঠ। ইহাদিগের আকৃতি মঙ্গোলীয় জাতির ন্যায়। ইহারা সৈনিক কার্য্যের বিশেষ উপযুক্ত। নেপালের পূর্ব্বাংশে লিম্বু, কিরাতিদিগের বাস। তাহারাও সৈনিক বিভাগে নিযুক্ত। ইহারাও মঙ্গোলীয় বংশজ এবং অতি উত্তম শিকারী। সিকিমের নিকট লেপচাদিগের বাস। ইহারা দেখিতে ভূটিয়াদিগের ন্যায় কুৎসিত নহে। তিব্বত এবং নেপালের মধ্যপ্রদেশে ভূটিয়াদিগের বাস, ইহারা অত্যন্ত দৃঢ়কায়, বলিষ্ট ও শক্তিশালী। কিন্তু আকৃতি বড় কুৎসিৎ। দুরারোহ পার্ব্বত্য পথে ইহারা সর্ব্বদাই ভারবহন কার্য্যে নিযুক্ত। ইহারা এক এক জন অবলীলাক্রমে দুই মণ ভার পিঠের উপর লইয়া যায়। নেপালে বিদেশী লোকেরা প্রায় বাস করে না। কাটমণ্ডুতে বাণিজ্য ব্যপদেশে কাশ্মীরী মুসলমান ও মাড়বারীগণ বাস করেন। শীতঋতুর সমাগম হইতে না হইতে তিব্বত হইতে দলে দলে লোক ছাগল ভেড়া কম্বল লবণ কস্তুরি প্রভৃতি লইয়া কাটমণ্ড উপত্যকায় উপস্থিত হয়। শীতকালে এখানে বাস করিয়া বসন্তের সমাগমে দেশে প্রত্যাবর্ত্তন করে। নেপালে জাতিগত ভাষাগত আকৃতিগত এবং ধর্ম্মগত বৈষম্য অত্যন্ত অধিক। গুর্খাগণ হিন্দু আর্য্যবংশ সম্ভূত। তাঁহাদিগের পার্ব্বতীয় ভাষা সংস্কৃত ভাষার অপভ্রংশ, দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হয়। এই হেতু ভারতবর্ষীয়েরা অল্পায়াসে এই ভাষা আয়ত্ত করিয়া লয়। নেয়ারগণ আর্য্য এবং মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন হইয়াছে। তাহাদের ভাষা তির্ব্বতের সহিত জ্ঞাতি সম্বন্ধ প্রকাশ করে। সে ভাষা আমাদের নিকট দুর্ব্বোধ্য। পূর্ব্বে নেওয়ারগণ অধিকাংশ বৌদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু এখন হিন্দুধর্ম্মের সহিত ইহার এরূপ সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে যে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ আর নাই। মগর গুরুম হিন্দু। অন্যান্য জাতিসকলের ভাষা বিভিন্ন; তাহারা অধিকাংশই বৌদ্ধ। ভুটিয়া এবং লিম্বুরা তিব্বতীয় ভাষা ব্যবহার করে।

দাসত্ব প্রথা

নেপালে দাসত্ব প্রথা পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান। প্রত্যেক সম্পন্ন গৃহস্থের গৃহ ‘ক্রীত’ দাস দাসীতে পূর্ণ। কাহারও অবস্থা মন হইলে দাস দাসী বিক্রয় করিবার রীতি আছে। দাস দাসীদিগের সন্তাণগণ। জন্মের সহিত দাসত্বফাঁস গলায় করিয়া আসে। নেপালের দাসত্ব প্রথা ইউরোপীয়দিগের দাসত্ব প্রথার ন্যায় নহে। এখানে দাস দাসীগণের কোন কষ্ট আছে বলিয়া মনে হয় না। তাহারা সন্তান নির্ব্বিশেষে প্রতিপালিত হয়। দাস হইতে দাসীর মূল্য অধিক—দাসীগণের ১৫০৲৷২০০৲ এবং দাসগণের ১০০৲৷১৫০৲ পর্যন্ত মূল্য হইয়া থাকে। সুরূপা হইলে দাসীদিগের মূল্য অধিক হয়। দাসীগণ প্রভুর সন্তান গর্ভে ধারণ করিলে তাহাদিগের পদমর্য্যাদা বৃদ্ধি হয় এবং চিরদিনের মত জীবিকার সংস্থান হয়। ভুটিয়াগণ অতি সহজে আপনাদের সন্তান বিক্রয় করে। অনেক পিতা মাতা ঋণদায়ে সন্তান বন্ধক রাখে। ঋণ শোধ করিতে পারিলেই সন্তানদিগের দাসত্ব মোচন হয়।

 নেপালে গণকঠাকুর এবং বৈদ্যের বিশেষ প্রতিপত্তি। নেপালে বিচারালয় আছে বটে কিন্তু বিচারের কোন পুঁথিলিখিত আইন আছে কি না জানিনা। সুবিচার সকল স্থলে না হইলেও মোটের উপর এক প্রকার বিচার হয়। গোহত্যা ব্রাহ্মণহত্যা করিলে তাহার মুণ্ডুচ্ছেদন করিয়া পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা হয়। হত্যাপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিরও মুণ্ডুচ্ছেদ করা হয়। অপরাধ স্বীকার করাইবার জন্য অনেক নিষ্ঠুর অত্যাচারের ব্যবস্থা আছে। নেপালে শিল্পবাণিজ্যের তদ্রুপ শ্রীবৃদ্ধি নাই। দেশে অত্যন্ত মোটা সুতার এবং মোটা পশমী বস্তু নির্ম্মিত হয়। নেপালীগণ সচরাচর বিলাতি কাপড় ব্যবহার করে। নেপালে এক প্রকার কাগজ হয় তাহা সহজে ছেঁড়া যায় না। পিতল কাঁসার বাসন এবং হাতির দাঁতের মোটা কাজ ভিন্ন বিশেষ কোন শিল্পের প্রচলন নাই। স্বাধীন রাজ্যের এ বিষয়ে এরূপ দুরবস্থা দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই।